#গল্পঃ_অতুলনীয়া
#পর্ব |২৪|
#লেখিকাঃ_দিশা_মনি
—
ফাতেমা জেল থেকে মুক্তি পাবার পর কয়েকটা দিন সুন্দরভাবে অতিবাহিত হয়েছে। ফাতেমার জীবনে এই ক’দিনে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ সে এখন অনেক শান্তিতে দিন যাপন করছে৷ জীবন যেন অনেক ঝামেলামুক্ত মনে হচ্ছে৷ ফাতেমা এখন অনলাইনে শাড়ির বিজনেস শুরু করেছে। এই জেলে যাওয়ার কারণে তার একটা সাপে বরই হয়েছে। অনেকেই তাকে চিনেছে এবং তার সংগ্রামের গল্পটা জেনেছে। তাই কাস্টমারের অভাব হয় না৷ ফাহিম,মোহনাও এখন তাকে সবসময় সাপোর্ট করে। তার এই ক্লাইন্ট একজন বড় বিজনেসম্যান। ফাতেমার কালেকশনে থাকা শাড়িগুলো তার অনেক পছন্দ হয়েছে। তাই তো তিনি ফাতেমাকে আরো কিছু শাড়ির অর্ডার দেন। ফাতেমা খুব খুশি হয়ে যায়। ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং শেষ করে সে ফারিয়াকে আনতে তার স্কুলের সামনে যায়।
স্কুল ছুটির কিছু সময় পর ফারিয়া বের হয়ে আসে। ফাতেমাকে ফারিয়ার কাছে যায়। ফারিয়া এসে ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে। ফাতেমাকে বলে আজ স্কুলে কি কি হয়েছে। ফাতেমা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনল।
ফারিয়াকে নিয়ে ফেরার সময় ফাতেমা হঠাৎ খেয়াল করে স্কুলেরই একটা বাচ্চা মাঝ রাস্তায় চলে গেছে। অন্যদিক থেকে একটা গাড়ি ছুটে আসছে। ফাতেমা ছুটে গিয়ে বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে নেয়। এদিকে নাজমা খাতুন(নুহাশ খন্দকারের মা) নিহার স্কুলের সামনে চলে এসে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যান। কারণ নিহার স্কুল তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে কিন্তু তার এখানে আসতে আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ওষুধের চোটে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। মাঝরাস্তায় জটলা দেখে তিনি ছুটে যান। তখনই শুনতে পান কিছু লোক বলাবলি করছে,
“আজ এই মেয়েটা না থাকলে বাচ্চাটার কি হয়ে যেত!”
ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে নিহাকে দেখে তিনি আতকে ওঠেন। নিহার নাম ধরে ডাকতেই নিহা তার দিকে ছুটে যায়। ফাতেমা উঠে দাঁড়িয়ে নাজমা খাতুনর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আপনি কি এই বাচ্চাটার কেউ হন? ও তো রাস্তার মাঝখানে চলে গেছিল৷ ভাগ্যিস আমি ঠিক সময় দেখে নিয়েছিলাম। এতটা কেয়ারলেস কেন আপনারা?”
নাজমা খাতুন বলেন,”তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মা। আমার নাতনিকে বাঁচানোর জন্য।”
“আপনি ওর ঠিকভাবে খেয়াল রাখবেন। মনে হয় খুব ভয় পেয়ে গেছে।”
নাজমা খাতুন মাথা নাড়ান। ফাতেমা তখন ফারিয়ার হাত ধরে সেখান থেকে চলে আসে। আসার পূর্বে নিহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এভাবে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করো না৷ যেকোন সময় যেকোন বিপদ ঘটে যেতে পারে।”
নিহা বুঝদার বাচ্চার মতো মাথা নাড়ায়। নাজমা খাতুন ফাতেমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“মেয়েটা কত ভালো! আজকাল তো এমন ভালো মানুষ পাওয়া কঠিন!”
৪৭.
নুহাশ খন্দকার থানায় ছিল। পুরাতন একটা কেইস হিস্ট্রি চেক করছিল। এমন সময় হঠাৎ থানায় হট্টগোলের শব্দে নুহাশের ধ্যান চ্যুত হয়। কি হয়েছে দেখার জন্য বেরোতেই দেখে থানার বাইরে দাঁড়িয়ে দুজন মধ্যবয়সী মানুষ জটলা পাকাচ্ছেন। নুহাশ খন্দকার এগিয়ে গিয়ে তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“কি হয়েছে টা কি?”
তাদের দুজনের মধ্যে থেকে একজন বলে ওঠে,
“স্যার, আমাদের মেয়েকে বাঁচান স্যার।”
নুহাশ খন্দকার বুঝতে পারে কোন বড় বিপদ হয়েছে। তাই সে তাদের দুজনের উদ্দ্যেশ্যে আবারো বলে,
“আপনারা শান্ত হোন। ভেতরে এসে বলুন কি হয়েছে। সবটা না জানলে তো আমরা কিছু করতে পারব না তাইনা?”
দ্বিতীয় লোকটি বলে,
“আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার। আমরা দুজনই প্রতিবেশী। আমাদের দুজনের মেয়ে সমবয়সী এবং দুজনেই অনেক ভালো বন্ধু। গতকাল তারা কোচিং করতে যাওয়ার পর আর ফিরে আসে নি। আমরা অনেক যায়গায় খোঁজ নিয়েছি কিন্তু ওদের কোন খোঁজ পাইনি।”
“আপনাদের মেয়ের কোন প্রেমিক-টেমিক আছে কিনা খোঁজ নিয়েছেন?”
