ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা চৌত্রিশ

0
315

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

চৌত্রিশ

শাহওয়াজ যখন আসলো তুমুল বর্ষণ হচ্ছে তখন৷ রুষ্ঠ প্রকৃতি৷ দুইটা নিথর দেহ পরে আছে সামনেই পাকার উপর৷ নিচে র’ক্তা’ক্ত চারোপাশ৷ শাহওয়াজ যখন গাড়ি থেকে নামবে ঠিক তখনি নিহানের গাড়িটা তীব্র গতীতে সৌহার্দ্য নিবাস থেকে বের হলো৷
শাহওয়াজ সে অবস্থাতেই ফের পিছু নিবে তখনি ময়ূরাক্ষীর কথা মনে পরলো৷ এখন নিহানের পিছু নিলে এখানে দেরি হবে৷ রুদ্ধশ্বাসকর এক পরিস্থিতির শিকার হয়েছে শাহওয়াজ৷ ময়ূরাক্ষীর প্রতিটা কথা ফোনের এপাশ থেকে শুনেছে সে৷ না পারছিলো গাড়িটাকে উড়িয়ে নিয়ে আসতে কিন্তু চেয়েও শেষ রক্ষা হলো না৷
নিজের কানে শুনলো প্রেয়সীর আর্তনাদ৷ ওই বাচ্চা মেয়েটাও প্রাণ খোয়াতে বসলো৷
প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার সাথে সাথে মানুষের হিংস্রতা নিমেষে দুটো প্রাণ কে নিষ্প্রাণ করে তুললো৷

এ বৃষ্টির মাঝেই ময়ূরাক্ষী মৃদুলার পানে বসলো শাহওয়াজ বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে যেন তার৷ টুপ টুপ করে বৃষ্টির ফোটার সাথে নিজের চোখ থেকেও কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো৷ আজ ডাক্তার হয়েও দুটো প্রাণ কে দেখতে তার বুকটা চিড়ে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে৷ মনে হচ্ছে ছুঁলেই যদি কিছু হয়ে যায়৷
কাঁপা কাঁপা হাতে মৃদুলার পালস চেক করলো৷ র’ক্তাক্ত হয়ে আছে ছোট্ট শরীর টা৷ হায়রে কি নিষ্ঠুর নিকৃষ্ট মানুষ৷ রাগ বাড়লো শাহওয়াজ এর৷ পালস একদম দৃঢ় হয়ে এসেছে৷

ময়ূরাক্ষীর টাও দেখলো কম্পিত হাত বুঝতে পারলো না কিছু৷ শূন্য মস্তিষ্কে বুকে তুলে নিলো মৃদুলাকে, দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে রাখলো৷ কিন্তু দুই-জন কে নিয়ে যাবে কি করে এক সাথে৷ এসে কম্পিত হৃদয়ে ময়ূরাক্ষীকে তুলেও গাড়িতে নিয়ে আসলো৷ মৃদুলাকে পিছনে শুইয়ে দিলো৷ ময়ূরাক্ষীকে নিলো সামনে৷ আজ যেন নিজের শরীর ও আসার হয়ে আসছে৷ বিরবির করে কয়েকবার বললো ও,
“ময়ূর দেখুন আমি রেগে নেই৷ চোখ খুলুন ময়ূর আপনাকে আমার অনেক প্রয়োজন৷”
কিন্তু মেয়েটা প্রতিবারের মতই তার অবাদ্ধ হলো খুললো না চোখ৷ মেয়েটা শুনলো না তার কথা৷

সময় নেই তার ভে’ঙে পরলে চলবে না দুজনকে বাঁচাতে হবে তার, গাড়ি স্টার্ট দিলো৷ এর মাঝেই রেজওয়ান কে ফোন করে জানালো সব টা রেজওয়ান আশ্রমে আছে৷ বৃষ্টির বেগ বাড়ছে বাতাসে যেন গাড়িও সামনে এগোচ্ছে না৷ স্প্রিড বাড়ালো শাহওয়াজ পরিস্থিতি হাতের বাইরে মেয়ে দুটোকে যে তার বাঁচাতে হবেই৷

