হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম #Nusrat_Jahan_Bristy #পর্ব_৪১

0
331

#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৪১

নতুন দিনের সূচনা। ধরণী জুরে ভোরের আলো ফুটেছে। ঘন কুয়াশায় ডেকে আছে চারিদিক। পুব আকাশের লাল সূর্যটা কুয়াশার চাদরে ডেকে আছে। রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে শীতের প্রকোপটাও বেড়ে গেছে। এই শীতের মাঝেই পাখির মধুর কলধ্বনিতে সকালের পরিবেশ মুখরিত হয়ে আছে।

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা নুহাশ কিঞ্চিৎ নড়ে চড়ে উঠল। ঠান্ডায় নিজেকে আরো একটু গুটিয়ে নিয়ে আরো কয়েক মিনিট শুয়ে রইল। ধীরে ধীরে চোখ মেলে শুয়া থেকে উঠে বসল। ফোনটা নেওয়ার জন্য বেড সাইডের টেবিলের দিকে হাত বাড়াতে নিলে দেখে ফোন নেই। গেলো কোথায় ফোনটা? তার স্পষ্ট মনে আছে সে এইখানে গত রাতে ফোনটা রেখেছিলাম। বেডের চারপাশে খুঁজাখুঁজির পর ফোনটা পেল। কিন্তু মনের মাঝে একটা খটকা লেগে আছে তার ফোন বেডে আসল কি করে? সে সবসময় ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফোনটা টেবলিের উপরে রাখে তাহলে। নুহাশের নজর পড়ে টর্চলাইট টার উপরে। ভ্রু কুঁচকে হাত বাড়িয়ে টর্চলাইটটা নিয়ে বুঝার চেষ্টা করে এই টর্চলাইটটা কার? তার তো এমন টর্চলাইট নেই তাহলে এটা কোথা থেকে আসল? ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই টর্চলাইট এখানে ছিল না তাহলে কি রাতে ঘরে কেউ এসেছিল। নুহাশের নজর পড়ে তার বাহুর উপরে যা দেখল তাতে সে স্তব্দ, বিমুঢ়। নিজের চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। তার বাহুতে এই লাল দাগটা কোথা থেকে আসলো? দেখে মনে হচ্ছে কেউ খামছি দিয়েছে শক্ত হাতে। ঘুমের মাঝে সে কোনো ভাবে খামছি টামছি দেয় নি তো। নুহাশ নিজের দু হাতের নখ গুলা চেক করে, না তার নখ এতটাও লম্বা নয় যে এভাবে নিজেকে নিজেই খামছি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করবে। কিন্তু কে এভাবে খামছি দিল? নুহাশ ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে পুরো রুমটা নজর বুলায়। ছোট বেলায় শুনতো গভীর রাতের আঁধারে নাকি জোয়ান, অবিবাহিত পুরুষদের সন্নিকটে নাকি কারা এসে ঘোরাঘুরি করে কোনো ভাবে কি তারা তার সাথে এমনটা করেছে। নুহাশ নিজের ভাবনাতে নিজেই চমকে উঠে। কি আবোলতাবোল কথা ভাবছে সে? এমনটা হয় নাকি আবার! এসব মনগড়া কথাবার্তা। কিন্তু এই দাগ, এই দাগ কোথা থেকে আসলো আর এই টর্চলাইটেই বা কি করে আসলো? কোনো ভাবে কি জারা রুমে এসেছিল। কিন্তু জারা রুমে আসলে এমন ভাবে খামছি দিবে কেন তাকে? না এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা আর ভাবতে পারছে না সে। ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। নুহাশ উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার দিকে পা বাড়ায়।

