#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা
সাতাশ
এক ঘর লোকের সামনে বসে আছে শাহওয়াজ৷ মুখশ্রীতে গম্ভীর্যতা বিরাজ করছে৷ যেন না চাইতেই বসেছে এখানে৷ ক্রুদ্ধ তার দৃষ্টি, রুষ্টতার ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট৷
সে কাউকে জবাবদিহিতা করতে পছন্দ করে না ময়ূরাক্ষীর কথা ভেবে বসেছে এখানে৷
লোকে তাকে না পেরে মেয়েটা কে মন্দ কথা বলছে৷ সে পারলে জিব টেনে ছিড়ে দিতো৷ কিন্তু সে অধিকার যে আপাতত নেই তার৷
অনেকটা দূর গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে ময়ূরাক্ষী৷ তার পাশে রুপা দাঁড়িয়ে৷ বৈঠক খানায় আজ ভীর জমেছে৷ আকবর চৌধুরী বিব্রত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে থাকা কাজের মহিলাটির দিকে৷ সে ও বেশ লজ্জিত ছেলের সামনে বসে৷হুট করেই কি কান্ড ঘটে গেলো? বড় দের আলোচনায় আজ মৃদুলাও উপস্থিত৷
অন্য সময় তাকে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্ষুদ্র আলোচনাতেই৷ মা সব সময় বলে বড় দের আলোচনায় থাকতে নেই৷ বড় দের আলোচনায় থাকলে বেয়াদব বলে সবাই এবং এ কথাই মৃদুলা বিশ্বাস করে এসেছে সর্বদা৷
তাকে আজ রাখা হয়েছে জবানবন্দির জন্য, তা মৃদুলা জানে বেশ ভালো করে৷ বাচ্চা এক মেয়ের মনে কৌতুহলতা ব্যাপক আজ তাকে বড় দের মাঝে দাড় করানো হয়েছে আজ তাকে বেয়াদব বলবে না মানুষ ??
সবার ভাবনার মাঝেই ফোড়ন কাঁটলো নুর জামান চৌধুরী৷ কাটকাট কন্ঠে কটুক্তি-র স্বরে বললো,
“ভাইজান এবার জিগ্যেস করুন গোলাপি বুয়া কে৷ ও কি দেখেছে? কতক্ষণ যাবত এমনেই বইসা আছেন৷ আপনি কি কিছু বলতে চান না নাকি? লোকজন অপেক্ষা করতাছে নাকি নিজের ছেলে বলে কিছু বলছেন না?”
আকবর চৌধুরী নড়েচড়ে বসলো একটু৷ কতশত বিচার শালিসিতে ছিলো সে, বিচার শালিসি করেছেও সে আজ এমন লাগছে কেন?
ছেলে বলে? কিন্তু ছেলে যে নির্দোষ সে জানে৷ কি জবাব দিবে সে মধুলতার কাছে? ছেলেকে বাড়িতে রেখে অপদস্ত করেছে?
গোলাপি হলো মালির বউ৷ সে ও কাচুমাচু খেয়ে দাঁড়িয়ে, তার স্বামী ও তার উপর বেজায় ক্ষুব্ধ৷
খোদেজা বসে পান চিবোচ্ছে, এই গোলাপি বুয়ার উপর সে ও বিরক্ত আজ৷ মালির কথায় রাখলো এই মহিলাকে ওর জন্য সব ভাবনা ভেস্তে যাবে৷
খোদেজা পাশেই রাহেলা৷ পান চিবোতে চিবোতে খোঁচা দিয়ে নিচু স্বরে বললো,
“জামান রে চুপ করতে কও বউ৷ বেশি কথা কইতাছে ও৷ নিজের মাইয়ার ভবিষ্যৎ নিজে নষ্ট কইরা দিতাছে৷ ওইহানে যদি সত্যি তেমন কিছু হইয়া থাকে গোলাপি আর মৃদুলা যদি কিছু কয় জানো না কি হইবো?”
