তিক্ত_প্রণয়ালাপ কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল পর্ব:8

0
403

গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:8

অনামিকা পাথরের মত বসে আছে…ওর এখন কি করা উচিৎ সেটা ও নিজেও ভেবে উঠতে পারছেনা, মন খুশিতে নাচছে কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে প্রান্তিক প্রতারণা করেছে ওর সাথে সবকিছু গোপন করে…

— “অনামিকা, তুমি খুশি তো? একটা বৈধ সম্পর্ককে ভিত্তি করেই কিন্তু আমরা এক ছাদের তলায় নিশিযাপন করছি…”

প্রান্তিকের হাতের বাঁধন আলগা হতেই অনামিকা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়…প্রান্তিক শোয়া থেকে উঠে বসে…
— “কিছু বলো অনু?”

— “কি বলবো আমি প্রান্তিক? বলার কোনো জায়গা রেখেছেন? আমার অমতে ,লুকিয়ে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করানোটাকে আপনি বৈধ বলে মনে করেন? আপনি তো প্রতারণা করেছেন আমার সাথে”

— “আমি প্রতারণা করিনি অনামিকা, আই লাভ…”

হাত দেখিয়ে প্রান্তিককে থামিয়ে দিলো অনামিকা…
— “লাভ, ভালোবাসা! এভাবে জোড় করে বিয়ে করে এক ছাদের তলায় রাত্রিযাপন করলেই বুঝি ভালোবাসা হয়ে যায়? ভালবাসা এতটাই সহজলভ্য ?”

প্রান্তিক দীর্ঘশ্বাস ফেললো, ও জানতো একদিন এই পরিস্থিতিটা তৈরি হবে…তাই ও আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলো…
— “জোর করে বিয়ে করেছি ঠিক, এক ছাদের তলায় রাত্রিযাপন করেছি এটাও ঠিক..কিন্তু তোমাকে অন্ধকারে রেখে এই চল্লিশ দিনে একবারও খারাপ ভাবে স্পর্শ করিনি…, কারণ আমি চাইনি নিজের ভালবাসার মানুষের কাছে সারাজীবন ধ*র্ষ*ক হয়ে বাঁচতে…”

— “তাহলে আমার কাছ থেকে এতদিন সবটা লুকালেন কেনো?? আচ্ছা প্রীতমের ব্রেনওয়াশ করে কি আপনি ওকে আমার কাছে খারাপ করলেন যাতে আপনার রাস্তাটা পরিষ্কার হয়ে যায়??”

— “একটা জায়গায় যাবে অনামিকা?”

অনামিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…
— “আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাবনা,আপনি একটা প্রতারক…আপনি আমার সব শেষ করে দিয়েছেন…”

— “তোমার সব প্রশ্নের উত্তর সেখানেই আছে …”

— “আমি কলকাতায় ফিরবো,আমি আমার বাড়ি যাবো, মা বাবার কাছে যাবো আমি..”

— “এখন তোমাকে কলকাতায় নিয়ে গেলে তোমার বাবা,দাদা যে আমাকে বকবেন..”

— “মানে?”

— “তোমার বাবা সবটা জানেন,ওনার পরামর্শেই আমি তোমাকে বিয়েটা করেছি…”

অনামিকা চমকে উঠলো, ওর বাবা কিভাবে ওর সাথে এটা করতে পারে ভেবেই অবাক হয়ে ও..
— “বা..বাবা ? আমি বিশ্বাস করিনা, আপনার পুরোটাই মিথ্যে দিয়ে ভরা,এটা যে সত্যি বলছেন সেটা বিশ্বাস করবো কিভাবে?”

— “তার জন্য তো তোমাকে আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যেতে হবে, সেখানে গেলে আশা করি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে…”

— “কোথায়?”

— “রেডী হয়ে বাইরে এসো,আমি ড্রয়িং রুমে ওয়েট করছি..”

