রজনীগন্ধা #অলিন্দ্রিয়া_রুহি #পর্ব_৪

0
186

#রজনীগন্ধা
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
#পর্ব_৪

অর্থি গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সে কোনোকিছুই মুখে তুলবে না। রজনী অনেক জোর করেও কিচ্ছু খাওয়াতে পারেনি মেয়েটাকে। রজনীর ব্যর্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। কত উপায় বের করল, তবুও মেয়েটার মুখে একটা দানা অবধি তুলতে পারল না!

রজনী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার পাশের বেতের সোফায় বসল। রাতের আকাশ বলে মেঘগুলোকে বোঝা যাচ্ছে না তেমন একটা, কিন্তু রজনীর মনে হচ্ছে কালো মেঘে তলিয়ে যাচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি নামবে। অর্থি একটা বারবি পুতুল নিয়ে খেলছে, রজনী একদৃষ্টে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওই বারবি পুতুলও অর্থির কাছে কিছুই না! অর্থি এতটাই সুন্দর বাচ্চা! রজনীর মন ভরে যায়। এরকম একটা মেয়ের বন্ধু মা হওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার! ইশ, এই মেয়েটার সত্যিকারের মা যদি হতে পারতো সে..
রজনী চমকায়; এই মাত্র এটা কী ভাবলো সে? এই মেয়ের সত্যিকারের মা মানে তো আদ্র সাহেবের… ধুর! হেসে উঠল রজনী। নানান ধরনের চিন্তায় চিন্তায় মাথাটা একদম গেছে তার।

অর্থি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, গাল ফুলিয়ে রেখেছে এখনো। রজনী থতমত খেয়ে হাসি থামায়। অর্থি রিনরিনে কণ্ঠে বলল, ‘হাসলে কেন?’

–‘এ..এ..এম..নি..’ তোতলায় রজনী, ভয় পেয়ে গেছে।

অর্থি গম্ভীর স্বরে বলল, ‘একদম হাসবে না, এখন আমার মন অনেক খারাপ।’

–‘তুমি শুধু শুধু মন খারাপ করে রাখছো মামনী।’

–‘পাপা আমাকে বকলো, আর আমি মন খারাপ করব না? তাও ওই মেয়েটার জন্য…’

ছোট্ট অর্থির অভিমানের পাল্লা যেন আকাশচুম্বী। রজনী অবাক হয় কিঞ্চিৎ! বড় আদরের মেয়ে দেখেই এত অভিমান বুঝি? রজনী সোফা ছেড়ে উঠে অর্থির বিছানায় বসল। তারপর নিজের কোলের ভেতর অর্থিকে টেনে নিল। অর্থির মাথার উপর নিজের থুতনিটা রেখে মৃদু স্বরে বলল, ‘এরকমটা বলে না মামনী। আমরা যাকে ভালোবাসি, তাকে শাসনও করতে পারি। তোমার পাপা তোমাকে বকেছে, তোমারও কিন্তু দোষ ছিল। অন্তরা মেয়েটা যেমনই হোক, ও তোমার খাবার দাবার নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত ছিল, তাই আমার সাথে উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলছে। আমিও কিন্তু ছাড় দেইনি। শুনিয়ে দিয়েছি,তখন আদ্র সাহেব এসে কিন্তু অন্তরাকেই বকেছেন, এর মধ্যে তুমি যখন ছোটো মানুষ হয়ে অন্তরাকে মারতে গেলে, তখন আদ্র সাহেব তোমাকে ধমক দিলো। অন্তরা যাই করছে, এর জন্য আমি, তোমার পাপা দু’জনেই ওকে বকে দিছি কিন্তু। তুমি ছোট হয়ে বড়কে মারতে গেছ, এটা অনেক বড় অপরাধ মামনী। এখন যদি তোমাকে আদব-কায়দা শেখানো না হয়,তাহলে আর কখনোই শেখা হবে না। এরকমই থেকে যাবে আজীবন। এই জন্যে তোমার পাপা তোমাকে দুটো ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে মামনী। এতে দোষের কিছু নেই সত্যি! একদিন তুমি বড় হবে, তুমি মা হবে, তোমারও ছোট্ট অর্থি হবে। তখন তুমি কী চাবে, কেউ তোমার বাচ্চাকে বেয়াদব বলুক? বলো?’