রাহেলার মস্তিষ্ক খুললো৷ আরে এ কি করছে তার স্বামী৷ সে ক্ষানিকটা৷ এভাবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল কে মারে? কাছে গেলো স্বামীর খোঁচা দিতেই সে পিছন ঘুরে চাইলো৷ অতঃপর চোখ গরম করে তাকালো সে৷ ইশারা বুঝলো না নুর-জামান৷ সে বললো,
“ভাইজান গোলাপিরে জিগান৷”
শাহওয়াজ মুষ্ঠিবদ্ধ করে বসে আছে৷ মুখ বুঝে সহ্য করছে শুধু সে৷
স্বামীর কথায় রাহেলা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে শাশুরীর উদ্দেশ্যে বললো,
“আম্মার আপনার পোলা জীবনেও বুঝবো না৷ একদম আপনার মত হইছে মাথা ভর্তি বুদ্ধি কিন্তু কোনোটাই কাজের না৷”
রাহেলার কথা খোদেজার কানে যাওয়া মাত্রই বিষম খেলো৷ চোখ রাঙিয়ে তাকালো, কিছু বলবে তখনি আকবর চৌধুরী গলা খাকারি দিয়ে বিচক্ষণী কন্ঠে বললো,
“মৃদুলা আম্মা ওইখানে গিয়া কি দেখছো কও তো? গোলাপি যা বলছিলো তা কি সত্যি?”
মৃদুলার ভাড়ি নেত্রপল্লব দু একবার ঝাপটালো এদিক ওদিক চাইলো৷ যা বুঝলো, ভাইজান আর বুবুকে নিয়েই আলোচনা বসেছে৷
কিন্তু গোলাপি বুয়া যা বলছে তা তো ঠিক না৷ সে তো দেখেছে ভাইজান বুবুর চুল ঠিক করে দিচ্ছিলো৷ কিন্তু এখন এটা বললেও চলবে না তাহলে সবাই বুবুকে অপমান করবে৷
সে অতশত না বুঝলেও এটা ঠিক বুঝে এসব বলতে নেই সবাইকে৷ মৃদুলা মাথা দু-দিক নাড়িয়ে না বোধক বুঝালো অতঃপর বললো,
“না বড় বাবা, বুবুতো খরগোশ ছানা আনতে গেছিলো ভাইজান ঘরে ছিলোনা৷ ভাইজান বের হতে গেছে তখন ধাক্কা খাইছে বুবুর সাথে৷”
বলেই দাদি জানের পানে তাকালো মৃদুলা৷ দাদির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি৷ অতঃপর ময়ূরাক্ষীর দিকে তাকালো সে৷ ময়ূরাক্ষী শাহওয়াজ বিস্মিত হলো৷ এইটুকু মেয়ের কি বুদ্ধি৷ কি সুন্দর গুছিয়ে কথা গুলো উলটে দিলো৷
শাহওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে ক্ষানিকটা হাসলো মৃদুলা৷ শাহওয়াজ এর দৃষ্টি এখনো বিস্মিত৷
আকবর চৌধুরীর চোখমুখ চিকচিক করে উঠলো৷ খুশির রেশ বিদ্যমান৷ সে জানতো তার ছেলে তেমন একদমই না৷ তার সাথে বাড়ির প্রায় সবার মুখে হাসির রেশ দেখা গেলো সবাই খুব একটা ময়ূরাক্ষী আর শাহওয়াজ কে পছন্দ না করলেও আজ বেজায় খুশি৷
ময়ূরাক্ষীর কথা চিন্তা করছে না, ওই মেয়ে চুলোয় যাক৷ রাহেলা, খোদেজার তো চিন্তা ছিলো শাহওয়াজ কে নিয়ে৷ এখন যদি মৃদুলা ইতিবাচক কিছু বলতো নির্ঘাত বিয়ে দিয়ে দিতো সবাই৷ যা চায় না ওরা দু-জন৷
সবাই খুশি হলেও খোদেজার বোন জোবেদার মুখ বাংলার পাঁচ এর মত হয়ে আছে৷ সে অখুশি এ বিষয়ে৷
আকবর চৌধুরি এবার গলা খাকাড়ি দিলো৷ গম্ভীর কন্ঠে গোলাপি বুয়া কে শুধালো,
“বুয়া এবার তুমি বলো কি দেখছো? তুমি কেন চিৎকার করে ওসব বলছিলে?”
