গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ৪৬
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
“প্লিজ ভাইয়া,এভাবে বলো না। কারোর কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। কতশত স্বপ্ন পূরণ করা বাকি, প্রাপ্তি খাতা যে এখনও শূন্য। জীবনে সফলতা, প্রেম, বিয়ে কিছুই তো হলো না৷ এ জীবনে কি পেলাম আমি! আমার কতদিনের ইচ্ছে মামা ডাক শুনার সেই ইচ্ছে টাও তো কেউ পূরণ করছে না!”
তানভিরের কথা শুনে আবির শুকনো মুখেই বিষম খেল। রাকিব তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে। কোনোরকমে একটু পানি খেয়ে গ্লাস টা টেবিলে রাখতে রাখতে আবির বলল,
“তোর বোনের সাথে প্ল্যানিং টা তাহলে খুব শীঘ্রই করতে হচ্ছে। ”
আবিরের কথা শুনে তানভির পুরাই বেকুব হয়ে গেছে। আবিরের সিরিয়াস মুড ঠিক করতেই তানভির মজা করেছিল৷ আবির যে এমন কথা বলতে এটা সে ভাবতেই পারে নি। রাকিব ঠাট্টার স্বরে বলল,
“প্রেম, বিয়ের খবর নেই ডিরেক্ট বাপ হওয়ার ধান্দা। ”
আবির রাকিবের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে জানাল,
“সবাই তো সিরিয়াল মেইনটেইন করেই আমি বরং উল্টোটা করলাম। শুধু আমার বউটা রাজি হলেই হবে৷ ”
তানভির আর রাকিব দুজনেই হাসছে সেই সাথে আবিরও। বেশ কিছুক্ষণ চললো এসব ফাজলামো। আবিরের জুনিয়র তানভিরকে মামা ডাকবে নাকি চাচ্চু সেই নিয়েও আলাপচারিতা চলল৷ খানিকক্ষণ বাদে তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” ভাইয়া, বন্যা কি আমার জন্য ঠিকঠাক? আমি আবারও ভুল পথে পা বাড়াচ্ছি না তো?”
“দেখ ভাই, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত সঠিক নাকি ভুল তা বলার ক্ষমতা আমাদের নেই৷ বন্যা মেয়েটা খুব ভালো এই কথায় কোনো ভুল নেই। কিন্তু তোকে আর একটু সাবধান হতে হবে৷ আমি জানি তুই ওর জন্য নিজেকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করার চেষ্টা করছিস। তারপরও একটু কেয়ারফুল থাকিস। রেগে গেলে যে উল্টাপাল্টা আচরণ করিস সেটার প্রভাব যেন কোনোভাবেই তার উপর না পরে। প্রয়োজন, অপ্রয়োজনে একটু খোঁজ খবর নিবি। জানিস তো, মেয়েরা সুদর্শন পুরুষের থেকেও দায়িত্বশীল পুরুষের প্রেমে বেশি পড়ে। ”
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেছে। দুই ভাইয়ের কথা ফুরাচ্ছে না। এরমধ্যে ফুপ্পি আবিরকে কল দিয়েছিল। দুই ভাই ই ফুপ্পির সঙ্গে কথা বলেছে। আবির আর তানভির যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, সপ্তাহে অন্ততপক্ষে একদিন হলেও ফুপ্পির সাথে দেখা করে আসে। আসিফ ভাইয়া এখনও দেশে ফেরে নি। তবুও জান্নাতের একায় দু বাড়িতেই যাতায়াত করতে হয়। একদিকে রাকিবদের একমাত্র বোন অন্যদিকে ঐ বাড়ির বড়বৌ। জান্নাত সবার ই খুব আদরের। বিশেষ করে মাহমুদা খানের চোখের মনি। শাশুড়ী সর্বক্ষণ বউমাকে চোখে হারায়। বিকেলে খাওয়াদাওয়া করার সময় তানভির কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল,
“ভাইয়া একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কি কথা?”
