#হিয়ার_মাঝে ৬১.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। জানালার ফাঁক গলিয়ে জোছনার টিমটিমে আলো উঁকি দিচ্ছে জিতু নুবাহদের অন্ধকার রুমে। নুবাহ সাপের মত পেঁচিয়ে আছে জিতুকে। তার বুকে মাথা রেখে তারই অতীত শুনে যাচ্ছে। হঠাৎই তার গাড়ি দুর্ঘটনার কথা শুনে নুবাহ মুখে করুণ সুর তুলল। তার বোধশক্তি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। হুট করে চোখমুখ খিঁচিয়ে থরথর করে কাঁপছে তার সমস্ত শরীর। জিতুকে পেঁচিয়ে রাখা হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করল সে। চোখের জলে জিতুর বক্ষস্থল ভিজিয়ে শীতল করে দিচ্ছে। কান্নায় কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। শব্দগুচ্ছ উচ্চারিত হয়েও তা আর স্পষ্টত বেরুলো না, শুধু গোঙ্গানির শব্দই ভেসে আসছে। জিতু নুবাহর এমতাবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল। দ্রুতই নুবাহকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বসালো। দু’গালে হাত রেখে বলে উঠল,
‘নুবাহ চোখ খুলো, এভাবে কাঁদবে না। দেখ, আমার কিছু হইনি। এই যে তোমার চোখের সামনে বসে আছি। এই বোকা মেয়ে তাকাও।’
নুবাহ যেন নিথর এক মূর্তি মানবী। জিতুকে ঝাপ্টে ধরল আরও দৃঢ় করে। হাউমাউ করে শব্দ তুলে কেঁদে যাচ্ছে। চোখের জল বাধাহীন ভাবে গড়িয়ে পড়ছে তার দু’গাল বেয়ে। জিতু দিগ্বিদিক শূন্য। অসহায় হয়ে নুবাহকে আঁকড়ে ধরল। কন্ঠে তার কাতরতা। ফের বলে উঠল,
‘তুমি সহ্য করতে পারবে না বলে আমি বলতে চাইনি। বোকা পাখি দেখ, আমার কিছুই হইনি। তোমার ভালোবাসার জোরে বেঁচে গেছি। এভাবে সারাজীবন পাশে থেকো। দেখবে আমার কিচ্ছু হবে না। বলো থাকবে? আর হারিয়ে যাবে না।’
নুবাহর কান্নার বেগ কমলো না। উল্টো আরও দ্বিগুণ হল। দমবন্ধ হওয়ার মতই অবস্থা। হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। জিতু ফের অসহায় হয়ে পড়ল। কিভাবে নুবাহর কান্না বন্ধ করবে। এভাবে কাঁদলে মাথা ব্যথা করবে নির্ঘাত। কিছুসময়ের মাঝে অস্থির হয়ে যাবে তখন। তাই দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিল। কালক্ষেপণ না করে নুবাহর ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরল নিজের ওষ্ঠদ্বয়ে। গভীর চুম্বনে লিপ্ত হল সে। দীর্ঘসময় অতিক্রান্ত করল এভাবে। নুবাহ ধীরে ধীরে শান্ত সুস্থির হতেই তার ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে দিল। দু’গালে হাত রেখে ফের বলে উঠল,
‘এভাবে কাঁদলে কখনো আর কিছু বলবো না তোমাকে।’
নুবাহর শীতল ঘোলাটে দৃষ্টি। দু’চোখ থেকে আপনা আপনি জল গড়ালো। জিতু চোখের জল মুছে বুকের মাঝে ঝাপ্টে ধরে আছে। এই ভয়ে বলতে চাইনি তার অতীতের কালো স্মৃতিগুলো। তার বোকাপাখি সহ্য করতে পারবে না। এটা তো তার জানায় ছিল। নুবাহ এখানো নীরবে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। ঘড়ির কাটায় ভোররাত ৪টা। জিতুর মুঠোফোন আচমকাই কর্কশধ্বনি তুলল। সে প্রচন্ড অবাক হল। এত রাতে কে কল দিল তাকে। ছোট টেবিল থেকে মুঠোফোন হাতে নিতেই অবাক। চিন্ময়ের মামার কল, তাও এত রাতে। বিস্মিত হল বেশ। দ্রুত কল রিসিভ করল।
ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন এক কন্ঠ শোনা গেল। শাহাদাৎ ধরা গলায় বলল,
‘আগেই দুঃখিত বলে নিচ্ছি, এত রাতে কল দিয়ে বিরক্ত করার জন্য। মামা, চিন্ময়কে একটু ডেকে দিবে।’
জিতু কেমন সন্দিহান। তড়িঘড়ি বলে উঠল,
‘মামা কোন সমস্যা হয়েছে?’