অর্থি ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, ‘না, চাবো না।’

–‘তোমার পাপাও চায় না। বুঝছো? এখন কী অভিমান আছে নাকি গলছে?’

অর্থি পেছন ঘুরে রজনীর গলা জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘তুমি অনেক ভালো ননা মা..’

–‘ননা মা?’ ভ্রু কুঁচকালো রজনী, তার কপালের চামড়া ভাঁজ ভাঁজ, প্রশ্নবিদ্ধ চোখে অর্থির দিকে চেয়ে রইল।

অর্থি হেসে বলল, ‘তুমি তো আমার বন্ধু মা। বন্ধু মা’কে কী আন্টি বা ন্যানি বলে ডাকব? তাই তোমার নাম দিলাম আমি ননা মা। তুমি আমার ননা মা…’

বিশুদ্ধ প্রশান্তিতে রজনীর মন ভরে উঠল। কিছু একটা শিহরণের মতোন, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল, ছুটতে শুরু করল। তাৎক্ষণিক ভাবে কোনোপ্রকার জবাবই দিতে পারল না সে। চোখটাও কেমন যেন জ্বলছে, ভার ভার লাগছে। একসময় নিজেকে একটু সামলে নিল রজনী। বুকের ভেতর চলা হাহাকার গুলোকে ঢোকের মতোন করে গিলে নেওয়ার চেষ্টা করল। আজ যদি ভাগ্য ভালো থাকত, তাহলে তার আর অভির ঘরেও এরকম ছোট্ট রাজকুমারী কোল ভরিয়ে আসতো। সে তখন ননা মা না, ‘মা’ বলে ডেকে ডেকে পুরো বাড়ি মাথায় তুলত। একজন নারীর কাছে মাতৃত্ব যে কতটা সাধের, সেটা কে বুঝবে?

রজনী ঢোক চেপে ধীর গলায় বলল, ‘ননা মা ডাকছো, আবার আমার কথাও শুনছ না!’

–‘কোন কথা শুনিনি?’ প্রশ্ন করে উঠল অর্থি।

–‘এই যে, খাচ্ছো না…’

–‘তুমি খাবার নিয়ে আসো। আমি খাবো।’

রজনী হেসে নাশতার প্লেটটা গোল সেন্টার টেবিলের উপর থেকে টেনে নেয়। অর্থি লক্ষী বাচ্চার মতো খেতে খেতে খেলতে থাকে।

আগামীকাল অভির দ্বিতীয় বিয়ে। জহুরা বেগম আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন, একমাত্র রজনীর যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। যেই না রজনী গেল, ওমনি ছেলের বিয়েটা দ্রুততার সঙ্গে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন তিনি। তার এখনো ভয় হয়, যদি রজনী পুলিশ টুলিশ এনে ফেলে? তখন একটা ঝামেলা হয়ে যাবে। এরচেয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিয়েটা হয়ে যাক, এরপর যা হয় দেখা যাবে।

জহুরা বেগম অভিকে বিয়ের ব্যাপারে বলেছে, তবে অভির কোনো ভাবান্তর নেই। কেমন নির্বিকার ভাবভঙ্গি। জহুরা বেগম সন্ধ্যের পর থেকেই চিন্তায় পড়েছেন। অভিটা না আবার সদ্য বউয়ের বিরহে পাগল হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে মানা করে দেয়। তিনি সবকিছু গোছগাছ করে ফেলেছেন। মেয়েটা ডিভোর্সি, এর আগে যেখানে বিয়ে হয়েছিল, জামাইটা মোটেও ভালো ছিল না। নেশা করত আর রাত নেই দিন নেই, মেয়েটাকে খুব মারত। বিয়ের এক বছরের মাথাতেই মেয়ের বাবা-মা মেয়েকে ওখান থেকে ছাড়িয়ে আনেন। কোনো সন্তান ছিল না, বয়সটাও কম। তারপরও সুবিধামত কোনো ভালো জায়গায় মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিলেন না তারা। একবার কোনো মেয়ের গায়ে ডিভোর্সি তকমা লেগে গেলে, অন্যত্র সেই মেয়েকে বিয়ে দেওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার! অভি ভালো ছেলে, তেমন ভালো চাকরি করে না তবে কোনো নেশা-পানির মধ্যেও নেই। আগে বউ ছিল, এক ছেলের হাত ধরে ভেগে গেছে- এমনটাই বলেছেন জহুরা তাদের। তারা দ্বিমত করেনি। তিন লাখ টাকা নগদ ক্যাশ দিবে, তা দিয়ে যেকোনো ভালো ব্যবসা ধরা যাবে। ডিভোর্সি মেয়ের জন্য ডিভোর্সি পাত্রই তো পাওয়া যাবে! নাকি?