________

জাহিন শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। পুরো কপাল জুরে ভেজা চুল পড়ে রয়েছে তার। পড়নে টি শার্ট আর ট্রাউজার। হাতের ভেজা টাওয়ালটা চেয়ারের উপরে রেখে কপালের চুল গুলা হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসে বেডের দিকে। আস্তে করে বেডে উঠে কনুই বালিশের উপরে ঠেকিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল থুতনিতে আর তর্জনী ঠোঁটের উপরে রেখে এক নজরে তার সামনে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত রমণীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মৃদু হাসি। বার বার কিছু একটা মনে করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরছে। সময় গড়িয়ে যায় প্রায় দশেক মিনিট। অয়ন্তি ঘুমের মাঝে জাহিনের দিকে কাঁধ হয়ে ফিরে। গালে ছড়িয়ে পড়ে তার অবাধ্য চুল গুলা। জাহিন মুচকি হেসে তার বরফের মতো ঠান্ডা হাত দিয়ে অয়ন্তির গালে পড়ে থাকা চুল গুলা সরিয়ে দেয়। নজরে পড়ে অয়ন্তির বুকের উপরি ভাগের দিকে লাল হয়ে থাকা একটা দাগের উপরে। এই দাগ দেওয়ার মালিকটা যে সে আর বুঝতে বাকি নেই তার। জাহিন হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে লালচে হয়ে জায়গাটাতে হাত বুলায়। অয়ন্তি ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুঁচকে নেয়। চোখের পাতা নড়ে উঠে। ঘুমের মাত্রা পাতলা হয়ে আসছে তার। জাহিন হাত সরিয়ে নেয়। অয়ন্তি আধবোজা অবস্থায় চোখ মেলে তাকাতেই ঝাপসা হয়ে ভেসে উঠল জাহিনের হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা। অয়ন্তি পুনরায় চোখ বন্ধ করে পুরোপুরি ভাবে চোখ মেলে তাকায়। জাহিন ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে নরম কন্ঠে বলে।

“গুড মর্নিং মিসেস অয়ন্তি।”

অয়ন্তি কিছু একটা মনে পড়তেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সাথে সাথে নিজের মুখটা কম্বল দিয়ে ঢেকে ফেলে। জাহিন অয়ন্তির কাজ দেখে বড্ড অবাক হয়। কি হলো এটা? অয়ন্তি এমন করলো কেন? লজ্জা পাচ্ছে নাকি তাকে। জাহিন স্বব্দ হয়ে বসে রইল। অয়ন্তি কম্বলের নিচে চোখ, মুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে গত কাল রাত্রের সকল দৃশ্য। কি হয়ে গেল এটা তার সাথে? এবার জাহিনের সামনে সে এই মুখ কিভাবে দেখাবে? লজ্জায় তো মরেই যাবে? কানের মাঝে গতকাল রাতে জাহিনের বলা প্রতিটা মধুময় কথা প্রতিধ্বনি হচ্ছে। অয়ন্তি শুকনো ঢোক গিয়ে জিভ দ্বারা নিজের শুষ্ক ঠোঁটে জোড়া ভিজিয়ে নিল। বক্ষস্থলে উঠানাম অস্বাভাবিক ভাবে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাহিন গলা খাকারি দিয়ে নরম কন্ঠে বলে।

“কি হলো?”

অয়ন্তি ক্ষীণ গলায় বলল, “কখন উঠেছেন আপনি?”

“উমমম মিনিমাম এক ঘন্টা হবে।”

“এক ঘন্টা। এই ঘন্টা একা একা কি করেছেন আপনি?”

“দেখছিলাম।”

“কি দেখছিলেন?”

“আমার লজ্জাবতী বউকে। দেখি কম্বলটা সরাও মুখ থেকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হবে তো।”

জাহিন কম্বলটা সরাতে নিলে অয়ন্তি শক্ত করে টেনে ধরে কম্বল। যার অর্থ কম্বল সরাবে না সে। জাহিন এবার শক্তি প্রয়োগ করে কম্বলটা সরালো অয়ন্তি সাথে সাথে নিজের মুখ ঢেকে নেয় দু হাত দিয়ে। জাহিন নিঃশব্দে হেসে অয়ন্তির দু হাত তার মুখ থেকে সরিয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরে। অয়ন্তি চোখ, মুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। জাহিন অল্প ঝুঁকে আছে অয়ন্তির উপরে। নিজের ডান হাতটা অয়ন্তির গালে রেখে ধীর গলায় বলে।

“চোখ খুলো।”

অয়ন্তি মাথা দু পাশে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। জাহিন পুনরায় বলে, “কেন? লজ্জা পাচ্ছো বুঝি আমায়!”

