অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৬৭।

0
259

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৭।

শুভ্রতায় সেজেছে ফারজাদের নববধূ। কবুল বলার পর্ব শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মৌমির জোরাজুরিতে যাই একটু সেজেছিল, কেঁদে কেটে ঐটুকুও গায়েব করে ফেলেছে সে। লুৎফা বেগম এখনো কাঁদছেন। দিলরুবা বেগম বোঝাচ্ছেন তাকে। কিন্তু মায়ের মন, মেয়ে বিদায় দেওয়ার কষ্ট কি আর কারোর বোঝানো তে কমে যায়। প্রিয়তার বাবা, অলিউল সাহেবের চোখে মুখেও বিস্তর বিষন্ন ভাব। কিছুদিন আগেই মেয়েকে ছাড়া থেকে বুঝেছেন, মেয়ে ছাড়া কতটা অসহায় তিনি। এখন সারাজীবনের জন্য মেয়েকে ছাড়া কী করে থাকবেন, সেটাই ভাবছেন হয়তো।

নীহালের পাশে দাঁড়াল মৌমি। অনুচ্চ স্বরে বলল,

‘মন খারাপ করবেন না, ঐটা প্রিয়তার আপুর’ই আরেকটা বাড়ি। ওখানে প্রিয়তা আপু ভালো থাকবে।’

নীহাল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। তাদের সবার আদরের রাজকন্যা প্রিয়তা। চোখ ছলছল করলেও কাঁদল না সে। বলল,

‘সেই ভরসা আছে আমার।’

কাজী সাহেবসহ আরো তিন থেকে চারজন লোক এসেছে। বিয়েতে সাক্ষী লাগে। অলিউল সাহেব দুই পক্ষের’ই সাক্ষী এনেছেন। এখন তাদেরকেই টেবিলে খেতে বসিয়েছে আগে।তারা চলে গেলেই বাড়ির মানুষগুলো খাবে।

খাওয়া দাওয়ার প্রথম পর্ব শেষ। বাইরে থেকে আসা হাতে গুনা মেহমানরা প্রস্থান ঘটিয়েছেন। মৌমি গিয়েছে প্রিয়তার ঘরে। মেয়েটা একা ঘরে চুপচাপ বসে আছে। মৌমি গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলল,

‘চেহারার একি হাল করেছো, ভাবিজান?’

মৌমির মুখে “ভাবিজান” শুনে চমকে তাকাল প্রিয়তা। বলল,

‘সম্বোধন’টা বেশ পছন্দ হয়েছে, মিষ্টি ননদিনী।’

‘কিন্তু আমার তো তোমাকে এভাবে পছন্দ হচ্ছে না। আমি তোমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলাম, সেগুলো কোথায় গেল?’

প্রিয়তা ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

‘চোখের জলে ভেসে গিয়েছে সব।’

মৌমি মন খারাপ করে বলল,

‘তাই বলে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে? তোমার চোখের জল এত পাজি কেন?’

‘তোমার মতোই হয়েছে আরকি।’

‘হয়েছে যাও। আর বলতে হবে না কিছু। এখন এসো, একটু টাচ আপ করে দেই। ঐদিকে আমার ভাইজান তোমার অপেক্ষায় শুকিয়ে যাচ্ছে।’

প্রিয়তা লজ্জা পেল সেই কথায়। মৌমি হেসে বলল,

‘বাহ, গালের ব্লাশান আবার ফিরে এসেছে, হুয়াট অ্যা ম্যাজিক।’

প্রিয়তা এবার বেশিই লজ্জা পেল। বলল,

‘মৌমি, এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে।’

মৌমি হাসে। বলে,

‘আচ্ছা, এখন একটু লিপস্টিক দিলেই হবে।’

