প্রিয়তম #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-১৭

0
152

#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৭

দু-দু’বার ডেইট পিছিয়েছে ইফাদ। টিকিট ওকে করার আগে বললেও তো হতো, রিতু এখন বলছে! ইফাদ তবুও গুরুত্ব দিলো রিতুর কথাটায়। ভাবলো একবার ব্যাপারটা নিয়ে।
— ক্যান্সেল করে দিন বললেই কি আর ক্যান্সেল
করে দেওয়া যায়? দেখলেই তো এই ক’দিন কাগজপত্রের ঝামেলা নিয়ে কত খাটুনি করেছি। প্রফেসরও একের পর এক মেইল করে চলেছে।
এবার না গেলে সত্যিই আমার লস হবে…
রিতু সব লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে মনের ইচ্ছেটা জানিয়েই দিল। ধীর স্বরে বলল,
— আমার আপনাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না।
রিতু নিজের মুখে এ কথাটা বলছে? ইফাদ শুনে বিস্মিত হলো। অনেকক্ষণ চুপ রইল। অভিমান, রাগ গলে গেল। রিতু এভাবে বললে সে কীভাবে যাবে? লন্ডন শহরের চাকচিক্যের মধ্যেও তো মন বসবে না ওর। পরে ভাবলো সব গোল্লায় যাক। রিতু যখন
নিজের মুখে বলেছে ওর চাওয়ার তো দাম তো সে নিশ্চয় দেবে, দেওয়া উচিৎ। দিনশেষে তো এই মেয়েটার কাছেই ও ফিরতে চেয়েছিল। সেই ভেবেই ইফাদ বলল,
— তুমি ভালোবাসলে থেকে যাব…
রিতু শিহরিত হলো। কম্পিত অথচ নিচু গলায় বলল,
— বাসব…
বলেই ইফাদের বুকে মুখ গুঁজলো। এভাবে কি কমবে দূরত্ব? রাগ, জেদ ভুলবে অংক স্যার? রিতু মন থেকে কথাটা বলছে। লোকটার সান্নিধ্য চাইছে। ইফাদ সেটা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে শক্ত করে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করল ওকে। রিতু প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে সময়টা উপভোগ করতে লাগল সব ভুলে, সব দূরত্ব ঘুচিয়ে। ইফাদ সরু গলায় জিজ্ঞেস করল,
— ঘুমিয়েছো?
রিতু অস্পষ্ট গলায় বলল,
— উহু!
ইফাদ ওর কানের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়াল। অন্ধকারেও রক্তিম হয়ে উঠল রিতুর ফর্সা গাল। কাঁপলো হাত। সেই হাতে আঁকড়ে ধরল ইফাদের পরণের টি-শার্ট। ঊষ্ণ অনুভূতিতে টালমাটাল ইফাদের গলা শুকিয়ে এলো। ফিসফিস করে রিতুর কানে কানে বলল,
— একটু ছুঁই?
রিতু উত্তর দিলো না তবে বারণ ও করলো না। ইফাদ ওর না বলা কথাটা বুঝতেই নিজের সাথে পিষ্ট করে ফেলল রিতুকে। এরপর নাক ঘষলো ওর গালে। উষ্ণ অধরের চুম্বন বসালো চোখের পাতায়। লজ্জায় লাল হলো রিতু। দু’জনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এক হলো। এরপর ভেসে গেল বাস্তব পৃথিবী থেকে বহুদূরে!

.