আগামীকাল শুক্রবার, সকালে গায়ে হলুদ, বিকেলে বিয়ে। ছিমছাম ভাবে.. তেমন একটা বড় আয়োজন না হলেও মিনিমাম একশো লোকের আয়োজন থাকছে। ডিভোর্সি মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে কেউ বড় করে করেও না। মান-সম্মান বলতে কোনো জিনিস আছে তো নাকি?

মেয়েটার নাম দোলা। সুন্দর, ছোট্ট, মিষ্টি চেহারার অধিকারী। এক দেখাতেই তাকে বেশ মনে ধরেছে জহুরার। আবার ঘরের পাঁচও পাঁচটা কাজ পারে। অভির জন্যে এরকম মেয়েই পারফেক্ট।

রাত ন’টার কিছু আগে অভি বাহির থেকে ফিরে। সন্ধ্যের পরেই সে বাইরে বেরিয়েছিল, হয়ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য। অভি গায়ের শার্ট খুলছিল, জহুরা তখনি রুমে ঢুকলেন। অভি দেখেও দেখল না। শার্টটাকে অগোছালো ভাবে আলনায় অবহেলায় ফেলে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জহুরা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে শার্টটা গুছিয়ে রাখলেন। তারপর ছেলের শিয়রে এসে বসলেন।

অভি বলল, ‘কিছু বলবে মা?’

–‘হুম। তুই এরকম করতেছিস কেন?’ জহুরা বেগমের কণ্ঠটা রাগী শোনায় খানিক, অভি মায়ের দিকে ফিরে তাকাল। বলল, ‘কী করতেছি?’

–‘এইযে, দেবদাসের মতোন হইয়া আছোস! কালকে তর বিয়া আর তর মধ্যে কোনো ভাবান্তর নাই! কেন?’

–‘এমনি… আমার ভাল লাগতেছে না।’

–‘কেন ভাল লাগতেছে না? ওই ডাইনীর কথা মনে পড়ে?’

অভি হালকা ধমকের সুরে বলল, ‘আহ মা! ও তো চলেই গেছে। ওকে গালি দিয়ে কথা বইলো না আর। ওর সাথে আমার সকল চুক্তি টুক্তি মিটে গেছে।’

–‘আমার তো তা মনে হয় না। দেখ গা, কোন লাঙ্গের কাছে পইড়া আছে মা**। আর তুই এইহানে বইসা শোক পালন করতেছস! ছাও পয়দা না করতে পারলে কিয়ের মাইয়া মানুষ? ক তুই আমারে। তোর কী নিজের বংশের প্রদীপের কথা একটুও মাথায় আহে না? আহাম্মকের মতো একটা বাল বিয়া কইরা আনছিলি। তাও মাইনা নিছিলাম। কিন্তু নাতি-নাতনীর মুখ দেখুম না, এইডা কোনো কতা?’

অভির বিরক্তি লাগছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। চুপচাপ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু জহুরা বেগম যতক্ষণ আছেন, চুপ করে শুয়ে থাকার উপায় নেই। তাই সে দ্রুত উত্তর করল, ‘না, নাই। এখন যাও আম্মা। আমি একটু ঘুমাই। কালকে আবার অনেক ধকল যাবে।’

–‘হ বাবা, ঘুমা। কিন্তু মনে রাখ, আমি যা করতেছি সব তর ভালার জন্য করতেছি। তুই ভালা থাকলেই আমার কলিজা জুড়াইবো। শো বাবা, ঘুমা। রাইতে তর বড় ভাই আইলে খাওয়ার লিগা ডাক দিমুনি।’

