#প্রিয়_প্রাণ
সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৭
— বাবা? বাবা?
বুজে থাকা চোখ দুটো খুলে তাকালো আরহাম। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে দিলো ছেলের দিকে। প্রাণ বাবা’র পাশে বসে হাত ধরে তাতে চুমু খেলো। উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো,
— আমি বাবা হয়ে গেলাম বাবা।
আরহাম চোখ বুজে নিলো। চোখের কার্ণিশ বেয়ে পরলো জলধারা। প্রাণ সযত্নে তা মুছে দিলো। বাবা’র কপালে চুমু খেয়ে বললো,
— ছেলে হয়েছে বাবা। কি নাম রাখব? তুমি রেখে দিও তো।
আরহাম মুখ খুলে কিছু বলতে চাইলো তবে পারলো না। বাবা’র না বলা কথা প্রাণ বুঝে। তাই ঝটপট করে বলে উঠলো,
— প্রিয় ঠিক আছে বাবা। মাত্র হসপিটালে দেখে এলাম। ঘুমাচ্ছে।
আরহাম চোখ ঝাপটালো। সেদিকে লক্ষ্য করে প্রাণ এবার বললো,
— আম্মুকে বলতে যাচ্ছি এখনই। শুনে অনেক খুশি হবে।
আরহাম পুণরায় চোখ বুজে নিলো। প্রাণ বাবা’র মাথায় হাত বুলালো। ও জানে বাবা ও এখন মায়ের কাছে যেতে চাইছে কিন্তু প্রাণ কিছুতেই এখন বাবা’কে ছাড়বে না। তার বাবা’কে চাই। খুব করে চাই। এই বাবা তার ভীষণ প্রিয়। ভালোবাসার একজন। বাবা’র ঘুমন্ত মুখে তাকিয়ে রইলো প্রাণ৷ অতঃপর উঠে দাঁড়ালো। নিজের বলিষ্ঠ দেহটা আজ ক্লান্ত মনে হলো। গতরাতে প্রিয়মে’র পেইন উঠেছিলো। এরপর ওকে নিয়ে ছুটেছিলো হসপিটালে। হসপিটালে গিয়ে ও শান্তি নেই। ফিমেইল ডক্টর অত রাতে এভেইএবল ছিলো না৷ ম’রে গেলেও মেইল দিয়ে ডেলিভারি করাবে না প্রাণ। তুষার তো মেয়ের কষ্ট দেখে এক পায়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। তার মেয়েকে সে মেইল ডক্টর দিয়েই ডেলিভারি করাবে। প্রাণের যে তখন কি ভয়ংকর রাগ লাগলো। মন চাইলো ধ্বংস করে দিতে সব। নিজেকে সামলে দাঁত চেপে শুধু ত্যাড়া ভাবে বলেছিলো,
— আমার বউ আমার সিদ্ধান্ত চাচ্চু।
তুষার ও দমবার পাত্র নয়। তার মেয়ে ম’রে ম’রে অবস্থা। একপ্রকার নীরব যুদ্ধ লেগে গেলো যেন। প্রিয়ম বাবা’র হাতটা চেপে ধরে বহু কষ্টে শুধু বলার চেষ্টা করলো,
— আমি মেইল ডক্টর দিয়ে করাব না আব্বু।
ব্যাস তুষার আর কথা বলে নি। নার্সরা সামাল দিতে দিতে ডক্টর হাজির হয়ে যায়। তুষার থেকে প্রিয়মের হাত ছাড়িয়ে প্রাণ ওটিতে চলে যায়। ছলছল চোখে তুষার তাকিয়ে রয়। তার ছোট্ট পরীটা কি না মা হচ্ছে। সময় গুলো কতই না তারাহুরো করলো চলে যাওয়ার জন্য।
_________________
অতীত~
কলিং বেল বাজতেই তোঁষা দরজা খুললো। আরহাম ভেজা শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। গরমে চপচপা অবস্থা। তোঁষা হাসিমুখে ওকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। পেছন থেকে দৌড়ে প্রাণ এসে এক ঝাপ দিলো বাবা’র কোলে। তোতলানো গলায় বললো,
— বাব্বাহ বাব্বাহ মজা তাও।
