#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা
ছত্রিশ
..
দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর পর এ গ্রামে পা রাখলো শাহনাজ মধুলতা, দৃষ্টিপটে ভেসে উঠলো কতশত স্মৃতি৷ কত শত মানুষের মুখঅভয়ব৷ যে মানুষ গুলো কে সে প্রিয় বলে জানতো৷ আপন বলে জানতো৷ তাদের বলা সহস্র মিথ্যা বুলি৷ তারা যে কতটা ভয়ংকর এ মধুলতা ছাড়া কেউ জানেনা৷
এ গ্রাম তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে৷ এ গ্রাম মানুষ চিনতে শিখিয়েছে, এ গ্রাম তাকে একা পথ চলতে শিখিয়েছে৷ এ গ্রাম তাকে শক্ত হতে শিখিয়েছে৷
সেই চেনা গন্ধ চেনা প্রকৃতি৷ আবার সেই চেনা মুখোশধারী মানুষের সাথে দেখা হবে, ঘিন ঘিন করে উঠলো মধুলতার সর্বাঙ্গ৷
চাকচিক্যতার মাঝে থাকতে থাকতে মন টা ও সেখানকার ইট পাথরের বিল্ডিং এর ন্যায় হয়ে গিয়েছিলো৷ পাথরের ন্যায়! অনেক যে হিসেব নিকাশ বাকি৷ আশেপাশে পরখ করতে করতেই এসেছে মধুলতা বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই বের হলো না৷
খুশি হতে পারলো না, তৃপ্তি নিয়ে নিশ্বাস নিতে পারলো না৷ আঁখি যুগল বারংবার অবাদ্ধ হয়ে টলটল করে উঠছে৷ কিন্তু সে যে নিজের কাছেই নিজেকে শক্ত প্রমাণ করতে ব্যাস্ত৷ নিজের কাছেই নিজেকে কঠিন প্রমান করতে ব্যাস্ত৷
এ অশ্রুজল নিজেকে নিজের কাছে দূর্বল চিত্তের করে তুলে যে৷ এ যে চায় না মধুলতা৷ সে নিজের কাছেই নিজেকে শক্ত রাখতে চায় তারপর তো বাইরের মানুষের নিকট নিজের শক্তি দিয়ে নিজের কঠিনত্ব তুলে ধরবে৷ তাকে দেখবে লোকে বলবে এ সেই নারী যে ভালোবাসার মানুষের বদলে যাওয়া দেখেও ভেঙে পরেনি৷ এ সেই নারী যে স্বামী হীন থেকেও ভালো আছে৷ ছেলেকে ভালো ভাবে মানুষ করতে পেরেছে৷
কে বলে বাঁচতে গেলে শক্ত হাতের প্রয়োজন? বাঁচতে গেলে নিজেকে শক্ত করা প্রয়োজন৷ যে হাত সে ধরবে সে হাতটা যতই শক্ত হোক ওটা অন্যের থাকে খুঁটি থাকা মানে দূর্বলতার বীজ বড় করে তোলা৷
কালো গাড়িটা থেকে নামলো মধুলতা, শক্ত মুখশ্রী খানায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট৷ গম্ভীরতা আর চিন্তা তাকে এক সাথে ঘ্রাস করেছে৷
শাহওয়াজ থেকে সবটা শুনেছে সে তারপরই তো বাবার সাথে রওনা হলো এত বছর পর৷
যেখান থেকে যাওয়ার আগে প্রতিজ্ঞা করে গিয়েছিলো এ গ্রামে আর পা দিবে না কখনো সে গ্রামেই আসতে হলো নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে৷ মধুলতা বাবা কে নিয়ে সামনে পা বাড়াবে আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত এক মুখের সাথে পরিচয়৷চককালো মধুলতা৷ সামনের মানুষটি মধুলতাকে দেখেই ঝাপটে এসে জড়িয়ে ধরলো৷ হতভম্ব হয়ে রইলো কিছুসময়৷
“বড় মা তুমি এসেছো?”
ভরকালো মধুলতা, বিস্ময়নিয়ে দাঁড়িয়ে সে৷ এখানে থাকা তার বাবার চোখে মুখেও বিস্ময় ভাব৷ হুবহু তার মেয়ের মত দেখতে একটা মেয়ে এ যেন অষ্টাদশী মধুলতাকে দেখছে সে৷
মধুলতার হুট করেই মাথায় আসলো কিছু৷ স্বাভাবিক হলো সে, শাহওয়াজ বলেছিলো এই মেয়েটির কথা৷ তবে দেখেনি কখনো৷ মধুলতা খানিকটা গম্ভীর মুখেই শুধালো,
“তুমি রুপা?”
