#প্রেমস্পন্দন
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০৯
” একজন কল রিসিভ না করে ফোন বন্ধ করে রেখেছে জন্য তোর কান্নাকাটি কেন করতে হবে নওশীন? তুই কি এখনো ছোটো? বুঝিস না কিছু? আমি আগাগোড়া বলেছি ওই ছেলে ভালো না, মুখে মধু নিয়ে কথা বলে। সোজা বাংলা কথায় নুহাশ তোকে ঠ*কিয়েছে। তোর সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করতে চায় না। কীভাবে ব্রেকাপ করবে সেটা হয়তো বুঝতে পারছিল না তাই তোর সাথে যোগাযোগ রাখছে না।”
নওশীন ভোরবেলা থেকে নুহাশকে কল দিয়ে আর একটাবারের জন্যও পায়নি। কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। নোয়া আর স্নেহার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছিল সে। তারা বাড়ি ফিরে এলে নওশীন ভোরবেলার ঘটনা খুলে বললে উক্ত কথাটি নোয়া বলে নওশীনকে পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করে।
স্নেহা শুধু নওশীনকে চুপ করতে বলে যাচ্ছে। কান্নার শব্দ বাহিরে গেলে নানা- নানি চলে আসবে আর তারা চলে আসলে বড়ো-সড়ো আকারের একটা ঝামেলা হয়ে যাবে।
নোয়া নিজের বিছানা ছেড়ে নওশীনের পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়। কী হয়েছে, কী হচ্ছে সেটা সে নিজেও জানে না। শুধু জানে নওশীনকে ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না। মেয়েটা ভেঙে পড়লে যে এবার আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না, একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবে এবার।
নওশীন মাথা তুলে নিজেই নিজের চোখের পানি মুছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে ওঠে,” আপু, আমার সাথে কি এবার সব ভুল হবে? আমি ঠ*কে যাব? নুহাশ আমাকে ঠ*কাবে? কীসে কমতি ছিল আমার বলো তো?”
নোয়া কিছু বলার আগেই স্নেহা বলে ওঠে,” আমার মনে হচ্ছে তোমরা একটু বেশিই ভাবছো। ওখানে কী হচ্ছে সেটা আমরা কেউ জানি না। আর এই যে নওশীন, কল রিসিভ করেনি হয়তো ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হতে পারে না এমন?”
নোয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু একটা ভেবে বলে,” নওশীন, নুহাশের বন্ধুর নাম কী যেন বলেছিলি? কবির! হ্যাঁ কবিরকে একবার কল দে। বিষয়টা আমার কাছে গোলমেলে লাগছে। দু’বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে পড়ছে আবার। জানি না তোর সাথে কী হচ্ছে বা হবে।”
নোয়ার কথা শুনে সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় নওশীন। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,” কী মনে হচ্ছে আপু? আমাকে বলো প্লিজ।”
স্নেহা নওশীনের ফোনটা নিয়ে নওশীনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,” ভাবাভাবি বন্ধ করে তুই কল দে। উনার কাছেই জানতে পারবি কী হচ্ছে বা হয়েছে।”
নোয়াও বলে ওঠে,” কী হচ্ছে সেটা জানার মাধ্যম তো আছেই, চিন্তা করছিস কেন? ফোন লাগা জলদি।”
নওশীন ওরনা দিয়ে চোখ-মুখ মুছে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে নুহাশের বন্ধু কবিরের ফোন কল দেয়। প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেলে নোয়া আবার কল দিতে বলে। নোয়ার কথা শুনে নওশীন আবার কল করে। দ্বিতীয়বারে কল রিসিভ হয়।
নওশীন সালাম দিতেই ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো গলায় সালামের জবাব আসে।
নওশীন মলিনমুখে বলে,” ভাইয়া এত সকালে আপনাকে কল করা উচিৎ হয়নি কিন্তু কল না করেও উপায় পাচ্ছিলাম না। আমি নওশীন, আমাকে চিনেছেন?”