প্রিয়তাকে একটু লিপস্টিক লাগিয়ে দিয়ে মৌমি তাকে নিয়ে এল বসার ঘরে। প্রিয়তার মাথার সাদা রঙের দুপাট্টা’টা বড়ো করে টানা। তার মুখটা স্পষ্ট নয় তাই। মৌমি তাকে ফারজাদের পাশে বসাল। এক জোড়া শুভ্র রাঙা কপোত কপোতীকে দেখে চোখ জুড়াল সকলের। দিলরুবা বেগম আর লুৎফা বেগম একসঙ্গে “মাশাল্লাহ” বলে উঠলেন। লজ্জায় মাথাটা আরো নুইয়ে নিল প্রিয়তা। ফারজাদ পারছে না একবার ঘুরে এই অতি অনুপম সুন্দর মেয়েটাকে দেখতে। শুভ্রতায় বদন রাঙানো মেয়েটাকে দেখার জন্য আর তর সইছে না যে। কিন্তু এত এত মুরুব্বির মাঝে কী করে তাকাবে সে। ভাইয়ের মনের কষ্ট বোধ হয় বোন বুঝল। বলল,

‘আচ্ছা আচ্ছা, এবার ভাইয়ার ভাবিজানের মুখ দেখার পালা। ভাইয়া, ভাবিজানের মাথার উপর থেকে দুপাট্টাটা সরিয়ে তার শুভ্র সুন্দর মুখখানা দেখে নাও তো।’

ফারজাদ এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিল। ঘুরে বসল সে। প্রিয়তার দিকে চাইল। প্রিয়তা এখনো মাথা নুইয়ে রেখেছে। ফারজাদ আলতো হাতে দুপাট্টা তুলল তার। প্রিয়তা ঢোক গিলল। ফারজাদের দিকে চাইল। শরীরে শিহরণ জাগল এটা ভেবে যে, এই মানুষটা আজ থেকে তার ব্যক্তিগত পুরুষ। ফারজাদ ঠোঁট নাড়িয়ে একেবারেই স্বল্প সুরে বলল,

‘মাশাল্লাহ।’

তা কেবলই প্রিয়তা কান অবধিই পৌঁছাল। লজ্জায় শামুকের ন্যায় খোলসের ভেতর লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করল তার।
মুখ দেখার পর্ব চুকতেই শুরু হলো ছবি তোলার পর্ব। বাড়ির এই কয়টা মানুষ, অথচ ছবি তুলল শ’খানেক। অবশেষে সব কাজ সমাপ্ত করে খেতে বসল সবাই। নিজের বাড়িতে নিজের মানুষগুলোর সাথেই খেতে বসেও প্রিয়তার জড়তা ভাব যাচ্ছে না যেন। বিয়ে হতে না হতেই কেমন একটা সংকোচ চলে এসেছে যেন তার মাঝে। খাবার খাচ্ছে অতি ধীর গতিতে।

সমস্ত প্রাসঙ্গিক কাজ সেরে মাত্রই নিজের রুমে এসেছে প্রিয়তা। এখন শাড়ি পাল্টাতে পারলেই বাঁচে সে। অথচ মৌমি এসে বাধ সাধল সেখানেও। সে এখন প্রিয়তাকে শাড়ি পাল্টাতে দিবে না। সন্ধ্যা নেমেছে বাইরে। প্রিয়তা ক্লান্ত সুরে বলল,

‘আর শাড়ি পরে থেকে কী হবে, মৌমি?’

‘আরেহ, তোমাদের বাসর রাতের আয়োজন করতে হবে না? একদম শাড়ি খুলবে না। হালকা করে হাত মুখ ধুতে পারো শুধু।’

প্রিয়তা মাথায় হাত দিয়ে বলল,

‘আবার বাসর রাত?’

‘সেকি, বিয়ে করেছ বাসর রাত করবে না। আমার ভাইটাকে সরল সোজা পেয়ে এত বড়ো অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছো? আমি থাকতে তা জীবনেও হতে দিব না।’

মৌমির কথা শুনে প্রিয়তা হাসবে না কাঁদবে বুঝে না। সে তার নাক টেনে বলে,

‘এত ফাজিল তুমি।’

মৌমি হাসল। বলল,

‘এটা তো শুধু ট্রেইলার। ভাবিজান হয়েছ না, এবার আবার ফাইজলামির পুরো পিকচার দেখাব।’

প্রিয়তা হালকা করে তার কান টেনে বলল,

‘তবে আমিও ভাবিজান হিসেবে খুব শাসন করব তোমায়।’

মৌমি জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। বলল,

‘ভাবিজান না বড়ো বোন হিসেবে করবে।’

