#গল্পঃ_অতুলনীয়া
#পর্ব |২১|
#লেখিকাঃ_দিশা_মনি
—
ফাতেমার কেস এখনো চলছে। কিন্তু সুরাহা মিলে নি। যেভাবে একের পর এক তার বিরুদ্ধে বড় প্রমাণ কোর্টে হাজির করা হচ্ছে তাতে অনেকে একপ্রকার নিশ্চিতই যে এই কেসটা সে হারতে চলেছে। গতকালই মোহনা ফারিয়াকে নিয়ে দেখা করে গেছে। নয়নাও প্রতিনিয়ত ফাতেমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তাকে উস্কানি দেয় এইসব নিয়ে। তবে ফাতেমা নির্বিকার। সে এখনো বিশ্বাস রাখে ন্যায়বিচারের প্রতি। আজকেও তাহাজ্জুদ এর নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল যেন সে সুবিচার পায়। এই দুনিয়ার না পেলেও আল্লাহর আদালতে যেন সবকিছুর সুবিচার হয়। ফাতেমা জানে এটাই হবে। এই দুনিয়ার ফয়সালা যাইহোক, আখিরে সেই শেষ হাসি হাসবে। তাই কোন কিছু নিয়েই সে মাথা ঘামাচ্ছে না। তার চিন্তা ছিল নিজের মেয়েকে নিয়ে, ফারিয়াকে নিয়ে। কিন্তু সেও তো এখন একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। তার ভাই-ভাবির তো কখনো সন্তান হবে না। ফারিয়া না-হয় তাদের সেই ফাঁকা স্থান পূরণ করুক!
পূর্ব আকাশে উদিত হয়েছে সূর্য। ফাতেমা সকালে ফজরের নামাজ আদায় করে কোরআন তিলওয়াক্ত করছিল। নয়নাকে কিছুদিন আগে অন্য একটা সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন ফাতেমার সাথে তার সেলে আরো তিনজন রয়েছে। এদের মধ্যে দুজন নতুন হলেও একজন পুরাতন কয়েদীও আছে। এই কয়েদীর নাম চম্পা খাতুন৷ মধ্যবয়সী এক মহিলা। বয়স বড়জোর ৫০ হবে। চুরির দায়ে এই বয়সে জেল খাটতে হচ্ছে। নয়নার সুমধুর কন্ঠের কুরআন তেলোয়াক্ত শুনে চম্পা খাতুন মুগ্ধ। নয়নার তেলোয়াক্ত শেষ হতেই তিনি বলে ওঠেন,
‘তোমার কন্ঠ খুব সুন্দর মেয়ে।’
ফাতেমা বিনিময়সহ মুচকি হাসে। চম্পা খাতুন বলেন,
‘আমি ভাবতেই পারছি না, তোমার মতো এত ভালো একটা মেয়ে জেলে কি করছে। আমি তো জন্মেছিলাম বস্তিতে। ছোট থেকে চুরি-ছিনতাই করে মানুষ হয়েছি। বিয়েও হয়েছিল এক দিনমজুরের সাথে। কিন্তু স্বামী সুখ জীবনে মেলে নি। সন্তানরাও খেতে দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে নিজের পেট চালানোর জন্য এই বয়সে এসেও পাপ করতে হয়েছে।’
ফাতেমা ভালো করে ওনাকে বুঝিয়ে বলেন,
‘আপনি চাইলেই ভালো কোন উপায়ে হালাল উপার্জন করতে পারেন। এসব পাপ কাজ আর না করাই ভালো। আখিরাতে এত পাপের মাশুল গুনতে পারবেন না।’
এরপর তাদের কথাবার্তা চলতে থাকে। হঠাৎ কথায় কথায় ফাতেমা চম্পা খাতুনকে জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা, এর আগে এই জেলে যে কয়েদী ছিল, মানে নয়না। তার কোন ব্যবহার কি আপনার সন্দেহজনক লেগেছে?’
‘ঐ মেয়ের কথা আর বলো না। ও তো পুরো একটা ক্রিমিনালের ক্রিমিনাল। জাত ক্রিমিনাল বললেও ভুল হবে না। আমার তো মনে হয় পুলিশদের সাথেও ওর ভালো যোগাযোগ আছে। পুলিশরাও ওর সাথে সমঝে কথা বলত আর মাঝে মাঝেই কাউন্টার সেলে নিয়ে গিয়ে কিসব বলত কিন্তু মনে হতো না কোন টর্চার করত বলে। একজন কয়েদীকে তো টাকা লেনদেনের ব্যাপারেও কথা বলতে শুনেছিলাম। যদিও জানি না কতটা সত্য।”
ফাতেমার সন্দেহ প্রগাঢ় হয়। সে বলে,
‘আচ্ছা, আজ থেকে কয়েক সপ্তাহ আগে। আনুমানিক তিন সপ্তাহ আগে রাতে কি কোন ব্যতিক্রম কিছু দেখেছিলেন আপনি?’
‘ব্যতিক্রম বলতে সেরকম কিছু দেখিনি৷ তবে…’
‘তবে কি?’
‘এক রাতের একটা ব্যাপার অদ্ভুত ছিল। তিন সপ্তাহ আগেই হবে। সেদিন খুব সন্ধ্যাতেই আমরা সবাই ঘুমিয়ে যাই। আমি সেদিন সবার আগে সকালে উঠে দেখি সবাই ঘুমিয়ে কিন্তু ঐ নয়না একা বসে ছিল। সাধারণত এত তাড়াতাড়ি ঘুমাই না আমি। তাই সন্দেহ হওয়াতে বাকি কয়েদীদের সাথে কথা বলি। তারাও জানায়, তারা খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছিল।’
ফাতেমার কাছে এবার যেন অনেক কিছুই পরিস্কার হয়৷ নয়নার কথা ভেবে সে বলে,
‘পাপ কখনো লুকানো থাকে না। তোর পাপও সবার সামনে আসবে৷’
৪১.
