আর একটিবার পর্ব-১৭

0
225

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১৭

রাত গভীর ইর্তেজা এখনো বাসায় ফিরেনি। ইরিনা আজ ঝর্ণাকে বাসায় যেতে দেয় নি ভয়ে। সে একা কখনো থাকতে পারবে না। ঝর্ণা তার বাসায় কল দিয়ে বলে দিয়েছে আজ আসবে না। ইরিনা হেলান দিয়ে বসে আছে। তার পাশে ঝর্ণা বসে ইরিনার মোবাইল দিয়ে ইউটিউব দেখছে। ইরিনা ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দেড়টা। লম্বা নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। সে ১২ টার মধ্যে ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু আজ ইর্তেজার চিন্তায় ঘুম আসছে না তার। ঝর্ণার কন্ঠ শুনে ইরিনা চোখ খুলল,
“আপা ফোন আইসে।”
ইরিনা চোখ খুলে ঝর্ণার দিকে তাকাল। দ্রুত তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে দেখে ইর্তেজার কল। রিসিভ করে কানে ধরেই ঝাড়ি মেরে বলল,
“কোথায় তুই? এত টেনশন কেন দিস আমায় বল তো।”
“তুমি ঘুমাও নি এখনো?”
“তুই বাসায় নেই। একটা বার কল দিয়ে বলিসও নি যে আজ আসবি না।”
“চিন্তা করো না। আমি সকালেই এসে পরবো।”
“কোথায় তুই ইর্তেজা? তুই ঠিক আছিস তো?
“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কি একা বাসায়?”
“না ঝর্ণা আছে আমার সাথে।”
“ঠিক আছে তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আর ঝর্ণাকে বলো দরজা ভালো মতো বন্ধ করে আসতে।”
“প্লিজ তারাতাড়ি ফিরে আসিস।”
“হুম”
ইর্তেজা কল কেটে দিলো। ইরিনার গলা ধরে আসছে কান্নায়। ঝর্ণার দিকে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ঘুমিয়ে পরি। তুমি ঘুমানোর আগে দরজা জানালা ভালো মতো দেখে ঘুমিও। ভুল করে খোলা রেখে দিও না।”
ঝর্ণা মাথা নাড়িয়ে মোবাইল নিলো। ইরিনাকে ধরে বিছানায় ভালো মতো শুইয়ে দিয়ে সেও শুয়ে পরলো। ইরিনার চোখে ঘুম নেই। তবুও জোড় করে চোখ বন্ধ করে রাখলো।
.
.
ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না। পরীক্ষা সামনে। আর সাগরিকা এখনো সব পড়া কমপ্লিট করেনি। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বইয়ে চোখ বুলাচ্ছে সে। পাশেই শ্রাবণ ঘুম। বাসায় আসার পর ঘুমিয়েছে আর উঠেনি। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ ধীরে ধীরে চোখ খুলল। সাগরিকার দিকে তাকিয়ে দেখে সে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ম*দের নেশা এখনো কিছুটা আছে শ্রাবণের মাঝে। ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বই বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলো। শ্রাবণ নেশাগ্রস্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাগরিকা শ্রাবণের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসো।”
শ্রাবণ হাসলো। সাগরিকার হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“তুমি কখন এলে? আমি জানতাম আমাকে ছাড়া তুমি থাকতেই পারবে না।”
সাগরিকা প্রথম অবাক হলেও পরে হেসে দিলো। শ্রাবণ তাহলে সব ভুলে গিয়েছে। সাগরিকার হাসি দেখে শ্রাবণ তার কিছুটা কাছে গেল। সাগরিকা তা দেখে হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে? শুয়ে পরো চুপচাপ।”
শ্রাবণ না সূচক মাথা নাড়াল। সাগরিকার নিজের হাত ছাড়িয়ে বই নিয়ে দ্রুত খাট থেকে নামতে নিলো। কিন্তু শ্রাবণ তার হাত ধরে ফেলল। সাগরিকা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ ঠোঁট বাচ্চাদের মতো বাঁকিয়ে বলল,
“আবার চলে যাচ্ছো?”