অন্যদিনের চেয়ে আজকের সকালটা নতুন ছিল রিতুর জন্য। ঘুম ভাঙার পর সে নিজেকে আবিষ্কার করল ইফাদের বুকে। ব্যাপারটা ওর জন্য লজ্জার হলেও নিজেকে নিজে বুঝ দিল রিতু। এই লোকটার সঙ্গে বহু দিন এক ঘরে থেকেছে সে। শত মান-অভিমানের মধ্যেও। কিন্তু এভাবে কাছাকাছি আসা হয়নি। তখন ইফাদের প্রতি রাগ কাজ করতো। এরপর দূরত্ব এলো, আর সবকিছু ভুলিয়ে দিলো। রিতু ঘুমন্ত ইফাদের
মুখের উপর দৃষ্টি স্থির রাখতে পারল না। লজ্জায় ওর হাত-পা কাঁপছে তিরতির করে। মনে হচ্ছে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু যাওয়াটা সমীচীন হবে না। কারণ ইফাদ বেরুবে। গত রাতেই বলে রেখেছিল যাতে খুব সকালে ডেকে দেয়। রিতুর যদিও ডাকতে ইচ্ছে করছিল না, তবুও নিজেকে সংযত করে আস্তে করে ডাকল,
— স স্যার….
ইফাদের কান পাতলা। ঘুমের মধ্যে একটু শব্দ হলেও সে উঠে যায়। রিতু দু’বার ডাকতেই ওর চোখ খুলে গেল। জমাট মস্তিষ্ক সচল হতেই চোখ দুটি আবারও
বন্ধ করে ওকে বুকে টেনে নিয়ে ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,
— অ্যাই মেয়ে, ইফাদ বলো…
রিতুর কপাল কুঁচকে এলো। বলছে কী! জীবনেও পারবে না সে। জীবনেও মুখ ফুটে ‘ইফাদ’ বেরুবে না ওর মুখ দিয়ে। শত চেষ্টায়ও না। মগের মুল্লুক না। এতদিনের অভ্যাস। পাল্টানো অসম্ভব। তারচেয়ে বড় কথা রিতুর লজ্জা লাগবে। ইফাদ গলা খাকারি দিয়ে আবারও বলল,
— বলো…
–পারবো না। স্যারই ডাকব!
— তুমি কী সংস্কার মানো? স্যার থেকে বর হয়েছি
সেই কবে…
রিতু লজ্জা মাখা গলায় বলল,
— সংস্কারের বিষয় না। এমনিই বলতে পারব না। বর হয়েছেন তাতে কী! একসময় আপনি আমায় কত মে রেছেন, কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন পর্যন্ত! আমি আপনাকে নামটাম ধরে বলতে পারব না।
ইফাদ আর জোর করল না। অস্বস্তিটা বুঝলো। যে না পারে তাকে কি করে জোর করবে। তাছাড়া এটা অভ্যাসের ব্যাপার। হুট করে চাপিয়ে দিলে হবে না। কিন্তু বউয়ের মুখে ‘অংক স্যার’ শুনতে ওর ভালো লাগে না৷ মাঝেমধ্যে মনে হয় রিতুর টিচার হয়ে আসলেই ওর বিরাট লস হয়ে গেছে। সবকিছুতে দেরি। মন পেতেও দেরি, সম্পর্ক দৃঢ় করতেও দেরি। ও গভীর স্বরে বলল,
— এত অভিযোগ! এমনি এমনি কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতাম? অংকে তো গোল্লা পেতে।
— খোঁটা দিচ্ছেন? তো বিয়ে করেছেন কেন!
রিতু তেড়েমেরে উঠতেই ইফাদ ওর হাতের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে চুমু বসালো। এরপর নিঃশব্দে হেসে বলল,
— আসলেই তো, কেন করলাম?
— ফাজিল লোক…
বাইরে তখন আলো ছড়িয়ে গেছে। সোনা বরণ রোদ ছড়িয়ে পড়ছে মুক্ত পৃথিবীতে, জানালার কার্নিশে।

