#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া মেঘলা
ছাব্বিশ
চেস বোর্ড এর দিকে ভাবান্তর দৃষ্টিতে আঁখি ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে রুম্মন চৌধুরী৷ টান টান উত্তেজনা চলছে৷ ভাইপো কে কিস্তিমাত করার জন্য কতইনা বুদ্ধি আটছে কিন্তু সব কিছুতেই যেন ফলাফল শূন্য৷
ছাদের মাঝ বরাবর বসে দু-জন৷ এক জনের মাঝে কৌতুহলতা আরেকজনের চোখে মুখে উচ্ছ্বাসতা৷ পরিপক্ক খেলোয়ার না হলে কি এত আত্মবিশ্বাস থাকে? বসেছিলোতো শাহওয়াজ এর কক্ষেই, মিনারা যখন ডাকলো শুনে এসে ছাদে এসে বসেছে দু-জন৷ বাড়িতে হুট করেই ইলেক্ট্রিসিটি সমস্যা হওয়ায় অর্ধ খেলাতেই ছাদে এসেছে৷
কাল সন্ধ্যে বেলা লোডসেডিং হয়েছে, বাড়িতে জেনারেটর এর সু-ব্যাবস্থা থাকলেও এখন অব্দি ইলেক্টিসিটি না আসায় মিস্ত্রির কাছে জানতে পারে সমস্যা হয়েছে৷ গরমে কি আর বুদ্ধি খোলে? তাইতো এলো এখানে৷
ভাইপো যে বেশ বুদ্ধিমান বুঝতেই পারছে৷ এইটুকুনি ছেলে তার মত দাবাড়ুকে টেক্কা দিচ্ছে ভাবা যায়? আর হবেই বা না কেন? মা কে দেখতে হবে না?তার ভাবিরই ছেলে৷
মধুলতার সাথে কখনোই খেলায় জিততে পারতো না রুম্মন চৌধুরী৷ অথচ সে বড় বড় দাবাড়ু কে ও হারিয়ে দিয়েছে৷
কি লজ্জার ব্যাপার না? ছেলের কাছে হেরে যাচ্ছে সে৷ নাহ এ লজ্জা পাওয়ার আগেই পরের চাল টা বুঝে শুনে দিতে হবে৷ এ চাল গরবর হলেই জিতে যাবে শাহওয়াজ৷ কিন্তু পরের চালটা দিবে কি করে?
শাহওয়াজ এর দৃষ্টি রুম্মন চৌধুরীর চোখের দিকে৷ সে তার চোখকে অনুসরণ করছে তাইতো টেক্কা দিতে পারছে নয়তো কোনো কালেই সে ভালো দাবা খেলতে জানে না৷ মা শিখিয়েছে বিপরীত খেলোয়ারের চোখকে অনুসরণ করলেই দাবা খেলা সহজ৷
নিজের শুধু লক্ষ রাখতে হবে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সে কি করতে যাচ্ছে তার দৃষ্টি কোন দিকে বেশি৷ দাবা খেলার জন্য ভালো খেলোয়ার হতে হয় না স্কিল জানতে হয়৷
চোখের দিকে তাকালেই পরবর্তী চাল কি হতে পারে তার বোঝা যায়৷ অপরজনের মস্তিষ্কের সাথে কাটাকাটি করতে হবে৷ বিপরীত খেলোয়ার কোন দিকে তার গুটি চালানোর জন্য অগ্রসর হচ্ছে তা লক্ষ করতে হবে৷
দাবা বুদ্ধি দিয়ে খেলতে হয়, ভেবে চিনতে পদক্ষেপ ফেলতে হয়৷ তবেই প্রতিপক্ষ কে হারানো সহজ এবং খেলাটাও৷ মায়ের কথাই কাজে লাগছে৷
রুম্মন চৌধুরী যখন নিজের রাজা নিয়ে পরবর্তী চাল দিতে ব্যাস্ত আকষ্মিক অদ্ভুত এক প্রশ্ন কর্ণে পৌঁছালো৷ যআ শুনে থমকালো সে৷ খেই হারালো কেমন৷ মস্তিষ্ক যেন নিজের প্রতিক্রিয়া হারাচ্ছে! শাহওয়াজ বললো,
“প্রিয়দর্শিনী আন্টি কোথায় মেঝো বাবা?”
