ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা ত্রিশ

0
311

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

ত্রিশ

শাহওয়াজ এর সকাল এর সূচনা হলো মিষ্টি কন্ঠ শ্রবণ করে৷ কর্ণে রিনরিনিয়ে যেন ঘুমের মাঝেই বাজছিলো কন্ঠটা৷ তবে তীব্র মাথা ব্যাথায় চোখ যেন খুলে তাকানোর জন্য সায় দিচ্ছিলো না শরীর৷ মাথাটা কেমন ভারী হয়ে আছে৷
মধ্যরাত থেকেই হুট করে মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, রাত আড়াইটা অব্দি কাজে কাজেই কেটেছে৷ সকালেই চট্টগ্রাম যাবে একটা ক্যাম্পেইন আছে দুই দিন এর৷ রাতে কাজের মাঝেই শুরু হয়েছিলো মাথার যন্ত্রণা, শাহওয়াজ ডাক্তার হলেও ওষুধ এড়িয়ে চলে বেশ৷ খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া মেডিসিন নেওয়ার অভ্যাস নেই তার৷ কারণ পেটে একবার ওষুধ গেলে সব কিছুতেই ওষুধ খেতে হবে৷

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা ফুলের টোকা লাগলেও ওষুধ খায়৷ শাহওয়াজ নিজের রোগীদের প্রায়ই বলে খুব বেশি কারণ ছাড়া ওষুধ সেবন করবেন না৷ ঠান্ডা মাথা ব্যাথার জন্য ঘরোয়া বেশ উপকরণ রয়েছে যা সেবন করলে ওষুধের থেকে আগে কাজ করে৷

এ তীব্য মাথা যন্ত্রণায় নিজ থেকে চা ও করে খেতে পারছিলোনা৷ ঘরে টি ব্যাগ থাকলেও নিজে বানিয়ে খাওয়ার জন্য ও যেন শরীর সায় দিচ্ছিলো না৷উঠারো যেন শক্তি পাচ্ছিলো না তখন! এত রাতে কাউকে বলতেও পারছিলো না৷সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে শেষ রাতেই চোখ টা লেগে এসেছিলো৷ তাই আরো শরীর সায় দিচ্ছেনা এখন ওঠার জন্য৷ ঘরিতে এলার্ম সেট করাই আছে এলার্ম যেহেতু বাজেনি তারমানে খুব একটা সকাল ও হয়নি৷

কাল বৃষ্টিতে ভেজায় আজ এ দশা, তা শাহওয়াজ খুব ভালো করেই জানে৷ কিন্তু কাল যা জানতে পেরেছে এ নিয়ে বেশ দ্বিধায় আছে শাহওয়াজ৷ ভাবনার মাঝেই ফের কড়া নাড়লো কেউ৷
কিন্তু এত সকালে কে আসলো? ওর ঘরেতো এত সকালে কেউ আসে না৷
শরীর এর সাথে মনের লড়াই চললো বেশ কিছুক্ষণ৷ বেশ কষ্টে চোখ খুলে মোবাইলের সময় পরখ করলো শাহওয়াজ৷ সবে ছয়টা বাজে৷ এত সকালে আসলো কে? রুপা?
ঘুমের ধ্যানে কন্ঠটাও ঠিক মত শুনছে না৷
শাহওয়াজ এর ভাবনার মাঝেই ফের ওপাশ থেকে শোনা গেলো মেয়েলি কন্ঠ,
“শুনছেন? আপনি কি এখনো ঘুমিয়ে? আপনার জন্য তুলসীপাতা দিয়ে চা এনেছিলাম৷”

শাহওয়াজ ঘুম ঘুম চোখে অবাকের আভা ফুটলো৷ ময়ূরাক্ষীর কন্ঠ না? এ মেয়ে এত সকালে এখানে?
কখনোতো বললেও পাওয়া যায় না আজ কি হলো? কি ভেবে যেন মুখ টা গম্ভীর করলো ফের৷
শাহওয়াজ খুব একটা বেলা করে উঠে না৷ ছয়টা সাতটার মাঝেই ঘুম ভাঙে আর নামাজ পড়তে উঠলে নামাজ পড়ে কখনো ঘুমায় না৷ আজ রাতেই এলার্ম সেট করে রেখেছিলো নয়টার৷
সকালে উঠেই বেরিয়ে পরবে ভেবেছিলো৷ শরীরে জোর প্রয়োগ করে উঠলো শাহওয়াজ৷ হাড় গুলো যেন মড়মড় করে উঠলো৷ সারা শরীর ব্যাথা হয়ে আছে৷ গম্ভীর মুখেই বিছানা থেকে নামলো দরজাটা খুলতেই দেখা মিললো ময়ূরাক্ষীর৷
স্নিগ্ধ তার আদল চেয়ে আছে ওর দিকেই৷ আজ আগের মত জড়সড় ভাব নেই৷ ভীত ও নেই৷ সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে আছে৷
ডাগর ডাগর আঁখি ঝাপটালো দু-এক বার৷ শাহওয়াজ এর দেখা পেতেই ময়ূরাক্ষী চা টা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আমি ভেবেছিলাম আপনি জেগেই আছেন৷ আপনিতো কাল ভিজে এসেছিলেন রাতে খেতেও আসেননি৷ ভিজে কি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? আপনার জন্য তুলসী চা করে নিয়ে এসেছি এটা খেলে ভালো লাগবে৷”