–‘না আম্মা। আমারে আর ডাক টাক দিও না। আমি খাব না, ঘুমাব।’

জহুরা বেগম জোর করলেন না। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অভি একবার শুধু বিয়েটা করলেই সব ঝামেলা শেষ। আর নতুন মেয়ে মানুষ যখন বিছানার পাশে ঘুমাবে, তখন এমনিতেই ছেলের মন-মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে- এমনটাই ধারণা তার। অভি অনেকক্ষণ যাবত চুপচাপ শুয়ে রইল। কিছু মানুষের গুরুত্ব দূরে গেলে বোঝা যায়, বলে না? অভিও বুঝতে পারছে, তার ভেতরের কোথাও না কোথাও একটা জায়গা ফাঁকা হয়ে পড়েছে রজনীর চলে যাওয়ার পর। সন্ধ্যের পর গিয়ে সে খুঁজেও এসেছে, যেখানে যত জায়গায় খোঁজা যায়। কিন্তু কোথাও রজনীর কোনো হদিস মিলেনি। না জানি কোথায় আছে, বা আদৌও বেঁচে আছে কী-না! এই শহরে ধুলোবালির মতোন মানুষের প্রাণ উড়ে যায় কত কত! কয়টার খোঁজ-খবর রাখে মানুষ?
অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একবার মন বলছে, রজনীকে এভাবে মেরেধরে তাড়িয়ে দেওয়াটা একদম উচিত হয়নি। বিয়ে করতো, রজনীকেও রাখত। একটা থাকার জায়গা তো থাকত! পেটে দু’বেলা দু-মুঠো খাওয়া তো জুটতো! না জানি এখন কোথায়, কোন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে রাত কাটাচ্ছে মেয়েটা! অপরদিকে আবার মনে হচ্ছে, রজনী চলে গিয়ে ভালোই হয়েছে। সে মুক্তি পেয়েছে অন্তত। রোজ রোজ রজনীর জন্যে মায়ের অশান্তি আর ভালো লাগছিল না তার। জীবনটা বিষে ভরে উঠেছিল, এখন সেই বিষ নেমে গেছে।

অভির বুক চিঁড়ে বারবারই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। কখনো বা সশব্দে, কখনো বা খুব সন্তর্পণে, মনের কিনার ঘেঁষে…
সাত-পাঁচ ভাবনায় ডুবেই একসময় ঘুম রাজ্যে পাড়ি জমালো অভি।

_________
পরাপর দুইবার দরজায় টোকা পড়ল। আদ্র’র কোলের উপর লেপটপ, আপকামিং একটা শর্ট ফিল্মের এডিট দেখছিল সে। নিস্তরঙ্গ গলায় অনুমতি দিল ভেতরে আসার।রজনী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তার এক হাতে কফির মগ। অন্য হাতে একটা ছোট্ট কাগজ টুকরো।

আদ্র’র দিকে কফি মগটা বাড়িয়ে দিয়ে রজনী নিজ থেকেই বলল, ‘কাজ করার সময় মুখে হালকা কিছু দিতে ভালো লাগে। তাই ভাবলাম একটু কফি করে দেই আপনাকে।’

আদ্র কফি মগটা নিতে নিতে জবাব দিল, ‘ধন্যবাদ।’ তারপর একটু থেমে প্রশ্ন করল, ‘কে বানিয়েছে? আপনি?’

–‘না, অন্তরাই।’ উত্তর দিল রজনী।

–‘ঝগড়া মিটেছে?’

–‘উঁহু… আমি শুধু গিয়ে বলছি একটা কফি করতে। সে চুপচাপ কফিটা করে মগ রেখে চলে গেছে। আমি নিয়ে আসলাম।’ কাচুমাচু হয়ে পড়ল রজনী, প্রথমদিন এসেই অন্তরার সঙ্গে ঝগড়া করে ফেলেছে সে। ব্যাপারটায় ভীষণ বিব্রতবোধ করছে রজনী। অবশ্য অন্তরারও হাত আছে। সেও তো কম কথা শোনায়নি তাকে! উল্টো বেশি বেশি বলেছে দেখেই রজনী জবাব দিয়েছে। নইলে কে চায় সেধে পড়ে ঝগড়া করতে?

