রজনীগন্ধা #অলিন্দ্রিয়া_রুহি #পর্ব_৯

0
210

#রজনীগন্ধা
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
#পর্ব_৯

-কী খাবেন? কোনটা অর্ডার করব?

হাত গুটিয়ে বসে ছিল রজনী। নিকষ কালো আকাশের মাঝে অলক্ষ্যে তাকিয়ে ভাবছিল কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। কী করে পারল সে আহাম্মকের মতো এমন কাজটা করতে? পা পিছলে পড়েছে, পড়তো। কোন কারণে আদ্র সাহেবের বুকের মাঝে আশ্রয় নিতে গেল? চারিদিকে অসংখ্য মিডিয়ার লোক, ছিল কত গুলো ক্যামেরা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘটনাটি ফলাও করে লেখা হয়ে গেছে। ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। আদ্র সাহেবকে তার জন্য কতগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে কে জানে! তবুও লোকটি তাকে একটি বাক্যও বলেনি এই ব্যাপারে। আর না তার উপর কোনো প্রকার রাগ দেখিয়েছে। এত ভালো কেউ কী করে হতে পারে? আজকালকার যুগে এরকম ভালো মনের মানুষ কয়টা হয়? হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তো পাওয়া মুশকিল! মৃদু শ্বাস ফেলে সামনে বসা আদ্র’র দিকে তাকালেও আদ্র’র করা প্রশ্নটি তার কানে ঢুকলেও ততটা ধাতস্থ হলো না রজনী। উদাস চোখজোড়া মেলে আদ্রকে বলে উঠল,
-সরি।

-কী কারণে?

-আমার জন্য আপনাকে বেইজ্জত হতে হলো। হিল পড়ে চলাচলের অভ্যাস নেই আসলে..

-তাহলে পড়লেন কেন?

-অর্থি জোরাজুরি করছিল। শাড়ির সাথে হিল না পড়লে নাকি ভালো দেখায় না।

আদ্র চোখ সরু করে অর্থির দিকে তাকাতেই অর্থি চোরা হাসি হাসল। আদ্র গমগমে স্বরে বলল,
-এরপর থেকে যেটা ভালো লাগবে না, সেটা করবেন না। কেউ জোর করলেও না। আপনি আমাকে ধরেছিলেন, সেটা বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হচ্ছে, যদি পড়ে যেতেন কমসে কম মাস খানেক সেই বিষয়টি নিয়ে হাসি-তামাশা হতো। ব্যাপারটা তখন সহ্য করতে পারতেন?

রজনী টলমলে চোখে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে মৃদু স্বরে জবাব দিল,
-না।

-এই জন্যে আপনি যেটায় কমফোর্টেবল ফিল করবেন, সেটাই করুন। ঠিক আছে?

রজনী মাথা কাত করে বলল,
-জি আচ্ছা।

অর্থি মুখ গোমড়া করল। একবার বলতে চাইল, তুমিও তো ননা মাকে শাড়ি পড়ার জন্য জোর করেছো পাপা। কিন্তু কী ভেবে যেন অর্থি বলল না। তারা এখানে ভালো সময় কাটাতে এসেছে। তর্ক বিতর্ক না করলেই ভালো।

-এখন বলুন, কী খাবেন?

রজনী খাওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ পেল না তাই বলল,
-আপনারা যা খাবেন, তাই।

-ওহ, ওকে।

ওয়েটারকে খাবারের মেন্যু দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল আদ্র। নাছির উদ্দীন কে ম্যাসেজ করল,
-গোলাপের বুকে রেডি নাছির মিয়া?

তৎক্ষনাৎ জবাব এলো, জি স্যার।

-পাঁচশোটা গোলাপ রাখতে বলেছিলাম, ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি রঙ মিক্সড থাকবে। সেরকম ভাবেই রাখা হয়েছে তো?

-জি স্যার।

-ওকে।

হাসিমুখে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রজনীর দিকে তাকাল আদ্র। আকাশের দিকে তাকিয়ে এত কী দেখে মেয়েটা? প্রাক্তন স্বামীকে মনে করে? মুহূর্তেই মনটা ছোট হয়ে এলো আদ্র’র। পরমুহূর্তেই মাথা থেকে উদ্ভট সব চিন্তাগুলোকে ঝেরে বিদায় করল। মনে মনে বলল, ভাবলে ভাবুক। আমার হওয়ার পর থেকে আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভাবলে একশো চুয়াল্লিশ ধারা আরোপ করা হবে ম্যাডামের উপর।