গোলাপি কাচুমাচু খেয়ে স্বামীর পানে তাকালো৷ স্বামী তার উপর বেজায় রেগে আছে৷ তার ভাষ্যমতে ময়ূরাক্ষী মেয়েটা অনেক ভালো এবং ছোটো সাহেব ও৷ তার স্বামী এ বাড়ির বাগানে কাজ করে সে এক সপ্তাহ হলো এ বাড়িতে কাজ করছে৷
গোলাপি বুয়া মাথা নিচু করে নমনীয় কন্ঠে বললো,
“সাহেব ছোটো আপা ওইসব বলতেছিলো তাই আমি ভাবছি সত্যি সত্যি৷ আমি নিজ চোক্ষে কিছু দেখি নাই৷ মাফ করবেন আমায়৷”
আকবর চৌধুরী ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো গোলাপি বুয়ার দিকে৷ এত বড় সাহস এ মহিলার তার ছেলে কে নিয়ে মন্দ কথা বলেছে? না দেখে কেউ এত বড় কথা বলে?
মাথা কাটা যাচ্ছে ছেলের সামনে লজ্জায়৷ সে আজ বাড়িতে মিটিং ডেকেছিলো দলের লোকজন ভর্তি ছিলো বাড়িতে৷
তার ছেলেকে কি সব ভাবছে? কি সাংঘাতিক লজ্জার ব্যাপার৷ ভাবনার মাঝেই ঠাস করে শব্দ হলো৷ থা’প্প’ড় এর শব্দ! মালি তার স্ত্রীর গালে থা’প্পড় দিলো৷ সে স্ত্রীর কাজে লজ্জিত৷ সে প্রথম থেকে বলছিলো চুপ করতে৷ তার স্ত্রীর অভ্যাসই না দেখে কথা বলা৷ মালি এসে আকবর চৌধুরীর সামনে শির নিচু করে দাঁড়িয়ে বললো,
“মাফ করবেন জনাব৷”
মালি শেষ করার আগি আকবর চৌধুরী উঠে দাড়ালো৷ হুংকার তুলে মালি কে বললো,
“তোমার বউ কে এখান থেকে যেতে বলো মালি৷ ওকে যেন এ বাড়িতে আর না দেখি৷”
মালি কিছু বললো না সে ভাবতে পারেনি এভাবে স্ত্রী কে এখানে আনলে এসব করবে৷ মহিলা মানুষ আসলেই বেশি বাড়াবাড়ি করে৷ এ মহিলার জন্য সর্বদা তাকে ছোটো হতে হচ্ছে৷ মাথা নিচু করে প্রস্থান করলো স্ত্রী কে নিয়ে৷
মৃদুলাকে এখন ঘরে বলতে যাওয়া হলো৷ সে বুঝলো তার প্রয়োজন এখানে ফুরিয়েছে৷ কিন্তু তার ছোট্ট মাথায় প্রশ্ন দাদি তো ময়ূরাক্ষীকে দেখতে পারে না৷ দাদি কেন শিখিয়ে দিলো? শাহওয়াজ ভাই জান এর জন্য?
আসলেতো মৃদুলা তেমন কিছুই দেখেনি৷ শাহওয়াজ শুধু চুমু খাওয়ার কথা বলে তাইতো শুধাচ্ছিলো তখন৷ শাহওয়াজ ভাইজানের চুমুতেইতো ময়ূরাক্ষী বুবুর জ্ঞান ফিরেছিলো৷
বৈঠকখানায় ভীর কমলো৷ গুঞ্জন ও কমলো অনেকে ময়ূরাক্ষী শাহওয়াজ কে ভুল বুঝেছিলো তারাও বুঝলো আসলে দোষ এখানে কারোই না৷ আজকাল বাচ্চারা যে কি পাঁকা যা মুখে আসে তাই বলে৷
আকবর চৌধুরী ছেলেকে কিছু বলবে তার আগেই শাহওয়াজ তার সামনে দাঁড়িয়ে কাটকাট কন্ঠে বললো,
“এখানে ইচ্ছে ইচ্ছে করে অপদস্ত করার জন্য আমায় রেখেছেন তাই না? আমি যদি সে কাজ টা করেও থাকতাম কখনোই জবাবদিহিতা করতাম না৷ ময়ূরাক্ষীর কথা ভেবে শুধু এখানে বসেছি আমি৷”
বলে একবার দূরে থাকা ময়ূরাক্ষীর পানে তাকিয়ে হনহনিয়ে উপরে চলে গেলো৷ সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো৷ ঘটনা যে হীতে বিপরীত হয়নি এটাই অনেক বড় ব্যাপার৷
সবায় আস্তে আস্তে বৈঠক খানা ছাড়লো৷ ময়ূরাক্ষী ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো অদুরেই৷
,,
পুকুর পারে বসে কাঁচা আমে লবন লাগিয়ে মুখে পুরলো রুপা৷ কনকনে রোদ৷ বিকেল তবুও রোদের উত্তাপ যেন কমার নামই নিচ্ছে না৷ সূর্য আজ এত ক্ষীপ্ত কেন তাই বুঝতে পারছে না৷
ক্ষতের কারণে মা দাদি টক খেতে পই পই করে নিষেধ করেছে কিন্তু কে শুনে কার কথা?
