#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১১)
বাড়ি ভর্তি মেহমান । উৎসব, উৎসব সময় । সাহা বাড়ির একমাত্র মেয়ের স্বাধের অনুষ্ঠান আজ। ব্যাস্ত সবাই।কাজ ফেলে এদিক ওদিক দেখার বিন্দুমাত্র ফুরসত নেই কারো।বাড়ি থেকে একটু দূরে বাইক থামালো আদিত্য।পেছনে তার শার্ট শক্ত হাতে খাঁমচে ধরেছিলো তিথি।বুকটা ভীষণ কাঁপছে। আদিত্য নিয়ে এসেছে তার বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করাতে।কিন্তু এমন একটা দিনে,বাড়িতে তো পা রাখার জোঁ-ই নেই।চারদিকে মানুষ। আত্মীয় স্বজনের মেলা বসেছে।উল্টোপাল্টা কিছু হলে? সব থেকে বেশি ভয় হচ্ছে আদিত্যর বাবা- মা তাকে মেনে নেবেন তো?
তিথি নেমে দাঁড়ালো।আদিত্য তার এক হাত আঁকড়ে ঢুকলো বাড়ির ভেতর।তিথির মুখ চোখ দেখে ঠাওড় করতে পারলো তার মনের অবস্থান।মৃদূ হেসে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘ ভয় পেওনা।আমার বাবা মা,খুব ভালো মানুষ। সুস্মিতাতো অনেক মিশুক।দেখবে খুব সহজে মিশে যাবে।
তিথি কিছু বললনা। উত্তরে একটু হাসলো।আদিত্য বাড়ির কাছাকাছি এসে হাতটা ছেঁড়ে দিলো। তিথির ঈষৎ অবাক লাগলেও চুপ করে থাকলো।আদিত্য দরজা দিয়ে ঢুকতেই বসার ঘরে অঢেল লোকজন দেখে একটুর জন্যে ভঁড়কে যায়।তিথির হৃদকম্পন বাড়তে থাকে।
একটা উজ্জ্বল ফর্সা রঙের মেয়ের গায়ে কলাপাতা রঙের শাড়ি।পেট টা বেশ উঁচু। চেয়ারে বসিয়ে তার সামনে সাজিয়েছে হরেক আয়োজন।বাহারি খাবার।আশপাশ ঘিরে বয়স্কা মহিলারা।এটা ওটা বেড়ে দিচ্ছেন থালায়।অতি যত্নে।
তিথি বুঝলো এটাই আদিত্যর বোন সুস্মিতা। চেহারায় কোনো মিল নেই ভাই বোনের। আদিত্য কে দেখে কারো ভাবান্তর হলোনা।কিন্তু তিথিকে চোখে পরতেই সুস্মিতার ভ্রু কুঁচকে এলো। পাশ থেকে একটি মেয়েকে চোখের ইশারায় নিজের কাছে ডাকলো ।মেয়েটি এগিয়ে এলে ফিসফিস করে বলল
‘ দাদার সাথে মেয়েটা কে? জিজ্ঞেস করে আয়তো সুমি।
সুমি মাথা নেঁড়ে দৌড়ে যায়। বয়স পনের হবে। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই আদিত্য পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ মা কই রে?
সুমি নিজের প্রশ্ন ভুলে উত্তর দিলো,
‘ জেঠিমা ঘরেই আছে।
আদিত্য তিথির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এসো।
তিথি গুটিগুটি পায়ে পিছু নিলো আদিত্যর।এতক্ষনে সকলের চোখ পরলো ওদের দিকে।কিন্তু ভ্রুক্ষেপ দেখালোনা কেউ,যতটা মনোযোগি হয়ে চেয়ে ছিলো সুস্মিতা।সুমি ওর কাছে হেটে অাসতেই ব্জিজ্ঞেস করলো,
‘ কে মেয়েটা? জিজ্ঞেস করেছিস?
সুমি দুদিকে মাথা নেঁড়ে বলল ‘ না।তার আগেই আদি দাদা চলে গেলো।
সুস্মিতা কটমটে চেহারায় চেয়ে থাকলো শুধু।এই মেয়েকে দিয়ে একটা কাজও হয়না।কে ওই মেয়ে? মাকে যার কথা বলেছিলো সেই মেয়েটা নাকি? সুস্মিতার নঁড়ন চড়ন না দেখে পাশ থেকে একজন বলে ওঠে,
‘ কি রে সুস্মি খাওয়া শুরু কর।আর তোর মা কই? এখনও আসছেনা কেন?
______
আদিত্যর মা শকুন্তলা, কাঁপড় গোছাতে ব্যাস্ত। আত্মীয়রা মেয়ের সাধে টুকটাক উপহার এনেছেন।এর মধ্যে দামি জিনিস গুলো আলমারিতে তুলে রাখছেন তিনি। অাদিত্য দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। অতি নম্র কন্ঠে ডাকলো,
‘ মা আসবো?
