#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৭)
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। শহরটাকে আঁকড়ে ধরেছে এক মুঠো অন্ধকার।ঘড়িতে সাতটা বাজে। সূর্য ডুবেছে অনেকক্ষন। বসার ঘর আর শোবার ঘরের আলো জ্বালানো। বসার ঘরের সোফায় বসে জোরে জোরে উচ্চারণ করে পড়ছে স্বপ্ন। আজকেও বাংলা বই। বাংলা পড়তে কষ্ট কম।মাথা ঘাটাতে হয়না, কোনো পরিশ্রম হয়না বলে এই একটা বই সকাল বিকেল আওড়ায় সে।
শোবার ঘরে তিথি, বৃষ্টি একসাথে। বৃষ্টি বরাবরের মত ফোন ঘাটতে ব্যাস্ত। কিন্তু মেজাজ তেঁতে আছে তিথির। ভীষণরকম। ক্ষেপে আছে বৃষ্টির ওপর। বৃষ্টির মধ্যে আদৌ এ নিয়ে হেলদোল আছে বলে সন্দেহ। তিথি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এবার। কড়া কন্ঠে বলল,
‘ দিদি,তুই আমার কথা শুনবি নাকি না?
বৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
‘ কোন কথা? কিছু বললেতো শুনবো।
তিথি হাতের বইটাকে শব্দ করে রাখলো টেবিলের ওপর। চেঁতে বলল,
‘ ঐ লোকের ফোন নম্বর এনেছিস কেন?
বৃষ্টি নিরুদ্বেগ ভাবে বলল,
‘ তোর জন্যে।
তিথি অবাক হয়ে বসে পরলো চেয়ারে। কপাল চাঁপড়ে বলল,
‘ হায় হায়,ছেলেটা আমায় কি ভাবলো? নিশ্চয়ই ভেবেছে আমি তোকে শিখিয়ে দিয়েছি।হ্যাংলা মনে করেছে আমাকে।আমার মান সন্মান,ইজ্জ্বত সব ধূলোয় মিশিয়ে দিলি তুই। এও কি আমার মায়ের পেটের বোন? সৎ বোন হলে মেনে নিতাম আমি। কিন্তু তুই এটা করে করতে পারলি আমার সাথে? কিভাবে? হাউ?
বৃষ্টির সহজ স্বীকারোক্তি,
‘ কিভাবে পারলাম সেতো দেখলিই।আর এতে হ্যাংলা ভাবার কি আছে? তুইতো সাহস করে কোনো দিনও একটা ছেলের থেকে ফোন নম্বর চেয়ে আনতে পারবিনা। তাই আমিই এনে দিয়েছি।তোর কাজ বলতে পারিস এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছি অামি। আর একবার চাওয়াতেই ছেলেটা যেভাবে দিলো মনে হলো ও এই অপেক্ষাতেই ছিলো।
তিথি জোড়ালো শ্বাস ফেলে বলল,
‘ থাকলে থাকতো! ও থাকতো।আমিতো আর ছোট হতাম না তাইনা?
বৃষ্টি চোখ সরু করে বলল,
‘ তুই কেন ছোট হবি আমিতো সেটাই বুঝতে পারছিনা।
তিথি ভীষণ অসহায় চোখে তাকালো।
‘এখন দিদিকে কি করে বোঝাই! আদিত্য যে আজই আমাকে বলল আমাকে ওর পছন্দ।আর আজই তোকে ওকে দেখাতে নিয়ে গেলাম।তুই নম্বর চেয়ে আনলি ও নিশ্চিত ভেবে বসে আছে ওটা আমি চেয়ে পাঠিয়েছি। কি করলি রে দিদি।কি করলি?
তিথির ভাবনার ফাঁকেই বৃষ্টির মুঠোফোন শব্দ করে বেজে উঠলো। ধ্যান কাটলো তিথির।বৃষ্টি স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে মুচকি হেসে তিথির দিকে তাকালো। তিথি এই হাসির সঠিক কারন ধরতে পারলোনা। বৃষ্টি ফোনটা তিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ নে কথা বল।
তিথি বুঝতে না পেরে বলল,
‘ কে?