ক্ষত তেমন শুকায়নি, কবে শুকাবে কে জানে? ততদিন কি আম থেকে দূরে থাকা যায়? পাশেই ক্ষুন্ন মনে বসে আছে ময়ূরাক্ষী৷ কেন ক্ষুন্ন তার মন সে বুঝতে পারছে না, সে ঘটনার তো সুরাহা হয়েছে তবুও কেন?
একটা আম শেষ হতে না হতেই গাছের দিকে ফের লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালো রুপা৷
অতঃপর ময়ূরাক্ষীর দিকে তাকিয়ে বললো ময়ূর আরেকটা আম পেরে দে না? এটা অনেক ছোটো ছিলো তার উপর অর্ধেক ভাগ মৃদুলা নিয়ে তাতে কি হয়?
মৃদুলা টক খেতে পারে না৷ এক বার মুখে দিচ্ছে চোখ মুখ কুঁচকে আসছে আবার বেশ কিছুক্ষণ পর আরেকটু খাচ্ছে৷ ময়ূরাক্ষীর আগে মৃদুলাই বললো,
“আমি শাহওয়াজ ভাইজান রে বইলা দিমু৷ বড় মা রে বইলা দিমু তুমি টক খাইতেছো৷ একটা খাইয়া আবার চাও কেন?”
ময়ূরাক্ষীও সায় দিলো মৃদুলার কথায়৷ বললো,
“একটা খেয়েছো এটাই অনেক আর খেতে হবে না বুবু৷ পরে সবাই আমাকেই বকবে৷”
রুপা বুঝলো ওরা কেউ পেরে দিবে না৷ভেবে ছিলো এখানে এসে মেয়েটার মন ভালো করবে কিন্তু তা হচ্ছেই না৷ গুলাইল টা সামনেই পরে আছে৷ গুলাইল টা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“কেউ বকবে না৷ আর সবাই জানবে কি করে? তোরা যদি মুখ বন্ধ না রাখিস তোদের গর্দান নিবো আমি৷ আর তোদের পেরে দিতে হবে না আমিই পারবো৷”
বলে বড় সড় একটা নুড়ি নিয়ে গুলাইলে পেঁচালো৷ অতঃপর এক চোখ বন্ধ করে নিশানা দেখে নিলো৷ বড় আমটার দিকে নজর তার গুলাইল সই করতে করতে বললো,
“তোদের একটুও দেবো না এবার৷”
বলেই নিশানা অনুযায়ী গুলাইল ছুড়লো৷ নিশানায় গিয়ে লাগলেও অদ্ভুত এক সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়ে বসলো রুপা৷ রেজওয়ান এদিকেই আসছিলো বড় নুড়িটা গিয়ে রেজওয়ান এর মাথায় লাগলো৷ হা করে তাকিয়ে রইলো রুপা৷ রেজওয়ান এর কপালে লাগায় ইতমধ্যে কপাল ফেঁ’টে র’ক্ত আসা শুরু করেছে৷ মৃদুলা ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
“কেলেংকারী হইছে৷ ময়ুর বু শিগগিরই পালাও এখান থেকে রুপাবু এখানেই থাকুক৷”
চলবে,