“ইশশ শ্রাবণ, তোমার মতো দামড়া পুরুষের কাছ থেকে আমি এমন ন্যাকামো আশা করি নি।”
শ্রাবণ হেসে উঠল। সাগরিকা বিরক্ত হয়ে বলল,
“যেতে দাও। পালিয়ে যাচ্ছি না বই রাখতে যাচ্ছি।”
শ্রাবণ তবুও ছাড়লো না সাগরিকাকে। সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“ফিরে তোমার কাছেই আসবো।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে সাগরিকার হাত ছেড়ে দিলো। সাগরিকা গিয়ে বই রেখে রান্নাঘরে গেল। একগ্লাস চিনি ছাড়া লেবুর শরবত নিয়ে আসলো। শ্রাবণ হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। গ্লাস টেবিলের উপর রেখে সাগরিকা শ্রাবণের কাছে আসলো। সাগরিকার উপস্থির টের পেয়ে শ্রাবণ চোখ খুলল। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে ইশারায় বলল খাট থেকে নামতে। শ্রাবণ সাথে সাথে সাগরিকার হাতে হাত রেখে খাট থেকে নামলো। সাগরিকা তাকে বাথরুম নিয়ে গিয়ে শাওয়ারের নিজে দাঁড় করালো। শ্রাবণ হারিয়ে আছে ভালোবাসার জগতে। সে শুধু সাগরিকাকে দেখছে। আশে পাশে কি হচ্ছে সেটার খেয়াল নেই। সাগরিকা শাওয়ার ছেড়ে দিলো। হঠাৎ মাথায় পানি পরায় শ্রাবণ চমকে উঠল। সাগরিকা তাকে ধরে রাগী কন্ঠে বলল,
“চুপচাপ দাঁড়াও। পুরো গা থেকে বাজে গন্ধ আসছে আমি সহ্য করতে পারছি না।”
শ্রাবণ চুপসে গেল। সাগরিকা তাকে গোসল করতে বলে বাথরুম থেকে বের হলো। সেও কিছুটা ভিজেছে। আলমারি থেকে শ্রাবণের জামা বের করে আবার বাথরুমে গেল। শ্রাবণ এখনো শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকা তাকে দাঁড়াতে বলেছিল বলে সে সত্যিই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকা নিঃশব্দে হাসলো। মাঝেমধ্যে এমন এমন কাজ করে শ্রাবণ সে না হেসে পারে না।

শ্রাবণ খাটের উপর বসে আছে আর সাগরিকা তার মাথা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে। শ্রাবণ বার বার পড়ে যেতে নেয় সাগরিকা ধরে ফেলে। এক সময় ধমক দিয়ে বলল,
“তুমি সোজা হয়ে বসতে পারো না? মাথা ভিজে আছে দেখেছো?”
“আমার অনেক ঘুম আসছে।”
সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে তোয়ালে বিছানার উপর রেখে দ্রুত গিয়ে শরবতের গ্লাস নিলো। ফিরে আসতে আসতে শ্রাবণ নেতিয়ে পড়েছে। সাগরিকা তার হাত ধরে টেনে তুলে বসালো।
“শ্রাবণ এটা খেয়ে নাও।”
শ্রাবণ সাগরিকার হাতে গ্লাস দেখে নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“ইয়াক একদম না।”
“কি বললে?”
সাগরিকা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ মন খারাপ করে বলল,
“তুমি শুধু অত্যাচার করো আমার উপর।”
“আর নিজে যখন আমার উপর অত্যাচার করো সেটা কি?”
“হয়েছে তো আর কত লজ্জা দিবে?”
“আর দিবো না। এখন লক্ষী বাচ্চাদের মতো হা করো। এটা পুরোটা পান করতে হবে বুঝলে?”
