#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৫
হানিমুন ট্রিপের কথা শুনে শুভ্র’র কোনো ভাবান্তর হলো না। ব্রেকফাস্টের টেবিলে যখন অভ্র বলল, তখন নির্লিপ্ত গলায় বলল, ও তোরা এই করেছিস লুকিয়ে লুকিয়ে।
অভ্র বোকার মতো হেসে বলল, হ্যাঁ সারপ্রাইজ কেমন দিলাম বস!
শুভ্র পরোটা আর ডিম মুখে পুরে বলল, তা কোথায় যাচ্ছি আমরা?
আনিকা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, কক্সবাজার। কী ভালো একটা রিসোর্ট বুক করা হয়েছে তোমাদের জন্য।
সবার উৎসাহে একরাশ পানি ঢেলে দিয়ে শুভ্র বলল, কক্সবাজার! ইয়াক! ধূলোর শহর ছেড়ে যাব বালির শহরে! কেন আমরা কী হানিমুনে গিয়ে বালি মাখামাখি করে শুয়ে থাকব নাকি?
অভ্র’র মুখ টা ছোট হয়ে গেল। তানি এতক্ষণ চুপচাপ মাথানিচু করে খাচ্ছিলো। বিস্মিত চোখে শুভ্র’র দিকে তাকালো। মাহফুজা রান্নাঘরে রান্না করছিলো। ঠিক তখনই আনিকা চিৎকার করে বলল, ভাইয়ায়ায়া তুমি একটা আস্ত খবিশ।
শুভ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, আমি আরও ভেবেছিলাম অফ টাইমে ভালো কোথাও একমাত্র বউটা’কে নিয়ে ঘুরতে যাব। তোরা’ই তো সব পন্ড করে দিলি।
অভ্র কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, অকৃতজ্ঞ, বেইমান।
তানি অবাক গলায় বলল, আপনি এমন কেন! ভাইয়া, আনিকা আর ইরা কতো কষ্ট করে প্ল্যান করলো। ”
শুভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, আচ্ছা তানি বলোতো, তুমি আসলে কোন দলের? বরের হয়ে তো কখনো একটা কথাও বলো না। সবসময় দেখি বজ্জাত দেবর, ননদের ন্যাওটা হয়ে থাকো। অথচ তুমি যখন রেগে গিয়ে টমেটো হয়ে যাও তখন আমিই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করি।
তানি লজ্জায় মাথানিচু করে ফেলল। কী অসভ্য লোক! কোনো রাখডাক নেই। যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছে। ছোট ভাই বোনেরা সামনে সে খেয়াল নেই।
অভ্র বলল, ঠিক আছে আমরা তাহলে সব ক্যান্সেল করে দেই। কী বলিস আনু?
আনিকা বলল, হ্যাঁ ঠিক ই বলেছ।
তানি রুক্ষ গলায় বলল, কেন? উনি না গেলে আমি একা যাব। প্রয়োজনে তোমরা আমার সাথে যাবে।
শুভ্র মিনমিনে গলায় বলল, আরে তোমরা সবাই মিলে এতো হাইপার কেন হচ্ছো? আমি তো যাব না বলি নি।
অভ্র বলল, না না। বালির শহরে তোমাকে আর বালি মাখাতে পাঠাচ্ছি না।
শুভ্র হাসতে হাসতে বলল, আরে আমি তো মজা করছিলাম। কেন এতো সিরিয়াস হচ্ছিস তোরা? তাছাড়া তানি কী একা একা হানিমুন করবে নাকি? বর ছাড়া কী আর হানিমুন হয়?
তানি রেগে গিয়ে বলল, আপনি চূড়ান্ত অসভ্য এক লোক।
শুভ্র হেসে বলল, আরে বউয়ের সাথে অসভ্যতা করা ফরজ।
আনিকা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ভাইয়া আমি কিন্তু এখনো ছোট।
শুভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, ওমা তাই? আগে তো জানতাম না। আমি তো জানতাম যে লিপস্টিক, নেইলপলিস ঠিকঠাক লাগাতে পারে তাকে বিয়ে দেয়া যায়। তাহলে তুই ছোট কিসের!