আদিত্যের মা তাকালেন।ছেলেকে দেখে মৃদূ হেসে বললেন,
‘ আয় না।
আদিত্য পাল্টা হেসে ঘরের ভেতর এলো।একটু এগিয়ে আসতেই আদিত্যর মায়ের চোখে পরলো পেছনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তিথিকে।ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ ও কে?
আদিত্য আস্তে করে বলল,
‘ মা ও… ওই যে তোমাকে বলেছিলাম না? আমি একটা মেয়েকে…
আদিত্যর মা ভ্রু নাঁচিয়ে বললেন,
‘ ও আচ্ছা। বুঝেছি এসো মা.. ভেতরে এসো।
তিথি একটু স্বস্তি পেলো আদিত্যর মায়ের আদূরে সম্বোধনে।গুটিগুটি পায়ে ভেতরে গিয়ে ওনার পাশে এসে দাঁড়ালো। শকুন্তলা তীক্ষ্ণ চোখে পরোখ করলেন। হেসে বিছানা দেখিয়ে বললেন,
‘ বোসো।
তিথি বসলো।শকুন্তলা আবার ব্যাস্ত হলেন আলমারির তালাতে চাবি ঘোরাতে।সে অবস্থাতেই প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ তা কি নাম তোমার?
তিথি উত্তর দেয়ার আগেই আদিত্যর মা হঠাৎ আদিত্যর দিকে ভ্রু কুঁচকে চাইলেন। খেকিয়ে বললেন,
‘ এই তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি ওর সাথে কথা বলছি।তুই যা…
আদিত্য মাথা চুলকে তিথির দিকে তাকালো। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে ঘর ছেড়ে বের হলো অনিচ্ছাসত্ত্বেও। তিথির ভয় হচ্ছে।আদিত্য থাকলে একটু স্বস্তি নাহলেও শান্তি লাগতো,কিন্তু এখন যেন বিব্রত বোধ তুমুল জেঁকে বসলো। আদিত্যর মা এসে তিথির পাশে বসলেন, কোমল কন্ঠে বললেন,
‘ কি নাম বললেনা?
তিথি নিচের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
‘ তিথি।
‘ পুরো নাম কি?
তিথি একটা ঢোক গিলে বলল,
‘ সুপ্রতা তিথি মিত্র!
শকুন্তলা যেন হোচট খেলেন। চিকন চোখে চেয়ে বললেন,
‘ তোমরা মিত্র?
তিথি ক্ষীন মাথা নাড়লো। শকুন্তলা গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ আমাদের কি বংশ জানো?
তিথি উত্তর দিলোনা।চেয়ে থাকলো ভয়ে ভয়ে। শকুন্তলা নিজে থেকেই বললেন,
‘ আমরা সাহা।কত উঁচু বংশ জানো?
তিথি চুপ করে থাকলো। শকুন্তলা যত্র প্রশ্ন ছুড়লেন আবার,
‘ সম্পর্কে যাওয়ার আগে জানতেনা তুমি? আদিত্য বলেনি?
তিথি দুদিকে মাথা নেড়ে “না জানালো।
‘ তোমার বাবা কি করেন?
তিথি মিহি কন্ঠে বলল,
‘ বাবা জেলা প্রশাসক।
শকুন্তলা একটু স্বস্তি পেলেন.. ভাবলেন,
‘ যাক ছেলে অন্তত কাঁদায় পা দেয়নি।পরমুহুর্তে থমথমে কন্ঠে বললেন,
‘ আর মা? সে গৃহিনী? নাকি চাকরি বাকরি করে?
তিথি একবার চোখ তুলে চেয়ে আবার নামিয়ে নিলো।বলল,
‘ জ্বি,মা স্কুল টিচার,আর একটা টেইলার্স আছে ওনার।
শকুন্তলা মুখ কুঁচকে বললেন,
‘ টেইলার্স? মানে দর্জির দোকান? কেন? তোমার বাবাতো জেলা প্রশাসক, তাহলে তোমার মা কেন এই কাজ করেন?
তিথি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। কথাটা উচ্চারন করতে বুক ফাঁটলেও,মৃদূ স্বরে বলল
‘ আমার মা আর বাবা আলাদা থাকেন।
শকুন্তলা মুহুর্তেই জ্বলে উঠে বললেন,
‘ কি? তোমার মা ডিভোর্সি? তার মানে স্বামীর সংসার করতে পারেননি?
তিথি ব্যাস্ত হয়ে বলল,
‘ না না ডিভোর্স হয়নি,এমনি আলাদা থাকেন।
শকুন্তলা মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
‘ চুপ করো তো বাপু।যা বোঝার আমি বুঝে গিয়েছি। ডিভোর্সি হওয়া আর স্বামীর থেকে আলাদা থাকার একই মানে।তা কেন আলাদা হলেন? তোমার বাবার বাইরে কোথাও ছুঁকছুঁক স্বভাব ছিলো নাকি?বা তোমার মায়ের? পুরুষ মানুষের এমন থাকতেই পারে,নির্ঘাত তোমার মায়েরই ছিলো কোনো কেচ্ছা,তাই স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে তাইনা? তা তোমার বাবা আবার বিয়ে করেছে?