শ্রাবণ নাক মুখ কুঁচকে রেখে কোনোমতে শরবত পান করে নিলো। সাগরিকা মুচকি হেসে শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ওড়নায় টান অনুভব করলো। ঘুরে দেখে শ্রাবণ তার ওড়না দিয়ে মুখ মুছছে। সাগরিকা কিছু বলল না। শ্রাবণ দ্রুত গিয়ে বিছানা গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সাগরিকা রান্নাঘরে গিয়ে গ্লাস রেখে ঘরে ফিরে আসলো। নিজের জামা বের করে পরিবর্তন করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুম। সাগরিকা লাইট বন্ধ করে এসে শুয়ে পরলো। শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই গায়ে স্পর্শ পেলো। শ্রাবণ সাগরিকার গলায় মুখ ডুবিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। সাগরিকা শ্রাবণকে সরানোর চেষ্টা করলো কিন্তু শ্রাবণ সরলো না। সে সাগরিকাকে আরো শক্ত করে ধরে ঘুমিয়ে রইলো। সাগরিকা মুচকি হেসে শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো।
.
.
ধীরে ধীরে চোখ খুলল মাহা। মাথা ভার হয়ে আছে তার। চারপাশে চোখ বুলালো কিন্তু কেও নেই। সে তো পার্লারে গিয়েছিল হঠাৎ এখানে আসলো কীভাবে বুঝতে পারছে না। কোথায় আছে এখন সেটাও বুঝতে পারছে না। পুরো কক্ষ আবছা আলোয় ঢাকা। ঠিক মতো দেখাও যাচ্ছে না কিছু। মাহা উঠে দাঁড়াল। কোথায় গেলে বাহিরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাবে বুঝতে পারছে না। এক কদম এগিয়ে যেতেই মাথা ঘুরিয়ে দিলো তার। পড়ে যেতে নিলো তার আগেই কেও একজন এসে তাকে ধরে ফেলল। মাহা নিভু নিভু চোখে মানুষটার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এই আবছা আলোয় সে মানুষটা কে বুঝে গিয়েছে। নিজের চোখে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? এটা বাস্তবতা বুঝতে পারলো। মাহা চোখ বড়ো বড়ো এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তার হাত পা কাঁপছে। কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। তার মনে হচ্ছে কেও তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। হঠাৎ অতি পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসলো,
“অনেকে বলে দুনিয়া খুব ছোটো। আজ মনে হচ্ছে, সত্যি দুনিয়া খুব ছোটো।”
মাহা আশে পাশে দেখে বলল,
“আ..আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন? আমার চাচী কোথায়?”
“চাচী? হুম রোকসানা আন্টি। তাই তো উনার ছবি দেখে মনে হচ্ছিল আমি উনাকে চিনি। কিন্তু কোনোমতেই মনে করতে পারছিলাম না।”
“আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
তখনই চারপাশের লাইট জ্বলে উঠলো। ইর্তেজা দরজার দিকে তাকাল। বাদশাহ লাইট জ্বালিয়েছে। বাদশাহ বলল,
“হয়তো আপু আপনাকে চিনতে পারে নি।”
“তোমার আপু আমাকে অন্ধকারেও চিনে ফেলতে পারে। এখানে তো তাও আবছা আলো ছিল।”
মাহা একবার বাদশাহ’র দিকে তাকাল। আর একবার ইর্তেজার দিকে। তাদের কথা শুনে উঁচু স্বরে বলল,
“হচ্ছেটা কি এখানে? আপনারা আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
“শান্ত হও মাহা।”
“কেন শান্ত হবো? আমার চাচী, চাচু, সায়ান সবাই কোথায়?”