আরহাম ছেলের কপালে পরা চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে তোঁষা’কে বললো,
— দরজা লক করে দে তুঁষ।
বলেই ছেলেকে নিয়ে সোফায় বসে পরে। বাবা’র কোলে বসেই প্রাণ বাবা’র পকেট হাতালো এক এক করে। না কিছু নেই। ওয়ালেট আর ফোন পেয়েছে শুধু। শেষে হাত দিলো হ্যান্ড ব্যাগে। সোনালী মোরকে প্যাচালো ছোট্ট এক বক্স। তিনটা ফেরিও রোচার এটাতে। কুট্টি কুট্টু দাঁত বের করে হাসলো প্রাণ। বাবা’র বুকে মিশে গালে চুমু দিয়ে বললো,
— প্লান লাব বাব্বাহ।
— নিজের নামটা ও এখন পারে না।
তোঁষার কথায় প্রাণ তাকালো মায়ের দিকে। অতঃপর হাতে থাকা বক্সটা দেখালো হাসিমুখে। তোঁষা হাতের গ্লাসটা আরহামকে দিয়ে বললো,
— তোমার ছেলের এমনিতেই ইঁদুর দাঁত। চকলেট খেয়ে দাঁতে ক্যাবেটি হোক একদম ভালো হবে।
আরহাম জুসে চুমুক বসাতেই প্রাণ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমমমু বাব্বাহ’কে বতো তেন?
— বতি মতি তোর কি? সারাক্ষণ ত ত ত ত! এই ত ছাড়া আর কি পারিস?
— প্লান লাব না আমমমু। আমমু পঁতা।
বলেই বাবা’র বুকে মুখ দিয়ে রাখলো। মায়ের সাথে রাগ হয়েছে তার। সে কি করলো? মা কেন বকলো? আরহাম এতক্ষণ মা-ছেলের নোকঝোক দেখছিলো। এই পর্যায়ে সে মুখ খুললো,
— কি শান্তি পাস সারাটাক্ষন ওর পিছু লেগে?
— ওহহো। হ্যাঁ। এটাই শুনা বাকি ছিলো? আমি ওর পিছু লাগি? হ্যাঁ, বলবেই তো। আমি তো অশিক্ষিত। গন্ড মুর্খ। চালিয়ে যাও। তোঁষা এখন খারাপ। এসো আবার আমার কাছে তখন মজা দেখাব।
বলেই কিচেনে চলে গেল তোঁষা। প্রাণ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মা বাবা’কে বকেছে। তার কান্না পায় কেউ তার বাবা’কে কিছু বললে। এদের কান্ডে আরহাম হাসছে। তোঁষা রেগে গেলেই ছেলে কাঁদে আর এটা হয় সর্বক্ষণ। কারণ তোঁষা রোজই রেগে যায়। প্রাণ’কে বুকে নিয়েই আরহাম উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো রুমের দিকে। ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে ফুলা ফুলা গালে আদর দিতেই সে থামলো। আরহাম ওকে ফ্লোরে নামিয়ে দুটো খেলনা ও নামিয়ে ও দিলো। ছেলেকে বুঝিয়ে বলে গেলো,
— এখানেই খেলবে বাবা’র প্রাণ। ঠিক আছে?
— আত্তা।
আরহাম ঝটফট একটা টাওয়াল আর টাউজার নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকে পরলো। এতক্ষণে তোঁষা দুইবার রুমে এসে গিয়েছে। ছেলেকে দেখে আবার চলে যায়। প্রাণ মা’কে এই দফায় দেখে ফেললো। তোঁষা চলে যেতে নিলেই উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলো,
— আমম্মু।
তোঁষা পিছু ঘুরে মুখ ভেঙিয়ে নিজেও বললো,
— আমম্মু।
প্রাণের ছোট খাটো ঠোঁট দুটো তখন কাঁপছে। মা তাকে ভেঙাচ্ছে। কিন্তু কেন? প্রাণ তো দোষ করে নি। নাক টানতে টানতে মাথা নিচু করে আস্তে ধীরে মায়ের কাছে হাঁটু জড়িয়ে ধরলো। তোঁষা চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,
— কি চাই?
