#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২২
নিকষ কালো রাত্রির পর পৃথিবীর বুকেতে ঘটেছে আলোর সঞ্চার! অন্তরীক্ষে এখন আর মেঘমেলার দেখা নেই। সারারাত বৃষ্টির পর স্বচ্ছ অন্তরীক্ষে সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ ঠিকরে পড়ছে যেন এখন! জানালার কাঁচ ভেদ করে এক ফালি রোদ্দুর এসে আছড়ে পড়ল আমার মুখশ্রীতে। ফলশ্রুতিতে আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। আড়মোড়া ভেঙে তাই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। জ্বর বোধহয় কমেছে খানিকটা। তবে শরীরের অসার ভাবটা যায়নি এখনো। তবুও কষ্ট করে একটু উঠে, বালিশে হেলান দিয়ে বসলাম। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে! তাই চোখ বুঁজে রইলাম খানিক সময়।
-‘ উঠে পড়েছিস মেহু! কেমন লাগছে এখন? কাল সারারাত তোর যা জ্বর ছিল, আমরা তো ঘুমাতেই পারিনি তোর চিন্তায়!
রিনরিনে গলায় কথাগুলো বলতে বলতে স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করল রিশতা। আমি একবার চাইলাম রিশতার পানে। তবে কিছু বললাম না। মনটা হুট করেই কেমন বিষন্নতায় ছেয়ে গেল আমার। সত্যি বলতে কি রিশতাকে এ মুহুর্তে আশা করিনি আমি। রিশতা এগিয়ে এসে বেড সাইড টেবিলে স্যুপের বাটিটা রেখে, আমি দিকে ফিরে কপালে হাত ঠেকাল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রিশতা বলল
-‘ যাক বাবা, অবশেষে তোর জ্বরটা তো কমেছে। রাতে অনেক বেশি জ্বর ছিল তোর।
আমার মাথা থেকে রিশতার হাতটা সরিয়ে দিয়ে, উদাস গলায় ওর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলাম
-‘ আদ্রিশ ভাইয়া কোথায়? ওনাকে কোথাও দেখছি না যে।
আমার পাশে বসে এক চামচ স্যুপ উঠিয়ে ফুঁ দিতে দিতে তাড়া দিয়ে রিশতা বলে উঠল
-‘ জলদি জলদি স্যুপটা খেয়ে নে তো। এরপরে তোকে আবার ওষুধ খাওয়াতে হবে।
রিশতা সম্পূর্ণরূপে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছে বলে আমার কিছুটা রাগই হয়। জেদ ধরে তাই চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম
-‘ আমি এখন খাবনা। আগে আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার জবাব চাই, তারপরে খাব আমি।
রিশতা বিরক্ত হয়ে পড়ে। চোখমুখ কুচকে ফেলে বলল
-‘ মেহু এতো জেদ করিস না তো। যাওয়ার আগে আদ্রিশ ভাইয়া আমায় বলে গিয়েছে, তোকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতে।
আমি বিচলিত হয়ে বললাম
-‘ কোথায় গিয়েছে ভাইয়া? আমায় একবার দেখতেও এলোনা যে!
শেষোক্ত কথাটা বলার সময় বারবার আমার গলা ধরে আসছিল কেমন। আমি অসুস্থ তবুও একটা বার খোঁজ খবরও নিতে এলো না? আমি কোনোভাবে অসুস্থ হলে তো সে পাগলপ্রায় হয়ে পড়ত, অথচ আজ তার দেখা নেই! ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছে খুব।
তপ্ত শ্বাস ফেলে রিশতা বলল
-‘ তোর ওষুধ শেষ হয়ে গেছে তাই আদ্রিশ ভাইয়া আনতে গেছে সেগুলো। এখন আর কোনো কথা নয়, চুপচাপ খেয়ে নে তো।
না খেয়ে আমি আগের মতো নির্বিকার বসে রইলাম। আদ্রিশ ভাইয়ার কথা উঠতেই রিশতা এড়িয়ে যাচ্ছে কেন বারবার? আজকে রিশতার আচরণটা সুবিধার ঠেকছে না। আর তাছাড়াও ও একবারও আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলছে না, অথচ ও সবসময় আমার চোখের দিকে তাকিয়েই কথা বলত! কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর নিরবতা ভেঙে থমথমে গলায় বললাম
-‘ একটা সত্যি কথা বল তো রিশু। কিছু কি হয়েছে? আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে তুই কিছু লুকাতে চাইছিস আমার থেকে!
থতমত খেয়ে যায় রিশতা। আমতা আমতা করে বলল
-‘ মেহু, তোকে সব পরে বলব না হয়। এখন প্লিজ এমন করিস না। আদ্রিশ ভাইয়ার যে বারণ..।
এতোটুকু বলতে বলতে থেমে যায় রিশতা। মুখ ফঁসকে সে কি বলে ফেলেছে!
