আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব- ৪৮ লেখিকা- সালমা চৌধুরী

0
990

গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ৪৮
লেখিকা- সালমা চৌধুরী

মেঘ নিজের গাল আবিরের কপালে চেপে ধরেছে ঠিকই কিন্তু হৃদয়ের তোলপাড় কোনোক্রমেই সামলাতে পারছে না। আবিরের গা থেকে আসা তীব্র, ঝাঁঝালো গন্ধ মেঘের নাক দিয়ে ঢুকে সোজা স্নায়ুতন্ত্রকে কম্পিত করছে। মেঘের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছে যা আবিরের নাকে মুখে পরছে৷ নিজেকে সংযত করতে না পেরে মেঘ তৎক্ষনাৎ উঠে বসেছে। বুকটা অসহনীয় পর্যায়ে কম্পিত হচ্ছে। ফিনফিন করে কাঁপছে ঠোঁট। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে আবিরের জ্বর কমছে না বরং ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে। মেঘ যে নিচে গিয়ে বড় আম্মুকে ডাকবে এই সুযোগ টাও পাচ্ছে না। মেঘের ফোন রুমে রেখে আসছিল৷ আবিরের ফোনের লক খুলতে পারছে না। আবিরের জ্বর বাড়তেছে দেখে দুরুদুরু কাঁপছে বুক, চোখেমুখে চিন্তার ছাপ।

আবিরের অকস্মাৎ কান্ডে মেঘের নিঃশ্বাস আঁটকে গেছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে, আঁখি জোড়া প্রশস্ত হয়ে গেছে, এই বুঝি কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসবে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে হৃৎস্পন্দনও থেমে গেছে।
জ্বরের ঘোরে আবির বালিশ থেকে সরে মেঘের উরুতে শুয়েছে। এক হাতে মেঘের কোমড় আঁকড়ে ধরেছে। আবিরের মুখ ঠিক মেঘের উদরের সঙ্গে মিশে আছে। আবিরের উষ্ণ শ্বাস জামা ভেদ করে মেঘের নমনীয় উদর স্পর্শ করছে। এতেই মেঘ পাথর বনে গেছে। অনেকটা সময় নিঃশ্বাস আঁটকে ছিল, শেষ পর্যায়ে ভেতরে আটকানো নিঃশ্বাসটা খুব জোরে ছাড়ে। বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ পাখিটা এই বুঝি উঁড়ে যাচ্ছে। আবিরের একেকটা নিঃশ্বাস মেঘের উদর স্পর্শ করছে আর মেঘের ছোট্ট দেহ প্রতিবার কম্পিত হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত পুরুষের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে মেঘ পুরো হতভম্ব হয়ে গেছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে শ্বাসনালীতে তুফান শুরু হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাট, বার বার ঢোক গিলছে। অবিরত কাঁপছে দুহাত। আবির জ্বরের ঘোরে মেঘকে আরও শক্ত করে জরিয়ে ধরেছে। এমন কল্পনাতীত কান্ডে মেঘের হৃৎস্পন্দনের মাত্রা বেড়ে আকাশ ছোঁয়ার পথে। জানালা দিয়ে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাস মেঘের কানে ঢুকছে, বাতাসেরা যেন মেঘের কানে কানে বলছে,

” তুই তো আবির ভাইয়ের প্রণয়ের অনলে পুড়তেই চাস৷ তবে কিসের এত অভিশঙ্কা?”

মেঘের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। আবিরের গায়ের জ্বরের তাপে মেঘের পেট পুরো গরম হয়ে গেছে। জ্বরের ঘোরে আবির আবোলতাবোল বলা শুরু করেছে। দীর্ঘ সময় পর মেঘ নিজের কাপাঁ কাঁপা হাতে আবিরের মাথায় আলতোভাবে স্পর্শ করেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে কোমল কন্ঠে ডাকল,

“আবির ভাই ”

আবির উত্তর দেয়ার অবস্থাতে নেই ৷ ঘোরের মধ্যে কি সব বলেই যাচ্ছে। মেঘ কান পেতে শুনছে। বুঝতে চেষ্টা করছে আবির কি বলছে৷ সব কথা বুঝতে না পারলেও শেষটুকু শুধু বুঝতে পেরেছে,

“আমি মা*রা গেলে তুই কাঁদিস না, প্লিজ”

আবিরের এমন কথা শুনে মেঘ আবিরের মাথা দু হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠে,

“এমন কথা বলবেন না প্লিজ। কিছু হবে না আপনার। ঠিক হয়ে যাবেন৷ আপনার কিচ্ছু হতে দিব না আমি। ”