‘ কথা বলে দ্যাখ।চিনতে পারিস কিনা! ধর এখন, কেটে যাবে নাহলে।
তিথি চোখে মুখে এক রাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে রিসিভ বাটনে প্রেস করে কানে ঠেকালো। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একটা ব্যাস্ত , শান্ত কন্ঠ ভেসে এলো,
কি করছো তিথি?
তিথি জমে এলো প্রায়।এটাতো আদিত্যর কন্ঠস্বর।নাকি ভুল ভাবছে? সারাদিনে লোকটা মাথায় এমন ভাবে জেঁকে বসেছে বলে? ধড়ফড় করে স্ক্রিনে চোখ বোলালো তিথি।আননোন নম্বর ভাসছে। সেভ করেনি বৃষ্টি। প্রশ্ন নিয়ে তাকালো বৃষ্টির দিকে।বৃষ্টি মিটিমিটি হাসছে।তিথি বুঝতে পারলো সে ঠিক ধরেছে।এটা আদিত্যই! প্রচন্ড কৌতুহল নিয়ে মৃদূ স্বরে বলল,
‘ আপনি?
‘ আমি।আদিত্য।চিনতে পারলে?
‘ পেরেছি।
‘ বাহ!
তিথির চূড়ান্ত অস্বস্তি হচ্ছে। কি বলবে বুঝে পেলোনা। লাইন কেটে দেবে? কিন্তু সেটাকি ভালো দেখাবে? ইতস্তত করে বলল,
‘ কিছু বলবেন?
‘ বলার ইচ্ছেতো অনেক।তুমি কি শুনবে?
তিথি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।প্রত্যুত্তর করলোনা।আদিত্য নিজেই বলল,
‘ আমার ভীষণ মন খারাপ জানো? কেন খারাপ জানিনা। ঘরে ফিরতে মন চায়না আজকাল।ইচ্ছে হয় সারাটা দিন রুস্তমের দোকানের সামনে বসে থাকি। আর তারপর একজন কে দুচোখ ভরে দেখি।
তিথির গলা শুকিয়ে এলো। আদিত্যর ঠান্ডা আওয়াজে। লোকটা কিছু বললেই তার শরীর কেঁপে ওঠে।কেমন এক অনুভূতি হয়! এ অনুভূতি কিসের? ভালো লাগার? নাকি মিশ্র!
তিথিকে নিশ্চুপ দেখে আদিত্য শীতল কন্ঠে ডাকলো,
‘ তিথি…
তিথি আস্তে করে জবাব দেয়,
‘ হু…
‘ ভালোবাসি।
।তিথির হৃদস্পন্দন এক মুহুর্তের জন্যে থমকে গেলো ওখানেই। কিছু বলার মতন শব্দ পেলোনা।স্থির হয়ে বসে রইলো। ঠোঁট দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। বৃষ্টি উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে। আদিত্য কি বলছে শুনতে না পেলেও বোনের চেহারায় কিছু ঘটেছে স্পষ্ট। কিন্তু কি?
আদিত্য প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘ কিছু বলবেনা?
তিথি হুশে ফিরলো। কিছু বলতে ধরবে এর আগেই কেউ একজন ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে নিলো ফোন।হকচকিয়ে তাকালো দু বোন। সুচিত্রা শক্ত মুখ করে তাকিয়ে আছে তিথির দিকে। মাকে দেখে ভয়ে প্রান নাশ হয় তিথির।সুচিত্রা সন্দেহী কন্ঠে বলল,
‘ কার সাথে কথা বলছিলি?