প্রিয়তাও আগলে নিল। ছোট বোন নেই তার, ছোটবেলা থেকেই এই আফসোস ছিল। কিন্তু আজ থেকে আর নেই।

_______________

ফারজাদ প্রিয়তা কেউই ঠিকমতো আর ফ্রেশ হতে পারল না। এই মৌমি মেয়েটা নাজেহাল অবস্থা করে ছেড়েছে তাদের। নীহালকে দিয়ে ফুল কিনিয়ে এনেছে সে। একা একা প্রিয়তার পুরো রুম সাজিয়েছে। এইদিকে প্রিয়তার লজ্জায় মরমর অবস্থা। ফারজাদও যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে আছে তা না। এই মেয়েটার জন্য তাকেও বেগ পোহাতে হচ্ছে বেশ।

রাতের খাবার শেষ হলো। খাবার টেবিলে দিলরুবা বেগম জানালেন, তারা কালই পাকিস্তানে ফিরতে চান। এখন টিকেট পেলেই হয়। এইদিকে যাওয়ার কথা শুনে প্রিয়তাসহ তার পরিবারের মানুষগুলোর মুখ চুপসে যায়। প্রিয়তা পারছে না তখনই কেঁদে দেয়। লুৎফা বেগম বলেছিলেন, আর দুটো দিন থেকে যাওয়ার কথা। কিন্তু দিলরুবা বেগম জানান, সেখানে গিয়ে আরেক বিয়ের প্রস্তুতিও যে নিতে হবে। সরাসরি না বললেও যারা বোঝার তারা বুঝে গিয়েছে। লজ্জায় আর মৌমি তখন খেতে পারেনি ঠিক মতো।

বেশ জোর করেই মৌমি আরেকদফা সাজাল প্রিয়তাকে। প্রিয়তার ক্লান্ত মুখশ্রী। ঘুমে সে ঢুলে পড়ছে। লুৎফা বেগম তার রুমে দুধের গ্লাস রেখে গেলেন। বুক এবার ধরফর করছে প্রিয়তার। মৌমি ফাঁকে দিয়ে একবার উঁকি দিয়ে “অল দ্যা বেস্ট” বলে গিয়েছে তাকে। প্রিয়তা নতুন বউয়ের মতো চুপচাপ খাটে বসে। বুকের ভেতর ঝড় বইছে বোধ হয়। এমন ভয়ংকর অনুভূতি আগে হয়নি কখনো। দরজা খোলার শব্দ হয়। প্রিয়তা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সেদিকে তাকায়। তার কাঙ্খিত পুরুষের আগমন ঘটেছে। ভেতর থেকে দরজাটা আটকে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় ফারজাদ। প্রিয়তা নেমে আসে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সালাম করতে উদ্যত হয়। ফারজাদ আটকে দেয়। বলে,

‘মুখে বললেই হবে।’

প্রিয়তা বলল,

‘আসসলামু আলাইকুম।’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আপনাকে এখন থেকে “তুমি” বলে সম্বোধন করলে কোনো অসুবিধা নেই তো?’

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে “না” বলল। খুশি হলো ফারজাদ। বলল,

‘তবে তুমিও আমাকে “তুমি” বলেই সম্বোধন করো, “আপনি” বলার প্রয়োজন নেই।’

প্রিয়তা আবারও মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল। ফারজাদ খানিকটা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘আমার জানা মতে তুমি তো কথা বলতে পারো, তবে বেচারা মাথাটাকে এত প্রেসার দিচ্ছো কেন?’

প্রিয়তা ঠোঁট চেপে হাসল ফারজাদের কথায়। সেই রাগী, গম্ভীর, তাকে সবথেকে বেশি অপছন্দ করা মানুষটাও যে কখনো তার সাথে এত রগড় সুরে কথা বলবে, সেটা সে কখনো কল্পনাও সে। মানুষের জীবনের কল্পনাহীন ঘটনাগুলোই সবথেকে সুন্দর, তাতে কোনোপ্রকার আশা ছাড়াই অনেক কিছু পেয়ে ফেলা যায়।

চলবে….

(নিন, ফারজাদ আর প্রিয়তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এবার খুশি তো, পাঠকমহল?)

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here