নিজের অদ্ভুত কথোপকথন নিজেই মৃদু শব্দে হেসে উঠল আদ্র। সেদিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল অর্থি। আদ্র’র চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে রজনীর দিকে তাকিয়ে সেও মুচকি হাসল।

অর্থিকে নিয়ে রজনী দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির সামনে। আদ্র তাদের এখানে দাঁড়া করিয়ে রেখে কোথাও একটা গেল। রজনীর দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগছে না বরং বেশ ভালো লাগছে। এখানে কোনো মিডিয়ার লোকজন নেই। ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউই নেই। মাথার উপর বিশাল আকাশ, কালো চাদরে মুড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছে। মৃদুমন্দ বাতাসে অর্থির চুলগুলো বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তা দেখে চুলগুলোকে হাত দিয়েই ঠিকঠাক করে দিল রজনী। তখন অর্থি আঙুল তুলে সামনে ইশারা করে বলল,
-ননা মা। দেখো..

রজনী তাকাল। একঝাঁক মিডিয়ার পাল হৈচৈ লাগিয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ক্যামেরার আলোয় মনে হচ্ছে দিন হয়ে গেছে। রজনীর চোখ কড়কড় করছে তা দেখেই। তাদের সবার সামনে আদ্রকে বিশাল বড় একটি ফুলের তোড়া হাতে এগিয়ে আসতে দেখে জমে গেল মুহূর্তেই রজনী। অর্থি সুযোগ বুঝে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে সে চেয়ে রইল। তার ঠোঁট ভর্তি হাসি। মনে মনে বিধাতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করল, ননা মা যেন রাজী হয়ে যায় আল্লাহ। প্লিজ, প্লিজ, প্লিইইইজ।

একধরনের অসাড়তা ভর করেছে রজনীর হাতে-পায়ে। কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা তার মনে এখনি জানান দিয়ে দিচ্ছে। বলে না,মেয়েদের সিক্স সেন্স বেশ প্রখর? হাতে থাকা পার্সটাকে শক্ত করে চেপে ধরল রজনী। তার শরীর এবার একটু একটু করে কাঁপতে শুরু করেছে। এসব কী স্বপ্ন নাকি বাস্তব? অর্থি কোথায়? রজনী ফিসফিস করে ঠোঁট নাড়িয়ে বলার চেষ্টা করল, আমার হাতে একটা জোরে চিমটি কাটো অর্থি।
কিন্তু বলতে পারল না। তার আগেই তার চোখের রেটিনায় একটি দৃশ্য গিয়ে আঘাত হানলো। আদ্র হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসেছে। তার দিকে ফুলের তোড়াটি বাড়িয়ে ধরেছে। তার চোখেমুখে হাসির ছটা, তবে সেখানে নার্ভাসনেসও উঁকি দিচ্ছে। সে কী যেন বলছে। কী বলছে? রজনী মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল। আদ্র বলছে, এসব মিথ্যে মনে করো না প্লিজ। তোমাকে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বিয়ে করতে চাই, তাও ভেবো না প্লিজ। আমি নায়ক নই, আমি সাধারণ একজন। এই সাধারণ মানুষটার তোমার মতোই সাধারণ কাউকে ভীষণ দরকার রজনী। উইল ইউ বি মাই…

আশ্চর্য! চোখের সামনে সাদা-কালো এসব কী? বিন্দুর মতো ঘুরছে… আরে, পাথরের মতো ছিঁটকে তার মুখমণ্ডলে পড়ছে কেন এসব? হঠাৎ এত অন্ধকার আসছে কোথাথেকে ? এত এত শোরগোলের মধ্যেও ঝিন ঝিন ধরনের একটি শব্দ ছাড়া তার কানে আর কিছু ঢুকছে না কেন? আদ্র সাহেব, আদ্র সাহেব কী বলছেন? পুরোপুরি শুনতে পারার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল রজনী। আদ্র বেশ চমকে উঠে রজনীর নাম ধরে চিৎকার করে উঠল।