বেশ খানিকক্ষণ পর মেঘ আবিরকে রেখে দৌড়ে নিচে নামলো। ততক্ষণে বাড়ির সবাই শুয়ে পরেছে। শীতের রাত তাই সবাই একটু তাড়াতাড়ি ই শুয়ে পরে। বড় আম্মুকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। বড় আম্মুও অসুস্থ, আবির ভাইয়ের এ অবস্থা দেখলে বড় আম্মুর শরীর আরও খারাপ হবে এই ভেবে আর ডাকে নি। ছুটে গেল তানভিরের রুমে। তানভিরও বাসায় নেই। মেঘ নিজের রুম থেকে ঔষধ আর ফোনটা নিয়ে তানভিরকে কল করতে করতে আবিরের রুমে গেল। তানভিরকে আবিরের অবস্থা জানিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে৷ অনেকক্ষণ ডাকার পর আবিরের একটু হুঁশ আসছে। মেঘ কোনোরকমে আবিরকে উঠিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। আবির চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মেঘ আবিরের কপালে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। আবির বেশখানিকটা সময় নিস্তেজ হয়ে পরে রইলো৷ জ্বর মাথায় উঠে গেছে। মেঘ জলপট্টি দিচ্ছে আর সরাচ্ছে, কপালের তাপে কয়েক মুহুর্তেই পট্টি গরম হয়ে যায়। তাই বার বার পাল্টাতে হচ্ছে৷ প্রায় ১ ঘন্টা পর আবির হঠাৎ ই চোখ মেলল। জ্বর কিছুটা কমেছে তাই হুঁশ ফিরেছে। সরাসরি মেঘের চোখের দিকে তাকালো।শরীরের উত্তাপে চোখ লাল হয়ে গেছে। মেঘ জলপট্টি দিতে দিতে শুধালো,

“শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”

আবির মলিন হাসলো। মেঘ পুনরায় প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে?”

“কিছু না। আর পট্টি দিতে হবে না। অনেক রাত হয়ছে ঘুমাতে যা। ”

“আপনি চুপ করে থাকুন, প্লিজ।”

আবিরের হাসি ঠোঁট থেকে সরছেই না। বরং ধীরে ধীরে প্রশস্ত হচ্ছে আবিরের ওষ্ঠদ্বয়। মনে মনে মেঘকে নিয়ে রঙিন স্বপ্নের দুনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। মেঘ এমনভাবে আবিরের যত্ন নিচ্ছে “ঠিক যেন ঘরের বউ”। আবির জ্বরের ঘোরেও মেঘের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে। আবিরের নেশাক্ত দৃষ্টি দেখে মেঘ জিজ্ঞেস করল,

” আপনি কি কিছু বলতে চাচ্ছেন?”

জ্বরের কারণে আঁটকে আঁটকে বলে,
“বলতে তো চাই”

“বলুন।”

“না থাক। কিছু না”

“বলুন।”

“বাদ দে। জলপট্টি দিতে হবে না । একটু শান্ত হয়ে বস। হাত নাড়াচাড়া করছিস পরে হাত ব্যথা করবে৷ ”

মেঘ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“আমার হাত ব্যথার চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। নিজের হাত নিয়ে ভাবুন।”

“আমার হাত ঠিক হয়ে যাবে৷ ”

মেঘ হঠাৎ ই মায়াবী দৃষ্টিতে আবিরের চোখের দিকে তাকিয়েছে। মেঘের দুচোখ ছলছল করছে। বুকে চাপা পড়া কষ্টে ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। আবিরের নজরও ঠিক মেঘের চোখ বরাবর। অষ্টাদশীর মায়াবী দৃষ্টি আবিরের বুকে ধ্রিম ধ্রিম কম্পনের কারণ। অনুভূতি লুকাতে অক্ষম, জ্বরের কারণে আবিরের হৃদয়ের ব্যকুলতা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। মেঘ আবিরের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কোমল কন্ঠে বলল,

“আপনি এমন কেন করেন? ”

আবির ক্ষীণ হেসে প্রশ্ন করে,
“কেমন করি?”

” নিজেকে এত আঘাত করেন কেন? সকালে এভাবে হাত না কাটলে তো এখন জ্বরটা উঠতো না।”

” রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না, এতে আমার কি দোষ”

“এত বড় ছেলে হয়েও রাগ কন্ট্রোল করতে পারেন না আবার আমায় জেদ কমাতে বলেন।”

“তোর জেদটা কমালেই আমার রাগ কমে যাবে।”

“কিভাবে?”

“তা তো এখন বলবো না। জ্বর তো এখন কমেছে। তুই বরং রুমে চলে যা।”

“তাড়িয়ে দিচ্ছেন কেন?”

“তাড়াচ্ছি না। শীতের রাত এমনিতেই ঠান্ডা অনেক। তারমধ্যে এত রাতে তুই আমার রুমে…”

“আজব তো।৷ এত রাতে কি আমি শুধু শুধু আপনার রুমে আসছি নাকি। ভাইয়া বলছিল বলেই আসছি৷ আর আমি না আসলে তো জানতামও না যে আপনি জ্বরে পরে আছেন। ঔষধ পর্যন্ত খান নি। ঔষধ টা খেয়েছেন বলেই জ্বরটা একটু কমেছে। তাছাড়া আমি তো নিচে গিয়েছিলাম। বড় আম্মু,আম্মু সবাই ঘুমে ছিল তাই ডাকি নি। ভাইয়াকে কল দিয়ে বলছি, ভাইয়া আসতেছে। বাসায় কেউ অসুস্থ হলে কি দেখাও যাবে না?”