“তিনদিন তুমি কোথায় ছিলে? ”
“তোকে নিয়ে যাব নে। নিজেই দেখে আসিস কোথায় ছিলাম।”
“আচ্ছা। ”
অফিসের কাজ শেষ করা পর্যন্ত তানভির অফিসেই ছিল। যতটুকু পেরেছে নিজেও হেল্প করেছে৷ অফিস শেষে রাকিব সহ তানভির আর আবির ঘুরতে বেড়িয়েছে৷ সেখান থেকে বাসায় ফিরেছে প্রায় ৮ টার দিকে। মেঘ সোফায় বসে টিভি দেখছিল৷ আবির পকেট থেকে একটা কিটকেট চকলেট বের করে সোফার সামনে রাখা টি টেবিলে ঠিক মেঘের সামনে রাখল। মেঘ চকলেটের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল,
“আমি খাব না চকলেট। ”
আবিরের ভারী কন্ঠের জবাব,
“না খেলে ফেলে দে। ”
মেঘ সঙ্গে সঙ্গে চকলেট টা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খানিক চেয়ে রইলো। পরক্ষণেই নিজের রুমের দিকে চলে যাচ্ছে। তখনই রুম থেকে আদি আসছে। ফ্লোরে চকলেট পরে আছে দেখে চকলেট হাতে নিয়ে মেঘের কাছে ছুটে এসে প্রশ্ন করে,
“মেঘাপু, চকলেট টা কার? ”
“খেতে ইচ্ছে হলে খেয়ে ফেল। ”
“Thank you Meghapu”
বলেই আদি চকলেটের প্যাকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে রুমের দিকে চলে গেছে। আবির উপর থেকে সেটা দেখে নিজেও রুমে ঢুকে গেছে। মেঘ অত্যন্ত জেদি একটা মেয়ে৷ যা বলবে তাই করবে৷ কোনোকিছু খাবে না বললে, দুনিয়া উল্টে গেলেও খাবে না৷ আবার কোনো জিনিস লাগবে মানে লাগবেই। মালার প্রতি তার রাগ অনেকদিন যাবৎ। ঐদিন রাতে কল দেয়ার পর থেকে সেই রাগ এখন কন্ট্রোলহীন হয়ে গেছে। রাত ১২ টার পর কোনো মেয়ে কারণ ছাড়া কোনো ছেলেকে কল দেয় না। যদি এমনটাও হয় যে আবির মালাকে পছন্দ করে না এমনকি তার হাতে আশিক নাম টাও আবির ই লিখিয়েছে তবে কেন মালা আবারও আবিরকে কল দিবে। আর আবির ই বা কেন মালাকে ব্লক করছে না। মূলত এই জিদেই মেঘ এমন আচরণ করছে।
৯.৩০ নাগাদ তানভির বন্যার নাম্বারে কল দিয়েছে। ২ বারের বেলায় কলটা রিসিভ হলো । বন্যা সঙ্গে সঙ্গে সালাম দিয়েছে। তানভির সালামের উত্তর দিয়ে কিছুটা রেগে প্রশ্ন করল,
“তোমার চোখে কি কোনো সমস্যা আছে?”
“কই না তো৷ কেনো?”
“তোমাকে কয়েক ঘন্টা আগে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি৷ দেখো নি? নাকি এক্সেপ্ট করার প্রয়োজন মনে করো নি?”
বন্যা তৎক্ষনাৎ ফোন কেটে দিয়েছে। আরও ২ ঘন্টা আগেই দেখেছে তানভির রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। এমনকি তানভিরের আইডি ঘুরেও দেখেছে । বন্যা ইচ্ছেকরেই এক্সেপ্ট করে নি। এমনিতেই যেভাবে শাসন করে, সেখানে ফ্রেন্ড লিস্টে এড করলে সবকিছুতে নজরদারি করবে এই ভয়েই এক্সেপ্ট করে নি৷ কিন্তু এভাবে কল দেয়াতে বন্যা তাড়াতাড়ি গিয়ে এক্সেপ্ট করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর তানভির আবার কল করেছে। কল রিসিভ করতেও বন্যার এখন হাত কাঁপছে। ভয়ে ভয়ে রিসিভ করেছে। তানভির এবার স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“কল কেটেছো কেন?”
“এক্সেপ্ট করেছি৷ ”
“ওকে। কোথায় আছো?”
“নানু বাড়িতে৷ ”
“তোমার নানু কেমন আছেন?”
“এখন কিছুটা সুস্থ, দোয়া করবেন৷ ”
“ফি আমানিল্লাহ। রাতে খেয়েছো?”
“জ্বি। আপনি?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা রাখি এখন”
“এই শুনো ”
“জ্বি ভাইয়া। ”
“আবার ভাইয়া৷ ”
“সরি, মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। বলুন ”
“I am Sorry. দুপুরে তোমার সাথে রাগ দেখানো টা একেবারেই উচিত হয় নি। কিছু মনে করো না প্লিজ৷ মেজাজ একটু গরম ছিল। ”
বন্যার অক্ষি যুগল প্রশস্ত হয়ে গেছে। হা হয়ে রুমের দেয়ালে চেয়ে আছে। স্বয়ং তানভির খান তাকে সরি বলছে এটাও ভাবা যায়। ছোট থেকে মেঘ আর বন্যা তানভিরের কম ধমক খায় নি সেসব এখন অতীত। স্কুল কলেজের গন্ডি পেড়িয়ে দুজনেই এখন ভার্সিটির স্টুডেন্ট। মেঘ আর বন্যার আচরণে যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি তানভিরের আচরণেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে আজকের সরি বলাটা বন্যার কাছে অকল্পনীয় বিষয়। তানভিরের সঙ্গে কথা শেষ করেই মেঘকে কল দিয়েছে।
বন্যা- জানিস তোর ভাই আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে আবার দুপুরের আচরণের জন্য সরিও বলেছে।
মেঘ- তোকে আগেই বলেছি আমার ভাইয়ের মতো মানুষ হয় না৷ রাগী হলেও মন ফ্রেশ।
বন্যা- কিসের ফ্রেস। তোর ভাইয়ের আইডিতে ঢুকছিলাম। লাস্ট কয়েকদিনের পোস্ট পড়ে আমি এখন কোমায় যাওয়ার রাস্তা খোঁজছি৷
মেঘ- ওমা কেন?
