#নিশীভাতি
#৫৭তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)
তোমার ফাজলামি লাগছে সবকিছু? তুমি জানো কিসের বিনিময়ে তোমার মুক্তি এসেছে?”
“ফাইজানের প্রাণের বিনিময়ে”
বিকারহীন, জড়তাহীন উত্তর। সালমা নিজের ছেলের এমন উত্তরে থমকে গেলেন। রক্তশুন্য হয়ে গেলো মুখখানা। ভাত বাড়তে গেলেও হাত আটকে গেলো। মাকে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমান মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“কি হলো, ভাত দাও। দাঁড়িয়ে আছো যে! মুড়োটা ফাটাফাটি হয়েছে। দাও দাও, আরেকটু ভাত দেও”
শরীফা স্বামীর দিকে তাকালেন। তার মুখখানা কঠিন হয়ে আছে। ছেলেটা বড্ড বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যেনো। এমনটা তো সে ছিলো না। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকতো, কিন্তু কারোর মৃত্যুতে এমন বিকারহীন তো ছিলো না। সব ওই হুমায়রার জন্য। মেয়েটি অন্য ঘরে যেয়ে তার ছেলের জীবনটা একেবারে তছনছ করে দিলো। ছেলে কি না তার জন্য খুন করতেও বাধে না। এতে অবশ্য দেলোয়ার সাহেবের কৃতিত্ব অনেক। সালমার হাজার বোঝানোর পরও নিজের জিদকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। কি হতো হুমায়রার সাথে বিয়েটা হলে! অন্তত ছেলেটার জীবন কি এমন হতো? সালমার বুকখানা যেনো ভেঙ্গে গেলো। দেলোয়ার সাহেব ছেলের ঔদ্ধত্যে রাগী স্বরে বললেন,
“ফাইজান বেঁচে আছে ভুইলো না”
দেলোয়ারের কথা শুনে কুৎসিত হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো আমান। তার হাসি বদ্ধ দেওয়ালেও ভীতি তৈরি করলো। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, অপরাধবোধ নেই, বরং চামড়ার পরদে পরদে যেনো প্রগলভতা। মুখে ভাতের লোকমা পুড়তে পুড়তে বললো,
“মৃত্যুকে ক’বার এড়ানো যায়?”
ছেলের কথার মর্মার্থ ধরতে সময় নিলেন না দেলোয়ার সাহেব। থমথমে কন্ঠে বললেন,
“জেলে কিন্তু এতোদিন ছিলে, এমন কিছু কইরো না আবার তোমারে জেলে দেয়”
আমান গা এলিয়ে দিলো। বিশ্রী নোংরা হাসিটা এখনো তার ঠোঁটেই লেপ্টে আছে। অলস ভঙ্গিতে বললো,
“আমি করবো কেনো, একটা মশা মে’রেই শিক্ষা হয়েছে। আমি কিছুই করবো না। কিন্তু করার মানুষের অভাব নেই। এবার কি আমি আর আপনি কিছু করেছি? না তো, অথচ ঠিক ই ফাইজান এখন হাসপাতালে”
“ফাইজানের ঘরের খবর তো আমরাই দিয়েছি। ও যে নিজের ভাড়া বাসায় আছে সেই খোঁজ তো আমি দিয়েছি”
“তাই তো আমি বাহিরে। অবশ্য আমরা না বললেও তারা ঠিক জানতো, আপনি অহেতুক চিন্তা করেন আব্বা। ফাইজান তো ম’রবেই, আমরা কেনো লাভ নিবো না? ও বেঁচে থেকেও কি লাভ হয়েছে বলুন? আপনার কি মনে হয় পুলিশের রাতে স্বপ্ন এসেছিলো আমি শফিকে খু’ন করেছি? শফির খু’নে কোনো প্রমাণ ছিলো না। কিন্তু প্রমাণও কোর্টে গেছে। কে করছে? ফাইজান একটা দুমুখো সাপ। ও আপনারে ভয় দেখায়ে ঠিকই ভোট হাতাইলো। ভোটে জিতে এখন মন্ত্রী হইছে। অথচ যখন সাহায্য করে ঋণ ফেরৎ দেওয়ার সময় এলো ঘুরে গেলো। কিন্তু দেখেন যাকে আপনি ধোকা দিয়েছেন সেই আমাকে সাহায্য করেছে। তাই বলছি ফাইজানকে ভয় পাবার কারণ নেই। ও কিচ্ছু করতে পারবে না। দেখতে থাকেন খালি, মই এ চড়তে চড়তেই সাপের পেটে গেলো বলে”
দেলোয়ার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সত্যি বলতে সেও ফাইজানের শেষ দেখতে চায়। কিন্তু ভয়ও হয়। অন্যের জন্য করা গর্তে না নিজেই পড়ে যায়। সাপ লুডো খেলায় তো যে কেউ ই সাপের পেটে যেতে পারে।
******
ফাইজানের বেডের পাশের চেয়ারে বসে আছে ফরিদ। সামনের টেবিলে ছবিটি রাখা। ফরিদের মুখখানা মলিন। ফাইজানের ড্রেসিং শেষ হলো মাত্র। হাতের বেল্ট টা খুলে রাখা হয়েছে। তাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে আধশোঁয়া করে। তাই ফরিদের মুখখানা দেখতে পাচ্ছে না ফাইজান। অবশ্য ফরিদের মুখখানা দেখতেও তার ইচ্ছে হচ্ছে না। সে শুধু জানতে চায় একটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা চাই তার। ফরিদ অপ্রতীভ স্বরে বললো,
“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?”
“করাটা কি অস্বাভাবিক?”