অয়ন্তি দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। এই লোক তো মারাত্মক খারাপ। দেখচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে সে তারপরও বলছে লজ্জা পাচ্ছে কি না! জাহিন বুঝল এই মেয়ে এই মুহূর্তে চোখ খুলবে না। চোখ খুলার জন্য অন্য কিছু করতে হবে। জাহিন বলল।

“তা মিসেস অয়ন্তি আপনার লজ্জা কমানোর জন্য কি কি করতে হবে যদি বলে দিতেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।”

অয়ন্তি শক্ত গলায় বলল, “আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আপনি শুধু এই ঘর থেকে…।”

অয়ন্তি আর কিছু বলতে পারল না তার আগে তার অধরে শব্দ করে চুমু খেয়ে বসলো জাহিন। বড় বড় চোখ করে অয়ন্তি জাহিনের পানে তাকাল। জাহিন হেসে হেসে বলে।

“এই তো এবার চোখ মেলে তাকিয়েছো।”

দুজনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল। অয়ন্তির চোখের সামনে বাস্তব রুপে ভেসে উঠে গতকাল রাত্রের নানান দৃশ্য। অয়ন্তি লজ্জায় লাল হয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নজর সরিয়ে নেয়। জাহিন তর্জনী দ্বারা অয়ন্তির চুল গুলা কানে গুঁজে দিয়ে নরম গলায় বলে।

“কোনো সমস্যা হচ্ছে মানে কোনো ব্যথা ফিল হচ্ছে।”

অয়ন্তি দু পাশে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। জাহিন তা দেখে সন্দিহান গলায় বলে, “সত্যি বলছো তো।”

অয়ন্তি ক্ষীণ গলায় বলল, “হুমম।”

জাহিন অয়ন্তির কপালে চু’মু এঁকে দিয়ে বলে, “ঠিক আছে তাহলে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি নিচে যাচ্ছি।”

জাহিন রুম থেকে বের হয়ে যায়। অয়ন্তি তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে শুয়া থেকে উঠে বসে। কিন্তু তল পেটে ব্যথা অনুভূত হয়। সর্বাঙ্গে ব্যথায় জর্জরিত হয়ে গুঙিয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত শক্ত করে চেপে ধরল। জাহিনকে সে মিথ্যা কথা বলেছে, যদি বলতো সমস্যা হচ্ছে তার তাহলে লোকটা নিজেকে নিজেই দোষী সাব্যস্ত করত। আর এই ব্যথাটা সামান্য হওয়ারই কথা তাই আর কিছু বলল না। সময়ের সাথে সাথে এটা সয়ে যাবে। অয়ন্তি নিজের গা থেকে কম্বলটা সরাতেই আতকে উঠে। গায়ে তার শুধু জাহিনের শার্ট। ইস কি লজ্জা!

অয়ন্তি পুরো ঘর নজর বুলাল তার গতকাল রাতের পরিহিত কাপড় কোথায় গেলো? মনে হচ্ছে জাহিন গুছিয়ে রেখেছে। অয়ন্তি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতেই জাহিন রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। জাহিনকে হুট করে আসতে দেখে অয়ন্তি হকচকিয়ে উঠে সাথে সাথে বেডে বসে কম্বল দিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয়। কিন্তু ব্যথায় অর্তনাত করে উঠে। জাহিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল অয়ন্তির দিকে। এই‌ মাত্র কি হলো এটা? ব্যথায় অয়ন্তি চোখ মুখ খিঁচে রেখেছে। জাহিন দ্রুত পায়ে হেঁটে অয়ন্তির দু বাহু ধরে অধৈর্য গলায় বলল।

“কোথায় ব্যথা পেয়েছো?”