“আচ্ছা বাবা সরি। আর কিছুই বলব না তোকে।”

“কিছু বলতে হবে না৷ কি খাবেন সেটা বলুন। খাবার নিয়ে আসি৷ ”

“কিছু খাব না। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা করছে, তুই শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দে তাহলেই হবে। ”

মেঘ আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, একসময় আবির ভাইয়ের চুলে হাত দেয়ার কত ইচ্ছে ছিল, কতই না বাহানা খুঁজেছে কিন্তু সাহস করে ছুঁতে পারতো না। আজ আবির ভাই নিজেই সেই অধিকার দিয়েছেন। মেঘ আবিরের মলিন চেহারায় তাকিয়ে ঈষৎ হাসলো। আবিরের চোখ বন্ধ। মেঘ এক দৃষ্টিতে আবিরের মুখের পানে চেয়ে আছে। এই শ্যামবর্ণের পুরুষ যে অষ্টাদশীর মনের রাজ্যের একমাত্র রাজকুমার। যাকে নিয়ে রোজ রাতে স্বপ্নের দেশে পারি জমায়, কল্পনায় ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। অষ্টাদশীর মনিকোঠায় একমাত্র আবির ভাইয়ের বসবাস। তখনই তানভির রুমে ঢুকে। আবির ঘুমাচ্ছে, মেঘ আবিরের মুখের পানে চেয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছিল। তানভির হুট করে রুমে প্রবেশ করে এই দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে উঠলো। রুম থেকে বেড়িয়ে যাবে নাকি ঢুকবে বুঝতে পারছে না। তানভির আস্তে করে গলা খাঁকারি দিতেই মেঘ আঁতকে উঠে। আবিরের থেকে কিছুটা দূরে সরে বসে।

তানভির কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়ার জ্বর কি কমছে?”

মেঘ ছোট করে বলল,
“অনেকটা কমেছে। ”

তানভির আবিরের কপালে আর গলায় হাত রেখে জ্বরের মাত্রা বুঝার চেষ্টা করল। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“তুই আর কিছুক্ষণ বস। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

“আচ্ছা। ”

তানভির রুম থেকে বের হতে হতে মুচকি হাসলো। সে এটায় চাইছিল। সকাল থেকে সারাদিন আবিরকে বুঝিয়ে মাথা ঠান্ডা করেছে। মিনহাজের প্রতি যতটা না ক্ষোভ তার থেকেও বেশি রাগ উঠেছিল মেঘের প্রতি। আবির যেখানে আব্বু, আম্মু, চাচা-চাচিদের সামনে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে, মেঘ সেখানে হুট করে সবার সামনে বাড়ি ছাড়ার কথা বলে ফেলছে। আবির মন-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে সম্পর্ক ঠিক করতে অন্যদিকে মেঘ কিছু মানুষের উষ্কানিতে সেটা ভাঙতে চাইছে । এজন্যই মূলত আবিরের রাগ কন্ট্রোলের বাহিরে চলে গেছে আর আব্বু চাচ্চুর সামনে যা তা বলে ফেলছে। আবির নিজেও ভেবে পাচ্ছে না আব্বু- চাচ্চু এই ঘটনাটা কিভাবে নিয়েছে বা এর পরিণাম কি হতে চলেছে। মেঘের ভুল আর অন্যায় গুলো তানভির খুব সুন্দর করে ঢাকার চেষ্টা করেছে। আবিরের মাথা ঠান্ডা করতে তানভির শেষ পর্যন্ত হুমকিও দিয়েছে,

“যদি মেঘের সঙ্গে ঠিকঠাক মতো কথা না বলে তাহলে সে নিজে মেঘকে নিয়ে হোস্টেলে দিয়ে আসবে৷ ”

একপ্রকার বাধ্য হয়েই আবির শর্ত মেনে নিয়েছে। শত রাগের পরও মেঘকে না দেখে আবির থাকতে পারবে না। গত ৭ বছর অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে৷ আর সম্ভব না। এখন কয়েক ঘন্টা মেঘকে না দেখলেই ছটফট করতে থাকে। বাসায় থাকলে কারণে অকারণে বার বার নিচে আসে যেন মেঘকে একপলক দেখতে পারে।

তানভির রুমে চলে গেছে। মেঘ খানিকটা সময় মাথা নিচু করে বসে রইলো। নির্লজ্জের মতো আবির ভাইকে দেখছিল এটা ভাইয়া দেখে ফেলছে ভেবেই লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না। আবির ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরতেই বালিশের উপর রাখা মেঘের হাত আবিরের গাল স্পর্শ করে। আবিরের গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শে মেঘের গাত্রে শিহরণ জাগে। শিরা-উপশিরায় তুফান শুরু হয়ে গেছে। হুটহাট আবির ভাইয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ মেঘের হৃদয়ে প্রেমানুভূতি জাগ্রত করে। হাত সরিয়ে মুগ্ধ আঁখিতে তাকিয়ে রইলো আবিরের অন্যপাশের গালে। আবির কখনো ক্লিন সেইভ করে না। ছোট করে কেটে রাখে দাঁড়ি৷ সপ্তাহ খানেক আগেই হয়তো কাটিয়েছিল এখন কিছুটা বড় হয়েছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সহ গালটা মেঘকে টানছে। আবির ভাইয়ের প্রতি তীব্র প্রেমানুভূতি, মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ গাল মেঘের হৃদয়ের সমস্ত প্রাচীর ভেঙে দিচ্ছে। ইহজগতে আবির ভাইয়ের গাল ব্যতীত আপাতত আর কোনোদিকে তাকাতে পারছে না। মেঘ আস্তে করে আবির কে ডাকল, কিন্তু সারা নেই। সকালের ঘটনায় শরীর থেকে অনেকটা রক্ত বেড়িয়ে গেছে। তাছাড়া কিছুদিনের দৌড়াদৌড়িতে আবিরের শরীরও বেশ দূর্বল৷ ঠিকমতো খায় না, নিজের যত্ন নেয় না, তারউপর জ্বর, সব মিলিয়ে ক্লান্তিতে বার বার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তাছাড়া প্রেয়সীর সঙ্গ পেয়ে আবিরের হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে গেছে। মেঘ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ায় আবিরের মনে হচ্ছিল, “ইহজগতে আর কিছুই প্রয়োজন নেই তার। এভাবেই তার Sparrow কে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে সে। ”