নেহা মির্জার ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে একটি আলিশান ঘরে। ঘুম থেকে উঠতেই সে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পায়। দেখতে পেয়েই সে বলে ওঠে,
‘তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ কেন? কি চাইছ কি তুমি?’
আগন্তুক বলল,
‘তেমন কিছু না। শুধু তোমায় আমার কথামতো কাজ করতে হবে। যেমনটা তুমি সবসময় করতে।’
‘তুমি তো আমাকে কাজ থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলে। আমায় মে** ফেলার ট্রাই করেছিলে। তাহলে এখন হঠাৎ এমন উল্টো সুরে কথা বলছ কেন?’
‘এত কথা তো শুনতে চাই না। তুমি যদি বেঁচে থাকতে চাও তাহলে আমি এখন যা যা বলছি তাই তাই করো। তোমাকে আমি আবারো কাজে ফিরিয়ে নেব। নতুন দমে কাজ শুরু করতে হবে।’
‘এর বিনিময়ে কি করতে হবে আমায়?’
‘বেশি কিছু না। এরজন্য শুধু আমার শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো বলতে হবে কোর্টে গিয়ে।’
‘কোর্টে?’
‘হ্যাঁ, কোর্টে সোহেলের মৃত্যুর কেইস চলছে। আর সেখানে তোমার কথায় বদলে যাবে অনেক কিছু।’
‘আমার কথায়? কিন্তু সোহেল তো..’
‘জানি, আমি সবটাই জানি।’
এরপর আগন্তুক থামে৷ একটা কাগজ ধরিয়ে দেয় নেহা মির্জার হাতে। অতঃপর বাকা হেসে বলে,
‘এটা হলো তোমার সংলাপ। এখানে যা যা লেখা আছে ঠিক তাই তাই বলতে হবে বিচারকের সামনে। ভালো করে মুখস্থ করে নাও।’
নেহা মির্জা দুদিকে মাথা নাড়ায়। বেঁচে থাকার জন্য তার যে এখন অন্য কোন উপায় নেই।
৪২.
প্রত্যুষ চৌধুরী উদাস মনে ফাহিমের সাথে একটা কফিশপে বসে ছিলেন। ফাহিম প্রত্যুষ চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার বোনটাকে বাঁচানোর কি সত্যি কোন আশা নেই?’
প্রত্যুষঃআমি বলবো না যে আশা নেই। কিন্তু সেটা খুবই ক্ষীণ। আমার মনে হয়, পরের হেয়ারিং এর ডেইটটাই শেষ ডেইট হবে। এরপরই বিচারক রায় দেবেন। কেন না এখনো অব্দি আমরা ফাতেমার জন্য বড় কোন এভিডেন্স জোগাড় করতে পারিনি।
ফাহিম হতাশ হয়। সে যে ছোট্ট ফারিয়াকে কথা দিয়েছে তার মাকে আবার তার কোলে ফিরিয়ে দেবে। তবে কি আর সেই কথা রাখতে পারবে না? প্রত্যুষ চৌধুরী তবুও শান্তনার হাত রাখে ফাহিমের কাঁধে। বলে,
‘আমি এরমধ্যে নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করব যেন ফাতেমার জন্য কিছু করতে পারি। আপনি একদম উদাস হবেন না।’
ফাহিম একটু পরেই কফিশপ থেকে চলে যায়। প্রত্যুষ চৌধুরী বিল মিটিয়ে তারপর একটা বস্তির দিকে রওনা দেয়। তার একটা পুরানো ক্লাইন্ট এই বস্তিতেই তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।
সেই ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করে সে কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলে। সেই ক্লায়েন্ট প্রত্যুষ চৌধুরীর সাথে অনেক ভালো ভাবে কথা বলেন, অনেক আপ্যায়ন করেন। কারণ প্রত্যুষ চৌধুরীই তাদের বস্তিকে ডিমোলিশ হওয়া থেকে বাঁচিয়ছে। আসলে এই বস্তিকে অবৈধ স্থাপনা উল্লেখ করে একটা বিরাট কোম্পানির মালিক এটা ডিমোলিশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এই প্ল্যান পুরো ফ্লপ হয়ে যায়। প্রত্যুষ চৌধুরী নিঃস্বার্থ ভাবে বস্তিবাসীর হয়ে কেইস লড়ে এবং জয়লাভ করে।
প্রত্যুষ চৌধুরী দেখা করে ফেরার পথে হঠাৎ একজন হুড়ি পড়া ব্যক্তির সাথে ধাক্কা খায়। এতে ব্যক্তিটার মুখ সামান্য নজরে আসে। লোকটা সরি না বলেই চলে যায়। প্রত্যুষ চৌধুরী বেশ অবাক হয়। এই অতীষ্ঠ গরমে হুডি পড়ে কে? আবার লোকটাকেও তার ভীষণ চেনা চেনা লাগে। কিন্তু মনে করতে পারে কে এই লোক। তারপর হঠাৎ করেই তার মুখের সামনে কারো মুখশ্রী ভেসে ওঠে। প্রত্যুষ চৌধুরী হতবাক হয়ে যায়। বিস্ফোরিত চোখে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে,
‘সোহেল..’
ততক্ষণে লোকটাও দৌড়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। প্রত্যুষ চৌধুরী দৌড়াতে থাকে তার পিছু।
(চলবে)…
#গল্পঃঅতুলনীয়া/#অতুলনীয়া
(সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন, পরবর্তী পর্ব নিয়ে খুব শীঘ্রই আসছি…)