“আমাদের মেয়েরা একদম এমন নয় সাহেব। ওরা অনেক ধার্মিক, সবসময় পর্দায় চলাফেরা করে, নামাজ পড়ে। ওরা এমন কিছু করতে পারে না।”
নুহাশ ভাবনায় পড়ে যায়। মাথা চুলকে বলে,
“আপনারা থানায় জিডি করে যান। আমরা ব্যাপারটা দেখছি।”
“দয়া করে আমাদের মেয়েকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন স্যার।”
“আমরা চেষ্টা করব।”
বলেই নুহাশ থানার ভেতরে প্রবেশ করে। গভীর ধ্যানে কিছু চিন্তা করতে থাকে। এমন সময় তার সহকর্মী আতাউল হক বলে ওঠে,
“স্যার, ওনারা যাই বলুক, আমার তো মনে হয় ওনাদের মেয়েরা ভেগেই গেছেন। আজকালরা মেয়েরা উপরে যতোই ধার্মিকতা দেখাক ভেতরে ভেতরে ঠিকই..”
“আহ, আতাউল। কারো সম্পর্কে না জেনে এমন কথা বলা উচিৎ নয়। আর তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন এটাই প্রথম নয়, গত তিন-চার বছরে এলাকা থেকে এমন অনেক মেয়েই গায়েব হয়েছে। অথচ আমরা এখনো এর কোন কূল কিনারা করতে পারিনি। আমার মনে হয়, এখানে কোন চক্র জড়িত আছে।”
“কি বলছেন টা কি স্যার?”
“হুম।”
নুহাশের মুখভঙ্গি আরো কঠোর হয়। সে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। অতীতের কিছু কালো স্মৃতি মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় অর্পার সেই বুকফাটা আর্তনাদ,
“আমি মেয়েগুলোকে বাঁচাবোই নুহাশ। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও বাঁচাব।”
৪৮.
ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরার পর নুহাশ দেখতে পায় নাজমা খাতুন ভাত নিয়ে তার অপেক্ষাতেই ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। নুহাশ তার মার পাশে এসে বলে,
“এত রাত অব্দি জেগে থাকার কোন দরকারই ছিল না তোমার আম্মু। তোমার বয়স হয়েছে, নিজের শরীরের কথাও একটু ভাবো।”
নাজমা খাতুন হালকা হেসে বলেন,
“মায়ের মন, তুই বুঝবি না। সন্তানের চিন্তায় ঘুম আসে না। তুই এত রাত করে বাড়িতে ফিরিস। কিছু খাস কিনা সেটাও আমি জানি না। ”
নুহাশ খাওয়া শুরু করে। নাজমা খাতুন বলতে থাকেন,
“আগে যখন অর্পা ছিল তখন আমায় এত চিন্তা করতে হয়নি। ও যত্ন করে তোকে খাওয়াতো কিন্তু এখন..”
নুহাশ খাওয়া তাকিয়ে নিজের মায়ের পানে চায়। নাজমা খাতুন জিভ কে*টে বলে,
“আমি বোধহয় তোকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। কিন্তু কি করবো বল, ভুলতে চেয়েও তো পারি না। তোকে এভাবে দেখতে যে আমার একদম ভালো লাগে না নুহাশ। অর্পার মৃত্যুর পর প্রায় দুই বছর হতে চলল। তুই বুকে কষ্ট চেপে রয়ে গেছিস। নিজের কথা না ভাব, নিহার কথাটা একটু ভাব। মেয়েটাকে তো অনাথ আশ্রম থেকে এজন্যই নিয়ে এসেছিলি যেন ওকে মা-বাবার ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে পারিস। কিন্তু মেয়েটা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করছিস। আমি আর কতদিন আছি বল? তাছাড়া আজকে যা হতে যাচ্ছিল..”
“কি হতে যাচ্ছিল আজ?”
উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে নুহাশ খন্দকার। নাজমা খাতুন নুহাশকে সবকিছু খুলে বলে। সব শুনে নুহাশ অবাক। ভয় পেয়ে বলে,
“নিহার কিছু হয়নি তো?”
“না, ওর কিছু হয়নি। ভাগ্যিস মেয়েটা সঠিক সময় এসে বাঁচিয়ে নিয়েছিল।”
নুহাশ হাফ ছেড়ে বাঁচে। নাজমা খাতুন আবারো বলেন,
“নিজের জীবনটা নিয়ে এবার ভাব নুহাশ। সারাজীবন এভাবে একা থাকা সম্ভব নয়। জীবনে চলতে গেলে কারো সঙ্গের প্রয়োজন। ভরসার হাতের প্রয়োজন।”
নুহাশ খাওয়া শেষ করে উঠে বলে,
“আমি একা থাকতে শিখে গেছি আম্মু। আর যারা একা থাকতে শিখে যায় তাদের আর কারো সঙ্গের প্রয়োজন পড়ে না। তারা একা একাই সবকিছু মানিয়ে নিতে পারে।”
বলেই সে নিজের রুমে চলে যায়। নাজমা খাতুন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তুই মুখে যতোই বলিস, বাস্তবতা আলাদা রে নুহাশ। আমি মা হিসেবে তোকে সুখী দেখতে চাই। আর তোর সুখের জন্য যা যা করা প্রয়োজন আমি তাই করব। বেঁচে থাকতেই তোর একটা গতি আমায় করতেই হবে। নাহলে যে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাবো না।”
(চলবে)…
#গল্পঃঅতুলনীয়া/#অতুলনীয়া
(সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন, পরবর্তী পর্ব নিয়ে খুব শীঘ্রই আসছি…)