#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১০
শুভ্র স্পষ্ট টের পেলো যে হাতের মুঠোয় রাখা তানির হাত টা অনবরত কাঁপছে। মুচকি হেসে হাত টা’কে শক্ত করে ধরে রাখলো। এমন ভাব করলো যেন হাত ধরে রাখার ব্যাপার টা ওর মাথাতেই নেই। শুভ্র এর পরের অংশটুকু দেখতে চায়। তানি ঠিক কীভাবে ওকে হাত ছেড়ে দেয়ার কথা বলে!
তানির শরীরের কাঁপন বাড়ছে। চোখের কোনে পানি ও জমতে শুরু করেছে। সে একই স্পর্শ। কতো বছর পর! কিছু সময় বাদে তানি খেয়াল করলো শুভ্র হাত ধরে রেখেই কথা চালিয়ে যাচ্ছে। হাত ছাড়ার কথা হয়তো মনে নেই। তানি আকাশের দিকে তাকালো, মনে মনে বলল, হে আল্লাহ রিকশায় যতক্ষণ আছে ততক্ষণ যেন এমন ভাবেই হাত টা ধরে রাখে। প্লিজ প্লিজ।
শুভ্র খেয়াল করলো তানির কাঁপাকাঁপি কমেছে। স্বাভাবিক ভাবেই কথার জবাব দিচ্ছে। তবুও আরেকটু শয়তানি করতে ইচ্ছে করলো। শয়তানি করে হাত টা ধরেই রাখলো। আগের মতো ই এমন ভাব করলো যেন মাথায় ই নেই তানির হাত ধরে আছে।
রিকশা থেকে নামার সময় শুভ্র অবাক গলায় বলল, একি আমি তোমার হাত ধরেছিলাম এতক্ষন? ইশ আমার তো খেয়াল ই ছিলো না!
তানি মাথানিচু করে ফেলল। মাথা নিচু করায় দেখতে পেল না যে শুভ্র মিটিমিটি হাসছিলো।
শুভ্র তানিকে নিয়ে এসেছে রবিন্দ্রো সরোবরে। রিকশা জিগাতলা পর্যন্ত এসেছে। বাকী পথ দুজন মিলে হেটে যাবে বলে রিকশা ছেড়ে দিয়েছে।
লেকের পাশ ঘেঁষে দুজন হাটছে। তখন শেষ বিকেল। কন্যা কুমারী আলোয় দুজন ব্যস্ত শহরের রাস্তায় হাটছে আর গল্প করছে। শুভ্র গল্প বলছে আর তানি মুগ্ধ হয়ে শুনছে। এতো ভালো কেন লাগে সেটা ও জানেনা। শুধু জানে এই মানুষ টা পাশে থাকলে, কথা বললে, এমনকি কথা না বলে যদি ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে থাকে তাহলেও ওর খুব ভালো লাগে। এতো টা ভালো লাগে যে সময় জ্ঞান ও ভুলে যায়।
বিকেলে দুজন মিলে অনেক ঘুরলো, ফুচকা খেলো। ফুচকা খেয়ে নাক, মুখ লাল করে শীতের মধ্যে আইসক্রিম ও খেল। সন্ধ্যারও অনেক পরে দুজনে আবারও রিকশায় উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তানি এবার আর এক কোনে বসে নি। শুভ্র’র গায়ের সাথে গা মিশিয়ে বসেছে। রিকশায় যেতে যেতে তানি ভেবে রাখলো আজকের দিন টা ও ডায়েরিতে লিখে রাখবে। প্রতিবছর এই দিন টা’কে স্মরণীয় দিন হিসেবে পালন করবে। জীবন খুব ছোট কিন্তু প্রাপ্তি, আনন্দগুলো খুব দামী। আজকের দিন টা তানি সবসময় মনে রাখবে। নাতি নাতনিদের কাছে গল্প করবে। গালে পান গুজে হাতের আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে জিবে দিতে দিতে বলবে, তোদের নানুভাই’র সাথে আজকের দিনে ডেটে গেছিলাম। তানির নাতি বা নাতনি তখন বলবে, বিয়ের এতো দিন পর ডেট! কী ব্যকডেটেড ছিলে তোমরা!
তানি তখন পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে বলবে, এইসব তোমরা বুঝবা না। পাশাপাশি রিকশায় বসা, হাত ধরা, এইসব অনুভূতি ব্যকডেটেড না হইলে পাওয়া যায় না।
ঢাকা শহরের অসহ্য যানজটে শুভ্র যখন বিরক্ত হয়ে বসেছিল তখন ই টের পেল তানি কাঁদছে। শুভ্র ভরকে গেল। জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে তানি?
তানি জবাব দিলো না। কান্নাভেজা চোখেই শুভ্র’র দিকে তাকালো। এই প্রথম এতো কাছাকাছি এসে দুজনের চোখে চোখ রাখা! শুভ্র কেবল তাকিয়েই রইলো গভীর চোখ দু’টির দিকে। কী সুন্দর চোখ! কাজল টা লেপ্টে গেছে বলেই বোধহয় এতো সুন্দর লাগছে। শুভ্র মনে মনে বলল, যদি কোনোদিন তোমার সাথে প্রেম হয় তবে যখনই কাজল চোখে দিবে ইচ্ছে করেই একটুখানি কাঁদাবো। তুমি কষ্ট পেলেও অনেকখানি স্বার্থপর হয়ে দু’চোখের তৃষ্ণা মেটাবো।
রাতের শহর, ঝমকালো আলো, মৃদুমন্দ বাতাস আর বড় বড় বিলবোর্ডগুলো এই সময়টুকুর সাক্ষী হয়ে রইলো। ভালোলাগা আর মুগ্ধতার সময়টুকু।
********
“আচ্ছা আমাদের বিয়ে টা কবে হবে?”