আবিরের সারা শব্দ না পেয়ে মেঘ দ্বিতীয় & তৃতীয় বার ডাকে৷ কিন্তু আবির গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। মেঘ ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে, আবিরের গালে টুক করে কিস করেই রুম থেকে ছুটে পালায়৷ বেলকনিতে যেতেই আর একটুর জন্য তানভিরের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিলো। তানভির সামনে থেকে সরে কিছুটা তপ্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
“এভাবে ছুটছিস কেন? কি হয়েছে? ”

“কিছু না” বলেই মেঘ নিজের রুমে চলে গেছে। তানভির আবিরের রুমে ঢুকতেই দেখে আবির গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। তানভিরকে ঢুকতে দেখেই আবির তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে । তানভির ঠাট্টার স্বরে বলল,

” আমি কি অসময়ে চলে আসলাম?”

আবির নিঃশব্দে হেসে লেপের নিচে মুখ লুকিয়েছে। তানভির হাসতে হাসতে বলল,

“নববধূও এত লজ্জা পাবে না তুমি যতটা লজ্জা পাচ্ছো! সমস্যা নেই। আমি কিছু বুঝি নাই। চিল”

আবির লেপের নিচ থেকে মুখ তুলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” তুই বুঝলেই বা কি! আমি কি অবৈধ কিছু করছি নাকি?”

“নাহ! একদম ই না।”

তানভির একটু থেমে সিরিয়াস মুডে বলল,
“থ্যাংকস ভাইয়া। বিশ্বাস করো, তোমাদের দুজনকে হাসিখুশি দেখলে আমার সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। সবসময় এভাবেই থেকো প্লিজ।”

“ভাইরে এভাবে থাকলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্ট হয়ে যাবে। তোর বোনের যন্ত্রণায় আমি কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।”

” তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। তারপরও কোনো অঘটন ঘটলে সমস্যা নেই। আমি সামলে নিব।”

তানভির খানিকক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় বলে,
” হাতের কি অবস্থা? ব্যথা আছে?”

“আছে। একটু কম।”

“তুমি জানো,তোমার নিজের দোষেই আজ তোমার এই অবস্থা ”

“আমি আবার কি করলাম?”

“তোমার কিছুদিনের আচরণে এমনিতেই বনুর মেজাজ বিগড়ে ছিল তারমধ্যে তুমি বিবাহিত এ কথা কেন বলতে গেছিলা? তারউপর তুমি নাকি এক বাচ্চার বাপ! এসব বলছিলা কেন? এজন্যই জিদে হোস্টেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিছিলো।”

“আমি কি করব। ঐদিন ফোন টা রেখে জাস্ট একটু রুমে গেছি আর আসছি। এরমধ্যে তোর বোন আমার ফোন চেক করে ফেলছে। মালাকে পাঠানো ম্যাসেজ দেখছে। কতটুকু পড়তে পারছে জানি না। তাছাড়া ওয়ালপেপারে যে তোর বোনের সঙ্গে ছবি দেয়া ঐ ছবিও নিশ্চয় দেখছে। কতটুকু কি দেখছে তা বুঝার জন্যই বউ আর বাচ্চার কথা বলছি। তোর বোনের রিয়েকশন দেখে বুঝছি ওয়ালপেপার টা সে ভালোভাবে খেয়াল করে নি। কিন্তু পরদিন তুই আর আমি যখন সোফায় বসে ছিলাম তখন তোর বোন সিঁড়ি থেকে আবারও আমার ফোনের ওয়ালপেপার টা দেখছে। বউ বাচ্চার ব্যাপার টা বিশ্বাস করুক আর না করুক ওয়ালপেপার দেখছে মানে ওরে আর কোনোভাবেই কিছু বিশ্বাস করাতে পারব না। তাই বাধ্য হয়ে আমার ছবি দিয়ে আরেকটা ছবি ইডিট করাইতে হয়ছে। ঐ ছবিটা ওয়ালপেপার দিয়েছি। যাতে তোর বোন ভুল না বুঝে। ভাগ্য ভালো দূর থেকে তোর বোন ওয়ালপেপার টা ঠিকঠাক মতো দেখে নি। না হয় সিউর বুঝে যেত এটা ইডিট করা ছবি। ”

তানভির হাসতে হাসতে আবিরের উপর গড়িয়ে পরছে। তানভিরের অট্ট হাসি দেখে আবিরের ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে হুঙ্কার দেয়,

“পাগলের মতো হাসছিস কেন?”