কথাটা বলে প্রান্তিক অনামিকার রুম থেকে বেরিয়ে যায়, অনামিকা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে…ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ও…
— “এই লোকটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, কেনো বারবার আমার সাথেই এরকম হয়…প্রথমে প্রীতম আমার সাথে প্রতারণা করলো আর এখন প্রান্তিক…এই মানুষটার সাথে এতগুলো দিন সংসার করেছি, যাকে আমি একজন নষ্ট পুরুষ মনে করেছি সে নাকি আমার স্বামী…কেনো আমাকে এতদিন অন্ধকারে রাখলেন উনি, কেনো??????”

.
.

একটা বড়ো হসপিটালের করিডোরে বসে আছে প্রান্তিক আর অনামিকা…প্রান্তিক ওর মুখটা মাস্ক দিয়ে ঢেকে রেখেছে আর অনামিকা স্কার্ফ জড়িয়ে রেখেছে নিজের মুখে…
— “হসপিটালে কেনো এনেছেন আমাকে? তাও আবার এভাবে মুখ ঢেকে??”

— “সব প্রশ্নের উত্তর পাবে তুমি,একটু ধৈর্য্য ধরো…”

একজন নার্স এগিয়ে এলো প্রান্তিকের দিকে, চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে প্রান্তিকের উদ্দেশ্যে বললো..
— “স্যার এবার আপনারা যেতে পারেন, ডক্টর ত্রিপাঠী আপনাদের ডাকছেন…”

নার্সটা চলে গেলে প্রান্তিক অনামিকাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর অনামিকার হাত ধরে দুজনে মিলে একটা কেবিনে ঢুকলো…অনামিকা দেখলো বেডে একটা যুবতী মেয়ে অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে…জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ও প্রান্তিকের দিকে…

— “চলো”

অনামিকা আর প্রান্তিক এগিয়ে গেলো মেয়েটার সামনে, প্রান্তিকের খুব কষ্ট হলো মেয়েটাকে দেখে…
— “ডক্টর এখন ও কেমন আছে?”

— “আগের মতই, আর কোনো আশা দেখতে পাচ্ছিনা আমি..”

— “না ডক্টর বলবেননা এরকম, গত পাঁচ বছর ধরে রাখি পড়িনি, কেউ ভাইফোঁটা দেয়নি আমাকে… ওকে ওর দাদার জন্য সুস্থ হতেই হবে…বোন ওঠ তুই, সামনের বছর আমি তোর হাত থেকে রাখি পড়বো, ভাই ফোঁটা নেবো। আমাকে নিরাশ করিসনা”

অনামিকা অবাক হয়ে প্রান্তিকের প্রত্যেকটা কথা শুনছে, তাহলে কি ওর সামনে যে অবচেতন হয়ে পড়ে আছে সে প্রণতি, প্রান্তিকের বোন…অনামিকা হাত রাখলো প্রান্তিকের কাঁধে…প্রান্তিক অনামিকার দিকে তাকালো…

— “দেখেছো ওরা আমার বোনটার কি অবস্থা করেছে?? বিগত পাঁচ বছর ধরে ও একভাবে শুয়ে আছে…ওই দেওয়ালের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু,আমাকে আর ভাইয়া বলে ডাকেনা…”

— “এটা প্রণতি দি?”

— “হুম”

— “কিভাবে হলো এরকম?”

— “তুমি সত্যি জানতে চেয়েছিলে না,আমি মনে করি প্রণতির থেকে বড় সত্যি আর কিছু হতে পারেনা…”

— “কারা করেছে এসব??”

প্রান্তিক চোখের জলটা মুছলো, একটা রাগী স্ট্রং মানুষকে কাঁদতে দেখে অনামিকার হৃদয় ও ব্যথিত হয়ে উঠলো…প্রান্তিক একবার ডক্টরের দিকে তাকালো…
— “ডক্টর আমরা এখন আসছি…”

প্রান্তিক অনামিকাকে নিয়ে বেরোতে গেলে ডক্টর বাঁধা দেয়,
— “প্রান্তিক শোনো!”

