“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ২০
(নূর নাফিসা)
.
.
“এক চড়ে যদি মেরে ফেলতে পারেন, তো দেন।”
“তোকে মেরে আমি জেল খাটতে পারবো না।”
“আর আমাকে অন্যের ঘরে খুব দেখতে পারবেন?”
“আবার বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
বিপু কৌতুহলী চোখে তাকায় কান্তার দিকে। কান্তা মলিন মুখে পথ চলতে চলতে জবাব দেয়,
“হতে কতক্ষণ। আম্মাকে বলে দিছি আপনার কথা।”
“তারপর?”
“তারপর মাইর খেয়ে এই ক’দিন যাবত আমি ঘরে বন্দী।”
একটু মেজাজেই জবাব দেয় কান্তা। বিপু চুপ করে থাকে। যা নিয়েই ভাবতে যায়, এলোমেলো লাগে শুধু। কিনারা পাচ্ছে না যে ঠিক কি যে সে করবে। হুট করেই হাতটা ধরে ফেলতে পারে না চতুর্দিকে ঘিরে থাকা সমস্যার কারণে। একটা পথ তো অন্তত খোলা থাকতো। ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলে ক্লিয়ার হতে চাইছিলো ব্যাপারটা। একে তো বড় ভাই, সেভাবে সবটা বলা যায় না খুলে। দ্বিতীয়, এই আলাপ করতে যাবে দেখলেই কেমন খাপছাড়া জবাব দিয়ে বসে ভাই। “এখনই এতো প্যারা নেওয়ার কি আছে? বয়স খুব হয়ে যায়নি। সময় বহু বাকি। কান্তা পড়ছে, পড়তে থাকুক। বাড়িঘর ঠিকঠাক হোক। এক বউ এসেই তো ঘর পায়নি এখনো।”
বিপু ভাবনা নিয়ে চুপ থাকলেও কান্তা আরও বলে,
“শুধু আম্মা ই না। আব্বাও টের পায় কিছু কিছু। আপনে বাড়ির সামনে গেছেন?”
কান্তার চোখে একবার তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলে,
“গিয়েছিলাম। তোর আব্বার সাথে ভুলেভালে দেখা হয়েছিলো।”
“ভুলে ভালে দেখা? দিলেন তো আমার বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে। আজকে পরীক্ষা দিতেও বের হতে দিচ্ছিলো না আম্মা। অবাধ্য হয়ে আসছি। এইযে, এখনো সাথে সাথে ঘুরতাছেন। বাজারে যদি আব্বা থাকে, কেমন হইবো?”
“থাকলে থাকুক। দেখলেই তো ভালা। রাগারাগি যা করার, করে তাড়াতাড়ি মেনে নিবো।”
“স্বপ্ন! দুঃস্বপ্ন!”
“স্বপ্ন? তুই কেন আইছিলি প্রেম করতে?”
“আপনি কেন ডাকছেন আমারে?”
“আমি ডাকলেই তোর আসা লাগবে?”
“তো চলে যান।”
“তুই না কাঁদলে ঠিকই যাইতাম।”
“বয়েই গেছে আপনার জন্য কাঁদতে।”
“তো কার জন্য মাইর খাইলি?”
জবাব দেয় না কান্তা। ব্যথিত নয়নে একবার ওই মুখে দেখে আবার সামনে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। বিপু ঠোঁট প্রাঙ্গণে মৃদু হাসির ঠাঁই দেয়। বাজার ছুঁয়ে নিয়েছে, তবুও বিপু সরে না পাশ থেকে। সাথেই চলছে। কান্তা বিব্রত হয়ে বলে,
“দূরে যান। এলাকার মানুষজন দেখলেই সমস্যা বাঁধবো।”
“দেখলে দেখুক।”
“দেখুক মানে কি?”
“এত্তো বেশি না বললেই কি তোর হয় না?”
চুপ হয়ে যায় কান্তা। হাঁটতে থাকে নিজের মতো করে। আগের তুলনায় পায়ের গতিও বেড়ে এসেছে। বিপু সেই গতিতেই তাল মেলায়। প্রস্তাব করে,
“আয়, বালুর মাঠে যাই।”
“না।”
“কেন?”
“কোনো মাঠেঘাটে যাওয়ার শখ আমার মনে ধরে নাই। যেতে হলে আপনার বাড়ি নিয়া যান।”
“যাবি? তো আয়, বাড়িই যাই।”
বিপুর ঠোঁটে হাসি থাকলেও ভ্রুর কোণ সংকুচিত হয়ে থাকে কান্তার। এর বিরক্তি দেখতেও ভালো লাগে বিপুর। এতেও মায়া জন্মে মনের কোণে। দোকানপাট ছেড়ে যাচ্ছে সব। জিজ্ঞেস করে,
“কি খাবি?”