বন্যা- একেকটা স্ট্যাটাস যে দিয়েছে, লাইন গুলো পড়েই আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। স্ট্যাটাসের মানে বুঝা তো বহুদূরের বিষয়৷
মেঘ- এটা আমার ভাইয়ের একার সমস্যা না। আমার মনে হয় এটা ছেলের ব্রেইনের সমস্যা। মাঝে মাঝে আবির ভাইও আধ্যাত্মিক লেবেলের কথা বলেন৷ আমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেড়িয়ে যায়। আগামাথা কিছুই বুঝি না।
বন্যা- আবির ভাইয়ের টা জানি না তবে আমার কি মনে হয় জানিস, তোর ভাই হয়তো প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছে । আজকে দুপুরেও দেখলি না রেগে ছিল, কতবার ফোনে কথা বলতে উঠে উঠে গেছে৷ বিশ্বাস না করলে তুই নিজেই ওনার স্ট্যাটাস গুলো দেখিস।
মেঘের হাসিমুখে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। খুব চিন্তায় পরে গেছে মেয়েটা । বন্যা পুনরায় বলল,
“আমার আসতে কয়েকদিন দেরি হবে। তুই সাবধানে থাকিস আর ক্লাস গুলো ঠিকমতো করিস। ”
মেঘ আচ্ছা বলে কল কেটে দিয়েছে। তার মাথায় বন্যার বলা কথাটায় ঘুরছে। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে ঢুকে তানভিরের আইডি চেক করল। বেশ কয়েকটা পোস্টে আবির ভাই আর রাকিব ভাইয়াদের কমেন্ট ও আছে। মেঘ সেসব কমেন্টও পড়েছে বিষয় টা বুঝার জন্য কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। মেঘের শরীর ঘামছে, চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। ফোন রেখে রুম থেকে বেড়িয়ে তানভিরের রুম পর্যন্ত আসছে। দরজা ভেতর থেকে লাগানো, রুমে কম সাউন্ডে গান বাজতেছে,
“একাকি মন আজ নিরবে
বিবাগি তোমার অনুভবে
ফেরারি প্রেম খুজে ঠিকানা
আকাশে মেঘ মানে বোঝ কিনা!”
গানটা শুনে মেঘ কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ কিছু ভেবে দু কদম পিছিয়ে গেছে৷ ডাকবে কি না বুঝতে পারছে না। মনে অশান্তির ঝড় চলছে। চলে যেতে নিয়ে পুনরায় এসে দরজায় ডাকল। ভেতর থেকে তানভির প্রশ্ন করে,
“কে?”
“আমি। দরজা টা খুলো। ”
তানভির সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিয়েছে। মেঘ তানভিরকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে ফোনের গান টা অফ করে একটা চেয়ার টেনে ঠিক রুমের মাঝখানে ফ্যানের নিচে বসেছে। মেঘের এমন আচরণে তানভির একটু অবাক হয়েছে। মেঘের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“এত রাতে তুই এখানে। কিছু হয়ছে?”
“হ্যাঁ হয়ছে। তবে আমার না তোমার ”
তানভির ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে৷ বন্যা নিশ্চয় মেঘকে কিছু বলছে আর তারজন্যই মেঘ এসেছে। মেঘ হঠাৎ ই গুরু গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে,
“তুমি এমন ছ্যাঁকা খাওয়া গান শুনছিলা কেন? কি হয়ছে তোমার?”
“কিছু হয় নি। গানটা ভালো লাগে তাই শুনছিলাম।”
“এসব গান তারাই শুনে যাদের মনে অনেক দুঃখ। তোমার মনে কিসের দুঃখ বলো। কে তোমায় কি বলছে?”
তানভির মৃদু হেসে জবাব দেয়,
“আমায় আবার কে কি বলবে। কিছু হয় নি আমার৷ টেনশন করিস না। ”
“টেনশন তো করতেই হবে। দুপুর থেকে তোমার মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছি। বাই এনি চান্স, তোমার কি তার সঙ্গে কোথাও দেখা হয়ছিল?”
“কার সঙ্গে?”