মাহফুজা রান্নাঘরে বসে টের পেলেন ডাইনিং টেবিলে রীতিমতো মাছের বাজার বসে গেছে। বুঝলেন যে তার ছেলে মেয়েরা আবারও ঝগড়া শুরু করেছে। কাজ সেড়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তোরা খাওয়া বাদ দিয়ে এমন ঝগড়া কেন করছিস?
অভ্র আর আনিকা শুভ্র’র বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করলো। সব শুনে মাহফুজা শুভ্র’কে বলল, তোর এসব ধানাইপানাই কিন্তু চলছে না, ক’টা দিন তানিকে নিয়ে ঘুরে আয়। মেয়েটা সারাদিন একা একা থাকে।
শুভ্র ভ্রু উঁচিয়ে বলল, আচ্ছা! আমাকে তাহলে তোমার পুত্রবধূর বডিগার্ড হয়ে যেতে হবে?
মাহফুজা হেসে বলল, হ্যাঁ হবে।
“ওহ আচ্ছা! আমি এখন পর তাই তো?”
অভ্র বলল, হ্যাঁ। তাছাড়া আমাদের ভাবীকে আমরা তো আর একা পাঠাতে পারি না, তাই তোমাকে পাঠাচ্ছি পাহারাদার হিসেবে।
শুভ্র দুঃখী হবার ভান করে বলল, আগে জানতাম মেয়েরা বিয়ের পর বাপ, মায়ের কাছে পর হয়ে যায়। এখন দেখলাম ঘরে বউ এলে ছেলেরাও মা, ভাই, বোনের কাছে পর হয়।
শুভ্র’র কথার ধরন শুনে সবাই ই হাসলো। শুধু তানি হাসলো না। গম্ভীর হয়ে রইলো।
******
তানি ঘরে ফিরে গোছগাছ শুরু করলো। ট্রলিতে কেবল নিজের কাপড়, চোপর ই নিচ্ছে। শুভ্র ঘরে ঢুকে সেটা দেখতে পেয়ে বলল, কী স্বার্থপর তুমি? নিজের জামাকাপড় গোছাচ্ছো, আর আমি কী বানের জলে ভেসে এসেছি! আমি পাহারাদার, ভুলে যেও না।
তানি পিছনে ফিরে কোমড়ে হাত দিয়ে বলল, আপনি এতো অসভ্য অসভ্য কথা বলছিলেন কেন?
শুভ্র আকাশ থেকে পড়লো যেন। বলল, যাহ বাবা! বউয়ের সাথে অসভ্যতা করব না তো কার সাথে করব?
“ছিঃ! শেইমলেস কোথাকার।”
শুভ্র জামা, প্যান্ট ভাজ করতে করতে নির্লিপ্ত গলায় বলল, আমি দুটো পঁচা কথা বলে অসভ্য হয়ে গেলাম! আর কেউ কেউ যে রাতে আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে জড়িয়ে ধরে সেটাকে কী বলা যায়!
তানির চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। শুভ্র তার মানে জেনে গেছে কাল রাতের ব্যাপার টা!
তানি শুকনো ঢোক গিলে বলল, মানে?
শুভ্র বলল, মানে হলো কিছু কিছু ভদ্রমহিলা আছে যারা স্বামী ঘুমিয়ে গেলে তার চুল হাতাহাতি করে, হাতের আঙুলের ভাজে আঙুল রাখে। একটু কায়দা করে জড়িয়ে ধরে। আর বেচারা স্বামী ভালো ছেলের মতো ঘুমিয়ে থাকে।
তানি রাগে ফুসতে ফুসতে বলল, হুহ! ভালো ছেলে। কতো ভালো জানা হয়ে গেছে।
“কী কী জানলে?”
তানি রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলে শুভ্র শব্দ করে হেসে ফেলল।
*******
সন্ধ্যেবেলা তানি আর শুভ্র’কে স্টেশনে এগিয়ে দিতে অভ্র আর ইরাও এলো। ইরা তানিকে নিয়ে একটু সামনে সামনে হাটছিলো আর শুভ্র, অভ্র পিছনে হাটছিলো।
অভ্র গলা খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া একটা সত্যি কথা বলবে?