আদ্র একটা চুমুক দিয়ে মগটা পাশে রেখে দিল। তার চোখ লেপটপের দিকে নিবদ্ধ। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে এডিটিং দেখছে সে। রজনীকে যেতেও বলল না, বা আর কোনো কথাই বলল না। রজনী অস্থির হয়ে উঠল। ইতস্তত করে বলল, ‘শুনুন…’

–‘হুঁ..’ তখনো লেপটপ থেকে চোখ সরালো না আদ্র। ছোট্ট করে জবাব দিল।

রজনীর হাতে থাকা কাগজ টুকরোটি সে বাড়িয়ে ধরল, ‘নিন… অর্থি মামনী দিয়েছে।’ এইবার আদ্র তাকাল। একটু অবাক মনে হলো তাকে দেখে। উৎসুক হয়ে কাগজটি নিয়ে খুলল,
‘মাই ডিয়ার পাপা,
আই এম ভেরি ভেরি সরি… আমি না বুঝেই তোমার উপর অভিমান করে ফেলেছিলাম। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও কেমন? ননা মা আমাকে বুঝিয়ে বলেছে কেন তুমি আমাকে বকেছিলে। আমি বুঝেছি। আমি আর কখনো বড়দের সাথে বেয়াদবি করব না পাপা, আই প্রমিস। গুড নাইট পাপা… সুইট ড্রিম।’

অর্থি এত অক্ষর লেখা এখনো শেখেনি। বিশেষ করে যুক্তাক্ষর গুলো লিখতে তো মোটেও পারে না। বারবার ভুল করে ফেলে। সেই ও এত সুন্দর করে একটা চিঠির মতো চিরকুট লিখে ফেলল? এত সুন্দর বুদ্ধি ওর মাথায় এলো কোথাথেকে? আদ্র মুগ্ধ, সেই সাথে তার মনের সব রাগ গলে তরলে পরিণত হলো। বিগলিত হয়ে পড়ল সে। চকচক করতে থাকা চোখের দৃষ্টি নিয়ে রজনীর দিকে তাকাল। রজনী মৃদু হাসল। আদ্র বলল, ‘ওকে আপনি লিখিয়ে দিয়েছেন?’

মাথা ঝাঁকালো রজনী, ‘জি। হাতে ধরে ধরে লিখে দিয়েছি।’

–‘বুদ্ধিটাও নিশ্চয়ই আপনার?’

–‘জি। ও বলছিল, আপনার কাছে সরি বলবে কিন্তু আপনার সামনে আসতে ভয় পাচ্ছিল। তাই আমি এই বুদ্ধি দিলাম। আর ও রাজী হয়ে গেল।’

–‘হুম… বুঝলাম। কিন্তু এই ননা মা টা কী? এটা বুঝলাম না। হু ইজ ননা মা?’

আদ্র’র এহেন কথায় ঈষৎ লজ্জা পেল রজনী। চোখেমুখে মৃদু লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ে। এতক্ষণ আদ্র’র দিকে তাকিয়ে থাকলেও এবার সে চোখ নামিয়ে ফেলে দ্রুত। এদিক ওদিক তাকায়। উত্তর দেয়, ‘মানে.. আসলে হয়েছে কী… মামনী.. মানে মামনীই বলল যে আমাকে ননা মা বলে ডাকবে। কারণ আমি ওর বন্ধু মা। আর বন্ধু মা’কে শুধু মা-ও ডাকা যায় না। আবার আন্টি,ন্যানিও ডাকা যায় না।’ একটু থেমে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টালো রজনী, ‘আপনার মেয়ের মাথায় অনেক বুদ্ধি, মাশা-আল্লাহ। এই বয়সেই তাকে দেখলে মনে হয় তিরিশ বছরের বুদ্ধিমতি নারী। ও বড় হলে অনেক নাম করবেন, দেখবেন।’

আদ্র হাসল, গৌরবে বুক ফুলানো হাসি। তারপর মৃদু স্বরে বলল, ‘সুন্দর নাম- সাউন্ড ইন্টারেস্টিং! ননা মা!’