প্রান্তিক আর অনামিকা থমকে যায়…ডক্টর ওদের কাছে এগিয়ে আসে…
— “তোমার ওয়াইফ??”

প্রান্তিক মৃদু হাসলো…
— “হুম, ওর নাম অনামিকা..”

— “এখন শরীর কেমন আছে মা? হসপিটালে যখন এসেছো একবার চেকাপ করিয়ে যেও..”

অনামিকা একবার কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…ডক্টর হাসলেন অনামিকার চোখের চাওনি দেখে…
— “ভাবছো তো তোমার জ্বর হওয়ার কথা কিভাবে জানলাম? কাল রাত দুটোর সময় প্রান্তিক আমাকে ফোন করেছিলো, ঝড়বৃষ্টির জন্য যেতে পারিনি, কিন্তু ওকে বলেছিলাম কি করতে হবে…খুব চিন্তা করছিলোও…”

— “প্রান্তিক আপনি রাত দুটোর সময়…”

— “প্রান্তিক খুব ভালো ছেলে মা, ভাগ্য করে ওকে পেয়েছো…অবহেলা করোনা ,কারণ কিছু মানুষ জীবনে বারবার আসেনা…”

প্রান্তিক অনামিকার মুখের অভিব্যক্তিটা বোঝার চেষ্টা করলো…তারপর মুখে হাসি টেনে ডাক্তারকে বললো…
— “আপনার বৌমাকে বোঝান তো একটু, শুধু পালাই পালাই করে আমার থেকে…এরকম চলতে থাকলে আপনার আর দাদু ডাক শোনা হবে বলুন?”

অনামিকা কটমট করে তাকায় প্রান্তিকের দিকে…ডক্টর জোড়ে হেসে ওঠে…
— “You are so much funny Prantik… সারাজীবন এরকম হাসিখুশিই থেকো”

— “আপনি শুধু ভগবানের কাছে একটু প্রার্থনা করুন আমার বোনটা যেনো খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়…”

— “ভগবান তোমাকে নিরাশ করবেনা প্রান্তিক, সব ঠিক হবে”

বিছানার দুই প্রান্তে বসে আছে প্রান্তিক আর অনামিকা…হসপিটাল থেকে এসে চেঞ্জ না করেই অনামিকা আগে প্রান্তিকের কাছে নিজের প্রশ্নবিচিত্রা খুলে বসেছে…
— “কে প্রণতি দির এমন অবস্থা করেছে ??”

— “সহ্য করতে পারবে তো??”

বুকটা কেঁপে উঠলো অনামিকার,তাহলে কি ওর আপন মানুষ এই কাজটা করেছে…কাঁপা কন্ঠে বললো…
— “ক..কে?”

— “তোমার দাদাভাই অনিস পাল আর তোমার প্রাক্তন প্রেমিক প্রীতম সেন…”

দু পা পিছিয়ে গেলো অনামিকা….ওর দাদাভাই কিভাবে এরকম কাজ করতে পারে…

— “দ..দাদাভাই?”

— “হ্যাঁ ”

— “মিথ্যে বলছেন আপনি, আপনি আমার কাছ থেকে আমার সব আপন মানুষদের দূরে করার জন্য এগুলো করছেন…”

— “প্রণতির অসুস্থতাও কি তোমার কাছে মিথ্যে নাটক মনে হয় অনামিকা? তোমার দাদাভাইকে জিজ্ঞাসা করলেই সবটা জানতে পারবে তুমি…”

— “কি করেছে কি ওরা প্রণতি দির সাথে?”

প্রান্তিক উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে…জানালার ধারে গিয়ে গ্রীলটা শক্ত করে চেপে ধরলো…
— “আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে প্রণতি জেদ ধরে ইন্ডিয়া যায়, এর কারণ ছিলো প্রীতম… ও প্রীতমকে ভালবাসতো…তোমার দাদার মাধ্যমেই ইন্টারনেটে যোগাযোগ হয়েছিলো ওদের…কিন্তু ও এটা জানতো না যে পুরোটাই ছিলো অনিস দা আর প্রীতমের সাজানো পরিকল্পনা….”