তানভিরের হাসি থামছেই না, হাসতে হাসতে কোনো মতনে বলল,
“আমার বোনকে এত ভয় পাও?”

“ভয় তো পেতেই হবে একমাত্র বউ বলে কথা। ও মানে কি না জানি না! আমি তো ও কে আমার বউ মানি। আমার মতে, পৃথিবীর ৯০% বিবাহিত পুরুষ ই তাদের বউকে ভয় পায়। পৃথিবীর বুকে রাজ করা পুরুষটাও তার বউ এর সামনে নাথিং। এর একটায় কারণ, বউয়ের প্রতি প্রবল ভালোবাসা। আর বাকি যে ১০% পুরুষ আছে তারা বউকে ভালোই বাসে না৷ পছন্দ তো একজনকে করিস ই, দেখবি রাজনৈতিক ক্ষমতা, দাপট তার সামনে কিছুই না।”

তানভিরের হাসি থেমে গেছে। সত্যিই তাই! বন্যার প্রতি যবে থেকে ইমোশন কাজ করে তবে থেকে নিজেকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে তানভির। কেন করছে সে নিজেও জানে না।

পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)

★★★★★

দু’দিন কেটে গেছে। মেঘ এই দুদিন ক্লাসে যায় নি। কারো সাথে যোগাযোগও করে নি। মিনহাজ কম করে হলেও ৫০ বার কল করেছে। সাদিয়া, মিষ্টি, তামিমও কল করেছে কিন্তু মেঘ কারো ফোন ধরে নি। রাগ তার নিজের প্রতিই, ওদের উস্কানিতে নিজের গলে যাওয়া একদম ই উচিত হয় নি। আজ ভার্সিটিতে আসছে। অনেকদিন পর বন্যাও আজ ক্লাসে আসছে। বন্যাকে দেখেই মেঘ জড়িয়ে ধরেছে। ক্লাস শেষ হতেই সকলে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে।

মিনহাজ – কিরে, এতগুলো কল দিলাম ধরিস নি কেন?

মিষ্টি – তোকে কতগুলো কল, মেসেজ দিলাম কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেছিলি।

মেঘ- কোথাও না৷
বন্যা- কিরে কি হয়ছে? কোনো সমস্যা?
মেঘ- আমার জীবনটায় সমস্যায় ভরপুর।
বন্যা – হয়ছে কি বল তো

মেঘ- আমি ভাবছিলাম হোস্টেলে সিট নিব। ওরা সবাই বলতেছিল হোস্টেলে আসলে ভালো হবে। তাই ফরম নিয়ে গেছিলাম। ফরম পূরণ করে পরদিন আব্বু আর বড় আব্বুকে বলেছি, ওনারা কিছু বলার আগেই আবির ভাই ফরম ছিঁড়ে, চিল্লাচিল্লি শুরু করছেন, এমনকি আমার পা ভাঙার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। বড় আব্বু আবির ভাইকে ধমক দিয়েছে। ঐ রাগে রুমে গিয়ে ড্রেসিং টেবিল ভেঙে হাত কেটে একাকার অবস্থা করে ফেলছে। ৩ দিন ধরে হাত ব্যথা আর জ্বরে ভুগতেছে। আজ দেখছি এ অবস্থাতেই অফিসে যাচ্ছে।

মিষ্টি, সাদিয়া, মিনহাজ, তামিম, বন্যা সকলেই পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। বন্যা আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

” তোর বইন বিরাট সাহস হয়ছে। তুই জানিস ছোট থেকে তোরে কিভাবে বড় করছে। প্রয়োজন ছাড়া এক পা এদিক সেদিক যেতে পারিস নি। তুই ভাবলি কিভাবে যে তোকে হোস্টেলে আসার অনুমতি দিবে। আর তুই অনুমতি চাইতেই বা গেলি কোন সাহসে? তোরে মে*রে আধমরা করে নি সেই কপাল। তুই আমায় একটাবার কল দিতি৷ আমি ডিরেক্ট নিষেধ করতাম তোকে। ”

মেঘ – আমি কিভাবে জানবো এমন কিছু হবে। আবির ভাইয়ের উপর রাগ করেই তো চলে আসতে চাইছিলাম।

মিষ্টি রাগান্বিত কন্ঠে বলা শুরু করল,
“তুই হোস্টেলে আসলে এই ব্যাটার কি সমস্যা? ব্যাটা বিয়ে করতে পারে, বাচ্চা থাকতে পারে আর তুই সামান্য হোস্টেলে আসবি এতেই এত হাঙ্গামা। আসলে পুরুষ জাত টায় খা*রাপ। আমি তোর জায়গায় থাকলে না বলেই চলে আসলাম।”

মিনহাজ- দেখ মিষ্টি সব ছেলে কিন্তু খারাপ হয় না। দেখিস না আমি কত নিষ্পাপ !

তামিম- আমিও৷

বন্যা- কি বলছিস তুই এসব? আবির ভাই বিবাহিত? বাচ্চা আছে? এসব কি শুনছি মেঘ?