ইফাদ বিকেলে ফিরল। ফিরেই বাড়ির সবাইকে জানালো ও আপাতত লন্ডন ফিরছে না। ওর এমন সিদ্ধান্তে বাড়ির সবাই হতভম্ব। রিতুও। নাজিয়া
ইসলাম বললেন,
— এই ছেলের মাথায় কী চলছে! গতকাল বললো
তিনদিন পরের ফ্লাইট। এখন বলছে যাবে না! মানে
কী? রিতু তুমি কিছু জানো?
— তেমন কিছু বলেনি।
— উফ! আমি পাগল হয়ে যাব। ওর বাবা শুনলে
শেষ। রাগারাগি করবে!
রিতু ঘাবড়ে গিয়ে নিচু স্বরে বলল,
— আসলে আমি কাল বলেছিলাম টিকিট ক্যান্সেল
করে দিতে। সেটা বোধহয় উনি সিরিয়াসলি নিয়েছে…
নাজিয়া ইসলাম কপালে হাত দিলেন,
— দেখেছো কান্ড!
রিতু মাথা নামিয়ে নিল,
— আমি তো এমনিই বলেছিলাম…
নাজিয়া ইসলাম বুঝতে পারলেন। দু’জনের তাহলে মিলমিশ হয়েছে। ব্যাপারটা স্বস্তির। এরপর একটু চিন্তা করে বললেন,
— তুমি একটু বোঝাও ওকে। আমরা ও তো চাই ছেলেটা কাছে থাকুক। কিন্তু বাস্তবটা তো ভিন্ন। তাই না? সব ছেড়েছুড়ে ডিগ্রি আনতে গেল। এখন যদি মাঝপথে ছেড়ে দেয় ব্যাপারটা কি ঠিক দেখায়?
রিতু বাস্তবতা চিন্তা করে দেখল এর আগেও বহুবার ওর কথার উপর ভিত্তি করে ইফাদ অনেক কিছু করেছে। চাকরি ছেড়েছে, পরিবার ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আর এবার যদি ইফাদকে না যেতে দেয় তাহলে সেটা অন্যায় হবে। মুখের কথা তো নয়,
যে হায়ার স্টাডিজের কোর্স কমপ্লিট না করলে কিছু
হবে না। মাঝপথে ছেড়ে দিলে বোকার কাজ হবে।
এটা ইফাদের স্বপ্ন আর ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতি। সর্বোপরি সুন্দর একটা ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতি। মাঝখান থেকে সময়গুলো নষ্ট হবে, টাকা-পয়সাগুলোও জলে যাবে। ফেল্টুস রিতু তো
আর নিজের জন্য ইফাদকে তার স্বপ্নের পথ থেকে
পিছু হটাতে পারে না। ও শ্বাশুড়িকে বুঝিয়ে এরপর ঘরে এলো। ইফাদ মাত্রই ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। রিতু ওকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
— আপনার জন্য!
ইফাদ চা নিল৷ থম ধরা গলায় বলল,
— এক রাতেই এত বদল!
রিতু বলল,
— তাই না? আমাকে ছেড়ে তো বিদেশে আপনি ভালোই ছিলেন। এদিকে আমি চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়েছি। সেগুলো আপনি জানবেন কেন! আপনি তো আমাকে ভুলেই গেছিলেন।
বলতে বলতে রিতুর গলা ধরে এলো। ছলছল করে উঠল চোখজোড়া। ইফাদ নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইল। ওর রক্তিম, ফর্সা ভেজা গালটায়। নাকের গোলাপি ডগায় আঙুল বুলিয়ে সরু গলায় বলল,
–কত ফোন দিয়েছিলাম জানো? ব্লক করে রেখেছিলে ফোনে। নিজের নিষ্ঠুরতার কথা তো বললে না!