ইর্তেজার রাগ হচ্ছে। অগ্নি দৃষ্টিতে মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একদম চুপ, তোর সব প্রশ্নের উত্তর দেবো।”
মাহা হাতমুঠো শক্ত করে তাকিয়ে রইল ইর্তেজার দিকে। ইর্তেজা নিজেকে শান্ত করে আবার বলল,
“বসো তুমি” আবার বাদশাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ওর জন্য কিছু খেতে নিয়ে আসো।”
মাহা রাগী কন্ঠে বলল,
“আমাকে এখানে ডিনার করাতে নিয়ে এসেছেন আপনারা? আমাকে আমার বাসায় দিয়ে আসেন এখনই।”
ইর্তেজা ধমকের স্বরে বলল,
“দিয়ে আসবো, দিয়ে আসবো তোমাকে তোমার স্বামীর কাছে এবার আল্লাহর ওয়াস্তে মুখ বন্ধ রাখো।”
মাহা চুপসে গেল। ইর্তেজা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। কলিজা ফেটে কান্না আসছে তার। বাদশাহ পরিস্থিতি দেখে চলে গেল। মাহা চেয়ারে বসে কপালে হাত দিয়ে বসে রইল। নিয়তি কেন আবার ইর্তেজা আর তার দেখা করালো বুঝতে পারছে না সে। ইর্তেজা মাহার দিকে এগিয়ে আসলো। মাহা সাথে সাথে মাথা তুলে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দূর, দূর থাকুন আমার থেকে।”
“দূর-ই আছি। দেখো আমায়। কতটা দূর আছি আমি তোমার থেকে। আমাদের মাঝে এতটা দূরত্ব এসে পরেছে যে দূরত্ব কখনো শেষ হবে না। সময়ের সাথে সাথে আরো বাড়তে থাকবে।”
মাহা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ইর্তেজা মাহার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“অনেক রাগ আমার উপর তাই না? মাহা সেদিন…”
মাহা দ্রুত ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চুপ, আমি কিছু শুনতে চাই না। অতীতে যা হয়েছে আমি সব ভুলে গিয়েছি। এখন নিজের বর্তমান নিয়ে আমি খুব ভালো আছি, খুব।”
“হ্যাঁ আমি জানি। আমি তো শুধু চাই তুই আমাকে মাফ করে দে। আমি পারি নি তোর কথা রাখতে।”
মাহার চোখের কোণায় অশ্রু জমে গেল। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। সে ইর্তেজাকে নিজের চোখের পানি দেখাতে চায় না। ইর্তেজা মাহার হাতের দিকে তাকাল। ভেজা কন্ঠে বলল,
“তোর হাতে অন্য কারোর নাম দেখে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। ভাবতেই খারাপ লাগছে তোর উপর আমার কোনো অধিকার নেই।”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন এসব বলে কি লাভ শুনি? আপনার কি মনে হয় আপনার এসব কথা শুনে আমার খারাপ লাগবে কষ্ট হবে? একদম না। আমার রাগ হচ্ছে অনেক রাগ। আপনাকে যতটা ঘৃণা করতাম এখন তার থেকেও বেশি ঘৃণা হচ্ছে।”
ইর্তেজা চোখ মুছে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“শ্রাবণ আহমেদের জন্য কাজ করি আমি। সে আমাকে রোকসানা আন্টিকে কিড*ন্যাপ করতে বলেছে।”
“চাচীকে? কিন্তু কেন?”
“তোর চাচার কাছ থেকে সে একটা জমি কিনতে চায়। কিন্তু তোর চাচা তাকে না করে দিয়েছিল। তাই সে ভেবেছে তার স্ত্রীকে কিড*ন্যাপ করে জোর করে জমি কিনে নিবে। কিন্তু আমরা ভুল করে তোকে তুলে নিয়েছি।”
মাহা দাঁড়িয়ে ইর্তেজার দিকে এগিয়ে আসলো। রাগে শরীর জ্বলছে তার। ইর্তেজার কলার চেপে ধরে বলল,
“গু*ন্ডামি শুরু করেছিস তুই? এত নিচে কিভাবে নামতে পারলি?”
“তুই বুঝবি না। যেদিন আমার প্রতি রাগ কমবে সেদিন বলবো কেন এই পথ বেছে নিয়েছি আমি।”
মাহা ইর্তেজার কলার এক ঝটকায় ছেড়ে বলল,
“এসবের পর তোর প্রতি আমার রাগ কম হওয়া সম্ভব?”