রুপা এবার সরে দাঁড়ালো৷ চোখে মুখে তার ও অবাকের আভা৷ তার সামনে থাকা মানুষ টি বাস্তবেও কত সুন্দর৷ রুপা মাথা ঝুলিয়ে বললো,
“আমি রুপা! ভাইজান তোমাকে আমার কথা বলেছে?”
মধুলতা চোখের ইশারায় হ্যাঁ বললো৷ কি নিখুঁত মিল নিজের সাথে৷ এমন ও হয়? সৃষ্টি কর্তার এ কেমন লীলা? মধুলতা এবার ধাতস্থ হলো বাবাকে বললো,
“আব্বা এটা আকবর চৌধুরীর মেয়ে৷”
মধুলতার বাবা কিছু বললেন না আর৷ মুখ ঘুরিয়ে নিলেন পা বাড়ালেন সামনের দিকে৷ মধুলতাও হাটা ধরলেন৷
..
“বুবু তোমার সতীন আইছে৷”
রাহেলার কথায় ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকায় রাবেয়া৷ বোধগম্য হয় না প্রথম এ কথার মানে৷ কি বলছে রাহেলা? তার সতীন মানে?
রাবেয়ার মাথা থেকে বেরিয়েই গেছে মধুলতার কথা৷ রাবেয়ার এমন তাকানো দেখে রাহেলা বললো,
“প্রথমে সতীনের পোলারে ঠায় দিলা ঘরে এখন আবার সতীন আসছে দেখো এরা মিলে তোমারে বের করে নাকি৷ ভাইজান তো ওই মহিলারে এখনো ভালোবাসে তোমার আর তোমার মাইয়ার কপালটা পুরলো মনে হয় বুবু৷”
রাবেয়ার মস্তিষ্ক খুলে৷ রাহেলা কি বলছে? মধুলতা এসেছে? চিকচিক করে উঠলো রাবেয়ার চোখ মুখ৷ এ কথা আকবর চৌধুরীর কানেও পৌঁছেছে৷
তারমানে মধুলতা এত বছর পর এসেছে? এর মাঝেই শাহওয়াজ ফোন নিয়ে তাড়াহুড়ো করে লিফটের দিকে গেলো৷ লিফট থেকে বের হলো মধুলতা আর তার বাবা আশরাফ৷
কালো একটা জামদানী পরনে সাইড সিথী করে হাত খোপা করা চুল৷ কয়েকটা চুলে পাক ধরেছে তাও দৃশ্যমান৷ মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরনে সে৷ পরিপাটি এক নারী৷ চোখ জুড়ালো রাবেয়া,আকবর চৌধুরীর সাথে এখনো ডিভোর্স হয়নি মধুলতার তবে এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই রাবেয়ার৷ বরং সে সর্বকাল নিজের কাছেই নিজের অপরাধী সে মানুষটার জীবনের রঙ কেড়ে নিয়েছে৷ মধুলতার পাশেই তার মেয়ে রুপা৷ মনে হচ্ছে মা মেয়ে হেটে আসছে৷ আহা! এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর হয়?
মধুলতা কিছুক্ষন আইসিইউর কাঁচের সামনে দাঁড়ালো তপ্ত শ্বাস টানলো৷
সে যদি আগে জানতো মেয়েটাকে তার কাছেই রাখতো৷ রাবেয়া এগিয়ে এলো মাথার গোমটা টা ভালো ভাবে টেনে শুধালো,
“ভালো আছো আপা?”