মেয়েটার থেকে পনেরোদিন দূরে থেকেছে শাহওয়াজ শুধু অভিমান করে৷ কেন সে দিন ময়ূরাক্ষী নিজে বললো না শাহওয়াজ তাকে কিছু করেনি?
এ পনেরো দিন নিজেও বেশ কষ্ট পেয়েছে৷ কিন্তু বাড়িতে এসে মেয়েটার এমন রুপ দেখে নিমেষে ভুলে গিয়েছিলো সব৷
কিন্তু এ অষ্টাদশী মেয়ে তার থেকে যে এভাবে প্রতিশোধ নিবে কে জানতো? কি নিশ্চিন্তায় চোখ বন্ধ করে আছে৷ শরীর টা রক্তাক্ত হয়ে আছে৷ জামা টা কয়েক জায়গা দিয়ে ছিঁড়ে আছে৷ সহ্য হচ্ছে না শাহওয়াজ এর৷ মৃদুলার অবস্থাও খুব একটা ভালো না৷ ছাড়বেনা শাহওয়াজ ওই ছেলেকে নিজে শাস্তি দিবে৷ সব হিসেব নিবে৷

ঝড়ের তান্ডব তীব্র হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে এ কালবৈশাখী ঝড় সব তছনছ করে দিয়ে গেলো৷ মেয়েটা বাঁচার জন্য তাকে কল করলো পারলো না শাহওয়াজ কিছু করতে পারলো না৷ আশ্রয় পাওয়ার জন্য মেয়েটা জায়গা খুঁজলো দিতে পারলো না সে নিরাপত্তা৷
এখন নিজের প্রতি নিজের রাগ জন্মালো মেয়েটাকে সে বাঁচাতে পারলো না, পারলো না৷
মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে নিঃশেষ হয়ে যাবে শাহওয়াজ নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না৷ সব থেকে বড় ব্যাপার ওই মেয়েটাকেই যে চাই শাহওয়াজ এর৷ যে কোনো মূল্যে চাই৷

মেয়েটার কান্না আকুতি ভরা কন্ঠ কানে পৌঁছালো কিন্তু শাহওয়াজ শুনেই গেলো শুধু কিছু করতে পারলো না৷ এ ব্যার্থতা থেকে এ অপরাধবোধ থেকে শাহওয়াজ নিজেকে কি করে মুক্তি দিবে? মুক্তি নেই যে৷ মুক্তি নেই৷

..

বৃষ্টি থামলো পরিবেশ নিরব হলো কিন্তু নিরব হলো না অপরেশন থিয়েটারে পাথরের মত নিজের কাজ করতে থাকা শাহওয়াজ এর মন এবং বাইরে বসে থাকা মানুষ দের মন৷ মৃদুলার মায়ের হাহাকারে কেঁপে উঠছে যেন হাসপাতাল৷ ওইটুকুনিইতো তার মেয়ে মানুষ এমন নিষ্ঠুর কেন হলো? রুপা নিরব হয়ে বসে আছে খোদেজা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেই ভর্তি রাবেয়া মৃদুলার মায়ের কাছেই বসে আছে৷
রাহেলা বিলাপ করছে আর বলছে,
“আমি বলছিলাম ওই মুখপুরিরে তারাইতে আমার কথা কেউ শুনে নাই সর্বনাশ করে দিলো মেয়েটার৷ সর্বনাশ হয়া গেলো৷ ওই মুখ পুরির কু-নজর যতদিন আছে কেউ ভালো থাকবো না৷”

রাহেলার কথায় কান দিচ্ছে না কেউ৷ হাসির আজ কেন যেন একটু একটু ভালো লাগছে৷ মৃদুলাটার জন্য খারাপ লাগলেও ময়ূরাক্ষীর অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে৷ বেশ হয়েছে এখন তো শাহওয়াজ মুখ ফিরেও তাকাবে না৷
জোবেদা বোনের কাছেই বসে আছে, নাতীর এমন খবর শুনে তার ভবান্তর নেই বরং শান্তি লাগছে তার৷
এ শান্তি কোথায় লাগছে সে ভালো করেই জানে৷ কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বের হতে হবে তার৷ পালানো যাবে না পালালে মানুষ ভাববে ওই নাতীকে ফুসলেছে৷ পরিস্থিতি সামলেই সে এখান থেকে বের হবে৷
এর আগে নাতীর একটা ব্যাবস্থা হোক ছেলেটা স্বল্প সময়ে দেশ ছাড়তে পারলেই হয়৷
ছেলেটাও না বড্ড বোকা এভাবে কেউ মেইন দরজা দিয়ে পালায়? সব টা আগে জানালে সুন্দর একটা পরিকল্পনা করে করা যেতো৷ এখানে শাহওয়াজ কে ফাসিয়ে দেওয়াও যেতো৷
বোকা ছেলে কত্ত বড় সুযোগ মিস হয়ে গেলো এর জন্য৷