রজনী আবার লজ্জা পেল। জবাব দিতে পারল না।

–‘ অর্থি কী করছে?’

–‘ঘুমোচ্ছে।’

–‘এত দ্রুত?’ বলে হাতঘড়িটায় চোখ বুলালো আদ্র। এগারোটা তেইশ- বাজছে। আদ্র বিড়বিড় করে বলল, ‘এত রাত? মাই গড! খেয়ালই করিনি। কখন যে সময় কাটলো।’

–‘আপনি খুব একাগ্রতা নিয়ে কাজ করছিলেন, তাই খেয়াল করেননি বোধহয়। আপনি খাবেন না? চলুন, আপনার খাবারটা বেড়ে দেই।’

–‘সেটার ব্যাপারে আপনাকে না ভাবলেও চলবে। স্যারের প্রয়োজন অপ্রয়োজন দেখার জন্য আমি আছি, আপনাকে অর্থির দায়িত্ব দিয়েছে- ওর প্রতিই নজর রাখুন।’
দরজা মুখ থেকে বলে উঠে একজন, দুইজোড়া চোখ মুহূর্তে ঘুরে তাকাল। অন্তরা ক্রর হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে। সে ভেতরে ঢুকে অন্তত বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, টেবিলে সব রেডি। খাবেন চলুন।’

আদ্র বিব্রতবোধ করছে। অন্তরার আচরণ সত্যিই ভালো না, এই মেয়েটা তো ভীষণ শান্ত আর করিৎকর্মা ছিল, তাহলে হুট করে এত চেঞ্জ কেন? রজনীকে একদমই সহ্য করতে পারছে না। আবার একটা কথা একটু সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বললেই হয়, সেই কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অপমানজনক করে তবেই কেন রজনীকে বলা? আদ্র’র মাথায় ঢোকে না। ওদিকে রজনীর চোখ জোড়া আপনাতেই ছলছল করে উঠল। অন্তরা তাকে সুনিপুণ ভাবে অপমান করে দিয়েছে। কেন এই মেয়ে রজনীকে মানতে পারছে না? কীজন্যে? এমন তো নয় যে রজনী আসায় ওর চাকরি চলে গেছে বা ও বেতনে কম পাবে! তাহলে কেন? কেন এরকম, এত নিচু আচরণ? তাও আবার আদ্র সাহেবের সামনে! রজনীর বুক ভার হয়। সে একটি জবাবও দেয় না। চুপ করে চলে যেতে নিলে, আদ্র শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘দাঁড়ান।’ রজনীর পা-জোড়া না চাইতেও থামে। সে পেছন ঘুরে আদ্র’র দিকে তাকায়। পানি চিকচিকে চোখ, আদ্র’র বুকের কোথাও না কোথাও গিয়ে লাগল ভীষণ ভাবে… এক সেকেন্ডের জন্য আদ্র হতবাক হয়ে পড়ল। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলালো। অন্তরাকে কঠিন গলায় বলল, ‘তুমি নিচে যাও। আমি আসছি।’

শিকারকে টোপ গেলাতে না পারলে, শিকারীর ভেতরটা রাগে ফুঁসে উঠে যেভাবে, অন্তরাও সেভাবে ফুঁসে উঠল। অগ্নি দৃষ্টিতে রজনীকে ভস্মীভূত করতে করতে সে ঘর ছাড়ল। রজনী ততক্ষণে নিজের খারাপ লাগাটুকু সামলে নিয়েছে। নত মস্তকে সে দাঁড়িয়ে রইল। আদ্র লেপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর রজনীর থেকে দূরত্ব রেখে রজনীর সামনে এসে বলল, ‘ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। প্লিজ… ওর আচরণের শাস্তি ও পাবে।’

–‘না স্যার, দরকার নেই। কিছু বলতে হবে না। আস্তে আস্তে হয়ত সে আমাকে এক্সেপ্ট করে নিবে।’

–‘এটা আমার বাসা, আমার ঘর। আমার কাকে ইচ্ছে আনবো, কাকে ইচ্ছে কাজ দেব, এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। সেখানে হস্তক্ষেপ করার সে কে? নাকি তার সাথে আমার আদার কোনো সম্পর্ক আছে? অবশ্যই সে এই আচরণের শাস্তি পাবে। আর সেটা এক্ষুনি। আপনি কষ্ট নিবেন না। আপনি খেয়েছেন?’