মধুলতা তাকালো ঘুরে৷ রাবেয়া দাড়ানো, এ মেয়েটার সাথেও এক সময় তার ভালো সম্পর্ক ছিলো৷ মেয়েটা নিজেও কত আকুতি মিনতি করেছিলো থাকার জন্য৷ মধুলতা হেসে উত্তর দিলো,
“ভালো আছি৷”
অতঃপর মৌনতা, রুম্মন মিনারা এগিয়ে এলো৷ রুম্মন কে দেখে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“মেয়েটাকে ও দেখে রাখতে পারলে না রুম্মন? নিজের মেয়েকে নিজের বাড়িতেই আশ্রিতা করে রাখলে৷ তোমার মহান ভাই এ মহান কাজ টা করলো কি করে? বুক কাঁপলো না? আর কত পাপ করবে তোমরা? তোমরা কেউওই আসলেই ভালোবাসার যোগ্য না৷”
রুম্মন শুনলো শুধু৷ কি উত্তর দিবে? মিথ্যে তো বলেনি৷ অতঃপর শাহওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওকে আমি দেশের বাইরে নিয়ে যাবো ব্যাবস্থা করো শাহওয়াজ৷ ওকে এখানে রেখে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না৷”
শাহওয়াজ কিছু বলার আগেই আকবর চৌধুরী বললো,
“ও আমার বাড়ির মেয়ে ওকে নিয়ে কোথায় যাবেন আপনি? ওর চিকিৎসা এখানেই হবে৷”
তাচ্ছিল্য হাসলো মধুলতা৷ বললো,
“এত দিন আশ্রিতা হিসেবে রেখে এখন বাড়ির মেয়ে বলতে লজ্জা করছে না আপনার? কোথায় আপনার মা? এবার আমি কাউকে ছাড়বো না৷ আপনার খালার আর মায়ের পতন ঘনিয়ে এসেছে৷
আকবর চৌধুরী থমথমে হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ আসলেই সে লজ্জিত কি বলবে সে? এখন মেয়ে বললে লোকেতো তাকেই নিন্দা করবে৷ শাহওয়াজ কারো কথায় আপাতত কান দিচ্ছে না৷
তার আপাতত কথা বাড়ানোর শক্তি নেই৷ সে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো বললো,
“এ অবস্থায় ওর জান্য জার্নি করা রিস্ক আম্মু৷ তার উপর ওর পাসপোর্ট নেই৷ বেশ ঝামেলার ব্যাপার৷”
মধুলতা কিছু বললেন না নিষ্পলকে চেয়ে রইলেন৷
,,
রজনী চলছে৷ মেঘের গুরুম গুরুম শব্দ আবার শুরু হয়েছে৷ মেঘ আজ বড়ই বেপরোয়া, আপন গতীতে ঝড়েই যাচ্ছে৷ আজ সারাটা দিন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতেই কাটলো৷ সন্ধ্যে বেলা ডাক্তার মিটিং বসেছিলো ইন্ডিয়া থেকে বড় ডাক্তার আসবে কিন্তু আকাশের অবস্থা বেগতিক৷ আবহাওয়া ঠিক না হলে কোনো ফ্লাইট নেই৷ এদিকে আজ রাতেই আরেকটা অপরেশন হওয়ার কথা৷ এ অপরেশন না বেশ রিস্কের৷ এদিক আকস্মিক ভয়ংকর এক কান্ড ঘটেছে৷ যা ভয় পেয়েছিলো সবাই আইসিইউতে রাখা অবস্থাতেই হুট করেই ময়ূরাক্ষীর কান দিয়ে র’ক্ত আসছে৷
এ অবস্থাতেই ময়ূরাক্ষীকে নিয়ে যাওয়া হলো সিটি স্ক্যান করাতে৷ আতঙ্ক যেন ঘ্রাস করছে সবার মাঝে৷
হেমোরেজিক স্ট্রো’ক হলো নাতো? এটা সাধারণ হলেও প্রাণঘাতী৷ মৃত্যুর সম্ভবনা থাকে বেশি৷ তবে এর প্রতিরোধের ক্ষমতা ডাক্তারের হাতে থাকলেও এ রোগীদের বেশিভাগই আশংকাজনক থাকে৷
সবাই বেশ চিন্তিত৷ সিটি স্ক্যান এর রিপোর্ট আসলো এক ঘন্টা পর৷ মূলত এ রিপোর্ট করলে এক দিনের মত সময় লাগে ইমারজেন্সি পেশেন্ট তাই এত তাড়াহুড়োতে করা৷ অতঃপর সেই রুদ্ধশ্বাসকর মূহুর্ত৷
বড় একজন নিউরোলজিস্ট দেখলো ময়ূরাক্ষীর রিপোর্ট৷ জানালো সবাইকে রোগো “হেমোরোজিক স্ট্রো’ক করেছে৷”
নিমেষে যেন পরিবেশ আরো গুমোট হলো৷ শাহওয়াজ পরিপূর্ণ দূর্বল হয়ে পরলো৷
ডাক্তার জানালো তাদেরই অপরেশন শুরু করে দিতে হবে নয়তো তারা বাঁচাতে পারবে না৷ ‘বাঁচাতে” পারবেনা শুনে শাহওয়াজ মেজাজ হারালো নিজের হাতের ফোনটা ছুঁ’ড়ে ফেললো দূরে হনহনিয়ে গিয়ে হাসির সামনে দাঁড়ালো৷ দাতে দাত কামড়ে শাহওয়াজ হাসির পানে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে নিয়ে বললো,
“একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ করলে কি করে তুমি?বুক কাঁপলো না? ওর কিছু হোক ছাড়বোনা তোমায় আমি৷”
চলবে,
[কাল ব্যাস্ত থাকবো কাল গল্প দিতে পারবো না৷ ]