“না”
বলেই থামলো ফরিদ। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো,
“দেলোয়ার সাহেব আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিলো। উনি দিশেহারা ছিলেন। আমি চাই নি তিনি তোমার বিরুদ্ধে চলে যান”
“তুমি আমানকে বেইল পাওয়াতে সাহায্য করেছো?”
সাথে সাথেই প্রতিবাদ করলো ফরিদ,
“আমি আমানকে বেইল পাওয়াতে সাহায্য করি নি। তুমি নির্দেশ না দিলে আমি কিছুই করবো না।“
“কিন্তু তুমি তো চাইছিলে যেনো আমি মামাকে সাহায্য করি”
“অস্বীকার করবো না, কিন্তু আসলেই আমি চেয়েছিলাম। শত্রুর অভাব নেই, অহেতুক কেনো শত্রুতা বাড়ানো? তোমার আজকের অবস্থাও তো শত্রুতার জের ধরেই”
ফরিদের কথাটা শুনে দুর্বোধ্য হাসি তার ঠোঁটে অংকিত হলো। শানিত স্বরে বললো,
“শত্রুতার ভয়ে কালসাপ তো পোষা কি সমুচিন? আজ তোমার সাথে আমার বিবাদ হলে তো তুমিও আমার শত্রু হবে, সেই শত্রুতার ভয়ে তোমার অন্যায়কে আপোষ করে নেওয়া কি যথার্থ?”
“আমি অন্যায় করি নি ফাইজান”
শক্ত গলায় উত্তর দিলো ফরিদ। ফাইজান কিছু সময় মৌন রইলো। তারপর শীতল স্বরে বললো,
“আমি চাই তোমাকে বিশ্বাস করতে ফরিদ ভাই। আমার আপন মানুষ কিন্তু হাতে গোনা। তুমি তাদের একজন। তোমাকে সন্দেহ করাটাই আমার জন্য মৃত্যুর সমকক্ষ যন্ত্রণা। তাই আমাকে ঠকিও না। যদি কখনো আমাকে কাঠগরায় দাঁড়িয়ে শাস্তি দেবার ইচ্ছে থাকে নিজ হাতে দিও। আমি মাথা পেতে নিবো। কিন্তু কাপুরুষের মতো পেছনে আঘাত করো না। সইতে পারবো না”
ফরিদ কিছু বললো না। হাসপাতালের কেবিনটিতে দাপিয়ে বেড়ালো বিশ্রী নীরবতা, শীতলতা। ফরিদ উঠে দাঁড়ালো। যাবার সময় শুধু একটি কথাই বললো,
“জীবন থাকতে আমি তোমাকে ঠকাবো না ফাইজান”
বলেই সে বেড়িয়ে গেলো। পাছে তার অশ্রু লোকের নজরে পড়ে যায়। কেবিনের দরজায় হুমায়রার সাথে দেখা হলো। হুমায়রা ফরিদকে দেখেই শুধালো,
“চলে যাচ্ছেন ফরিদ ভাই?”
ফরিদ অশ্রু আড়াল করে বললো,
“ফাইজানের দিকে খেয়াল রেখো”
********
বাজারে ঠিক রাশাদের পাশেই মুদির দোকান দিয়েছে কাওছার। বেশ রমরমা ব্যবসা। সামনে রোজার জন্য লালে লাল যেনো। রাশাদ বুঝতে পারলো না কাওছারের কাছে এতো টাকা কোথা থেকে এলো? বাজারে এতো বড় দোকান দেবার মতো টাকা তার কাছে ছিলো না। কাওছার তাকে দেখলেই নিজের দোকানের টাকার ড্রয়ারে হাত দেয়। দেখিয়ে দেখিয়ে টাকা গুনে। রাশাদ অবশ্য এসবে মাথা ঘামায় না। তবে আজ বিরক্তির শেষ পর্যায়ে চলে গেলো যখন কাওছার তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
“আমারে আমার বাড়ির থেইক্যা বাইর কইর্যা ভাবছে আমারে পথে আনবে। ফকিন্নির পুতে তো জানে না কাওছার কি জিনিস? আমার হক মারা এত্তো সোজা? আমার বাপে তো জানতো না ফয়িন্নির পুতের আসল পরিচয়। নিজের নাতী ভাইবে সব চোখ বন্ধ কইরে লিখে দিছে। কিন্তু রক্ত লাল হইলেই যে নিজের হয় না হেইডা তো আর জানতো না। কিন্তু আমি এর শেষ দেইখ্যা ছাড়ুম”
কাওছার কথাটা এতোই জোরে বলছিলো যে রাশাদ কান অবধি গিয়েছে। মিঠু রেগে এগিয়ে যাতে নিলে রাশাদ তাকে বাধা দেয়। ইশারায় বুঝায় শান্ত হতে। সে জানে তাকে রাগানোর জন্যই কাওছার এমন প্রলাপ গাইছে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই কাওছার সম্মুখের প্রবীন মানুষটি বলে উঠলো,
“কাওছার ভাই, নিজের পোলার উপর এতো রাগ ভালা না”
“কিয়ের নিজের পোলা? ওই হারামী আমার নি? কার রক্ত কবে কে?”…………….
চলবে
[আসসালামু আলাইকুম, গল্প দুদিন দেই নি। কারণ আমি লিখতে পারছি না। কি লিখবো বুঝতে পারছি না। বাজেভাবেই এলোমেলো হয়ে গেছে আমার চিন্তাগুলো। ক্লান্ত মস্তিষ্কে কিছুই আসছে না কি করে গল্প শেষ করবো? তবে ইনশাআল্লাহ গল্প শেষ করবো। শুধু একটু ধৈর্য্য রাখবেন। ইনশাআল্লাহ অন্তিমে হতাশ হবে না]
মুশফিকা রহমান মৈথি