“আমি ঠিক আছি নেতা মশাই।”

জাহিন বড়োসড়ো ধমক দিয়ে বলে, “কোথায় ঠিক আছো? আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্যথায় চোখ, মুখ লাল হয়ে গেছে তোমার। আর আমাকে দেখে এত বিব্রত হওয়ার কি আছে বোঝলাম না। আমি তোমার স্বামী হই অয়ন্তি কোন পরপুরুষ নই।”

অয়ন্তি চুপ করে রইল। জাহিন এবার রাগটা নিয়ন্ত্রণে এনে আবলীলায় বলে উঠল, “আর নিজেকে এতটা আবৃত করার কিছু হয় নি। যা দেখার গতকাল রাতেই দেখে নিয়েছি তাই এতটা কষ্ট করার মানে হয় না উল্টে নিজে ব্যথা পাবে।”

অয়ন্তি চোখ বড় বড় করে হা হয়ে জাহিনের দিকে তাকায়। কি লোক রে বাবা? কিসব বলছে? জাহিন অয়ন্তির চাওনি উপেক্ষা করে অয়ন্তিকে পাঁজাকোলা তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলে।

“যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে ঔষধ খেতে হবে।”

কথাটা বলে থেমে গিয়ে পুনরায় বলে, “রুমে এসেছিলাম ফোনটা নিতে কিন্তু মনে হচ্ছে এসে বিরাট ভুল করে ফেলেছি।”

জাহিন আর কিছু না বলে চুপচাপ ফোনটা নিয়ে বের হয়ে যায়। অয়ন্তিও চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।

______

“মা কাইফ ভাই আসবে না আজকে তাহলে আমাকে কে নিয়ে যাবে কোচিংয়ে?”

জোহরা বেগম পরোটা উল্টে বলেন, “রিহানকে গিয়ে বল তোকে কোচিংয়ে দিয়ে আসার জন্য।”

“হুম তোমার ওই বাউন্ডুলে ছেলে বাড়িতে থাকলে তো বলব।”

“কি ও বাড়িতে আসে কি গত রাতে?”

“না বৃষ্টির জন্য নাকি আসতে পারি নি তাই বন্ধুর বাড়িতে থেকে গেছেন ওনি।”

“আচ্ছা দাঁড়া আমি দেখছি।”

জারার সামনে থাকা আহানের বলে লাথি মেরে বলে, “স্কুটি নিয়ে বের হতে মানা করে দিলো অনেক আগেই। এখন মনে হচ্ছে নিজেকেই চার চাকার গাড়ি চালানো শিখতে হবে।”

জাহিন সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে বলে, “কি শিখতে হবে?”

জারা পেছন ফিরে বলে, “গাড়ি ড্রাইভ করা।”

জাহিন কিছু না বলে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে পড়ে। জারাও ভাইয়ের পেছন পেছন গিয়ে ভাইয়ের পাশের চেয়ারে বসে আপ্লুত গলায় বলল, “ভাইয়া আমাকে গাড়ি ড্রাইভ করা শিখাবে।”

জাহিন গম্ভীর গলায় বলে, “না আগে আঠারো হোক তারপর।”

জারা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “আমার আঠারো হয়ে গেছে।”

“আরো বড় হো তারপর।”

জারা ঠোঁট ফুঁলিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর নিজ থেকেই বলল, “ভাবি আসবে না নিচে।”

“আসছে।”

জাহিনের ইম্পর্টেন্ট একটা কল আসাতে বাড়ির বাইরে চলে যায়। জারা এবার মাকে তাঁড়া দিয়ে বলে, “মা একটু জলদি জলদি নাস্তাটা দাও দেরি হয়ে যাবে তো আমার।”