মেঘ- ওনি সেদিন বলছিলেন ওনি বিবাহিত, বাচ্চা আছে৷ তারপর জানছি আমার সাথে ফাজলামো করছে।

মিষ্টি – আজকে ফাজলামো করে বলতেছে, দুদিন পর দেখবি সত্যি সত্যি বউ নিয়া বাসায় চলে আসছে। পরে চিল্লাবি না বলে রাখলাম।

সাদিয়া – এই মিষ্টি চুপ করবি৷ তোর ব্রেকআপ হয়ছে বলে কি তুই সারা দুনিয়ার মানুষের ব্রেকাপ করিয়ে বেড়াবি নাকি?

মিষ্টি- আমি চাই না আমার ফ্রেন্ডরা কেউ ফালতু ছেলের জন্য নিজের জীবন বরবাদ করুক।

মেঘ- আবির ভাই মোটেই ফালতু ছেলে না। বাদ দে। আমার আবির ভাইকে নিয়ে তোরা কেউ কিছু বলবি না। আমার আবির ভাই ভালো হলেও আমার, খারাপ হলেও আমার। হইছে?

মিষ্টি – ব্যাটা বিয়ে করে ফেলছে শুনে সেদিন তুই ই কান্নাকাটি শুরু করছিলি। মনে নাই? এখন আমাদের দোষ?

বন্যা- ও দিনে ১০০ বার আবির ভাইয়ের জন্য কান্না করে, ১০০ বার হাসে। তাই বলে তোরা ওকে আরও উস্কাবি? আমি দুদিনের জন্য বেড়াতে গেছি কি না, আমার বেবিটার ব্রেইন ওয়াশ করা শুরু করে দিছিস!

মিনহাজ- আমরা তো চাই তোর বেবিটা হাসিখুশিতে থাকুক৷ তোর বেবির খেয়াল রাখার দায়িত্ব তো আমাদের ও৷

বন্যা- দেখলাম তো কেমন খেয়াল রাখছিস৷ ফাঁসাইয়া দিয়া নিজেরা তো বিরাট শান্তিতে আছিস। যা ঝড় গেছে তো আমার বেবিটার উপর দিয়ে গেছে।।

মেঘ- আবির ভাই বলছে, যারা আমাকে উস্কাইছে তাদের সবকটাকে আধমরা করে নিজের বাড়ি পাঠাবে।

বন্যা- একদম ঠিক আছে। এদের মা*রা ই উচিত।

তামিম- বন্যা, তুই এভাবে বলতে পারলি?
বন্যা- তুই আমার সঙ্গে কথায় বলিস না। বদমাশ পোলা।

মিনহাজ- মনে হয় তোর আবির ভাইয়ের থ্রেটে আমরা ভয় পাইছি। বলিস আসতে, দেখব নে তোর ভাইয়ের কত পাওয়ার আর আমার ভাই ব্রাদার্সদের কত পাওয়ার।

বন্যা হাসতে হাসতে বলল,
“এই গর্জন টা আবির ভাইয়া বা তানভির ভাইয়ার মুখোমুখি হওয়ার পর যেন থাকে। চল মেঘ”

মেঘকে নিয়ে বন্যা চলে গেছে। মেঘ বন্যাকে সব ঘটনা খুলে বলেছে৷ বন্যা শুধু একটা কথায় বার বার বলছে,

“তুই আমাকে একটা বার জানাতে পারতি। তুই জানিস, তুই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের কলিজার টুকরা তারপরও এমন কান্ড কেন ঘটালি। আবির ভাই না চিল্লালে তোর ভাই, আব্বু বা বড় আব্বু নিশ্চয় রাগ দেখাতো। ”

মেঘ নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত। বন্যাও আর বেশি কিছু বলে নি। মেঘকে বিদায় দিয়ে নিজেও বাসায় চলে গেছে।

এদিকে আবির আজ সকাল সকাল অফিসে আসছে। হাত এখনও পুরোপুরি ঠিক হয় নি। কিন্তু একটা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আজ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। গত তিনবছরের অর্ডারের সমতূল্য এই একটা অর্ডার৷ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আবির দের কোম্পানি দেশের সেরা পাঁচটা কোম্পানির মধ্যে একটা হবে। তাই হাতের দূরাবস্থা নিয়েও আবির অফিসে আসছে। টানা দেড় ঘন্টা মিটিং চলল আবির নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। মিটিং শেষে ওনারা ডিল কনফার্ম না করেই চলে গেছেন৷ বলেছে পরবর্তীতে কল দিয়ে জানাবে। তাই সকলেই একটু টেনশনে আছে। আবির আব্বুর থেকে বিদায় নিতে গেলে আলী আহমদ খান আবিরকে ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,

” শুনো আবির, নিজের রাগ যদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারো। তবে জীবনে সফল হতে পারবে না।”

আবির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে খুব ভালোভাবেই জানে, ঐদিনের বাড়িত ঘটনার ক্ষোভ প্রকাশ করবেন আলী আহমদ খান। চুপচাপ সহ্য করা ছাড়া কিছুই করার নেই তার।আলী আহমদ খান পুনরায় বললেন,