“কিছু না।”
“বাদাম? ছোলা? ঝালমুড়ি?”
“কিছু না, কইলাম না? এই ছোলা মুড়ি না সেধে সাধতে হইলে আপনার ঘরের ভাত খাওয়ার অধিকার সাইধেন।”
“সকালে ভাত খাইছোস?”
নিরুত্তর কান্তা হাঁটে শুধু। বিপুর বুঝতে বাকি থাকে না। এইযে, বিনা অধিকারে পিছু ঘুরছে তা-ও ভালো লাগে না। পাকাপোক্ত একটা অধিকার তার চাই৷ সময় সুযোগ যেন হাতছানি দিতে চায় না। কান্তা বাড়ি পর্যন্ত আসতেই বিপু হাত ধরে ফেলে। কান্তা নিজেও একটু চমকে যায় তার আকস্মিক হাত ধরে নেওয়ার প্রেক্ষিতে। বিপু টানে তাকে সামনের দিকে।
“এদিকে যাস কেন? আমার বাড়ি না যাবি?”
“পাগল নাকি! হাত ছাড়েন!”
“বলছোস যাবি, তো যাবিই। ঘরের ভাত খেতেও সাধছি এইবার। চল, ভাতও খাবি।”
“এইভাবে গেলেই তো খালি হয় না। অধিকারে নিয়া যাইতে হয়।”
“অধিকার আপনা আপনি আসবে না। জোরপূর্বক চাইতে হবে। আয়, আজই চাই।”
“আপনি গিয়ে চান।”
“তোর জন্য চাইবো। তুই যাবি।”
“আরেহ! ছাড়েন। সবসময় মজা ভালো না।”
মজার হাসি স্পষ্ট হয় বিপুর মুখে৷ হাতের বাঁধনও নরম হয়ে আসে। নরম গলায় বলে,
“আয়, ভাবির সাথে দেখা করে আসিস।”
“উহুম।”
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট মনে বাড়িতে প্রবেশ করে কান্তা। বিপু চলে যায় সামনে, নিজ বাড়ির দিকে। ভাবছে খালিদ ভাইকে নিয়ে। চায়ের দোকানে বসে থাকতে দেখে এলো। তাকেও দেখেছে নিশ্চয়ই। আবার কিছু বলবে কি না, তা-ই ভাবছে। বাড়ি এসে দেখতে পায় খালিদের বউ, সালমাকে। পারভীন বারান্দায় বসে পাঞ্জাবীর ছুটে যাওয়া বোতাম সেলাই করছে। পাশে বসে আছে সালমা, মামী শ্বাশুড়ির সাথে একটু গল্প করছে। মিনিট খানেক হয় মাত্র, সে যে এসেছে। বসেই এক গ্লাস পানি চেয়েছিলো পরীর কাছে। পরী তা-ই এগিয়ে দিতে দিতে বিপুকে দেখে বলে,
“ভাইজান, আইছেন? এক্কেবারে ঠিক সময়ে হাজির হইছেন।”
“কেন?”
“আম্মায় সেলাই করতে বইছে। তাত্তাড়ি দেন, ছিঁড়াখোঁড়া ততদিনে কি জমাইছেন। আপনের তো আবার স্বভাব ভালা৷ কাপড় ধুইতে দেখলে এক গাট্টি বাইর কইরা দেন। সেলাই করতে দেখলে লুঙ্গি কুর্তা সব বাইর করেন!”
যদিও বিদ্রুপ করে বললো পরী, তবুও বিপুর মুখে হাসি। ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
“মনের কথা বলছোস রে তুই, পরী। আমার শার্টেরও দুইটা বোতাম নাই কয়দিন যাবত। এক্ষুনি দিচ্ছি।”
ঘরে চলে যায় বিপু। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটে পরী। বারান্দায় হাজির হতে দেখে শ্রাবণকে। তার উদ্দেশ্যে বলে,
“বড় ভাইজান কিন্তু একদম ভালা এইদিক থেইকা। পোশাকাশাক ফাটে কম। সেলাই ঝামেলা আম্মার দিকে দেয় না তেমন। আর এইযে একখান মানুষ। এর ঘরে বউ আইলে চোখের সামনেই দেখবেন কত যে জ্বলে। আর আপনে কিন্তু খুব আয়েশেই থাকবেন বড় ভাইজানের কাছে। এই পরী গ্যারান্টি দিয়া কথা কয়।”
মুচকি হেসে শ্রাবণ বলে,
“এতো গ্যারান্টি দিতে নেই। আল্লাহ নারাজ হবেন। আমরা তো আল্লাহর সামান্য সৃষ্টি মাত্র। এতো বড়াই করলে চলে?”