— আম্মমু কোলে।
— কেন বাবা’র কোলে যা। আমার আদর তো সব তোর এখন। আমার কোলে কি? আমি শুধু প্রিয়ম’কে কোলে নিব।
এইবার মায়ের কোলে গাছের মতো বাইতে শুরু করলো প্রাণ। না পেরে তোঁষা ই ওকে কোলে তুললো। প্রাণ মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে দুটো চুমু দিয়ে বললো,
— পিও আতে না কেন? প্লান লাব পিও।
— হ্যাঁ হ্যাঁ। তিন বছরের ছেলে আবার লাব পিও। এই বয়সেই বউ বউ করিস আর তো দিন পরেই আছে। মায়ের কোলে কি তাহলে? যা নাম।
দাঁত বের করে হাসতে হাসতে মায়ের কাঁধে মুখ লুকালো প্রাণ। সে তিন জন কেই লাব করে। তার মা,বাবা আর প্রিয়’কে।
আরহাম গোসল করে বের হওয়া মাত্র ই মুখ ঝামটা মে’রে চলে গেল তোঁষা। আরহাম ঠোঁট টিপে হাসলো একটু। কাঁধে থাকা টাওয়াল নিয়েই বউয়ের পিছনে গেলো ও। তোঁষা টেবিলে খাবার সব এনে রেখেছে। আরহাম টেবিলে বসতেই প্রাণ বাবা’র কোলে উঠলো। সারাদিন তার কাজ ই এটা৷ কোলে কোলে থাকা। জোকের মতো মায়ের বুকে নাহয় বাবার বুকে লেগে থাকবে।
তোঁষা মুখ কালো করেই খেতে বসেছে। আরহাম প্রথমে ছেলের মুখে ছোট্ট ছোট্ট লোকমা তুলে দিলো। প্রাণ ও কম না। সে নিজেও মায়ের প্লেট থেকে হাত দিয়ে নিয়ে বাবা’র মুখে দিচ্ছে।
নীরবতার চাদরে ঘেরা পরিবেশে শুধু প্রাণের কিছু ভাঙা ভাঙা কথাই শুনা গেলো।
.
প্রাণ ঘুমালো মিনিট পাঁচ হবে। আরহাম এবার বারান্দায় গেলো। তোঁষা দূর আকাশপানে তাকিয়ে। পিছন থেকে আরহাম ডাকলেও হয়তো শুনলো না। পাশে দাঁড়াতেই ধ্যান ভাঙলো ওর। আরহাম ওর হাতে হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। জীবনে কতগুলো রাত তাদের চলে গেল। গুনে রেখেছে আরহাম। সামনেও গুনে রাখবে। তোঁষা হঠাৎ ফুপিয়ে উঠতেই আরহাম কিছুটা জোরেই হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— ছেলের সাথে মা হিংসে করে। এ কথা জনগন শুনলে কি এক অবস্থা হবে বল তো?
— আমাকে কেন আদর করো না?
— করি না?
— একটুও না।
— তাহলে তোর পেটে আবার আবার বাবু ঢুকলো কিভাবে?
তোঁষা বড় বড় চোখ করে তাকালো। আরহাম জানলো কিভাবে? তোঁষা নিজেই তো জানে না শিওর হয়ে। আরহাম তোঁষার এহেন চাহনি দেখে এবার একদম কাছে টেনে নিলো। গালের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
— তোকে তোর থেকে হাজার গুন বেশি আমি জানি প্রাণ।
— কিন্তু…
আরহাম তোঁষাকে চুপ করে দিলো। নরম আদর দিয়ে জানালো,
— ফুল এনেছি তো।
তোঁষার ডান হাতের কবজিতে বেলী’র মালা পেঁচিয়ে দিতে দিতে আরহাম বললো,
— সারাদিন কি করলি?