–‘হুঁ.. অর্থির সাথে।’

–‘ঠিক আছে। যান গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আপাতত আপনার ডিউটি শেষ।’

–‘আচ্ছা স্যার।’

আদ্র বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। তার কিছু সময় পর রজনীও নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

________
রাত কত বাজছে, রজনী জানে না। তুমুল বৃষ্টিপাতের শব্দে তার ঘুমটা ভেঙে গেল। রজনী উঠে বসতেই সর্বপ্রথম তার মাথাতে আসলো, অর্থি তার ঘরে একা ঘুমোচ্ছে। মেয়েটা জেগে গেলে ভয় পাবে। গায়ে ওড়না টা চাপিয়ে ঘরে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে রেখে রজনী নিজের ঘর ছাড়ল।

অর্থির রুমের দরজা খোলা থাকে, শুধু চাপিয়ে রাখা হয়। রজনী দরজা মেলতেই দেখলো, অর্থি চুপচাপ শুয়ে আছে। তবে সে জেগে, কারণ সে তাকিয়ে আছে রজনীর দিকে। রজনী তড়িঘড়ি করে বলল, ‘তুমি ভয় পাচ্ছিলে মামনী?’

অর্থি এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, ‘না। আমি তো একাই ঘুমাই সবসময়। তাই অভ্যাস হয়ে গেছে। এর আগে কত ঝড়বৃষ্টির রাতে একা ঘুমিয়েছি!’

অর্থির কণ্ঠে স্পষ্ট অসহায়ত্ব। আসলেই, ভাঙা পরিবার যতই পরিপূর্ণ ভাবে সাজানো হোক না কেন, কখনোই তা পরিপূর্ণ হয় না। একজন সন্তানের জন্য তো আরও না! রজনী অর্থির পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। পুরো ঘরের বাতি নেভানো, শুধু বেডসাইড টেবিল ল্যাম্প দুটো জ্বলছে। হলুদাভ আলোয় রুমের আনাচে কানাচে কেমন ভূতূড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আলো-আঁধার খেলা করছে।

রজনী বলল, ‘তুমি ঘুমিয়ে যাও মামনী। আমি পাশেই আছি।’

–‘আচ্ছা।’ বলে চোখ বুজল অর্থি। রজনী বেডে হেলান দিয়ে অর্থির মাথায় ছোট ছোট বিলি কাটতে লাগল। কিছু সময় কাটল৷ অর্থি রজনীর দিকে ফিরল, রজনীর গায়ের উপর এক হাতের ভর ছেড়ে দিয়ে, রজনীর কোলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেল অর্থি। অর্থির গরম নিঃশ্বাস, রজনীর জামা ভেদ করে শরীরের ভেতর ঢুকছে। প্রতিটি লোমকূপ এক অদ্ভুত শিহরণে দাঁড়িয়ে পড়ে। বুকের মধ্যে মাতৃত্বের স্বাদ, রজনীর চোখে জল চলে আসে। সে কাঁদে না, এত সুন্দর সময়ে কাঁদলে চলে না। সব সুন্দর মুহূর্তে কাঁদলে মানায় না…
রজনী নিচু হয়ে অর্থির কপালে চুমু খেলো। এক অপার্থিব দৃশ্য! সেই দৃশ্য দেখে স্বয়ং আদ্র সাহেবের মন জুড়িয়ে গেল। সে এসেছিল অর্থিকে দেখতে,ঝড়ের কারণে মেয়েটা ভয় পাচ্ছে নাকি- দেখতে। কিন্তু এসে দেখল, বাহিরে ঝড় হলেও ঘরের ভেতর অদ্ভুত শান্তি। আর শান্তির বটবৃক্ষের ছায়ার তলে অর্থি গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। আদ্র আর ভেতরে ঢুকে দু’জনকে ডিস্টার্ব করল না। প্রশান্তি ভরা বুক নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলল।

(চলবে)
★রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, মানিয়ে নিয়েন❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here