ইফাদের কথাটা শুনে রিতুর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। তখন রিতুর পরীক্ষা চলছিল। ইফাদকে সে প্রতিদিন ফোন দিতো। সেদিন রাতে পড়তে বসে ও ইফাদকে ফোন দিয়েছিল, কিন্তু ও ফোনটা রিসিভই করেনি। উল্টে সুইচড অফ করে রেখেছিল। ব্যাপারটায় কষ্ট পেয়ে রিতু কেঁদেই দিয়েছিল। ওর ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেটা আবার ইফতির চোখে পড়েছিল। আর তখুনি ও রিতুর ফোনটা নিয়ে ইফাদের নাম্বারটা ব্লক লিস্টে অ্যাড করে দিয়েছিল। সে কথা মনে পড়তেই রিতুর এমন সময়েও সামান্য হাসি পেল,
— ব্লক তো করেছিল ইফতি আপু। আপনাকে টাইট দিতে।
ইফাদের কপালে ভাঁজ পড়লো। এমন দুশমনি করে কেউ! আস্ত একটা ঘসেটি বেগম ওর বোনটা! ভাইয়ের প্রতি দরদ নেই ইফতির। ইফাদ বলল,
— তোমারও সায় ছিল!
রিতু অভিমান ভরা গলায় বলল,
— থাকবে না? আপনি আমার ফোন এড়িয়ে যেতেন তাই আমিও আর ব্লক খুলিনি। যে আমাকে এড়িয়ে গিয়ে শান্তি পায় তাকে তো শান্তিতে থাকতেই দেওয়া উচিৎ!
ইফাদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
— তোমাকে কে বলল আমি শান্তিতে ছিলাম?
কতবার অসুস্থ হয়েছি, পাশে কাউকে পাইনি। মনে
হতো কেন পড়ে আছি এই দেশে, এক্ষুনি ছুটে যাই। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না৷ সবাইকে মিস করতাম আমি, বিশেষ করে তোমাকে আর মাকে…
রিতুর খারাপ লাগল ভীষণ। ছি ছি! এতকিছু সহ্য করেছে ইফাদ শুধু ওর কারণেই। অহেতুক কষ্ট দিল মানুষটাকে। যেটা ওর প্রাপ্য নয়। রিতু কেন এমন করল? কী পেল এসব করে? উল্টো মানসিক শান্তি হারালো। কিন্তু আর সেটা হতে দেবে না। দীর্ঘশ্বাস
ফেলে এ পর্যায়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
— টিকিট ক্যান্সেল করে ফেলেছেন?
ইফাদ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,
— এখনো করিনি, করব…
রিতু তড়িঘড়ি করে বলল,
— করবেন না।
ইফাদ বিস্মিত হলো,
— কেন? তুমিই তো বললে।
রিতু হাসার প্রচেষ্টা করে বলল,
— ধুর! আমি গত রাতে টিকিট ক্যান্সেল করার কথাটা ভেবে বলিনি আপনাকে। কোর্সের মাঝপথে এসে ছেড়ে দেয় কেউ? বোকারাই এ কাজ করে।
ইফাদের গলার স্বর গম্ভীর হলো,
— তুমি কী আবারও আমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছো? সিরিয়াসলি বলছি! আমি কিন্তু আর ফিরব না।
রিতু ভড়কে গেল। নিজেকে শক্ত করল। এরপর ভার গলায় বলতে শুরু করল,
— আমার মা খুব ছোটবেলায় মা রা যায়। বাবা-মায়ের সংসার দেখিনি। বুঝিও না এতকিছু। বাবার ছায়ায় বেড়ে ওঠা। বাবা আমাদের দু-বোনের জন্য এতকিছু করেছেন যারজন্য বাবাকে কখনো কষ্ট দিতে চাইনি। তখন আমি সত্যিই বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। বাবা যখন বলল বিয়ের জন্য কথা দিয়ে ফেলেছে, তখন বাবাকে আমি আপনাদের কাছে ছোট করতে চাইনি। আপনি আমার শিক্ষক ছিলেন এবং আমাকে সরিয়ে বাবাকে একা করে দিয়েছেন এই ভাবনাটাই আমার মাথায় ঘুরতো। এজন্য আমার জেদ ছিল আপনার ওপর। আর এ জেদের কারণে আপনি নিজের অনেক কিছু হারিয়েছেন। বিশ্বাস করুন! আমি মাঝেমাঝে ভুল করে অনেক কটু কথা বলেছি, কিন্তু পরক্ষণেই অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। আপনি আমার কথার উপর ভিত্তি করে চাকরি ছেড়েছেন, দেশ ছেড়েছেন। আমি এতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি! আমার অপরাধবোধ বাড়াবেন না। আপনি যাবেন৷ ডিগ্রি নিয়ে ফিরবেন। নিজের সাথে হেয়ালি করবেন না, আমার জন্য। আমি তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আমি নিজের ভুল পুনরাবৃত্তি করতে চাই না, শুধরাতে চাই…
বলতে বলতে ওর মাথা ঠেকলো ইফাদের উরুতে। নিঃশব্দে কাঁদলো। গাল বেয়ে অশ্রু কণা বেয়ে পড়ল। ইফাদ তা টের পেয়ে ওর মুখ তুলল। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে কঠোর গলায় বলল,
–আমাদের মধ্যে মানসিকভাবে দূরত্ব অনেক বেড়ে যাবে রিতু। তুমি আমাকে ভুলে গেলে…
রিতু ভেজা চোখ মুছে নিয়ে ইফাদের কাছে ঘেঁষলো।
আশ্বস্ত করা কন্ঠে বলল,
— উহু। একটুও বাড়বে না। আপনাকেও ভুলব না। কয়েকটা বছরেরই তো ব্যাপার। আমি আপনার অপেক্ষা করব।

_________________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি৷]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here