অভ্র চা’য়ে চুমুক দিলো। সন্ধ্যাবেলা পাড়ার মোড়ের এলাচি চা না খেলে অভ্র’র রাতে ঘুম হয় না। প্রায় প্রতিদিন ই ইরা কে নিয়ে হাটতে হাটতে এই চা খায়। ওয়ান টাইম কাপে চা নিয়ে দুজন হাটে আর একটু একটু করে চুমুক দেয়।
অভ্র বলল, বুঝতে পারছি না।
ইরা গলা চড়িয়ে বলল, বুঝতে পারছি না মানে?
“আরে পাবলিক প্লেসে এতো জোরে কেউ কথা বলে?”
“ইরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, হোয়াট ডু ইউ মিন? বুঝতে পারছি না মানে কী?
অভ্র ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার মা তো আমাকে একদম পছন্দ ই করে না?
ইরা একটু নরম হলো। বলল, তো? বিয়ে তো মা করবে না, আমি করব।
অভ্র দাঁত বের করে বলল, তোমাকে বিয়ে করতে তো আমার কোনো আপত্তি নেই । চাইলে এক্ষুনি বিয়ে করতে পারি।
“আচ্ছা! সত্যি? ”
“তিন হাজার সত্যি। ”
ইরা একটু ভেবে বলল, আজ তো কাজী অফিস খোলা পাবো না। আমরা তাহলে কাল বিয়ে করি।
অভ্র চুপসে গেল। মিনমিনে গলায় বলল, এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? না মানে এইভাবে বিয়ে! তুমি শাড়ি পরবে, হাতে মেহেদী দিয়ে আমার নাম লিখবে, কবুল বলার সময় অল্প অল্প লজ্জা পাবে, সেসব কিছুই হবে না?
ইরা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। হাসি থামিয়ে বলল, তোমার মুখ টা দেখার মতো হয়েছিল।
অভ্রও হাসলো।
ইরা সিরিয়াস হয়ে বলল, সত্যি বলছি আমার এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে, তাছাড়া চাকরি করার প্যারা নেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি তো বিয়ে করব, সংসার করব, অনেক গুলো বাবুর মা হব।
অভ্র শুকনো কাশি দিয়ে বলল, কয়টা বাবুর মা হবা?
“মিনিমাম চারটা।”
অভ্র এবার জোরে জোরে কাশতে শুরু করলো। বলল, মাত্র?
“শোনো, এটাই আমার ড্রিম। ঘরভর্তি পিলপিল করে বাচ্চা হাটবে দেখতে কতো ভালো লাগবে!
“চারটা বাচ্চা কী আর পিলপিল করবে?”
“কেন? তানি ভাবী আছে না! আমাদের দুজনের কম করে হলেও আটটা বাচ্চা থাকবে”
অভ্র কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, জনসংখ্যা উর্ধ্বগতির জন্য আমরা জেলে গেলেই তো হয়! বেচারা ভাইয়া ভাবীকে নেয়ার কী দরকার?”
“তুমি কিন্তু আমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছো না। প্লিজ তাড়াতাড়ি বিয়ে করো। যে চাকরি করছ তাতেই আমাদের চলে যাবে”।
অভ্র হেসে বলল, আচ্ছা আমি শিগগিরই ভাইয়াকে বলব।
ফিরতি পথে অভ্র ইরাকে বলল, এই জানো আজ ভাইয়া আর ভাবী ডেটে গেছে। ফার্স্ট ডেট।
ইরা লাফিয়ে উঠে বলল, ওয়াও! কী রোমান্টিক!
“হ্যাঁ ওদের এভাবেই একটু একটু করে প্রেম টা হয়ে যাক”।
ইরা বলল, তানি ভাবীকে আমার খুব খুব খুব পছন্দ হইছে। শুভ্র ভাইয়ার সাথে ভাবী ই পারফেক্ট। আগের ওই ডাইনিটা’কে দেখলেই মনে হতো মানুষখেকো রাক্ষসী। আস্ত খবিশ।
অভ্র হাসলো। ইরা মন খারাপ করে বলল, ইশ কেন যে তোমার সাথে প্রেম করতে গেলাম! নাহলে আমাদেরও বিয়ের পর একটা মিষ্টি প্রেম হতো।
“তাহলে চলো ব্রেক আপ করে ফেলি”
ইরা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, কবুল না বলে কোনো ব্রেক আপ হবে না হুহ!
ইরা গেট থেকে যখন ঢুকবে তখন অভ্র ইরাকে ডাকলো। হাতে একটা বক্স দিয়ে বলল, এটা তোমার।
ইরা কৌতূহল নিয়ে বক্স টা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, কী আছে এতে?
অভ্র কিছু বলল না। ইরা বক্স খুলে একটা আর্তচিৎকার করলো। অভ্র বলল, এই আস্তে আস্তে লোকে শুনলে আমায় ধোলাই দেবে।
ইরার খুশী খুশী গলায় বলল, এই জানো আমার না তোমাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
“নেক্সট টাইম দেখা হলে যেন মনে থাকে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করব”।
“হু হু।”
“এবার যাও”
“এই শোনো, তুমি চোখ বন্ধ করে একটু কল্পনা করে নিও যে আমি তোমায় জড়িয়ে ধরেছি কেমন!
অভ্র হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা।
চলবে…..
সাবিকুন নাহার নিপা