অনামিকার জানার কৌতুহল হলেও নিজের দাদার সম্পর্কে এমনধারা মন্তব্য শুনে ও নিজেকে স্থির রাখতে পারছেনা…
— “তারপর?”

— “ওরা দুজন মেয়ে বিক্রির ব্যবসা করতো, আর ওদের একটা টোপ ছিলো প্রণতি, তখন ওর বয়স কত হবে ,উনিশ কি কুড়ি… ওই বয়সের একটা মেয়ে প্রেমেতে মজে নিজের জীবনের সবথেকে ভুল সিদ্ধান্তটা নিয়ে বসলো…”

— “কি সিদ্ধান্ত?”

— “লুকিয়ে বিয়ে করে ওরা অনীশ দার সহযোগিতায়…তারপর চলে যায় শিলিগুড়ি, আমার মা বোনের সাথে ইন্ডিয়া গিয়েছিলো। বোনকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন মা আমাদের জানায় বিষয়টা, আমি তৎক্ষণাৎ কলকাতা যাই, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাইনি ওকে খুঁজে…তারপর পাঁচদিনের মাথায় হটাৎ আমার মনে হলো তোমার দাদা আর প্রীতম তো বন্ধু,তাহলে নিশ্চয়ই জানবে ও…তখন আমি আমার নিজের পাওয়ার খাঁটিয়ে অনিশদাকে চেপে ধরি…সব বলে দেয় ও…তক্ষুনি শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই কিন্তু আমাদের পৌঁছাতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো…”

কথাটা বলে ভিতরে কষ্টটাকে ভিতরেই আটকে রাখলো প্রান্তিক,ঐদিনের কথা মনে পড়লেই ওর হৃদয় কেঁপে ওঠে…
— “সাতটা আলাদা আলাদা ডিএনএ পাওয়া গিয়েছিলো প্রণতি শরীরে, সাত জন মিলে ওকে…”

প্রান্তিক কথাটা শেষ করতে পারলোনা, অনামিকা প্রান্তিকের কাঁধে হাত রাখলো…প্রান্তিক চোখের জলটা মুছে নিলো…
— “ওই বয়সের একটা মেয়ে এত অত্যাচার নিতে পারেনি, সেই মুহূর্তে যদি আমি না পৌঁছাতাম তাহলে হয়তো বোনটা আমার মরেই যেতো, বাঁচিয়ে রাখতে পারলেও মেয়েটা কোমায় চলে যায়… তারপর থেকে ওই বেডেই ওর জীবন কাটছে…ওই শয়তানগুলোকে আমি ছাড়বোনা…”

— “এতকিছু হয়েছিলো আর আমি কিছুই জানতে পারিনি…”

— “তুমি তখন বন্ধুদের সাথে সামার ক্যাম্পে গিয়েছিলে…”

— “আমার দাদাভাই সবটা স্বীকার করেছিলো যখন ওকে পুলিশে কেনো দিলেননা?? আর প্রীতমকেই বা ছেড়ে দিলেন কেনো?”

— “প্রমাণের অভাবে, যেটা আমি আজও খুঁজে চলেছি…ওরা তো সামান্য দুজন চুনোপুটি…ওদের লিডারকে ধরতে না পারলে এই অপরাধ বন্ধ হবেনা…তাই জন্যই এতদিন ওদের খোলা আকাশে ঘুরতে দিয়েছি…”

অনামিকার মাথায় চট করে একটা প্রশ্ন খেলে গেলো…
— “তাহলে কি প্রীতম এই জন্যই আমার সাথে তিনবছর ধরে ভালোবাসার অভিনয় করেছে??”

((জানি আজকের পর্বটা একটু ছোটো মনে হবে, তবে এই পর্বে যদি বিকালের মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো কমেন্ট পাই তাহলে আজকেই আর একটা পর্ব দেবো))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here