“বাহিরে যায় করো না কেন, বাসায় অন্ততপক্ষে ঠান্ডা থাকার চেষ্টা করবা। ভুলে যেয়ো না তুমি বাড়ির বড় ছেলে৷ তোমার উপর বাকিরা নির্ভর। তানভির মতো মেঘ, মীম, আদি তিনজনকে আগলে রাখার দায়িত্বও তোমার। কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চেচামেচি করলে, রাগ দেখালে তোমার উপর থেকে তাদের ভরসা উঠে যাবে। তোমার তাদের সাথে সফ্টলি মিশতে হবে৷ যাতে ওরা ভুল পথে পা বাড়ালেও তোমাকে তা জানাতে দ্বিধাবোধ না করে। তারপর তুমি বিষয়টা দেখবে, ঠিক মনে হলে ঠিক আর ভুল মনে হলে ভাই বোনদের বুঝিয়ে সেটা থেকে সরিয়ে আনবে৷ কিন্তু চিৎকার করে, রাগ দেখিয়ে ওদের সাথে কখনও দূরত্ব বাড়িয়ো না। আমি যে ভুল করেছি আমি চাই না একই ভুল তুমিও করো। আমার পরে খান বাড়িত পুরো দায়িত্ব তোমার। তাই তোমাকে যেমন শক্ত তেমন কোমল হতে হবে। আশা করি বুঝতে পেরেছো। এখন যেতে পারো।। ”

“জ্বি আচ্ছা” বলে আবির অফিস থেকে বেড়িয়ে পরেছে। হাতের দূরাবস্থার জন্য বাইক নিতে পারে নি। রিক্সা করে নিজের অফিস হয়ে বাসায় আসছে।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান হাতে মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ইকবাল খান সিলেটে আছেন। বাড়িতে ঢুকেই সবাইকে ডাক শুরু করলেন।মেঘ, মীম,আদি, তানভির, আবির সহ সকলেই নিচে আসছে।

আলী আহমদ খান হাস্যোজ্জল মুখে বললেন,
“Congratulation My Boy. Order Confirmed. I am proud of you.”

আবিরও হাসিমুখে “Thank you ” জানালো।

সকলেই বেশ খুশি। সবাইকে মিষ্টি দেয়া হলো। আলী আহমদ খান নিজে আবিরকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়েছেন। সবশেষে আলী আহমদ খান আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“আজকের এই খুশির কারণ একমাত্র তুমি। এত অল্প সময়ের মধ্যে তুমি কাজে এত মনোযোগী হয়েছো তারজন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এটা তোমার জন্য অনেক বড় সফলতা । জীবনের সর্বোচ্চ সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে যাও।”

আবির মৃদু হেসে বলল,
“দোয়া করবেন আমার জন্য। ”

মোজাম্মেল খান বললেন,
“ফি আমানিল্লাহ। দোয়া করি যেন সবসময় সবজায়গায় তুমি সফল হতে পারো।”

আলী আহমদ খান শুধালেন,
“আজকের এই খুশির দিনে, তোমার কি চাই বলো। যা চাইবে তাই পাবে।”

আবির ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করল, খানিকক্ষণ নিরব থেকে বললো,
“আমার এখন কিচ্ছু চাই না,তবে একদিন চাইবো। এমন কিছু চাইবো যা দেয়ার জন্য আপনাদের এতবছরের নিয়ম-নীতি পর্যন্ত ভাঙতে হতে পারে। আশা করবো সেদিনের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকবেন।”

কথা শেষ করেই আবির নিজের রুমে চলে গেছে। মেঘ আহাম্মকের মতো চেয়ে আছে। আবির ভাইয়ের কথা কিছুই মাথায় ঢুকে নি। কেউ কিছু দিতে চাইছে, নিয়ে নিলেই তো ঝামেলা শেষ। প্যাঁচ লাগাতে হয় কেন৷ মেঘ এটায় ভেবে পায় না। আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খানও মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। আবিরের মা, মেঘের মা আর মীমের মাও নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছেন।

মীম মেঘকে প্রশ্ন করল,
“আপু তোমায় যদি বলতো, যা চাও তাই পাবা। তাহলে তুমি কি চাইতা?”

মেঘ মনে মনে বলল,
“আবির ভাইকে চাইতাম। আবির ভাইয়ের সম্পূর্ণ হৃদয় জুড়ে আমার অস্তিত্ব চাইতাম। আমি আবির ভাইয়ের পৃথিবী হতে চাইতাম”

মীম পুনরায় ডাকে,
“আপু বলো না, কি চাইতা?”

“জানি না”

বলে মেঘ নিজের রুমে চলে যাচ্ছে। মীম তারপরও মেঘের পিছন পিছন ছুটছে। তানভির এতক্ষণ যাবৎ নিরব ভূমিকা পালন করছিল৷ চলে যাবে কি না সেটাও বুঝতে পারছে না। মেঘ – মীম চলে যাওয়ায় নজর পরে তানভিরের দিকে। মোজাম্মেল খান স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
” তোমার ভাইয়ের এখন কিছু লাগবে না বলে গেল। তোমার কি কিছু লাগবে?”