মেয়েটার নিচু কন্ঠ৷ শাহওয়াজ গম্ভীর মুখেই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে৷ ময়ূরাক্ষীর কথা শুনে দাতে দাত চেপে বললো,
“মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে চা দেওয়া এ কেমন ভদ্রতা?আমি কি বলেছি খারাপ লাগছে আমার? আমি কি বলেছি, অসুস্থ আমি? আমায় নিয়ে আপনার এত না ভাবলেও চলবে৷ ”

বলেই মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দিলো শাহওয়াজ৷ চা টা ও নিলো না৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে অইলো ময়ূরাক্ষী চা হাতে নিয়ে৷ টলমল করে উঠলো আঁখি যুগল৷ কয়েক ফোটা নোনা চোখের পানি পরলো চা খানায়৷ অভিমান বাড়লো মেয়েটির৷ লোকটা তার সাথে এমন কেন করছে? কি করেছে সে?
লোকটা যে তাকে এড়িয়ে চলছে এ তো স্পষ্ট কিন্তু কেন এড়িয়ে চলছে?
হুট করেই নিজের কর্মে নিজেই অবাক হলো৷ কি হয়েছে ওর? কেন লোকটা কে নিয়ে এত ভাবছে? কেন লোকটার এড়িয়ে চলা ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে?
এ যন্ত্রণা লাঘব হবে কি করে? এ নিষিদ্ধ অনুভূতি করবে কি ময়ূরাক্ষী? চা টা নিয়েই বড় বড় পায়ে প্রস্থান করলো ময়ূরাক্ষী৷
চায়ের কাপটা অযত্নেই নিচে টেবিলের উপর রেখে দৌড়ে ছুটলো পুকুর পারের দিক৷ অষ্টাদশী অবাদ্ধ মন টা তার জন্য বেশ ভারী হয়ে উঠেছে যেন বহন করা দায়৷

অযত্নে ফেলে রাখা চায়ের কাপটা যত্নে তুলে নিলো রেহান৷ সে সবটা দেখছে কাল থেকে৷ এখনো দেখেছে সব টা৷ ময়ূরাক্ষীর মতিগতি ভালো ঠেকছে না একটুও৷ চা টায় প্রেয়সীর চোখের পানিও রয়েছে, মেয়েটার চোখে অন্য কারো জন্য পানি ছিলো মানতে পারছে না রেহান৷ কাপটা ন সামনে নিয়ে মাতাল করা দৃষ্টিতে তাকালো৷ চুমুক বসালো চায়ে, অতঃপর চোখ মুখ কঠিন হলো তার৷ রুষ্ট হয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরলো কাঁচের কাপটা৷ ক্ষোভ নিজের উপর ব্যাপক ক্ষোভ রেহানের৷ হাতের চাপে মুড়মুড়িয়ে ভাঙতে শুরু করলো কাচের চায়ের কাপ খানা৷
ক্রুদ্ধ দৃষ্টি এখনো বিরাজমান দাতে দাত চেপে আরো চাপ দিতেই পুরো কাপটা দু-তিন ভাগ হয়ে গেলো৷ চা টা নিচে ছড়িয়ে গেলো৷ কাঁচ গিয়ে ঢুকলো হাতের মুঠোয়৷ নিমেষে র’ক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলো হাত খানা৷ হেসে উঠলো রেহান অদ্ভুত ভাবে, এবার যেন শান্তি পাচ্ছে রেহান৷ অতঃপর ফের যত্ন করেই কাপটা নিয়ে ডাস্টবিনে ফেললো নিচে চা মিশ্রিত র’ক্ত গুলো পরিষ্কার করে সে ও বাইরের দিকে পা বাড়ালো৷