“হো, তা ঠিক অবশ্য।”
সালমা খালি গ্লাসটা এগিয়ে দেয় পরীর দিকে।
“ধন্যবাদ তোরে। গলা শুকায় গেছিলো একদম।”
“থাক, ধন্যবাদ দেওয়া লাগতো না। দিলে কয়ডা জাম দিয়েন। আপনে তো আবার জামাইডার মতোই কিপ্টা মানুষ। চাইতে আমারই শরম করে।”
সালমা মুখাবয়বে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে পারভীনকে বলে,
“দেখেন তো মামী, কি কয় ছেড়ি! আমি কি কোনো সিজনে আপনেগো তেতুল না দিয়া যাই? হারামীডা খাইয়া খাইয়াও স্বীকার করে না।”
“হো, দেন তো। নামে মাত্র।”
প্রত্যুত্তর করে ঠোঁট ভেঙায় পরী। পারভীন দাতে সুতা কেটে বলে,
“এই যা তো, গোসল সার গিয়া।”
“যামুনে।”
বিপু এসে তার শার্ট ধরিয়ে দেয় মায়ের হাতে। পরী দেখতেই বলে,
“আল্লাহ! এক শার্টেরই দুই বোতাম নাই! নিশ্চয়ই মারামারি কইরা ছিঁড়ছেন, ভাইজান।”
বিপু আলতো করে এবার মাথায় ঠুকে দেয় তার। ওদিকে সালমা হাসিমুখে বলে,
“জানেন মামী, আজকা কি হইছে?”
“কি?”
“ওইদিন একটা লটারি ধরছিলাম। ওইযে, গরু গুতা দিলো না আপনাগো ভাইগ্নারে? ওইদিনই ধরছিলাম। একটা কোম্পানির বেডা আইছিলো। ছয়শো টাকা দিয়া তিনটা বালতি কিনলে একটা লটারি দিবো। আর লটারি যে জিতবো…”
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পরী বলে,
“তিন বালতি দিয়া আপনে কি করবেন, ভাবি?”
“এই চুপ কর। কতা শেষ করতে দে। আর লটারি যে জিতবো, তার এক হাজার টাকা পুরস্কার। আজকা সকালে উনার মোবাইলে দেখলাম মেসেজ আইছে, আমি লটারি জিতছি। শিগগির তারে মোবাইলসহ পাঠায় দিলাম। টাকাও দিয়া দিলো। আমার জায়েই তো আবার পায় নাই। কপাল ভালা হইলে যা হয় আরকি। বুজছেন না ব্যাপারটা?”
খুশিতে গদগদে হয়ে উঠে সালমার মুখখানা। পারভীন সেলাইয়ে ব্যস্ত থেকে ছোট জবাব দেয়, “হুম।”
বিপু কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু পরী সুযোগ কেড়ে নিয়েছে চমকিত গলায়! কথায় টান দিয়ে বলে,
“এক হাজার টাকার লটারি পাইছেন, ভাবি!”
“হু।”
পরী সাথে সাথেই দুইহাত আকাশমুখী তুলে দিয়ে বলে,
“আল্লাহ, এইবার তুমি বকুল কাকারে দিয়া আরেকটা ভুল করাইয়া দিয়ো। খালিদ ভাই এই বাড়ি আইলে বকুল কাকার বেখেয়ালে যেন এইবার বড় ষাঁড়টা গোয়াল হইতে পালায়। আরেকবার যেন খালিদ ভাই গুঁতা খায়। আরেকবার যেন ভাবি লটারি জিততে পারে। এইবার বড় ষাঁড়ের উছিলায় যেন দশ হাজার টাকা পায়।”
“হেই, চুপ কর!”
সালমা ক্ষেপে উঠে দেয় ধমক। পরীর কথায় বিপু শব্দযোগে হেসে সারা! শ্রাবণও মুখ চেপে হেসে উঠেছে শব্দহীন। শার্টের বোতাম লাগাতে ব্যস্ত পারভীনের মুখেও সামান্য হাসির রেশ দেখা যায়। পরী তার ধমকে দোয়ার বাক্যে থামলেও দুই হাত মুখে বুলিয়ে “আমিন” বলে নেয়। পরক্ষণে খালিদের বউকে জবাব দেয়,
“দোয়া কইরা দিতাছি, ভাল্লাগে না?”
“থু থু পড়ুক তোর দোয়ায়।”
“দেইখেন কিন্তু, আর একবারও যদি লটারি ধরছেন!”
“তোর কাছে জিগায় ধরমু?”
“তাইলে দোয়ায় আবার চুলকানি ক্যা?”
“এই যা তো, যা। তোরে ডাক দিছি এনে?”
“আমারে ডাক দেওয়া লাগে না। পরী উড়তে উড়তে সব জায়গায়ই বিনা ডাকে হাজির থাকে।”