“তোমার অতীত৷ যার জন্য তুমি এখনও এসব গান শুনতেছো।”
“মাথা নষ্ট হয়ছে তোর? আমি কাউকে মিস করে এসব গান শুনছি না। আর কারো সঙ্গে আমার দেখাও হয় নি। তুই অযথা চিন্তা করছিস। ”
“সত্যি বলছো নাকি আমাকে বোকা বানাচ্ছ তা আমি জানি না। কিন্তু আর কোনোদিন তোমায় যেন ছ্যাঁকা খাওয়া গান শুনতে না দেখি৷ যদি আমার কথা না মানো তবে আব্বু, বড় আব্বু সবাইকে বিচার দিব।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তুই যা বলবি তাই হবে৷ এখন আজেবাজে চিন্তা বাদ দে৷ শুধু শুধু চিন্তা করে চেহারাটাকে পেত্নীর মতো করতেছিস। ঘুমা গিয়ে”
উঠে যেতে নিবে হঠাৎ ই মেঘ থমকে দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বলা শুরু করল,
“ভাইয়া শুনো, কোনোদিন যদি ভুলক্রমেও ঐ মেয়ের সঙ্গে তোমার দেখা হয়ে যায় চোখ বন্ধ করে একটা থা*প্পড় মারবা। তুমি না পারলে আমায় বইলো আমি দিব নে। প্রয়োজনে আমার ১৫-২০ টা বান্ধবী নিয়ে যাব। সবাই একটা করে থাপ্পড় দিলে ঐ মেয়ে শেষ৷ আর শুনো থাপ্পড় কিন্তু এক গালেই দিবা। তাহলে ঐ মেয়ের আর জীবনে বিয়ে হবে না। ”
মেঘের কথা শুনে তানভির নিঃশব্দে হাসছে। কিন্তু মেঘের চোখ রাগে জ্বলছে। আচমকা দরজা থেকে আবির বলে উঠে,
“আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান এখন কোথায়? ওনাদের আদরের মেয়ের এই রূপ কি তারা দেখেন না? তাদের মতে আবির গু*ন্ডা আর মেঘ একমাত্র লক্ষ্মী তাই না? আমিও ভিডিও করে রেখেছি আরেকদিন আমায় কিছু বললে আমিও দেখিয়ে দিব তাদের লক্ষ্মী মেয়ে কোন লেবেলের গু*ন্ডী।”
মেঘ চোখ গোলগোল করে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির মিটিমিটি হাসছে৷ মেঘ গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে রাগী স্বরে বলল,
“ডিলিট করুন ভিডিও। ”
“আগে এককাপ কফি করে নিয়ে আয় তারপর ভেবে দেখবো৷ ”
“আমি কফি করতে পারি না।”
মেঘ মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
“আমি কেন কফি করব। রাত ১২ টার পরে যার সাথে কথা বলেন তাকে বলতে পারেন না?”
আবির কোমল কন্ঠে বলে,
“পারি না বললে কিভাবে হবে! শিখতে হবে তো! আমি শিখিয়ে দিচ্ছি বানিয়ে নিয়ে আয়। ”
মেঘের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কফি বানাতে যাচ্ছে। আবির পুনরায় ডেকে উঠল,
” সাবধান, হাত পুড়াইয়েন না আবার। ”
আবির তানভিরের সাথে দুমিনিট কথা বলে দ্রুত নিচে আসছে । মেঘ ততক্ষণে গ্যাসে পানি গরম দিয়েছে মাত্র। আবির রান্নাঘরে এসে শান্ত কন্ঠে বলল,
“যা আমি করতেছি। ”
“আপনি ই যদি করবেন তবে আমায় পাঠাইছিলেন কেন?”
“তোরে কিছু বললে তো ভয় লাগে।যদি হাত পা পুড়াইয়া ফেলিস, তাহলে তো জীবনের জন্য আমার কফি খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ”
“এখন ভিডিও টা ডিলিট করুন।”
“ভিডিও করিই নি, ডিলিট কি করবো।”
“মানে? আপনি আমার সাথে ফাজলামো করছেন?”
“জ্বি ম্যাম। ”
মেঘ রাগে আবিরের মুখের পানে চেয়ে আছে।
আবির মুচকি হেসে শুধালো,
“রাগ করছেন?”
মেঘ রাগে ফুঁসছে। আবির পুনরায় বলল,
” রাগ টা কি একটু কমানো যায় না?”
মেঘের রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
” আমার রাগে কার কি যায় আসে?”
আবির নরম স্বরে বলল,
“Sorry.”
মেঘ ভেঙচি কেটে চলে যেতে নিলে আবির ডেকে বলে,
“কাল বিকেলে রেডি থাকিস একটা জায়গায় নিয়ে যাব। ”
“আমি যাব না।”
“কেন?”