নওশীনের পরিচয় পেয়ে ওপাশে থাকা ব্যক্তি তড়িৎ গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসে। চোখ ডলে স্ক্রিনে থাকা সেভ করা নম্বরটি দেখে নেয়।
চকিতে বলে, ” হ্যাঁ আপু বলো।”
নওশীন স্নেহা আর নোয়ার দিকে একবার করে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,” ভাইয়া, নুহাশ ঠিক আছে? ওর কোন বিপদ হয়নি তো? আমি ওকে ফোনে পাচ্ছি না৷ গতকাল দেখা হয়েছিল, তখন তো ভালোই ছিল। বাসায় আসার সময় গাড়ি ছাডা অবধি স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল। বাসায় ফিরে বিকেলে কথা হয়েছিল। ব্যস্ত ছিল জন্য রাতে কথা বলবে বলেছিল। রাতে ওকে ফোনে পাইনি, ফোন বন্ধ। সকালে দুইবার রিং হলেও পরে আবার ফোন বন্ধ। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ভাইয়া।”
কবির একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। তাকে চুপ থাকতে দেখে নওশীন কিছু একটা বুঝতে পেরে বলে,” ভাইয়া আমি সবকিছু শুনতে প্রস্তুত। আপনি আমাকে বলতে পারেন।”
নওশীনের জন্য কবিরের খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। কিছু লুকোতেও ইচ্ছে করছে না তার। সত্যিটা বলতেও মন সায় দিচ্ছে না। তবুও নিজেকে শক্ত করে বলে ওঠে,” কী যে বলি আপু! আপনাকে সত্যিটা বলার সাহস আমার হচ্ছে না। ”
” বলেন ভাইয়া।”
কবির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সত্যিটা বলবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। নওশীন আরেকবার জিজ্ঞেস করতেই বলে,” রাতে নুহাশের কাজিনের সাথে বিয়ে হয়েছে। ও একবার বলেছিল ওর কাজিন ওকে পছন্দ করে, নিজের কথা কখনো বলেনি। আমার মনে হয় ওদের সম্পর্ক ছিল।”
ফোনটা হাত থেকে ধপ করে মেঝেতে পড়ে যায়। নিশ্চুপ হয়ে যায় নওশীন। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। ফোনের ওপাশ থেকে কবির ‘ হ্যালো, হ্যালো’ করে যাচ্ছে। কলটা লাউডস্পিকার করা ছিল। নোয়া আর স্নেহা দুজন মিলে দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। নওশীন নিজের দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে কান্না করে ওঠে।
_____
দুপুর তিনটা-
নওশীন মন খারাপ করে জানালার পাশে বসে আছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। চোখের রং লাল হয়ে গেছে। ফুলেও গেছে খানিকটা। নুহাশের এমন একটা কাজের পর সে নিজেকে কোন ভাবে সামলে উঠতে পারছে না। সকালে খাওয়া দাওয়াও করেনি। দুপুরে খাওয়ার জন্য নোয়া ডাকতে এলেও খেতে যাইনি। নোয়া নিজেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে প্লেটে নওশীনের জন্য খাবার এনেছিল। জোর করে দুই তিন লোকমা নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দিয়েছে।
সকাল থেকে নওশীন এক ভাবেই জানালার পাশে বসে আছে। কী করবে, না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না।