জহুরা বেগমকে শত বুঝিয়ে কোনো কায়দা করতে পারল না অভি। তিনি মানতে নারাজ। বউয়ের কাছে কোনো শ্বাশুড়ি সজ্ঞানে মাথা নোয়াতে চায়? চায় না। জহুরা বেগমও চাচ্ছেন না। তার এক কথা, এই বাড়িতে থাকতে হলে দোলাকে তার কথামতো চলতে হবে। ঠিকমতো কাজকর্ম করতে হবে। শ্বশুর বাড়ি বসে খাওয়ার জায়গা নয় অবশ্যই। কথাগুলো শুনতে দেড়ি, দোলার উত্তর দিতে দেড়ি হয় না। তাই নিয়ে জহুরা বেগম আরেক দফা চেঁচামেচি লাগিয়ে দেন। শ্বাশুড়ির পক্ষ নিয়ে কথা বলতে এসে বড় ভাবী এসেও দোলাকে ঝাড়তে থাকেন। দোলা তাকে ছেড়েও কথা বলে না। কোনো বাড়িতে একসঙ্গে তিন নারী চিৎকার, চেঁচামেচি লাগিয়ে দিলে সেই বাড়ির অবস্থা ঠিক কী হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারছেন আপনারা? অভির অবস্থাও ঠিক তাই। কানে তুলো দিয়ে দু’দন্ড শান্তিতে বসার কায়দা নেই। সে ঘন ঘন কিছু শ্বাস ফেলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। রাস্তার অপরদিকে ছোট্ট একটি জমি, তাতে ধানের চাষ করছে জনাকয়েক কৃষক মিলে। সেই ক্ষেতের এক পাশে চুপচাপ পা ঝুলিয়ে বসে থাকল অভি। ঘরের ওই চিৎকার, চেঁচামেচি সহ্য করে ফ্যানের বাতাস খাওয়ার চেয়ে, নির্জন, নীরব এই স্থানে বসে রোদের গরম উত্তাপ সহ্য করাও ঢের ভালো।

-এখানে কী করোস?

শুভ’র প্রশ্নে ফিরে তাকাল অভি। ভাইকে দেখে চোখজোড়া শীতল হয়ে এলো তার। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক কদম এগিয়ে এলো সে। বলল, একটা সমাধান দাও ভাই। এভাবে কতদিন?

উত্তরে শুভ’র বুকচিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলেও, সে আড়াল করল তা। অভির এক কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করল, দুপুরে খাইছস?

-না।

-আয়, কিছু খাইয়া নেই। চল।

দু’ভাই মিলে একটা হোটেলে ঢুকল। শুভ জিজ্ঞেস করল বিরিয়ানি বা মোরগ পোলাও খাবে কী-না। অভি জানাল, এতটা ক্ষিদেও তার পায়নি। আর বাসায় গিয়ে ভাত খাওয়া যাবে। শুধু শুধু টাকা না খরচ করে শিঙারা খেয়ে নিলেই চলে। শুভও অভির কথা মতো শিঙারা অর্ডার করল। শিঙারায় এক কামড় দিয়ে অভি বলল, দোলা কে ছেড়ে দেওয়া মানে ওর বাপকে তিন লাখ টাকা ব্যাক দেওয়া। আবার ঘরের জন্য যতগুলা জিনিস দিছে, সেগুলাও দিয়ে দিতে হবে। আমার দোকান দেওয়ার স্বপ্নও জলে যাবে। আর দোলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকলে ওর বাপের থেকে আরও পাওয়া যাবে পরে। ঠিক বললাম কী-না বলো।

-হুম, ঠিকই তো।

-অথচ আম্মা এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতেছেন না। উনিই তো দোলাকে পছন্দ করে আনছেন। উনার যৌতুক দরকার, ঘরের জিনিসপত্র দরকার- সেগুলো সব পাইছেন। তারপরও কেমনে আশা করেন বউ ঘরের বান্দির মতো খাটবে? দোলার বাবা আমারে স্পষ্ট বইলা দিছে, আমি এতকিছু দিছি মেয়ের সুখের জন্য। আম্মারে কেমনে বুঝাই আমি?

-তোর ভাবীর বাসা থেকেও তো কতকিছু পাইছি আমি। তারপরও তোর ভাবী কী আরাম আয়েশে এই সংসারে আছে?

-সবাই কী এক হয় ভাই? হাতের পাঁচ আঙুল তো সমান না।

-তাইলে আর কী! আলাদা হইয়া যা।

-বলো কী!

আঁতকে উঠল অভি। এত সমস্যার মধ্যেও সে আলাদা হওয়ার কথা চিন্তা করেনি, যদিও দোলা প্রতিদিন, রাত বারবার আলাদা হওয়ার সুর ভাজছিল তার কানের গোড়ায়। আর তার ভাই-ও একই কথা বললো? তবে কী আলাদা হওয়া ছাড়া সত্যিই কোনো উপায় নেই? দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভি। শুভ আর কোনো জবাব দেয় না। কাঁচামরিচে কামড়ের পর কামড় বসিয়ে যাচ্ছে। নীরবে খেতে খেতে অভি সিদ্ধান্ত নেয়,আজ বাসায় গিয়ে আলাদা হওয়ার কথা সে তুলবে জহুরা বেগমের কানে। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে থামে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here