শুভ্র স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বলল, না বলব না। কারণ আমি সবসময় মিথ্যা বলে অভ্যস্ত।
“ভাইয়া সিরিয়াস কথা বলছি কিন্তু “।
“তাহলে ঢং না করে তাড়াতাড়ি বল। দিন দিন এতো ঢঙ্গী হচ্ছিস কেন? মেয়েদের সাথে থাকতে থাকতে বুঝি?
“মেয়েদের সাথে কই থাকি? ইরা, আনু আর ভাবী ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই আমার লাইফে। ”
শুভ্র বলল, মূল টপিক ভুলে যাচ্ছিস কিন্তু।
অভ্র বলল, ওহ হ্যাঁ! ভাইয়া সত্যি করে বলোতো তুমি কী ভাবীর প্রেমে পড়েছ?”
“অবশ্যই পড়েছি। ”
শুভ্র’র সহজ সরল স্বীকারোক্তি অভ্র’র হজম হলো না। বলল,
“ভাইয়া মজা না প্লিজ। সিরিয়াসলি বলো।”
“হ্যাঁ সিরিয়াসলি ই বলছি তো।”
“তা কবে প্রেমে পড়লে?”
“বিয়ের পর পর ই। চোখের সামনে এতো সুন্দর একটা বউ। তাও নিজের আপন বউ থাকলে যেকেউ প্রেমে পড়বে। আমিও পড়েছি। ”
অভ্র হাসলো। সেই হাসিটা মেকি হাসি না। প্রানবন্ত হাসি।
শুভ্র বলল, এতো হাসির কারণ?
“শুনে খুব খুশি হয়েছি তাই। ”
“এতো খুশি কেন হচ্ছিস?”
“শোনো ভাইয়া এবার সুযোগ বুঝে ভাবীকে প্রেমের কথাটা বলে দাও”।
শুভ্র কিছু একটা ভেবে বলল, আচ্ছা।
অভ্র খুশিতে পাগল হয়ে গেল। বলল, থ্যাংক ইউ ভাইয়া, থ্যাংক ইউ সো মাচ।
শুভ্র হাসলো। মিষ্টি হাসি। যে হাসি দেখলে তানির আত্মা কেঁপে ওঠে। চোখে পানি এসে যায়। খুশির পানি।
অভ্র আর ইরাকে বিদায় জানিয়ে দুজন ট্রেনে উঠলো। ট্রেন একটু একটু করে চলতে শুরু করলো। ইরা চাপা গলায় বলল, এই দেখো দুজন কে কত্তো সুন্দর লাগছে।
অভ্র উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, জানো ভাইয়াও আজ কনফেস করেছে। বলেছে ভাবীকে ভালোবাসে।
ইরা বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেলল। ট্রেনের গতি বেড়ে চলছে। শুভ্র, তানিকে দেখা যাচ্ছে না আর। ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে।
ইরার বিস্ময় কেটে গেলে চিৎকার করে বলল, সত্যি!
“হ্যাঁ। ”
“ইশ আমার আজ এতো খুশি লাগছে!”
“আমারও। ”
“আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।”
অভ্র আঁতকে উঠে বলল, এই না না প্লিজ প্লিজ। এটা পাবলিক প্লেস।
ইরা খিলখিল করে হাসলো।
রিকশায় উঠে ইরা বাদাম চিবুতে চিবুতে বলল, আজ আমি তোমার উপর খুব খুব খুব খুশি।
অভ্র মৃদু হাসলো। ইরা অভ্র’র একটা হাত ধরে বলল, আমার সাধ্য থাকলে আমি তারা ভরা একটা আকাশ দিতাম তোমাকে।
অভ্র বলল, উঁহু। আমার নীল আকাশ পছন্দ। নীল আকাশ না পেলেও চলবে তবে এই দুষ্টমিষ্টি মেয়েটাকে নীল শাড়ি পরা অবস্থায় প্রতিটি মিঠা সন্ধ্যায় চাই ই চাই।
চলবে…..
সাবিকুন নাহার নিপা