নোয়া তাকে বারবার বুঝিয়েছে এখন কোনভাবেই ভেঙে পড়া যাবে না। নোয়া আরো বলেছে তার এখন আদনানের বিষয় ভাবা উচিত। কোন মানুষই নিজের চেয়ে অন্য কাউকে বেশি ভালবাসতে পারে না। তাই নওশীনের উচিত যা হয়েছে তা ভুলে গিয়ে আদনানের বিষয় ভাবা।
রুমে তিনজনই ছিল। স্নেহা ঘুমাচ্ছিল, নোয়া শুয়ে শুয়ে ফোন দিচ্ছিল। নওশীন জানালার পাশে থেকে উঠে নোয়ার কাছে যায়।
নওশীনকে দেখে নোয়া মুচকি হেসে বলে, ” আয় এদিকে আমার কাছে বস।”
নওশীনের চোখ, গাল মুছে দিতে দিতে আবার বলে, ” দেখেছিস একটাবার নিজেকে? এই এক বেলায় নিজের কি অবস্থা করেছিস, আল্লাহ! আর কতবার তোকে বলবো ওই ছেলে তোর জন্য সঠিক ছিল না। ”
নওশীন নোয়ার কথার উত্তর না দিয়ে বলে,” আপু, আদনান স্যারের নম্বর পাওয়া যাবে? নানা- ভাইয়ের কাছে কি ওনার নম্বর আছে? ”
নওশীনের কথায় নোয়ার মুখে হাসি উঠে যায়। সে বলে,” তুই উনার সাথে কথা বলবি? তুই এখানে বস, আমি এক্ষুনি নানা- ভাইয়ের কাছে থেকে নম্বর এনে দিচ্ছি। ”
” না না তোমাকে কষ্ট করে নম্বর এনে দিতে হবে না, আমি নিজেই যাচ্ছি। ”
” নানা-ভাই তোকে এই অবস্থায় দেখলে কষ্ট পাবে। ”
” নানাভাই জানে, দেখেছে আমাকে।”
নওশীন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” নানাভাই জানে? ”
” হ্যাঁ, তোমরা দুপুরে খাচ্ছিলে তখন নানা ভাই আমার রুমে এসেছিল তখন নানাভাই রুমে এসেছিল। নানাভাই অনেকক্ষণ কথা বলেছে এসব নিয়ে৷ আগে যতটা খারাপ লাগছিল এখন আর ততটা লাগছে না। ওকে তো ঘৃণা লাগছে আমার।”
নওশীন নিজের কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার নানা বাহিরেই চেয়ার পেতে বসে ছিলেন। নওশীন ধীরপায়ে সেদিকেই এগিয়ে যায়। নওশীনকে আসতে দেখে মুহিব শেখ বলে ওঠেন,” ঘুম আসছে না?”
নওশীন মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,” না। ঘুম আসছে না। নানাভাই আদনান সাহেবের নম্বর আছে? উনার নম্বরটা দেওয়া যাবে?”
মুহিব শেখ হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,” তুই কি তার সম্পর্কে ভাবতে চাচ্ছিস নানাভাই?”
” হ্যাঁ। আচ্ছা, উনার সাথে বের হলে কি তোমরা কেউ মাইন্ড করবে? আমার বাড়িতে ভালো লাগছে না।”
” আজকেই ‘হ্যাঁ’ বলছি। এটাই প্রথম আর এটাই শেষ। এরপর এরকম আর কোন আবদার করবে না৷ নাও আমার ফোনটা নাও, এখানে নম্বর সেভ করা আছে।”
নওশীন মুহিব শেখ-এর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আদনানের নম্বরটা নেয়। নানার সাথে আরও কিছু কথা বলে রুমে চলে আসে।
নওশীনকে রুমে আসতে দেখে নোয়া বলে ওঠে,” পেয়েছিস নম্বর?”
” হ্যাঁ, পেয়েছি। ”
” কল দিবি?”
” কল না দিলে নম্বর কেন নিলাম?”
” কী বলবি?”
” দেখো কী বলি!”
নওশীন আর কোন কথা না বলে ফোনটা নিয়ে জানালার কাছে চলে যায়। আদনানের নম্বরটি বের করেই কল দেয়।
রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ হয়ে যায়। নওশীন কাঁপা কাঁপা গলায় সালাম দেয়। আদনান নওশীনের কলে বেশ অবাক হয়।
অপ্রস্তুতভাবেই বলে ওঠে,” হঠাৎ কলে দিলে যে? কোন প্রয়োজন? ”
” আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?”
#চলবে……