ইর্তেজা না সূচক মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। মাহা এক হাত কোমড়ে রেখে আর এক হাত কপালে রেখে ফুপাচ্ছে। ইর্তেজা মাহার উদ্দেশ্যে বলল,
“শ্রাবণ আহমেদ বললেই তোকে তোর স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসবো।”
মাহা কপাল থেকে হাত সরিয়ে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর এটা কবে হবে?”
“সকাল বা রাতের মধ্যে হয়ে যাবে।”
“আর রাত পর্যন্ত আমি এইখানে থাকবো তাই তো?”
“আমি শ্রাবণকে বলে জায়গা পরিবর্তন করে নিবো সমস্যা নেই।”
“আমার ভাবতেই অবাক লাগছে, যে ছেলেটা সবাই বলে বেড়াতো পাপ কাজ কর্ম থেকে দূর থাকতে সে নিজেই এখন পাপ পথের পথচারী?”
ইর্তেজা জবাব দিলো না। বাদশাহ আসলো খাবার নিয়ে। ইর্তেজা বাদশাহ’র কাছ থেকে খাবারের প্যাকেট নিয়ে বলল,
“জায়গা পরিবর্তন করবো। কোথায় যাওয়া যায় বাদশাহ?”
“এটা তো স্যারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আর এটা সকালের আগে সম্ভব না।”
ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মাহার দিকে খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিতেই মাহা নাক মুখ কুঁচকে হেটে গিয়ে চেয়ারে বসলো। ইর্তেজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাদশাহকে ইশারায় বলল চলে যেতে। বাদশাহ তাই করলো। ইর্তেজা প্যাকেট খুলে মাহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তোর ফেভারিট চিকেন বার্গার। রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে এসেছে কোনো ফুটপাত থেকে না খেয়ে নে।”
মাহা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ইর্তেজা আর কিছু বলল না। বার্গার প্যাকেটে রেখে একপাশে রেখে দিলো। এগিয়ে গিয়ে মাটিতে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিলো। মাহা তার বরাবর চেয়ারে বিরক্ত চেহারা বানিয়ে বসে আছে।

————-

সাগরিকার ডাকে শ্রাবণের ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সাগরিকা তার পাশে বসে আছে। শ্রাবণ হেসে সাগরিকার কোলে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে ধরলো। সাগরিকা বিরক্ত হয়ে শ্রাবণকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। শ্রাবণ ধীরে ধীরে উঠে বসলো। সাগরিকা রাগী কন্ঠে বলল,
“কাকে কিড*ন্যাপ করিয়েছো শুনি?”
“তুমি এটা শোনার জন্য আমাকে ঘুম থেকে উঠালে।”
“এমনই কিছু। জবাব দাও।”
শ্রাবণ হেলান দিয়ে বসে বিরক্ত চেহারা বানিয়ে বসলো। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাগরিকাকে সব বলল। সাগরিকা দ্রুত শ্রাবণের পাশে বসে বলল,
“ইর্তেজা কাকে কিড*ন্যাপ করেছে?”
“হয়তো আয়মান খলিলের বোনকে।”
“ওর নাম মেহরুন্নেসা মাহা?”
“হ্যাঁ, তুমি এত কিউরিয়াস হয়ে গেলে কেন হঠাৎ?”
“এইভাবেই। যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি নাশতা বানাতে যাই।”
শ্রাবণ মাথা নাড়াল। খাট থেকে নেমে সাগরিকাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে চলে গেল। সাগরিকা বিছানা গুছিয়ে মোবাইল নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। রান্নাঘরে গিয়ে ইর্তেজাকে কল করলো।

মোবাইল টনের শব্দ শুনে ইর্তেজার ঘুম ভাঙলো। মাহার দিকে তাকিয়ে দেখে মাহা গুটিশুটি মেরে চেয়ারেই শুয়ে আছে। ইর্তেজা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সাগরিকার নাম্বার ভাসছে। রিসিভ করে কানে ধরলো।
“আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কোথায় তুমি ইর্তেজা?”
“আছি আশে পাশেই। বলুন ম্যাম কোনো কাজ আছে?”