আপনাআপনিই আমার কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ চলে এলো। ওর হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বললাম
-‘ কি নিষেধ করেছে বল আমায়। তুই যে আমায় বলেছিস তা কখনো জানবে না আদ্রিশ ভাইয়া। এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারিস আমার প্রতি।
-‘ সব বলব তোকে। তার আগে খাবারটা তো খেয়ে নে।
-‘ তুই না বলা অবধি আমি কিছুতেই খাব না। আই থিংক আমার জেদ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে তোর?
বাঁকা হেসে রিশতার দিকে তাকাই আমি। রিশতা ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে। গতরাতের সব কথাই বলে দেয় রিশতা।
সব শুনে চোখ বুঁজে হেলান দিয়ে বসে রইলাম আমি। একটা মানুষ এতোকিছু নিজের মাঝে চেপে রাখতে পারে কিভাবে? আদ্রিশ ভাইয়ার জায়গায় আমি হলে তো কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম। অথচ তিনি কি নিদারুণ অভিনেতা! এমন একটা ভান ধরবে যেন কিছুই হয়নি।
আমায় চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে রিশতা বিচলিত হয়ে বলল
-‘ মেহু, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে আবার? এজন্যই আদ্রিশ ভাইয়া আমায় বারবার করে নিষেধ করছিল তোকে বলতে।
পুনরায় চোখ মেলে ভারী গলায় বললাম
-‘ কিছু হয়নি আমার। শুধু ভাবছি একটা মানুষ এমন হয় কিভাবে? কোন ধাতু দিয়ে আসলে তৈরি আদ্রিশ ভাইয়া, বল তো?
রিশতা আমার একটা হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলল
-‘ তোর কাছে আমার একটা অনুরোধ, আদ্রিশ ভাইয়াকে কষ্ট দিস না কখনো। ভাইয়া তোকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে মেহু।
আমি মলিন হাসলাম। আমার অজান্তেই চোখ থেকে কখন বারিরূপ ধারা নেমেছে তা জানা নেই আমার। মেয়ে মানুষের এই এক সুবিধে, কিছু হলেই তারা কেঁদে বুক ভাসাতে পারে! অথচ পুরুষ জাতি হাজার আঘাত পেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও তাদের কাঁদতে মানা! এর চাইতে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে!
.
-‘ তুই এখনো খাসনি মেহু? আমি আসলে কিন্তু খবর আছে তোর!
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বরে উক্ত কথাটি আমার কর্ণকুহুরে ঠেকতেই আমার ভাবনার ছেদ ঘটে। আমি চকিত ফিরে চাইলাম সেদিক পানে। দরজার ধারে হেলান দিয়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিশ ভাইয়া। তাকে দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলেও পরক্ষণে তা আবার মিলিয়ে যায়। তার চোখমুখ কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে! দেখলে বোঝা যাচ্ছে রাতে সে ঘুমায়নি, মুখটাও কেমন শুকনো শুকনো লাগছে তার মানে সে হয়তো এখনো খায়নি। তাকে এমনভাবে দেখে বুকটা ধক করে ওঠে আমার! আরও রিশতার কাছ থেকে সবটা জেনে আবারও খারাপ লাগতে শুরু করে আমার।
-‘ হা করে দেখছিস কি? আমায় দেখার সময় পরেও পাবি। এখন আগে খেয়ে তো নে, এরপরে স্যুপ ঠান্ডা হয়ে গেলে খাবি কিভাবে?
আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে উক্ত কথাটি বলে ওঠে আদ্রিশ ভাইয়া। আমি ইশারায় সরে যেতে বলি রিশতাকে। রিশতাও বাধ্য মেয়ের ন্যায় সরে পড়ে। আদ্রিশ ভাইয়া এসে ধপ করে বসে পড়ে আমার পাশে। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও তাকে ঠিক লাগছে না আমার।
স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল
-‘ আর কতোদিন এমন বাচ্চা থাকবি মেহু? সবসময় এভাবে খাইয়ে দেওয়ার জন্য কি আমি থাকবো?