তানভির এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে না করল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,

” বউ লাগবে। দিবেন এনে? ভাইয়ারও বউ ই লাগবে ”

পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)

★★★★★

দু-তিনদিন পর বিকেলে আবির তানভির কেউ বাসায় নেই। মেঘ আর মীম টিভি দেখতেছিল। মালিহা খান আর আকলিমা খান রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছিলেন। তখনই জান্নাত বাসায় আসে। গেইট থেকে বলে,

“ভেতরে আসতে পারি?”

মেঘ,মীম সহ রান্নাঘরে থাকা দুই কর্তীর নজর পরে মেইন গেইটের দিকে। মেঘ জান্নাত আপুকে দেখে আশ্চর্য নয়নে তাকায়। তৎক্ষনাৎ সোফার উপর দিয়ে লাফিয়ে ছুটে গিয়ে জান্নাতকে জড়িয়ে ধরে। জান্নাতও মেঘকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো। তুমি কেমন আছো ভাবি?”

জান্নাত হাসিমুখে উত্তর দেয়,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। এখানে ভাবি বলো না, যে কেউ শুনে ফেলবে।। ”

মেঘ আস্তে করে শুধায়,
“ফুপ্পি কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ। ”

মালিহা খান রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বললেন,

“আরে জান্নাত যে। এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল?”

“এদিকে কাজ নেই তাই তেমন আসা হয় না। আজ একটু কাজ ছিল এজন্য ভাবলাম আপনাদের সাথে দেখা করে যায়। ”

“খুব ভালো করেছো। ভিতরে আসো। এই মেঘ ভিতরে নিয়ে যা। এখানেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিস ”

জান্নাত সোফায় বসলো। জান্নাতকে দেখে মীম টিভি বন্ধ করে রান্না ঘরে চলে গেছে। মেঘ জান্নাতের পাশে বসে ফিসফিস করে সব প্রশ্ন করছে,
আসিফ ভাইয়া কবে আসবে, কেমন আছে, বাকিরা কেমন আছে থেকে শুরু করে এটা সেটা জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে৷ জান্নাত আস্তেধীরে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

মেঘ হঠাৎ ই প্রশ্ন করল,
“আপু তুমি যে বিবাহিত এটা বলবা না?”

“না”
“কেনো?”
” আবির ভাইয়া বারণ করেছেন। ”
“আবির ভাই জানে তুমি বাসায় আসবে?”

“আবির ভাইয়া ই আমায় পাঠিয়েছেন। ওনি আর তানভির এখন আমার শ্বশুর বাড়িতে। ”

“ওনারা হঠাৎ ফুপ্পির বাসায় কেন?”

“ওনারা প্রতি সপ্তাহেই আমার শাশুড়িকে দেখতে যায়। ”

মেঘ উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
“কিহ? আমায় একদিনও নিয়ে যায় না কেন?”

“আমরা সবাই ই তোমার কথা বলি৷ তোমাকে নেয় না বলে আম্মু প্রতিবার আবির ভাইয়াকে রীতিমতো ধমকায়।”

“দেখেছো তারপরও আমায় নিয়ে যান না। আজকে আসুক বাড়িতে। ”

এরমধ্যে মালিহা খান নাস্তা নিয়ে আসছেন। পাশের সোফায় বসে জান্নাত কে ভালোভাবে পরখ করছেন। ওনার সেই অনেকদিনের ইচ্ছে জান্নাতকে ছেলের বউ বানাবেন৷ আলী আহমদ খানকে বলেওছেন। ওনি তেমন সারাশব্দ করছেন না৷ ওনি আবিরকে একটু সময় দিতে চাচ্ছেন ব্যবসায় ঠিকমতো মনোযোগ দিলেই বিয়ে করাবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জান্নাতের নাস্তা খাওয়ার এক ফাঁকে আলী আহমদ খান বাসায় ঢুকলেন। জান্নাতের সাথে টুকিটাকি কথা বলে নিজের রুমে চলে গেছেন৷ জান্নাতও খানিকক্ষণ বসে মেঘের রুমে ঘুরে আড্ডা দিয়ে বেড়িয়ে গেছে।

আবির আর তানভির রাতে খেয়ে বাসায় ফিরেছে। ফুপ্পির বাসায় গেলে কখনও না খাইয়ে ছাড়েন না৷ আবির ফেরার কিছুক্ষণ পরেই মেঘ আবিরের রুমে হাজির হলো। আবির ভ্রু জোড়া নাচিয়ে প্রশ্ন করল,
“কিছু বলবি?”

মেঘ কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ ফেলে বলল,
“আমার ভাগ কোথায়?”

আবির স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কিসের ভাগ?”

“ভালোবাসার”

আবির ঢোক গিলে ছোট করে বলল,
“মানে”

“ফুপ্পির ভালোবাসার ভাগ দেন ”

“কাছে আয় দিচ্ছি ”

মেঘ দু কদম এগিয়ে গেল,
আবির হাত বাড়িতে মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

“ফুপ্পির হাতে আমি শুধু গাট্টায় খাই৷ তার ভাগই দিলাম। আর খাবারের ভাগ চাইলে এরপর থেকে নিয়ে আসব। ”

(চলবে)

[নেক্সট পর্ব সবার আগে পেতে চাইলে পেইজটি ফলো করুন]🌸🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here