“শ্রাবণের কাছ থেকে সব জেনেছি। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“জি ম্যাম করুন”
“তুমি যাকে ভুল করে কিড*ন্যাপ করেছো সে তোমার মাহা তাই না?”
ইর্তেজা দ্রুত উঠে বসলো। তার দৃষ্টি মাহার দিকে। সাগরিকা জবাব না পেয়ে বলল,
“হুম বুঝে গিয়েছি। নিয়তি আবার তোমাকে তোমার ভালোবাসার মানুষটার সামনে দাঁড় করিয়েছে। এবার তাকে হাতছাড়া করো না। জানো ইর্তেজা, সবার ভাগ্যে নিজের ভালোবাসার মানুষ লিখা থাকে না। সে সব মানুষগুলো লাকি যাদের ভাগ্যে লিখা থাকে।”
“ম্যাম, আপনার ভাগ্য খুব ভালো আপনি বসকে পেয়েছেন। উনি আপনাকে অনেক ভালোবাসে।”
“জানি, কিন্তু ইর্তেজা মন যখন অন্য কাওকে চায় আর কাওকে ভালো লাগে না।”
“আপনি কি আজও সেই মানুষটাকে ভালোবাসেন?”
“জানি না, আমি শুধু চাই সে ভালো থাকুক। তার পরিবারের কাছে ফিরে যাক। প্রতিদিন তার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তার সাথে কাটানো সময় গুলো। কান্না পায় খুব। দেখতে ইচ্ছে করে তাকে। হয়তো ভালোবাসি তাকে। হুম আমি আজমাইনকে আজও ভালোবাসি।”
হঠাৎ দরজার পাশ থেকে শ্রাবণের কন্ঠ ভেসে আসলো, “সাগরিকা”।

ইর্তেজা মোবাইলের দিকে তাকাল। আবার কানে দিয়ে দেখে কল কেটে গিয়েছে। ইর্তেজা দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকালো। সে সাগরিকার অনুভূতি বুঝতে পারছে। কারণ সেও এমন পরিস্থিতির শিকার। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকাল। মাহা নড়েচড়ে চোখ খুলল। পুরো শরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছে তার চেয়ারে বসে থেকে। সোজা হয়ে বসে দেখে ইর্তেজা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাহা বিরক্ত হয়ে অন্য দিকে তাকাল। বাদশাহ এসে ইর্তেজাকে বলল,
“নতুন জায়গার ব্যবস্থা করে ফেলেছি ইর্তেজা ভাই।”
ইর্তেজা উঠে দাঁড়াল। মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“লাগবে না। আমি ওকে ওর বাসায় দিয়ে আসবো এখনই।”
মাহা ইর্তেজার দিকে আড়চোখে তাকাল। বাদশাহ অবাক হয়ে বলল,
“শ্রাবণ স্যার আপনার ১২ টা বাজিয়ে দিবে কাজ পুরো না হলে।”
“যা করার করুক। আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে।”
মাহা দাঁড়িয়ে বলল,
“চাচুকে আমি মানাবো। উনি নিশ্চয়ই জমি দিয়ে দেবে আমি বললে।”
“ব্যস, প্রবলেম সল্ভ।”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজা এদিক সেদিক দেখে মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি তৈরী হয়ে নাও। আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে।”

শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে আছে। সাগরিকা হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে জ্বলন্ত চুলার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ সাগরিকাকে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“তুমি এখনো আজমাইনকে ভুলো নি?”