আকষ্মিক এহেন প্রশ্নে স্তম্ভিত হলো রুম্মন চৌধুরী৷ ভরকালো এলোমেলো হলো দৃষ্টি৷ দাম্ভিক মানুষ টা কে দূর্বল চিত্তের করলো৷ বিন্দু বিন্দু ঘাম ছুটলো শরীর থেকে৷ কম্পিত হস্তে বেখেয়ালি হয়ে গুটিটা রাখলো ভুল জায়গায়৷ রুম্মন চৌধুরী নিরব হয়ে রইলো কেমন৷ মৌনতার সাথে সঙ্গী আঁটলো৷ কি প্রশ্ন করলো ছেলেটা? হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?”প্রিয়দর্শিনী” নামটা কর্ণকুহর হতেই এক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো দৃষ্টিপটে৷
স্মৃতিচারণ হলো কিছু দৃশ্য,কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথা, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা৷ এত বছর পর ফের মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরন চালালো সেই নারী৷ ধ্যান জ্ঞান ফুলারো রুম্মন৷ এর মাঝেই সুযোগে কৌশলে শাহওয়াজ নিজের গুটিটা এগিয়ে নিয়ে গেলো৷ এইতো কিস্তিমাত৷ গুটি চালাতে চালাতে অদ্ভুত কন্ঠে বললো,
“চেক চেক চেকমেট”
বলেই গুটিটা জায়গায় রেখে উঠে দাঁড়ালো, তার এখানে আর কাজ নেই৷ উত্তর সে পাবে না শাহওয়াজ জানে,উত্তরের আশায় প্রশ্নটা করেনি৷ প্রশ্নটা করেছে এটা বোধগম্য হওয়াতে সামনে অনেক কিছু ঘটবে৷ শাহওয়াজ যে এ বিষয়ে অবগত তা জানাতেই প্রশ্নটা করেছে৷ উত্তর টা না হয় পরেই জেনে নিবে৷ বয়স তো বাড়ছে৷ মস্তিষ্ক কি আর এত কিছু সহ্য করতে পারবে? ধীরে সুস্থে কাজ করতে হবে৷ ভাবুক সে এক দু দিন৷ কোনো এক দিন না হয় সব শক্ত করে চেঁপে ধরে জেনে নিবে?
হিসেব নিকাশ তো এ বাড়ির মানুষের সাথে ঢের আছে৷ তিল কে তাল বানানো এ দের যে মুখ্য কাজ তা তো বুঝেছে৷ সে তালই ভাঙবে এবার শাহওয়াজ৷
শাহওয়াজ এর আপাতত খুব বেশি তাড়া নেই৷ এইতো খুঁটি গেরে বসতে পেরেছে, তারপর ভাবা যাবে কি হবে৷
মানুষ কতই না বোকা তাই না? ভাবছে তারা জোর
জবরদস্তি করে শাহওয়াজ কে এখানে থাকতে রাজি করেছে অথচ এ যে তার একান্ত পরিকল্পনা বুঝতেই পারলো না কেউ৷ এমনকি ঘুনাক্ষরে টের ও পেলো না৷ শাহওয়াজ কে জোর করে কিছুই করানো সম্ভব না৷
।।
শাহওয়াজ এর ঘরে উঁকি ঝুঁকি মারছে ময়ূরাক্ষী৷ শাহওয়াজ যে ছাদে আছে সে যানে৷ অভদ্র লোকটা আজ বাড়িতেই৷
লোকটাকে দেখলেই আজকাল তোলপাড় শুরু হয় বক্ষে তাইতো আড়ালে থাকে৷ এমন অনুভূতির সাথে পরিচিত না ময়ূরাক্ষী! চঞ্চল ময়ূরাক্ষীকে ঘরকুনো করে দিয়েছে৷