— কি করলাম? সংসার করলাম তোমার।
— সংসারের স্বাদ মিটেছে?
— ইহকালে মিটবে না।
আরহাম তোঁষা’র হাতে চুমু খেলো। হাঁটু ভেঙে ওর সামনে বসে পেটটা জড়িয়ে ধরে বললো,
— এবার একটা মা আসবে আমার।
— যদি বাবা আসে?
— মন বলে মা আসছে।
— শুধু তোমাকেই বলে?
— হ্যাঁ।
আরহাম উঠে দাঁড়ালো। চাঁদটা আজ জ্বলজ্বল করছে। তোঁষা আহ্লাদী হয়ে আরহামে’র গলা জড়িয়ে ধরলো। আরহাম ওকে পাজা কোলে তুলে রুমে নিতে নিতে বললো,
— এমন আরো বহু বছর তোর সাথ চাই প্রাণ। তোর হাত দুটো ধরে বুড়ো হতে চাই।
— মনজুর।
— প্রমিস।
— পাক্কা প্রমিস।
বিছানায় শুয়ে সবার আগে ছেলের কপালে আদর দিলো তোঁষা। আরহাম গিয়েছে কিচেনে। প্রাণ রাতে ঘুমের মাঝেই ফিডার খায় একটু। তোঁষা’র ছোঁয়া পেতেই প্রাণ গুটালো মায়ের কাছে। তোঁষা হাসলো। ইচ্ছে করেই মা ছেলে সারাদিন ঝগড়া করে। একা একা তোঁষা আর কি ই বা করবে?
ফিডার হাতে মা-ছেলেকে দেখে আরহাম মুগ্ধ হলো। এই তো সাইডে একটু ফাঁকা থাকে। সেখানটার দখলদার ও হাজির হচ্ছে অতি শিঘ্রই।
#চলবে……
— মাম্মা? মাম্মা মিশি এখানে।
— কোথায় আমার মা? এখানে আসো মা।
— নাহ। তুমি আসো।
— মাম্মা তো উঠতে পারছি না। মাম্মার কিশমিশ কোথায়?
এবার মিশি নিজেই রুমে এলো। এতক্ষণ বারান্দায় বসে বসে সে কিছু নয়নতারা ফুল কুড়ালো। সবগুলো মায়ের কোলে ঢেলে দিয়ে চুমু খেলো মায়ের পেটে। রোদ হাসলো। মিশির গাল টেনে বললো,
— ভাই কোথায়?
— বাইলে।
রোদ মিশান বলে ডাক দিতেই মিশান হাজির হলো। কিছু অলকনন্দা দিয়ে সে মালা গেঁথেছে। সেটা এনে মায়ের মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বললো,
— তোমাকে প্রিন্সেসের মতো লাগছে মা।
রোদ হাসলো। দুই সন্তান দুই দিকে বসিয়ে গল্প শুরু করেছে ও। আদ্রিয়ান এলো খানিক পর। হাতে ট্রে। রোদ ওকে দেখেই বললো,
— এবার উঠি।
— নাহ।
— কেন?
— না বলেছি রোদ।
কিছুটা কঠিন স্বর আদ্রিয়ানের। রোদ রাগে মুখ ঘোরালো। গাল দুটো ফুলিয়ে রাখলো। মিশি মায়ের সঙ্গে লেপ্টে থেকে মায়ের গালে চুমু খেয়ে বললো,
— মাম্মা মিশি বাবাইকে বতে দিবে। তুুমি মন তালাপ তলো না।
মেয়ের তোতলা তোতলা কথাতে আবেগী হলো রোদ। মেয়েকে বুকে টেনে নাক টানলো। আদ্রিয়ান বুঝলো না এত অল্পতে কাঁদার কি আছে? সময়টাই এমন। মুড সুইং প্রচুর হচ্ছে রোদের। মিশান বাবার দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই ফোঁস করে দম ছাড়লো আদ্রিয়ান। এগিয়ে এসে সন্তপর্ণে আগলে নিলো রোদকে। এই মেয়ে নিজের প্রেগনেন্সির ফায়দা লুটছে প্রচুর