এমন সময় জারার নজরে আসে নুহাশ সিঁড়ি দিয়ে নামছে এক্কেবারে ফিটফাট হয়ে। আহা কি মনোরম দৃশ্য। চোখ দুটো জুড়িয়ে এলো জারার। এই মনোরম দৃশ্যর মাঝে জারার মনে পড়ে যায় গত রাতের সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। মনের মাঝে অস্থিরতা কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এখনই নামতে হলো এই নুহাশকে! ভেবেছিল নুহাশের সামনে পড়বে না কিন্তু তা আর হলো কই? বেডা উপস্থিত ম্যাডাম বলতে চলে এলো। কিন্তু জারার অস্থিরতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহান দৌঁড়ে এসে বলে।

“আপু আমার টর্চলাইটটা কই? তোমার রুমে খুঁজে এসেছি পাই নি।”

জারা ভ্রুদ্বয় কুঁচকে বলে, “টর্চলাইট! কিসের টর্চলাইট?”

“ওই যে সোনালি রঙের টর্চলাইটটা তুমি ওই দিন নিলা যে ওইটা।”

জারা চোখ বড় বড় করে আহানের দিকে তাকায়। সর্বনাশ করেছে আহানের টর্চলাইটটা তো নুহাশের ঘরে সে রেখে এসেছে। কোনো ভাবে নুহাশের হাত পড়ে যায় নি তো টর্চলাইটটা? এবার কি হবে? জারা ভয়ে ভয়ে নুহাশের পানে তাকায়। নুহাশ ভ্রু কুঁচকে দুই ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যেটা ভেবেছে সেটাই হলো নুহাশের চেহারা সেটা সাক্ষি দিচ্ছে। আর এই বিচ্ছু আহান সকাল সকাল টর্চলাইট নিয়ে কেন পড়ল? পরীক্ষা শেষ তো তাই এই অবস্থা। আহান ভাবুক জারার হাত ঝাঁকিয়ে বলে।

“আপু কই রাখছো টর্চলাইটটা তুমি?”

জারা মলিন হেসে বলে, “আছে রুমেই আছে আমার। তুই ভালো করে খুঁজিস নি তাই পাস নি।”

“ঠিক আছে তুমি চলো আমাকে খুঁজে দাও।”

“পরে খুঁজে দিব এখন তুই খেতে বস।”

“না আমাকে এখনই‌ খুঁজে দাও।”

জারা রেগে কিছু বলতে নিবে সাথে সাথে নুহাশ বলে উঠে, “আহান এদিকে আয়। দেখ তো এই টর্চলাইটটা তোর কিনা।”

আহান দৌঁড়ে নুহাশের কাছে যায়। নুহাশ হাতে করে নিয়ে এসেছে টর্চলাইট’টা। নুহাশের কাছ থেকে টর্চলাইটটা নিয়ে খুশি হয়ে আহান বলে, “হুম এটাই তো। কিন্তু তুমি পেলে কই?”

নুহাশ ঘাড় ঘুরিয়ে জারার দিকে তাকাল। জারা ঢোক গিলে সাথে সাথে নজর সরিয়ে নেয়। নুহাশ মুচকি হেসে বলে, “আমার রুমের সামনে পড়েছিল। হয়তো কোনো ভাবে তোমার বোন ভুলে আমার রুমের সামনে রেখে দিয়ে গেছে।”

আহান আর কিছু না বলে নাচতে নাচতে চলে যায়। জারা কাচুমাচু হয়ে বসে রইল। কিভাবে কথা বলল? নুহাশ পকেটে হাত গুঁজে স্থির চোখে জারার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে সত্যি জারা তার রুমে এসেছিল রাতে। কিন্তু রুমে এসেছে ভালো কথা খামছি দিলো কোন দুঃখে তাকে? কিসের প্রতিশোধ নিলো এই মেয়ে?