শাহওয়াজ এর কক্ষে আসার কারণ তার খরগোশ ছানা৷ তার বিড়াল ছানাটি হুট করেই অসুস্থ হওয়ায় সুস্থ হওয়ার জন্য রেহানের এক বন্ধুর কাছে রেখে আসে৷ বিড়াল ছানাটি ময়ূরাক্ষীর অনেক শখের ছিলো, তাইতো শখ করে নাম দিয়েছিলো চাঁদ৷ মানুষ ঠিকি বলে শখের জিনিস থাকে না৷ ভালোবাসার মানুষ গুলো ও জিনিস গুলো ময়ূরাক্ষীর থাকে না কেন? কান্নাকাটি করছিলো ময়ূরাক্ষী তখনি তা দেখে খরগোশ টা এনে দেয় রেহান৷
যদিও কারো জায়গা কেউ নিতে পারে না৷ তবুও ক্ষানিকটা মন ভালো করতে পেরেছে খরগোশ ছানা টি৷
খরগোশটা তার মতই ছটফটে সারাদিন দৌড় ঝাপের মাঝেই থাকে৷ দু-দন্ড বসেই না৷ ছটফটে স্বভাব তার!
সে দিন তো দাদিজানের ঘরে গিয়েও ঘর নোংরা করে ছিলো, দাদিজান তো তুমুল রেগে গিয়েছিলো৷ ভাগ্য ভালো সে দিন রেহান ভাই বাঁচিয়ে নিয়েছিলো৷ রেহান ভাই না থাকলে কেলেংকারি হতো৷
আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো ময়ূরাক্ষী, লোকটা নিচে গেলেও দরজা আটকে যায়৷ বেখেয়ালিতে আজ বোধহয় দরজা টা খোলা রেখে গেছে৷ আর এই সুযোগ বুঝে খরগোশ ছানাটা এখানে এসেছে৷ আচ্ছা ও কি জায়গা পায়নি আর? এর থেকে দাদির ঘরে গেলেও পারতো৷
কক্ষে ঢুকতেই সামনেই পেলো বাচ্চাটা কে, মখমলের কার্পেটের উপর শুয়ে আছে কি শান্তি করে৷
এ ঘরটিতে অদ্ভুত সুন্দর সুভাষ রয়েছে৷ রুমের সুগন্ধি ব্যাবহার করে শাহওয়াজ৷
হেটে বিছানার পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলটার ধারে গেলো এখানে থাকা ছবির মহিলাটি শাহওয়াজ এর মা তা ময়ূরাক্ষী জানেন৷ ইশ কি সুন্দর৷ তার গুনগান বড় মায়ের কাছে শুনেছে ময়ূরাক্ষী৷ ছবিটিতে হাত বুলিয়ে রাখলো জায়গায়৷ অতঃপর আশেপাশে দৃষ্টি বুলালো৷ এ বাড়ির প্রতিটা জিনিস থেকে এ ঘরের জিনিস গুলো বেশি যত্নে রাখা৷
হুট করে ভাবনার জগত কা’টলো৷ আরে সে যে বাঘের গুহায় আছে ভুলে গেলো কি করে? খরগোশ টা কে তুলে নিলো৷ বুকে চেঁপে ধরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনি মাথায় এলো শাহওয়াজ এর কাছে তো তার নুপুর জোড়া রয়েছে৷ মোক্ষম সময় নুপুর গুলো নেওয়ার৷ কিন্তু কোথায় আছে?
মৃদুলার কাছে শুনেছিলো ব্যাগে আছে৷ কিন্তু এখন তো নিশ্চয়ই ব্যাগে জামা কাপড় নেই? নিশ্চয়ই আলমারিতে? খরগোশটা নিয়ে আলমারির দিকে এগোবে ঠিক তখনি কর্ণপাত হলো পুরুষালী কন্ঠ,
“মন চুরি করে ক্ষ্যান্ত হননি মেয়ে? এখন আবার কি নিতে এসেছেন? নাকি আমায় চোখে হারাচ্ছেন?”