“আমার কোথাও যাওয়ার মুড নেই তাও আবার আপনার সাথে। ”
“ঠিক আছে। আমার সাথে না গেলে তানভিরের সঙ্গে যাস৷ ”
“কারোর সাথেই যাব না৷”
“না গেলে কিন্তু স্পেশাল কিছু মিস করবি৷ মিস যদি না করতে চাস তাহলে কালকের জন্য রাগ টা পাশের বাড়িতে রেখে তানভিরের সঙ্গে চলে যাস। ”
“আমি যাব না মানে যাব ই না।”
মেঘ রাগে কটমট করতে করতে চলে যাচ্ছে। আবির পেছন থেকে আবারও ডেকে বলে,
” ভেবে দেখিস, রাগ টা পাশের বাড়িতে রাখা যায় কি না! ”
মেঘ আর পেছন ফিরে তাকায় নি৷ বিড়বিড় করে বকতে বকতে রুমে চলে গেছে। সকাল থেকে আবির আর তানভির বাসায় নেই। অফিস ৩ দিনের ছুটি। কিন্তু দু ভাই ভোরবেলা না খেয়েই বেরিয়ে পরেছে৷ তানভির ঠিক ২ টার সময় বাসায় ফিরেছে৷ ১-১.৩০ ঘন্টা মেঘকে বুঝিয়ে, রিকুয়েষ্ট করেছে রেডি হওয়ার জন্য৷ কিন্তু জেদি মেয়ে যাবে না মানে যাবেই না। আবিরের প্রতি ক্ষোভ ই কমছে না তার৷ আবির ভাইকে দেখলে একটু আধটু প্রেমানুভূতি জাগলেও তানভিরের কথা মনে পড়তেই সব ভুলে যায়৷ তানভির ভাইয়ের মতো তার জীবনটাও না এমন হয়! মালার সাথে যদি আবির ভাইয়ের সত্যিই কিছু থেকে থাকে তবে তাকেও তার ভাইয়ের মতো ছ্যাঁকা খাওয়া গান শুনে জীবন কাটাতে হবে এসব ভেবেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। মেঘকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে তানভির ৪ টার দিকে আবার বেরিয়ে পরেছে।
আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান সন্ধ্যায় সোফায় বসে চা খাচ্ছেন আর গল্প করছিলেন, সেই সকালে আবির আর তানভির বেরিয়েছিল, তানভির ২ ঘন্টার জন্য বাসায় ফিরলেও আবির সারাদিনেও ফেরে নি। বিষয় টা দুভাইয়ের ই নজরে পরেছে। আবিরের আম্মুকেও জিজ্ঞেস করেছে ওনিও জানেন না। সারাদিনে আবিরের সাথে কথাও হয় নি। আলী আহমদ খান নিজেও দুবার কল দিয়েছেন নো রেসপন্স। আবিরের সঙ্গে বাবা চাচার দূরত্ব দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আবির টাইমমতো অফিসে যায়, নিজের কাজও ঠিকঠাক মতো করে, সেই সাথে বাবা – চাচার কাজও একা হাতে সামলায়। কাজের বাহিরে ১০ মিনিটের জন্যও ওনাদের সাথে বসে না, এক কাপ চা পর্যন্ত খায় না৷ প্রয়োজনের বাহিরে কোনো কথা বলে না। অথচ একটা সময় পর্যন্ত আবির যা করতো সব আব্বু আর চাচ্চুকে জানিয়ে করতো। বাহিরে থাকাকালীনও রেগুলার আব্বু আর চাচ্চুর সঙ্গে কথা হতো। গত দের বছরে ছেলের এত পরিবর্তন মেনে নিতে পারছেন না আবিরের আব্বু। প্রায় ই দুই ভাই এই বিষয় নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু এর কোনো সমাধান পান না।
রাত ৯ টার দিকে আবির কয়েক বক্স মিষ্টি নিয়ে বাসায় আসছে। একটা বক্স হাতে নিয়ে উপরে সোজা মেঘের রুমে হাজির হয়েছে। মেঘ জামা প্রিন্ট করছিল৷ হঠাৎ পেছনক ঘুরতেই আবিরকে দেখে আঁতকে উঠে। আবির ঠিক তার পেছনে দাঁড়ানো। আবির একটা মিষ্টি হাতে নিয়ে নরম স্বরে বলল,
“নে হা কর। ”
“কিসের মিষ্টি।”
“হা করতে বলছি”
ভারী কন্ঠ শুনে মেঘ হা করে মিষ্টিটা মুখে নিল। আবির দ্বিতীয় মিষ্টিটা দু আঙুলে নিতে নিতে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” তুই যদি কথা মানতি তাহলে জানতে পারতি কিসের মিষ্টি। যেহেতু যাস নি তাই এ বিষয়ে তোকে আপাতত আর কিছুই বলব না। ”
আবির আরেকটা মিষ্টি মেঘকে খাইয়ে দিয়ে বক্সটা টেবিলের উপর রেখে চলে গেছে।
(scsalma90)
★★★★★
আজ সকাল থেকে বাড়িতে মানুষের ভিড়। আবিরের রুমে কাজ করাবে। এত বছরে বাড়ির অন্যান্য রুমগুলো ২-১ বার রং করা হলেও আবিরের রুমে রঙ করা হয় না অনেকবছর যাবৎ। রঙ করলে ছেলের স্মৃতি মুছে যাবে বলে মালিহা খানের কড়া নির্দেশ ছিল আবিরের রুমে কোনোরকমের কাজ করানো হবে না। আবির ফিরেছে অনেকদিন তবুও রঙ করায় নি। মায়ের অনুমতি নিয়েই রুমে কাজ করাচ্ছে। পুরাতন কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে নতুন জিনিস আনা হচ্ছে। রুমে এসি লাগানো হচ্ছে। দুপুর বেলা মেঘ হঠাৎ ই কি মনে করে যেন আবিরের রুমে আসছে। রুম সম্পূর্ণ অগোছালো। পা ফেলার অবস্থা নেই। দেয়ালে সাদা রঙ করা হচ্ছে, এরপর অন্য রঙ দেয়া হবে। মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে ডাকল,
“আবির ভাই.”