______

জারা কোনো মতে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বলে, “মা আমি গেলাম।”

জোহরা বেগম বলেন, “এই দাঁড়া একা একা যাবি নাকি।”

“সমস্যা নেই আমি রিকশা করে চলে যেতে পারব।”

জারা চলে যেতে নিবে সাথে সাথে জাহিন গম্ভীর গলায় বলে, “দাঁড়া নুহাশ তোকে দিয়ে আসবে।”

জারা মাথায় পুরো আসমানটা ভেঙ্গে পড়ে। জারা থেমে থেমে বলে, “না ভাইয়া আমি রিকশা করে চলে যেতে পারব।”

জাহিন চোখ রাঙিয়ে বলে, “যেটা বলছি চুপচাপ সেটা মান। আর কয়েকদিন পর নির্বাচন তোকে একা ছাড়তে পারব না।”

জারা কিছু বলতে নিবে সাথে সাথে নুহাশ খাওয়া রেখে বলে, “চলো জারা তোমাকে দিয়ে আসি।”

জারা বিস্ময়কর চোখে নুহাশের দিকে তাকায়। অন্য সময় হলে তাকে নিতে ভনিতা করত আর আজকে এক্কেবারে এগিয়ে এগিয়ে আসছে। বেডা বজ্জাত। নুহাশ জারার পাশ কেটে চলে যাওয়ার সময় বলে।

“বাইরে অপেক্ষা করছি জলদি আসো।”

কি আর করার? জারা বাধ্য হয়ে নুহাশের পেছন পেছন গেল। যদি নুহাশ তাকে কোনো ধরণের প্রশ্ন করে তাহলে তার উত্তর হবে সে কিছু জানে না। কিচ্ছু জানে না মানে কিচ্ছু জানে না।

______

গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। জারা টেনশনে দু হাতের নখ খুটছে। আড় চোখে একবার নুহাশের দিকে তাকাল। কি সুন্দর নম্র, ভদ্র হয়ে গাড়ি চালাছে মানুষটা। কিন্তু তাকে কিছু বলছে না কে? হঠাৎ করেই নুহাশ গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়। যে রাস্তা দিয়ে তার কোচিংয়ে যাওয়ার কথা সেই রাস্তায় না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে চলছে গাড়ি। জারা অবাক হয়ে বলে।

“নুহাশ ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে নিলে কেন কোচিং এর রাস্তা তো ডান দিকে তাহলে বাম দিকে কেন যাচ্ছো?”

নুহাশ কিচ্ছু বলল না চুপচাপ এক মনে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে। জারা হাজারটা প্রশ্ন করল নুহাশকে কিন্তু কোনো জবাব এলো না তার প্রেক্ষিতে। এই লোক কি করতে চাইছে তার সাথে?

গাড়ি এসে থামে মস্ত বড়ো এক বিলের ধারে। বিলের চারিদিক নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা। সবুজের সমরোহ হয়ে আছে পুরো মাঠ। তাতে শিশির জমে আছে। মাঝে মাঝে দেখা মিলছে গুটি কয়েকজন কুপোত-কুপোতির। এই ঠান্ডার মাঝেও প্রেম করতে এসেছে ভাবা যায়। এরাই প্রকৃত প্রেমিক প্রেমিকা। জারা এসবে পাত্তা না দিয়ে মুগ্ধ নয়নে জায়গাটা দেখল। নুহাশ গাড়ি থেকে নেমে বিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। জারা অবাক হল তাতে। নিজে ডেং ডেং করে গাড়ি থেকে নেমে গেল কিছু না বলে। জারা নিজেই গাড়ি থেকে নেমে নুহাশের পেছনে‌ দাঁড়িয়ে বলে।

“আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছো নুহাশ ভাই? আমার কোচিং আছে।”

নুহাশ জারার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, “আমার উত্তর চাই।”

জারা ভীত গলায় বলল, “উত্তর! কিসের উত্তর?”