তিথি জ্বিভের ডগায় উত্তর পেলোনা। ভাবতে লাগলো কি বলবে। পরিস্থিতি সামলাতে বৃষ্টি আমতা- আমতা করে বলতে শুরু করলো,
‘ মা আসলে…
সুচিত্রা হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলেন ওকে,কড়া কন্ঠে বললেন,
‘ আমি কাউকে জিজ্ঞেস করিনি। তুই বল( তিথির দিকে তাকিয়ে)
তিথি ভয়ে কাঁপছে।উশখুশ করছে। উত্তর না পেয়ে সুচিত্রা ফোনের স্ক্রিনে চোখ বোলালেন,
স্ক্রিন লক হয়ে গিয়েছে। ওয়াল পেপারে বৃষ্টির ছবি ভাসছে।
সুচিত্রার গলার স্বর শুনেই আদিত্য লাইন কেটে দিয়েছিলো।সুচিত্রা তেমন বিশেষ কিছু না পেয়ে ফোন টা বিছানার ওপর ছুড়ে মারলেন। শান্ত, কড়া কন্ঠে বললেন,
‘ আমি চাইনা, আমার মেয়ে বাকিদের মত হোক। দয়া করে কেউ যেন ওকে বিপথে চালিত না করে।তবে আমার থেকে খারাপ মা কেউ হবেনা।
মায়ের কথার ইঙ্গিত ঠিক বুঝে ফেলল বৃষ্টি। মুহুর্তেই রাগ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো।
সুচিত্রা চলে যেতে নিলে ফুঁসে উঠে বলল,
‘ আর কি বাকি আছে তোমার খারাপ মা হওয়ার? যে মা মাসের পর মাস সন্তানের খোঁজ নেয়না, সামনে দেখলেও দুটো কথা বলেনা সে ভালো মা হয়ই বা কি করে?
সুচিত্রা তিথিকে শান্ত ভাবে বললেন,
‘ সোনু,থামতে বল ওকে।
তিথি হা করতে নিলে বৃষ্টি চেঁতে বলল,
‘ ও আমাকে কি থামাবে? আর আমি কেনই বা চুপ করবো? সত্যিটা শুনতে খুব খারাপ লাগে তাইনা? তবে আমাকে শোনাও কেন? পরের ছেলের জন্যে এত দরদ উত্থলাচ্ছে অথচ নিজের মেয়ের জন্যে কিচ্ছু না? তোমার থেকেতো বাবা অনেক গুনে ভালো।অন্তত সোনু ওদের রাস্তায় পেলেও হেসে কথা বলে।
সুচিত্রা ঘুরে তাকিয়ে বললেন,
‘ বলেন কারন সোনু তোর মত নয়। তুই যা করেছিস তারপর তোর সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধে। পরের ছেলের জন্যে আমার দরদ উথলাচ্ছে না, আমি সত্যিটাকে সাপোর্ট করছি। আমরা তো তোকে বিয়ে করার জন্যে জোর জবরদস্তি করিনি,তুই নিজে যেচে করেছিস বিয়ে, ছেলেটার একটু খারাপ অবস্থা হলো কি ওমনি তাকে ডিভোর্স দিতে চাইছিস? তুই কি ভাবিস, তুই তোর বাবার কাছে না গিয়ে আমার কাছে কেন এসে থাকছিস আমি বুঝিনা? পেটে তুই আমায় ধরিস নি, আমি ধরেছি।আমি খুব ভালো করেই জানি, তুই এখান থেকে বেরিয়ে প্রত্যেকটা দিন ঠিক কোথায় কোথায় যাস,কার সাথে ঘুরে বেড়াস।কিন্তু কি করার! তোর দায়িত্ব যার সেই বুঝে নিক এসব।তবে আমার মেয়ে এত লোভী,বাজে চরিত্রের সেটা মা হিসেবে মেনে নিতে একটুতো কষ্ট হয়।
বৃষ্টি উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ তাই নাকি? আমি লোভী?বাজে চরিত্রের? আর তুমি খুব ভালো?
সুচিত্রা চোখ সরু করে বললেন,
‘ কি বলতে চাচ্ছিস?
তিথি অকূল পাথারে পরলো। দিদি আর মায়ের লড়াইয়ে দিশেহারা সে। কাকে থামাবে। পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রচেষ্টা হিসেবে দিদিকে অনুরোধ করলো,
‘ দিদি থাকনা।মাতো..