“হুমমমমমম”
“আমি কিন্তু আপনার রুমের দেয়ালগুলোতে আর্ট করব। ”
আবির এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা দেয়াল দেখিয়ে বলল,
“তুই চাইলে এই দেয়ালে তোর লতাপাতার ডিজাইন করতে পারিস। ”
মেঘ অভিমানী স্বরে বলল,
“থাক লাগবে না।”
হ্যান্ডপ্রিন্টিং এর কাজ শিখছে তাই মান অভিমান সাইডে রেখে এসেছিল প্রিয় মানুষের রুমটাকে নিজের মতো করে সাজাতে। আবির ভাই চান বা না চান সে তো নিজেকে আবির ভাইয়ের প্রেমিকা মনে করে৷ সেই অধিকারবোধ নিয়েই এসেছিল। কিন্তু আবির একটা দেয়ালে রঙ করার অনুমতি দেয়ায় তার বড্ড অভিমান হয়েছে।
আবির বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,
“রঙ না করলে বলছিস কেন? আর আসছিস কেন আমার রুমে? আমি ডেকে আনছিলাম তোকে? যা এখান থেকে আগামী ৭ দিন তোর আমার রুমে আসা সম্পূর্ণ নিষেধ। যদি ভুলেও আমার রুমের আসার চেষ্টা করিস তাহলে তোর খবর আছে। ”
রুমে কয়েকজন মিলে রঙ করছিল।সবার সামনে এভাবে কথা বলায় মেঘ খুব অপমানিত হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আপনার রুমে আসছি বলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে? ”
” হ্যাঁ হয়েছে। একদম কাঁদবি না। যা এখান থেকে। ”
মেঘ কাদঁতে কাঁদতে বেড়িয়ে যেতে নিলে কিসের সঙ্গে হোটচ খেয়ে পড়তে নিলে নিজেকে সামলাতে এক হাত দরজায়, আরেক হাত সদ্য রঙ করা দেয়ালে রেখে কোনোরকমে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচেছে। স্বাভাবিক হয়ে মেঘ পেছন ফিরে তাকিয়েছে, আবির যেন দেখেও না দেখার ভান করে আছে। একটা জলজ্যান্ত মানুষ পরে যেতে নিচ্ছিল অথচ তার ধরার কোনো চেষ্টা নেই, ঠিক আছে কি না জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজনবোধ করছেন না। এমন আবির ভাইকে মেঘ কখনও চাই নি৷ আবির ভাইয়ের এটিটিউটের চেয়েও বেশি ওনার যত্নের প্রেমে পরেছিল মেঘ। সেই মানুষটা এত পরিবর্তন হয়ে গেছে৷ ভেবেই মেঘ অবাক হয়ে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। ৫ মিনিটের মধ্যেই রুমে সাদা রঙ করা শেষ হয়ে গেছে। কয়েকজনের মধ্যে একজনের নজর পরে দরজার পাশের দেয়ালের দিকে৷ মেঘের হাতের চাপে দেয়ালে স্পষ্ট ছাপ পরে গেছে৷ ছেলেটা রঙ নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
” রঙটা দেখা যায় নষ্ট হয়ে গেছে। সমস্যা নাই এখনই ঠিক করে দিচ্ছি।”
আবির গম্ভীর গলায় বলে,
“সাবধান, এই ছাপের উপর যেন রঙ না পরে৷ ”
“ভাই এভাবে রাগ দেখানো ঠিক না৷ আপনার বোনের হাত বোধহয় ভুলে দেয়ালে লেগে গেছে । এখনও ভেজা আছে রঙ দিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে৷ কিছু বুঝা যাবে না। ”
আবির মুচকি হেসে বলে,
“এই ছাপ ভুল করে হয় নি। আমি ইচ্ছে করেই করিয়েছি। এই রুমটা যার তার স্মৃতি তো রাখতেই হবে।”
মেঘ যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে যাবে এমন সময় আবির পা বাড়িয়ে দিয়েছিল । আর আবিরের পায়ের সঙ্গে হোটচ খেয়েই মেঘ পড়তে নিয়েছিল।
ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
“ভাই, ওনি কি আপনার ভালোবাসার মানুষ?”
“হ্যাঁ!”
“তাহলে এত রাগ দেখালেন যে৷ ”
“কারণ আছে। তুমি কাজ করো। আর হ্যাঁ ও যেন কোনেভাবেই রুমে না আসে। খেয়াল রেখো।”
“আইচ্ছা ভাই। ”
দুইদিন হয়ে গেছে আবিরের রুমে রঙ করা হয়েছে। মেঘ অনিচ্ছা স্বত্তেও ছাদে যাওয়ার সময় আবিরের রুমের দিকে তাকিয়েছে৷ আবির বাসায় থাকলে সবসময় দরজা বন্ধ থাকে। আর বাসায় না থাকলে রুম তালা দেয়া থাকে৷ রুমে তালা দেখে মেঘের মেজাজ আরও বেশি খারাপ হয় । সন্ধ্যার দিকে মেঘ ড্রয়িং রুমে বসে বসে মা কাকিয়াদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলো।মেঘ অকস্মাৎ বলে উঠল,
“বড় আম্মু তুমি কি জানো তোমার ছেলে যে অবৈধ কাজ করে?”
“মানে? কি বলছিস কি?”
“হ্যাঁ। তা না হলে বাড়ির মধ্যে এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও ওনার রুমে তালা দিয়ে রাখতে হয় কেন বলো?”
“আবির রুম তালা দিয়ে রাখে?”