“তুমি সেটা খুব ভালো করেই জানো জারা।”

“আমি কিচ্ছু জানি না আর আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।”

নুহাশ নিঃশব্দে হেসে বলে, “আমার প্রশ্নের সকল উত্তর তোমার কাছে আছে জারা। আমি সহজ ভাবেই তোমাকে প্রশ্ন করছি আর‌ তুমিও সহজ ভাবেই সেই সকল প্রশ্নের উত্তর দিবে আশা করব।”

জারা নজর নিচু করে রেখেছে। নুহাশ এক পলক জারাকে দেখে প্রশ্ন করে, “আমার রুমে কেন এসেছিলেন তুমি গতকাল রাত্রে?”

জারা চটপটে গলায় বলল, “আমি তোমার রুমে কোন যাব শুধু শুধু।”

“মিথ্যা বলার চেষ্টা করো না জারা আমি যত গুলা প্রমাণ পেয়েছি তাতে তুমি আমার রুমে এসেছিলে সেটা একশো পার্সেন্ট সিউর।”

জারা কপট রেগে বলে, “আমি সত্যি বলছি আমি যাই নি।”

“রুমে এসেছো ভালো কথা কিন্তু আমায় খামছি কেন দিল আমার ঘুমের মাঝে? আমাকে এত রাতে খামছি দেওয়ার জন্য এসেছিল বুঝি আমার রুমে।”

জারা চমকে নুহাশের দিকে তাকায়। কি বলছে এই লোক? সে কখন খামছি দিল? জারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলে, “আমি কখন তোমাকে খামছি দিলাম আমি তো তোমার রুমে গিয়েছিলাম তোমার ফোন চেক‌ কর….।”

জারা চোখ বড় বড় করে নুহাশের দিকে তাকিয়ে দু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। মুখ ফসকে এটা কি বললে ফেললো সে? এত আগে আগে চলে কেন তার মুখ? নুহাশ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে জারার কথা শুনে। মেয়েটা তার ফোন চেক করতে এতো রাতে তার রুমে এসেছিল ভাবা যায়। নুহাশ সশব্দে হেসে বলে।

“তাহলে আমার ফোন চেক করতে এসেছিলে বুঝি আমার রুমে।”

জারা চোখ, মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিল। খুব বাজে ভাবে সে ধরা পড়ে গেছে নুহাশের কাছে। নুহাশ পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনের লক খুলে জারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে।

“নাও এখন চেক করতে পারো তুমি আমার ফোন।”

জারা অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকাল নুহাশের দিকে। নুহাশ বলতে শুরু করল, “ওই ফেইক অ্যাকাউন্টটা তোমার তাই না যে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার প্রেমিকা আছে কি না?”

জারা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কি বলা উচিত তার এখন? নুহাশ এত কিছু জানল কিভাবে? নুহাশ নিষ্প্রভ গলায় বলতে শুরু করল।

“আমার কোনো প্রেমিকা নেই। তবে একজন প্রেয়সী আছে যে এই মুহূর্তে আমার সামনে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার পানে।”

জারা হতবিহ্বল হয়ে বলে, “মানে?”

নুহাশ দু কদম এগিয়ে এসে কোমর বাঁকিয়ে জারার কানের কাছে মুখ নিয়ে মোলায়েম গলায় বলে, “দিনকে দিন তোমার পাগলামি বেড়ে যাচ্ছে জারা তাই তোমার পাগলামি বন্ধ করার জন্য স্বীকার করছি, ভালোবাসি আমি তোমায় আমার মনের গহীনে এত বছর লুকিয়ে রাখা পাগলি প্রেয়সীটাকে।”

জারা যেন নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছে না এটা কি সত্যি নুহাশ বলেছে নাকি স্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই এই সুন্দরতম স্বপ্নটা মিলিয়ে যাবে। যেটা জারা চায় না। সে মনেপ্রাণে দোয়া করছে আল্লাহর কাছে যেন এটা স্বপ্ন না হয় এটা যেন বাস্তবে হয়। জারার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে নুহাশ সোজা হয়ে জারার দিকে তাকিয়ে জারার গালে হাত রেখে বলে।

“কি হলো?”