চমকালো ময়ূরাক্ষী, থমকালো ভরকালো৷ উর্না খানা এক হাতে চেঁপে ধরলো৷ বিস্মিত নয়নে পিছনে ঘুরলো৷ যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়৷ ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে এলো শাহওয়াজ৷ ফিসফিসিয়ে বললো,
“নুপুর খুঁজছিলে?”
আরেক দফা চমকালো ময়ূরাক্ষী৷ এ লোকটা আচ্ছা ধরিবাজ বুঝে ফেলেছে৷ ক্ষানিকটা পিছিয়ে গেলো শাহওয়াজ কে আসতে দেখে৷ শাহওয়াজ ও এগোলো ময়ূরাক্ষী খরগোশ টা ইশারা করে মিনমিনিয়ে বললো,
“ও ওকে নিতে এসেছি আমি৷”
শাহওয়াজ বাঁকা হেসে আরেকটু এগোলো৷ তাতে ময়ূরাক্ষীর পিঠ ঠেকলো আলমারিতে৷ শাহওয়াজ একই কন্ঠে বললো,
“দূরে যাওয়ার আর জায়গা নেই৷ এভাবে সব ক্ষেত্রে নিজ থেকেই থেমে যাবে তুমি৷ সব কিছু তোমায় আমার সান্নিধ্যে আসার সাহায্য করবে৷”
ময়ূরাক্ষী শুকনো ঢোক গিললো একটু সাহস সঞ্চার করে বললো,
“স সরে দাঁড়ান৷ যেতে দিন আমায় দরজা খোলা ছিলো ও ঢুকে গেছে৷ আর যদি ভেবে থাকেন নুপুর খুঁজছি তবে বেশ করেছি৷ আমার নুপুর দিচ্ছেন না কেন আপনি?”
শাহওয়াজ কিঞ্চিৎ দুরত্ব রেখে এক হাত আলমারিতে রাখলো ময়ূরাক্ষী মাথার উপর দিয়ে৷ মেয়েটা তার বক্ষের কাছে পরে পুচকে একটা মেয়ে৷ আরেক হাতে পকেট থেকে কিছু একটা বের করে সামনে ধরলো ময়ূরাক্ষীর৷ রুনঝুন শব্দ শুনে উপরের দিকে তাকাতেই নিজের নুপুর টা দেখতে পেলো হাত বাড়িতে নিতে যাবে ঠিক তখনি শাহওয়াজ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“যা আমার কাছে থাকে তা আমারি৷ আমার থেকে আমার জিনিস নেওয়া কখনোই সম্ভন না৷ ”
ক্ষুন্ন হলো ময়ূরাক্ষীর মন৷ মাথা নিচু করে রইলো৷ সামনে থাকা ছোটো ছোটো কেশ গুলো চোখেমুখে আছরে পরলো৷ তাতে শাহওয়াজ এর দেখায় ব্যাঘা’ত ঘটলো৷ হিংসাত্মক হলো মন৷ ঝুকে ফু দিয়ে সরালো চুল গুলো ফিসফিসিয়ে বললো,
“আপনাকে ছোঁয়ার অধিকার শুধু আমার ময়ূর৷ ”
ময়ূরাক্ষী জড়োসড়ো হলো আরো৷ এর মাঝেই পিছন থেকে মৃদুলার কন্ঠ শোনা গেলো,
“আপনি আবার বুবুকে চুমু খাচ্ছেন ভাইজান?”
হুট করেই এমন কথায় চমকালো দু-জন তারপরই ঘটলো সাংঘাতিক কান্ড পিছন থেকে কেউ চিৎকার করে বললো,
“হায় আল্লাহ অনর্থ হইছে ভাবি৷ ছোটো সাহেব আর ময়ূরাক্ষী একা ঘরে কিসব করছে….!!”
চলবে,