“হ্যাঁ৷ বিশ্বাস না করলে ওনি বাসায় না থাকলে দেখে আইসো।”
আচমকা মাথায় গাট্টা খাওয়ায় মেঘ “উফফফফ” বলে পেছন দিকে তাকাতেই দেখে আবির দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। কন্ঠস্বর দ্বিগুণ ভারী করে বলে,
“রুমে তালা দিয়ে রাখছি বলে কি আমি অবৈধ ব্যবসা করি? এ কেমন লজিক
আচ্ছা আমি কি অবৈধ কাজ করি বল! না বলতে পারলে তোর একদিন কি আমার একদিন।”
মেঘ মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে বলল,
” আপনার ব্যবসা আপনিই ভালো জানেন। ”
মেঘ উঠতে নিলে আবির ধমক দিয়ে বলে,
“সব বিষয় নিয়ে ফাজলামি করবি না। তোদের যন্ত্রণায় রুমে তালা দিয়ে রেখেছিলাম। আমার রুমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আছে। যার মধ্যে একটা কাগজ হারালে সেটাকে খোঁজে বের করা জীবনেও সম্ভব না। সেগুলো যেন নষ্ট করতে না পারিস তারজন্য তালা দিয়ে রেখেছি।”
মেঘ মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে আছে। ইদানীং আবির ভাইয়ের সাথে ঝামেলা একটু বেশিই হচ্ছে। মজা করে কিছু বললেও আবির ভাই কেমন যেন সিরিয়াস হয়ে যায়। আবির এককাপ কফি হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসেছে। ল্যাপটপে কাজ করছিল। মেঘ কিছুক্ষণ বসে থেকে রুমে চলে যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠার পথে হঠাৎ নজর পরে ল্যাপটপের পাশে রাখা আবিরের ফোনের দিকে। ফোনে একটার পর একটা কল আসছে। আবিরের সেদিকে কোনো নজর নেই। মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে আর কফি খাচ্ছে। মেঘ ৩ টা সিঁড়ি নিচে নেমে দেখার চেষ্টা করছে কার কল আসছে, সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোনরকমে সিউর হলো কলগুলো মালা আপুর নাম্বার থেকে আসছে৷ মেঘের মেজাজ খারাপ হতে দু সেকেন্ড সময় লাগল না। আবির ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির মূলে এই মালা আপু। মেঘ রাগে গজগজ করে নিজের রুমে চলে গেছে। কিন্তু রুমেও স্থির হতে পারছে না। একবার রুমের বেলকনিতে যাচ্ছে, একবার শুয়তেছে, রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত এসে আবার রুমে চলে যাচ্ছে। কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না। একবার রুম থেকে বেরিয়ে বেলকনিতে আসতেই নিচে নজর পরে সোফায় আবির ভাই নেই। ল্যাপটপ ফোন এমনিতেই পরে আছে। রান্নাঘরেও কেউ নেই। মেঘ দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। ফোনের লক খোলা দেখে তাড়াতাড়ি করে কল লিস্টে ঢুকেছে মালা আপুর নাম্বার থেকে মোট ৩৫ টা মিসকল এসেছে। তখন ই ফোনে একটা মেসেজ আসছে। মেঘ মেসেজে চাপ দিতেই মালার নাম্বার থেকে আসা শতশত মেসেজ চোখের সামনে ভেসে উঠে। যতধরনের আবেগী, প্রেমময় কথা আছে সবই বলেছে। এত মেসেজ পড়ার সময় নেই। লুকিয়ে আবিরের ফোন দেখছে এই ভয়ে হাত কাঁপছে। আগেও কয়েকবার আবিরের ফোন ধরতে নিষেধ করেছিল তারপরও মেঘ ফোন ধরেছে। কয়েকটা মেসেজের উপরে হঠাৎ ই আবিরের দেয়া একটা মেসেজ চোখে পরে,
মেসেজ টাতে লেখা ছিল,
“তোকে আর কিভাবে বললে আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করবি বল৷ বহুবার বলেছি আমি সিঙ্গেল না। যদি মনে করিস ঘন্টায় ১০০ মেসেজ করলে আমি গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্রেকাপ করে তোর সঙ্গে রিলেশনে যাব তাহলে তুই বোকার স্বর্গে বাস করছিস। কারণ আমার এমন কোনো সুযোগ নেই। এখন পর্যন্ত কাউকে বলি নি। তোকেই প্রথম বলছি, আমি বিবাহিত । বাসার কেউ জানে না যে আমি বিয়ে করেছি। বিদেশে বউ …”
সহসা আবির মেঘের হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয়। অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,
“কতবার বলেছি আমার ফোনে হাত দিবি না। কোন সাহসে ধরেছিস?
মেঘ ঢোক গিলছে৷ কান্না যেন ভেতর থেকে উপতে পড়তে চাইছে৷ অবিরত হেঁচকি উঠছে৷ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে শুধালো,
“আবির ভাই, আপনি বিবাহিত?”
“হ্যাঁ। বিদেশে বউ রেখে আসছি। কিছুদিন পর চলে যাব। হইছে? শান্তি?”