অপরেশন থিয়েটার থেকে তিন ঘন্টা পর মৃদুলাকে নিয়ে বের হলো শাহওয়াজ৷ শাহওয়াজ কে দেখে হুমড়ি খেয়ে পরলো সবাই, মৃদুলাকে নিয়ে যাওয়া হলো শাহওয়াজ বসে পরলো একটা চেয়ারে৷ সবাই মৃদুলার ব্যাপারেই এটা ওটা জিগ্যেস করছে৷ রুপা এখনো চুপ আছে শাহওয়াজ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মৃদুলা আশংকা মুক্ত তবে ক্ষত বেশি আইসিইউতে রাখতে হবে৷”
আশ্চর্য না হয়ে পারলো না শাহওয়াজ৷ আরো একটা মেয়ের কথা জিগ্যেস ও করলো না কেউ৷
শাহওয়াজ এর ভাবনা কাটলো রুপা আর মৃদুলার মায়ের প্রশ্নে৷ দুজন এক সাথেই বললো,
“ময়ূর কেমন আছে?”
শাহওয়াজ নিশ্বাস নিলো জোরে৷ সে বেশ ক্লান্ত ওই যান্ত্রিক রুমটাতে থাকার সাধ্যি তার আর হচ্ছে না৷ মৃদুলার মায়ের প্রশ্নে রাহেলা অবাক হলো৷ যে কি না ময়ূরাক্ষীকে দেখতেও পারে না সে জিগ্যেস করছে ময়ূরাক্ষীর কথা? মৃদুলার মা জানে ময়ূরাক্ষী তার থেকেও বেশি খেয়াল রেখেছে তার মেয়ের৷ আজ না হয় পাষানের মত স্বার্থপর নাই হলো৷
শাহওয়াজ কে চুপ দেখে মিনারা এগিয়ে এলো চিন্তিত গলায় বললো,
“ও আব্বা বললা না ময়ূরের কি অবস্থা?”
শাহওয়াজ শুকনো ঢোক গিললো বললো,
“বোঝা যাচ্ছে না চাচি, ও কোনো কিছুতেই রেসপন্স করছে না৷”
শেষ এর কথাটা বলতে কাঁপলো শাহওয়াজ এর কন্ঠ৷ অপরেশন চলছে এখনো শাহওয়াজ বেরিয়ে এসেছে৷ ময়ূরাক্ষীর অবস্থা একেবারেই শোচনীয়৷ পালস একেবারে দৃঢ় গতীতে চলছে৷
মিনারা হুট করেই কিছু ভাবলো৷ আমতা আমতা করে বললো,
“আব্বা মাইয়াটারে কি নিহান…..!!”
মিনারার কথা শেষ হতে না হতেই থামিয়ে দিলো শাহওয়াজ৷ তড়িৎ গতীতে বললো,
“কি বলছেন কি এসব? কিছুই করতে পারেনি ও, কিছু করার আগেই ঝাপ দিয়েছে বারান্দা থেকে৷ এসব ভাববেন ও না৷ ”
শাহওয়াজ এর কথা শেষ হতেই রাহেলা মুখ কুঁচকে এবার বললো,
“তুমি দেখছো নাকি? তুমিতো ওইখানে আছিলনা কিছু করলে,,,,”
“চুপ করুন আর একটা কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না৷ মেডিকেল রিপোর্ট দেখতে চান? টেস্ট করতে হবে নাকি? কিন্তু আমি টেস্ট করাবো না আপনাদের মত মানুষের জন্য আমি এই টেস্ট করিয়ে ওকে ছোটো করবো না৷ যা ভাবার ভেবে নিন৷ এখনো পবিত্র আমার ময়ূর৷ ”
শেষ এর কথাটা হাসির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো শাহওয়াজ৷ শাহওয়াজ এর কথার ঝংকারে কেঁপে উঠলো যেন সবাই৷
তার সাথে অবাক ও হলো৷ কি বললো শাহওয়াজ? শাহওয়াজ এখান থেকে প্রস্থান করবে তার আগেই

আকবর চৌধুরী থামিয়ে দিলো ছেলেকে৷ কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
“আব্বা ওরে বাঁচাও, ওর কিছু হইলেযে নিজের কাছেই নিজে অপরাধী হইয়া যামু৷ ও যে একজনের দেওয়া আমানত৷”
হুট করেই শাহওয়াজ থমকালো দুয়ে দুয়ে চার মেলালো শূন্য মস্তিষ্কে বসে রইলো কিছুক্ষণ তাচ্ছিল্য হেসে উঠলো বললো,
“ও প্রিয়দর্শিনী আন্টির আমানত তাই না? রুম্মন চৌধুরীর একমাত্র কন্যা?”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here