‘আসলে সোনিয়া তার ছেলেকে খুঁজছে। আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে, ভাইজান আমার চিমু কই? আমি অনেক বাহানা দিয়েছি কিন্তু এখন আর ধরে রাখতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে কল দিলাম। চিন্ময় কল ধরছে না, বোধহয় সাইলেন্ট করা।’
‘আচ্ছা, আঙ্কেল আমি দেখছি।’
জিতু বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইল। কিন্তু নুবাহ তাকে শক্ত করে ধরে আছে। সে অনুরোধ করল, আমি চিন্ময়কে ডেকে আবার চলে আসছি। নুবাহর হেলদোল নেই। সে এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জিতুকে শক্ত করে ধরল। গলার স্বর তার অস্পষ্ট। জবাবে বলল, আ,,আমিও যা,,যাবো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জিতু। মেয়েটা বড্ড ভয় পেয়ে আছে। কেমন বাচ্চাদের মত আচরণ করছে এখন। তাদের পাশের রুম বন্ধুমহলের। সে বিছানা ছেড়ে না উঠে সানিকে কল দিল। কিন্তু রিসিভ হল না। মুবিনকে কল দিল। কয়েক রিং হতেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে জবাব দিল সে,
‘কি ব্যাপার জিতু? এত রাতে কেন কল দিলি?’
‘চিন্ময়কে ডেকে দে তো, বল ওর মামা কল দিয়েছে।’
মুবিন কিছু হতচকিত হল। এত রাতে ওর মামার কল। নিশ্চয় কোন সমস্যা হবে। সে দ্রুতই চিন্ময়কে ডাকল। দু’য়েকবার ডাক দিতেই চিন্ময় শোয়া থেকে উঠল। মুবিনের কাছে তার মামার কলের কথা শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠল। সে মরার মত ঘুমাচ্ছিল এত সময় ধরে। মুখ ফসকে বলে উঠল, মায়ের ব্যথা আবার বেড়ে যায় নিতো?
মুবিন কিঞ্চিৎ অবাক হল,
‘তোর মায়ের কিসের ব্যথা?
চিন্ময় থতমত খেল। সত্যিটা লুকাতে গিয়েও পারল না। বলে উঠল,
‘আম্মা হাসপাতালে। আচমকাই পেটের ব্যথা, বমি শুরু হয়েছে। তাই সন্ধ্যার সময় ভর্তি করানো হয়েছে। তুই আবার জিমান জিতুকে বলতে যাস না। দু’জনেই শুনলে এখনই ছুটে চলে যাবে।’
মুবিন দু’চোয়াল শক্ত করল। হুট করে এসে চিন্ময়ের একগালে কষে থাপ্পড় লাগাল। রুক্ষ ভাষায় জবাব দিল,
‘তোর মত এরকম বেয়াদব আমি দ্বিতীয়টা দেখিনি। মায়ের অসুস্থতা নিয়েও লুকোচুরি। আরে তোর মা অসুস্থ, এটা তুই আমাদের থেকে লুকিয়ে যাচ্ছিস। এরকম আরেক দিন করলে বন্ধুত্ব ঐখানেই শহীদ করে দেব। সামনে থেকে মনে থাকে যেন, বেয়াদব।’
চিন্ময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বেরুতেই মুবিনও তৈরি হল তার সাথে যাওয়ার জন্য। চিন্ময় উচ্চবাচ্য করল না। মুবিনকে নিয়েই হাসপাতালের উদ্দেশ্য বের হল।
___
সকাল হতেই নতুন বউ নিয়ে তোড়জোড় শুরু সবার। তমা নাস্তার টেবিলে বসতে সবাই নুবাহকেও খুঁজল। নুবাহকে অনুপস্থিত দেখে জিমি গেল ডাকতে। কিন্তু নুবাহর জায়গায় জিতু উঠে এল। সে জিমিকে বুঝিয়ে বলল, নুবাহর শরীর খারাপ, সে নাস্তার টেবিলে যেতে পারবে না। রুমে দিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। জিমি চলে যেতেই দরজায় ফের টোকা পড়ল। জিতু দরজা খুলতেই দেখল তাদের পাকনা বুড়ি ইনশিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সে চাচীআম্মুকে দেখতে এসেছে। জিতু ভেতরে আসতে বলল। ইনশিয়া দৌড়ে নুবাহর পাশে এসে বসল। আধো আধো বুলিতে বলল,
‘চাতীআম্মু তোমার অতুক। তুমি বেতি বেতি তাওনা না কিনো?’