——

“আম্মা প্রিয়দর্শিনী কে?”
সুপারি কাঁ’টছিলো খোদেজা৷ হুট করেই মিনারার এমন প্রশ্নে চমকালো ক্ষানিকটা, সামনেই বসা খোদেজার বোন জোবেদা৷ সে ও যায়নি এখনো৷ আরো মাস খানেক থাকবে৷
খোদেজা জোবেদা চাওয়াচাওয়ি করলো মুখ পানে৷ রাবেয়ার ও চেহারার রঙ পাল্টালো৷ হুট করেই এমন প্রশ্ন কেন মিনারার?
খোদেজা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো৷ খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
“এটা আবার কার নাম বলতেছো মেঝো বউ? আমি চিনমু কেমনে?”
বলেই নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো যেন তার কাছেটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কান৷ মিনারা ভাবুক হয়ে উত্তর দিলো,
“আপনার ছেলের পুরোনো বইয়ের ভেতর একটা ছবি পেয়েছি ছবির পিছনে প্রিয়দর্শিনী লেখা ছিলো তাই জিগ্যেস করলাম আম্মা৷ ”
খোদেজা মন দিয়ে শুনলো সব টা৷ নিজের কাজ করতে করতে ফের একই কন্ঠে উত্তর দিলো,
“এইগুলা কত কাল আগের বই৷ ওর বন্ধু বন্ধবেরাও এই বই নিয়া পড়তো৷ ওদেরি কেউ রাখছে মনে হয়৷ আমি বুঝিনা বাবা তোমার সব কিছুতে এত কৌতুহল কেন? এহন পর্যন্ত তো আমার পোলাডারে বাপ ডাক শুনাইতে পারলা না কই আল্লাহ বিল্লা করবা৷ ফাও প্যাঁচাল নিয়া পইরা থাকো৷”
মিনারা চুপ রইলো৷ এসব এখন আর তার খারাপ লাগে না৷ গাঁয়ে সয়ে গেছে৷ কত লোকের কত মন্দ কথা শুনেছে এগুলো তো স্বাভাবিক৷
ভাবনার মাঝেই ময়ূরাক্ষী চা নিয়ে এলো৷ এক সপ্তাহ যাবত মেয়েটার পরিক্ষা চলছে তাই পাওয়াই যায় না মেয়েটা কে৷ কলেজ থেকে এসে সেই ঘাপটি মেরে ঘরে বসে থাকে৷ চোখের নিচ কালো পরছে অল্প সল্প৷ খাওয়াতেও বেশ নীহা লক্ষ করেছে মিনারা৷
তার জানামতে ময়ূরাক্ষী রাত জেগে পড়ার মেয়ে না৷ যে পড়ার ভয়ে পরিক্ষা ছাড়া কলেজে যায় না সে রাত জেগে পড়বে? আচ্ছা মেয়েটা কি কিছু নিয়ে চিন্তিত? কিন্তু কি নিয়ে চিন্তা করবে? চঞ্চল মেয়েটা এমন চুপচাপ হয়ে গেলো কি করে?
এ মেয়েটা কে কেন যেন আপন আপন লাগে মিনারার৷

চা রেখে ময়ূরাক্ষী উঠে যাবে ঠিক তখনি মিনারা বাধ সেধলো থামালো ময়ূরাক্ষী খানিকটা পিছনে তাকাতেই মিনারার চোখে চোখ পরলো ময়ূরাক্ষীর৷ মিনারা চমকালো কেমন৷ ওই ছবিটার চোখের মত চোখ দুটো না ময়ূরাক্ষীর? হুবহু লাগছে কেন তার? বেশি ভাবছে কি ছবিটার মানুষ কে নিয়ে? কি জানি ভেবে ভাবনা পাল্টালো মিনারা৷ বললো,
“কোথায় যাচ্ছিস?সারাদিন তো ঘরেই থাকিস এখন চিরোনি নিয়ে এখানে আয় , চুল গুলো কি রুক্ষ হয়ে গেছে তেল দিয়ে আঁচড়ে দেই৷”
মিনারার কথায় সায় দিয়ে চিরুনি নিয়ে এসে বসলো ময়ূরাক্ষী৷ তার কেন যেন আজকাল কিছু ভালো লাগে না৷ শাহওয়াজ গিয়েছে আজ দশ দিন হলো৷ প্রথমে শুনেছিলো দুই দিন এর জন্য গেছে পরে জানতে পারলো সেখান থেকে আবার ঢাকা গেছে৷
ময়ূরাক্ষী বসতে কর্ণকুহর হলো দাদিজান এর বোন জোবেদার কন্ঠ৷ সে বললো,
“তুমগো রঙ ঢং দেখলে বাঁচি না বউ৷ একজনের সতীনের পোলার জন্য দরদ উতলে পরে আরেকজনের আশ্রিতার জন্য৷ কত্ত কি যে তোমরা দেখাইবা আরো৷”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here