সাগরিকা শ্রাবণের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কেন ভুলবো? সে তো প্রতারণা করেনি আমার সাথে। বরং আমাকে বাঁচাতে গিয়েই তোমার ফাঁদে পড়েছে। আর তুমি আজও তাকে বন্দী করে রেখেছো।”
শ্রাবণের মুখে অপরাধী ভাব ফুটে উঠলো। সাগরিকা শ্রাবণের হাত সরিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না শ্রাবণ। কারণ জানো? তোমার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। হ্যাঁ আমি সত্যি বলছি। যবে থেকে আমার মিসক্যারিজ হয়েছে আমি যেন অন্য রকম হয়ে গিয়েছি। তোমাকে দেখলে আর ঘৃণা হয় না আমার। আবার ভালোও বাসতে ইচ্ছে করে না। শ্রাবণ আমার এই রিকুয়েষ্টটা রাখো প্লিজ। তুমি তো বলেছো তুমি ভালো হয়ে যাবে। তাহলে আজমাইনকে ছেড়ে দাও প্লিজ। আমি সবসময় তোমার হয়ে থাকবো।”
শ্রাবণ অন্য দিকে তাকাল। তার বুকের বা পাশ ব্যাথা করছে খুব। সাগরিকা হঠাৎ শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি তো জানতে তার অবস্থা। তার মায়ের একমাত্র ছেলে সে। একজন মায়ের জন্য কত কষ্টের বিষয় হতে পারে এটা যে তার ছেলে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গিয়েছে। তুমি ওকে ছেড়ে দাও প্লিজ।”
শ্রাবণ সাগরিকার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পরলো। সাগরিকা শ্রাবণের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। চোখের পানি মুছে কাজে মন দিলো।

সাঈদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আছড়াচ্ছে। আজ সে কলেজ যাবে। আগের থেকে অনেকটা সুস্থ হয়ে গিয়েছে। দ্রুত তৈরী হয়ে ঘর থেকে বের হলো। মা বাবার সাথে নাশতা করে বেরিয়ে পরলো। ইরিনাকে কতদিন হলো দেখে না। মন ছটফট করছে তাকে এক নজর দেখার জন্য। ভেবেছে কলেজের ছুটির পর যাবে। কলেজ পৌঁছে সাঈদ পার্কিং প্লেসে বাইক পার্ক করে ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরতেই দেখে জেসমিন দাঁড়িয়ে আছে। সাঈদ বিরক্ত হলো কিন্তু চেহারায় প্রকাশ করলো না। হাসিমুখে বলল,
“গুড মর্নিং স্টুডেন্ট।”
জেসমিন জবাব দিলো না। সাঈদ আর কিছু বলল না পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো। হঠাৎ জেসমিন তার হাত ধরে ফেলল। সাঈদ পেছনে ফিরে দেখে জেসমিন মুখ লটকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাঈদ দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।
“কি হয়েছে তোমার?”
জেসমিন এখনো জবাব দিলো না। হঠাৎ সাঈদকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। সাঈদ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন ফুপাতে ফুপাতে বলল,
“আপনি অসুস্থ ছিলেন। জানেন আমার কত কষ্ট হচ্ছিল?”
সাঈদ নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
“এই কেমন বেয়াদবি জেসমিন? তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে জড়িয়ে ধরার।”
“অনেক হয়েছে। আপনি আজ স্পষ্ট শুনে রাখুন। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর আপনাকেও আমাকে ভালোবাসতে হবে।”
সাঈদ রাগে গজগজ করছে। জেসমিন আবার বলল,
“আপনি আমাকে ভালো না বাসলে আমি বি*ষ খেয়ে ম*রে যাব।”
সাঈদ সজোরে জেসমিনের গালে চড় বসিয়ে দিলো। জেসমিন গালে হাত দিয়ে সাঈদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাঈদ রাগে কটমট করতে করতে বলল,
“আজকের পর থেকে আমার চোখের সামনে আসবে না তুমি। আমি আজই তোমার বাবাকে বলে কলেজ থেকে রিজাইন নিচ্ছি।”
বলেই সাঈদ হনহন করে হাঁটা ধরলো। রাগে গা জ্বলছে তার। জেসমিন হাতমুঠো শক্ত করে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে তার বাবাকে কল করলো। বাবা কল রিসিভ করতেই কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“আব্বু”
“কি হলো মামনি কাঁদছো কেন তুমি?”
“আব্বু সাঈদ স্যার আমার সাথে জোরাজুরি করেছে। হি ট্রাইং টু রেই*প মি।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here