জিতু মুচকি হাসল। ইনশিয়াকে আরও শিখিয়ে দিল। বল, চাচীআম্মু তুমি এরকম উপোস থাকলে আমার ভাই-বোন অপুষ্টিতে ভুগবে। ইনশিয়া চাচার মত করে বলল,
‘চাতীআম্মু আমা,,আমায় ভাইবোন আ,,আ পুত্তিতে ভুব্বে।’
জিতু হেসে উঠল ইনশিয়ার কথা শুনে। নুবাহ পিটপিট করে তাকাল ইনশিয়ার দিকে। ইনশিয়া খিলখিল করে হাসছে। হঠাৎ করে হাসি থামিয়ে নুবাহর দিকে তাকাল। বিস্ময় ভরা চোখে বলে উঠল,
‘চাতীআম্মু তোমার থোত লক্ত কিনো?’
নুবাহ হা’ হয়ে ইনশিয়ার কথা শুনে। জিতু তড়িঘড়ি ইনশিয়াকে কোলে নিল। সে তার জবাব দিল,
‘তোমার চাচীআম্মুকে একটা ইয়া বড় ইঁদুর কামড় দিয়েছে। এজন্য রক্ত লেগে আছে।’
ইনশিয়া চোখ বড় বড় করে রাখল।
‘অ্যাহ,,বরো বরো ইঁদুর কামু দিছে।’
জিতু ফের হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ালো।
____
সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। সবাই হৈচৈ আর আনন্দে মাতোয়ারা। অথচো নুবাহ এককোণে নিথর হয়ে বসে আছে। ফোলা দু’চোখ আর বিবর্ণমুখ নিয়ে। তমা খুঁজতে খুঁজতে নুবাহর পাশে এসে বসল। এতটা মনমরা দেখে নুবাহকে জিজ্ঞেস করল,
‘কি হয়েছে তোর? এত মন খারাপ কেন?’
নুবাহ জবাব না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। তমা ফের প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘তুই কি জিতু ভাইয়ের বিষয় নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হয়ে আছিস?
নুবাহ তমাকে জড়িয়ে ধরল। চোখ জলশূন্য তার। কথাগুলোও অস্পষ্ট শোনা গেল।
‘তুই কি জানিস, জিতু ট্রাক দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েছিল। মরতে মরতে বেঁচে আছে আমার জিতু। হায়াৎ ছিল বলে তাই না তমা।’
তমা হ্যাঁ বলে কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ালো। ফের বলে উঠল,
‘তোর ঠোঁটের কোণে রক্ত জমে আছে। মনে হয় কামড়টা বেশি জোরে দিয়ে ফেলেছে জিতু ভাই। এজন্য বুঝি আজকের সকালের নাস্তা রুমে নিয়ে এসেছে তোর ফুল জামাই।’
নুবাহ যেন সব ভুলে লজ্জায় আড়ষ্ট হল। ছিঃ কি লজ্জা! কিন্তু সেও টিপ্পনী মারতে ভুলেনি তমাকে, ‘জিমান ভাই এজন্য বুঝি কামড় দেয় না, দাগের ভয়ে।’
তমার মুখে তখন লাজুক হাসি। জবাব দিল না আর সে।
___
হৃদি নীলাভ গল্পগুজব নিয়ে ব্যস্ত। বারান্দায় দু’জনেই বসে আছে। দুপুরের খাবারের জন্য তাদের ডাকা হল। জিমি এসে তাদের ডাকল। টেবিলে বসতেই হৃদির চোখ পড়ল সানির উপর। অতিরিক্ত ঘুমে চোখমুখ ফুলে আছে। রকিরও একই অবস্থা। কিন্তু বন্ধুমহলের বাকি সদস্যদের খুঁজে পেল না। তমা নুবাহর সাথে কথার প্রসঙ্গে উঠে এল চিন্ময়ের মায়ের অসুস্থতার কথা। শুনে খারাপ লাগল। চিন্ময়ের থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেও তার মায়ের প্রতি প্রগাঢ় টান তার। ছোনিয়া আন্টিকে ভীষণ ভালো লেগেছিল। কি সুন্দর মহিলা! কত সুন্দর করে কথা বলে। শুধু আফসোস মহিলা প্রতিবন্ধি। তার প্রবল ইচ্ছে জাগল চিন্ময়ের মা’কে দেখার জন্য। নীলাভকে রাজি করালো তার সাথে যাওয়ার জন্য। দু’জনেই বোরকা পরে যাবে। কিন্তু তার এই ইচ্ছেপূরণ আরও সহজ হল। যখন দেখল বন্ধুমহলের সবাই একসাথে যাচ্ছে চিন্ময়ের মা’কে দেখতে। হৃদি বেশ খুশি হল নিজমনে।
নুবাহ তমা তারাও তৈরি হল। সবাই এক গাড়ি করে বের হল হাসপাতাল যাওয়ার উদ্দেশ্য।
চলবে,,,,