জারা অস্ফুটে গলায় বলে, “তুমি মজা করছো আমার সাথে তাই না।”

নুহাশ মৃদু হেসে হতাশ হয়ে বলে, “আহ! জীবনের প্রথম কাউকে এতো আবেগ মিশিয়ে ভালোবাসার কথা বললাম আর সেই মেয়েটি বলছে মজা করছো আমার সাথে। কপালটাই মন্দ আমার।”

“সত্যি মজা করছো না তো‌ আমার সাথে।”

“এই‌ যে মিস শেখ‌ জারা আমি‌‌ মজা করছি না সত্যি বলছি কিন্তু?”

“কিন্তু কি?”

নুহাশ বিলের দিকে ফিরে উদাস গলায় বলল, “এই সম্পর্কটা পূর্ণতা হওয়ার নয় জারা। তুমি পাগলামি করছো। কেউ মেনে নিবে না এই সম্পর্ক।”

নুহাশের শান্ত, দৃঢ় কন্ঠে এমন কথা শুনে জারা মৃদু হাসলো আবেগী হয়ে বলল, “পাগলামি করে না হয় সবাইকে মানিয়ে নিবো।”

“তুমি জেনে শুনে বি’ষ পান করার দিকে অগ্রসর হচ্ছো জারা।”

জারা আগের ন্যায় বলল, “সবাই তো অমৃত পান করে আমি না হয় জেনে শুনে বি’ষ পান করলাম। সবার যে অমৃত পান করতে হবে এমনটা তো নয়। কাউকে না কাউকে তো বি’ষ পান করতে হবে। আমি না হয় এই বি’ষকে অমৃত হিসেবে পান করব।”

কথাটা বলে নুহাশের দিকে ফিরে কাতর গলায় বলে, “শুধু তুমি আমার পাশে থাকলেই হবে।”

কথাটা বলেই জারা নুহাশের কোমর দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিজের মাথাটা নুহাশের বক্ষস্থলে রেখে আবেশে চোখ বন্ধ করে বলে, “খুব ভালোবাসি তোমায় নুহাশ ভাই। প্লিজ ছেড়ে যেও না কোনো দিন। যদি ছেড়ে যাও তখন সত্যি সত্যি আমি পাগল হয়ে যাবো। আর তখন কিন্তু আমাকে পাবনার পাগলা গারদে পাঠাতে হবে।”

নুহাশ মুদু হেসে জারাকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। ভবিষতে কি আছে এটা ভেবে লাভ নেই। বর্তমানে এই মিষ্টি মধুর মুহূর্ত উপভোগ করা দরকার। ভেবেছিল কোনো দিন নিজের মনের কথা ব্যক্ত করবে না জারার কাছে কিন্তু তা আর হতে দিল কই এই মেয়ে। শেষমেষ এই মেয়ের পাগলামিতে পা দিতে বাধ্য হল নুহাশ। তবে এটা হওয়াতে তার জন্য ভালোই হয়েছে। বুকের মাঝে যেই পাথরটা এত বছর পড়ে ছিল সেটা সরে গেছে।

অদূরে নারকেল গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটি নুহাশ আর জারার দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রাখার মুহূর্তটা ক্যামেরা বন্দী করে নেয়। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তাদের ছবি তোলা হলো। ছবি তোলা শেষ হলে সমস্ত ছবি গুলা পাঠিয়ে দেওয়া হলো একটা নাম্বারে। লোকটি ছবি গুলা পাঠিয়ে নুহাশ আর জারার দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলে।

“আহারে এদের ভবিষতের কথা চিন্তা করেই কষ্ট হচ্ছে। আদৌ কি এদের প্রণয় পূর্ণতা পাবে।”

কথাটা বলেই লোকটি প্রস্থান করল এই স্থানটা। তার যা করার কথা ছিল সেটা করে দিয়েছে এবার বাকি কাজটা অন্য জনের হাতে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here