আদ্রিশ ভাইয়া হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বলেছে তবে আমার বুকে তা তীরের মতো বিঁধেছে। মনের সাথে সাথে আমার মুখটাও ভার হয়ে যায়। চোখটা আবারও ছলছল করে উঠল আমার। আদ্রিশ ভাইয়া হয়তো বুঝেছে, তাই হালকা হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘ আরে কুল কুল! আমি ম’রে যাওয়ার কথা বলছি না। বোঝাতে চাইছি যে এরপর পড়াশোনার জন্য আমার মতো যদি হোস্টেলে থাকতে হয় তখন তোকে খাইয়ে দিবে কে? তখন তো তোর নিজের কাজ নিজেরই করতে হবে। অন্য কেউ তো আর করে দিয়ে যাবেনা।
আমি আর কোনো কথা বললাম না। হুট করে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছ থেকে স্যুপের বাটিটা কেড়ে নিলাম আমি। আচমকা এমন হওয়াতে, হা হয়ে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। এই সুযোগে আদ্রিশ ভাইয়াকে স্যুপ খাইয়ে দিলাম আমি। হতভম্ব হয়ে যায় আমার এহেন কর্মকাণ্ডে আদ্রিশ ভাইয়া। ঠোঁট চেপে হাসলাম আমি। রিশতাও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। আদ্রিশ ভাইয়া হঠাৎ বিষম খেয়ে যায়। রিশতা দ্রুত পানি ঢেলে দেয়। আদ্রিশ ভাইয়া পানি পান করে নিল। তবুও তার কাশি থামছে না। আমি হাত বুলিয়ে দিলাম আদ্রিশ ভাইয়ার পিঠে। তারপর কিছুটা শান্ত হয় আদ্রিশ ভাইয়া। থম মেরে বসে রইল কিছুক্ষণ। নিরবতা ভেঙে থমথমে গলায় সে বলল
-‘ এসবের মানে কি মেহু? স্যুপটা তোর জন্য, আমার জন্য নয়। তু..।
আদ্রিশ ভাইয়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমি বললাম
-‘ কাল রাত থেকে কিছু খাওনি তুমি। এমন চলতে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে ভাইয়া। সবসময় আমার খেয়াল রাখলে চলবে, নিজেরও তো খেয়াল রাখতে হবে।
চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আদ্রিশ ভাইয়া। গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলল
-‘ তুই কিভাবে জানলি?
-‘ কোনো কিছুই আমার অজানা নয়, ভাইয়া। আমি সবই জানি। আর কতো কষ্ট লুকিয়ে রাখবে নিজের মাঝে? সুখের সাথে সাথে নিজের দুঃখগুলোও শেয়ার করো, এতে তোমার দুঃখ কমবে বইকি বাড়বে না।
আদ্রিশ ভাইয়া থম মেরে বসে রইল। তার মুখে রা টিও নেই। আমি পুনরায় বললাম
-‘ আমি জানি তুমি চাচ্চুর উপর রাগ করে রাতে খাওনি। রাগ করো না নিজের বাবার প্রতি। ভালো হোক বা খারাপ, তিনি তো তোমার বাবা হোন।
-‘ তাই বলে উনি জোর করে সবকিছু চাপিয়ে দিবেন আমার উপর? আমার স্বপ্ন আমি ডাক্তার হবো। সে প্রথম থেকেই আমার লক্ষ্যে বাঁধা দিয়েছে। তিনি কখনো চাননি যে ডাক্তার হই আমি, সে শুধু নিজের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিল আমায়। আম্মু আর ছোট চাচ্চু না থাকলে হয়তো আমার স্বপ্ন পূরণই হতো না। কাল রাতে তিনি আমায় দোষারোপ করে বলেছেন, তার ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে নাকি আমার জন্যে, আমিই তার ব্যবসার হাল ধরিনি বলে এমনটা হয়েছে।
এলোমেলো ভাবে এতোটুকু কথা বলে থামল আদ্রিশ ভাইয়া। রাগে এখনো ফুঁসছে সে। পরপর কয়েকটা লম্বা শ্বাস টেনে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে সে।
আমি ইশারায় রিশতাকে বললাম আমার জন্যে আরেক বাটি স্যুপ আনতে। ও চলে যায়।
আদ্রিশ ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করলাম তাকে। এরপর স্যুপের বাকিটুকু খাইয়ে দিলাম। বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে নিল সে। খাওয়া শেষ হতেই আচমকা সে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার এহেন কান্ডে আমি হতভম্ব বনে যাই। কিছুক্ষণ পর আমায় ছেড়ে ছিটকে দূরে সরে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। মেঝের দিকে তাকিয়ে করুণ সুরে একনাগারে বলে ফেলল
-‘ আ’ম সো সরি। আমি ইচ্ছে করে করিনি এসব। আমি আসলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি তখন। আই সয়ার, আমি আর এমন ভুল করব না। আ’ম এক্সট্রেইমলি সরি ফর দ্যাট।
কথাটা বলেই টলমলে পায়ে চলে যায় সে। আমি হা করে চেয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে। আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম এতোক্ষণ নাকি সবটাই বাস্তব ছিল!
#চলবে ~
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/