আবারও প্রশ্ন করে,
“আপনি সত্যি বিবাহিত? ”
“আমার একটা বাচ্চাও আছে৷ এখন যা এখান থেকে। ”
বাচ্চার কথা শুনে মেঘের হেঁচকি থেমে গেছে সেই সাথে নিঃশ্বাস আঁটকে গেছে গলায়। নিজের চোখ আর কান কোনো কিছুকেই বিশ্বাস করতে পারছে না৷ আঁখি জোড়ায় পানি টইটম্বুর হয়ে আছে৷ শুধু উপতে পড়ার অপেক্ষা।
মেঘ তৃতীয় বারের মতো বলে,
“আপনি সত্যি সত্যি বিবাহিত? ”
“আর একটা কথা বললে এমন থাপ্পড় দিব, সাতদিন অজ্ঞান হয়ে পরে থাকবি। যা এখান থেকে। ”
মেঘ স্তব্ধ হয়ে গেছে। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আবিরের মুখের পানে। চোখে পানি জমার জন্য চোখে ঝাপসা দেখছে। আবির আবারও ধমক দেয়,
“যা এখান থেকে।”
মেঘ সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে। মেঘের সারারাত নির্ঘুম কেটেছে। ছটফট করতে করতে রাত পার করেছে। কাদঁতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে একাকার অবস্থা করে ফেলছে৷ সকালে কোনো মনে হালকা নাস্তা করেই ভার্সিটিতে চলে গেছে। এই বাড়িটাতে এখন মেঘের দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটা ক্লাস কোনোমতে করেছে। ক্লাসও বিরক্ত লাগছিল তাই মাঠে ছিল। মিনহাজ, তামিম, মিষ্টি, সাদিয়া ক্লাস শেষ করে মেঘের কাছে এসে বসেছে৷ বন্যা এখনও নানু বাড়ি থেকে ফেরে নি। তাই অসহায় মেঘের কষ্ট শেয়ার করার মতও কেউ নেই৷ মেঘের চোখমুখ ফোলা দেখে মিনহাজ, সাদিয়া, মিষ্টি বার বার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে বলার জন্য কিন্তু মেঘ কিছুই বলছে না। ওদের জোরাজোরিতে মেঘ শেষমেশ বলেছে,
“আমি যাকে ভালোবাসি তিনি অলরেডি বিবাহিত আর এক বাচ্চার বাপ।”
সাদিয়া, মিষ্টি দুজনেই আর্তনাদ করে উঠে। মিনহাজ মনে মনে খুব খুশি হয়েছে৷ এ যেন মেঘ না চাইতেই জল৷ ওদের জোরাজোরিতে মেঘ কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া বিস্তারিত ঘটনা বলেছে। ওদের মধ্যে মিষ্টি খুব ত্যাড়া। মিষ্টি কপাল গুটিয়ে বলা শুরু করল,
“এতকিছুর পরেও তুই ঐ বাড়িতে আছিস কেন৷ আমি হলে তো কবেই বাড়ি থেকে চলে আসতাম। চোখের সামনে প্রিয় মানুষ অপ্রিয় হওয়ার চেয়ে, চোখের আড়ালে যা খুশি করতে থাকুক। এইযে তোর এত কষ্ট, খারাপ লাগা। কিছুদিন দূরে থাকলেই দেখবি সব ভুলে গেছিস। তুই এক কাজ কর তুই হোস্টেলে সিট নিয়া নে৷ আমাদের সঙ্গে হোস্টেলে থাকবি৷ আমরা একসাথে ঘুরবো ফিরব, আড্ডা দিব, পড়াশোনা করবো, দেখবি তোর মাথা থেকে ওনার ভূত একেবারে চলে যাবে। তখন আর আবেগ কাজ করবে না। ”
মেঘ আবারও কান্না শুরু করেছে। ওরা সবাই বুঝিয়েও মেঘকে শান্ত করতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে হিজাব অর্ধেক ভিজিয়ে ফেলেছে। চোখ-মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। সাদিয়া, মিষ্টি, মিনহাজ, তামিম প্রায় ঘন্টাখানেক বুঝিয়েছে৷ তাদের সব কথার মূল কথা মেঘ যেন বাড়ি থেকে চলে যায়৷ মেঘ হোস্টেলে আসলে মিনহাজের জন্যও বেশ সুবিধা হবে। তাই মিনহাজ আরও বেশি উৎসাহ দিচ্ছে । শেষ পর্যন্ত মেঘও মন স্থির করেছে সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসবে। ভার্সিটি কোচিং করার সময় একবার মন স্থির করেছিল, ভার্সিটিতে চান্স পেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে৷ কিন্তু আবির ভাইয়ের আবেগে জরিয়ে এতদিন বাড়ি ছাড়ার ইচ্ছে হয় নি। তবে ইদানীং আবির ভাইয়ের আচরণ প্রতিনিয়ত মেঘকে কষ্ট দিচ্ছে। গতকালের বলা কথাটাতে মেঘ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পরেছে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে একই বাড়িতে আবিরের মুখোমুখি চলাফেরা করা কোনোভাবেই সম্ভব না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে সত্যি হোস্টেলে চলে আসবে। স্যারের সাথে কথা বলে ফরমও নিয়ে গেছে।
(চলবে)