বৃষ্টি ধমকে বলল,
‘ তুই চুপ কর। আমি আজ বলবো,
মা বারবার আমার চরিত্র নিয়ে খোটা দেয় তাইনা।আচ্ছা মা তুমি নিজে বুঝি খুব চরিত্রবান ? তোমার চরিত্র যদি ঠিক থাকতো তবে আজ স্বামীর ঘর করতে।ওভাবে বাবা তোমাকে বের করে দিতোনা। আদিত্যতো এখনও আমার পায়ে পরে আমাকে ফিরিয়ে নিতে চায়,বাবা তো তোমাকে দু চোক্ষে দেখতে পারেনা।যার নিজের চরিত্রের ঠিক নেই,তার মেয়ে কি করে…
কথাটা শেষ করার আগেই বৃষ্টির গালে ঠাস করে চড় বসালেন সুচিত্রা। ভড়কে গেলো বৃষ্টি। গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকালো। তিথি চুপসে গিয়ে মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো ভয়ে।
সুচিত্রা টলমলে চোখে দাঁত খিচে বললেন,
‘ তোর মত বেয়াদব মেয়ে থাকার থেকে না থাকা ভালো।এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা তুই।এক্ষুনি…
বৃষ্টির চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তেঁতে বলল,
‘ যাবোইতো। আমার আসাই ভুল হয়েছে।আর কখনও এই বাড়িতে পা রাখবনা আমি..
সুচিত্রা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। দরজার কাছে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে ছিলো স্বপ্ন। সবটা দেখেছে সে।বৃষ্টি ব্যাস্ত হলো ব্যাগ গোছাতে।তিথি কাঁদছে আর বোন কে থামাতে চেষ্টা করছে,
‘ না দিদি প্লিজ যাসনা।মা রাগ করে বলেছে দিদি….
তিথি বৃষ্টির ব্যাগ চেপে ধরলো। কিছুতেই যেতে দেবেনা সে।এমনি হলে এক কথা! কিন্তু এভাবে একে অন্যের সাথে রাগ করে,মনমালিন্য নিয়ে ঘর ছাড়া মোটেও ঠিক নয়।
তিথির হাত ঝাঁড়া মেরে সরিয়ে দিলো বৃষ্টি।
‘ ছাড় আমায়। আর জীবনেও ওই মহিলার মুখ দর্শন করবোনা।
তিথির কোনো আকুতি মিনতিই কাজে লাগলোনা।
একটা সময় ব্যাগপ্যাক নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো বৃষ্টি। বসার ঘরে থম মেরে বসে ছিলেন সুচিত্রা।মাকে দেখেও না দেখার ভান করে সদর দরজা খুলে চলে গেলো বৃষ্টি। তিথি আর স্বপ্ন দৌড়ে পিছু নিতে গেলে সুচিত্রা শান্ত অথচ কড়া কন্ঠে বললেন,
‘ঘরের বাইরে এক পাও রাখবিনা কেউ।
মায়ের বরফ নির্দেশে তিথি, স্বপ্ন ওখানেই দাঁড়িয়ে পরলো।
বাইরে স্নিগ্ধ, শান্ত আবহাওয়া থাকলেও মনের মধ্যে উত্তাল ঝড় নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন সুচিত্রা। এতক্ষনের আটকে রাখা চোখের পানিটুকু গড়িয়ে গাল অব্দি এলো।যে সন্তানকে নয় মাস গর্ভে ধারন করে জন্ম দিলো, এত কষ্ট করে বড় করলো,সেই সন্তান আজ মাকে চরিত্র নিয়ে কথা শোনায়।এমন ও লেখা ছিলো কপালে!
সুচিত্রা ধড়াম করে দরজা আটকালেন।শব্দে কেঁপে উঠলো স্বপ্ন।গুটিয়ে গিয়ে আকঁড়ে ধরলো বোনের কোমড়। তিথির চোখ তখন থৈ থৈ। সুচিত্রা ধীর পায়ে গিয়ে বিছানায় শুলেন। বালিশ মুখে চেপে হুহু করে কেঁদে উঠলেন। ভাগ্য কেন এমন খেলা খেলছে? স্বামি সন্তানের চক্ষুশূল হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে, মরে যাওয়া যে ঢেড় শান্তির।
চলবে