তিথি লজ্জ্বায় চোখ খিচে বুজে নিলো।শ্বাস আটকে আসছে কথা বলতে। শকুন্তলা বুঝলেন এই মেয়ে জবাব দেবেনা।হঠাৎ চিল্লিয়ে ডাকলেন,
‘
এই আদিত্য আদিত্য…
ডাকার কয়েক সেকেন্ডের মাথায় তৎপর পায়ে হাজির হলো আদিত্য।
‘ হ্যা মা..
শকুন্তলা উঠে দাঁড়ালেন,ব্যাস্ততা দেখিয়ে বললেন,
‘ ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে আয়।
আদিত্য একটু অবাক হলো। একবার তিথিকে দেখে আবার মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
‘ কিন্তু মা ওতো প্রথম বার এলো,খালি মুখে…
শকুন্তলা তেঁতে বললেন,
‘ যা বলছি কর।দুদিনেই মায়ের মুখের ওপর কথা বলছিস দেখছি,এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন আসছে কি ব্যাপার?
শেষ কথাটা তিথির দিকে তাকিয়ে বললেন শকুন্তলা। ইঙ্গিতে তিথিকে দ্বায় দিলেন পরিষ্কার বুঝলো তিথি।তবু সে নিশ্চুপ। কারো দিকেই দেখছেনা চোখ উঠিয়ে। আদিত্য মায়ের ব্যাবহারে হতভম্ব। কূল -কিনারা পেলোনা। কথা না বাড়িয়ে তিথিকে বলল,
‘ চলো।
তিথি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।শকুন্তলার উদ্দেশে নম্র কন্ঠে বলল,
‘ আসছি।
শকুন্তলা জবাব দিলেন না।তিথি সামনে হেটে গেলো। আদিত্য বিষয়টার মাথামুন্ডু বুঝলোনা।প্রথমে তো সব ঠিকই ছিলো,হঠাৎ পরিবেশ এমন নিরব হলো কেন?
ঠিক তখনি ঘরে ঢুকছিলেন সমিরন। তিথি সামনে পরলো। সমিরন কে দেখে না চেনায় বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। এমনিতেই গলার মধ্যে এক সমুদ্র কান্না দলা পাঁকিয়ে বসে আছে। বাবা মাকে নিয়ে এমন কটু বাক্য এই প্রথম নয়, সেই ছোট থেকে শুনে বড় হয়েছে তারা।হয়তো বাকি জীবনও শুনতে হবে।সমিরন কপাল কোঁচকালেন। তিথির যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞাসা নিয়ে আদিত্যর দিকে ফিরলেন। আদিত্য চুপচাপ বাবাকে দেখে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো।সমিরন কিছুক্ষন অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন সেদিকে। ওরা যেতেই উদ্বেগ নিয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন,
‘ মেয়েটি কে?
শকুন্তলা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
‘ তোমার ছেলে জুটিয়েছে।
সমিরন বললেন,
‘ দেখতেতো ভালোই।
শকুন্তলা অধৈর্য কন্ঠে বললেন,
রাখো তোমার ভালো। বাবা মা আলাদাা থাকে,তারওপর নিঁচু জাতের।হায় ভগবান! দুনিয়ায় আর মেয়ে পাইনি তোমার ছেলে?
সমিরন চুপ করে থাকলেন। আসন্ন ঝড়ের আবহাওয়ার মত। হঠাৎ প্রসঙ্গ টা সম্পূর্ণ পাল্টে বললেন,
‘ বাইরে তোমাকে ডাকছে।যাও।
কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলেন সমিরন।এত শান্ত মেজাজ দেখে অবাক লাগলো শকুন্তলার। এরকম একটা কথা শুনেও নিরুদ্বেগ লোকটা? অবশ্য সংসারের এত বছরেও লোকটার মুখ দেখে মনের আন্দাজ পাননা তিনি। কি জানে কি আছে মনে?
‘ আদিত্য! এই আদিত্য!
কারো ডাক শুনে নড়ে উঠলো আদিত্য।কপাল কুঁচকে চোখ খুললো। ভোরের আলো ফুটতে আর কিছু সময়। পাখিদের কল-কাকলি শোনা যাচ্ছে মৃদু।এখনও তিথিদের দরজার সামনেই সে বসে আছে। অপেক্ষার প্রহর কাটাতে গিয়ে নিজেই তলিয়েছে ঘুম নদীতে। আদিত্য পাশ ফিরে দেখলো রঞ্জন বসে আছে। বুঝতে পারলো ঘুমের মধ্যেও সে অতীত হাতড়াচ্ছিলো এতক্ষন। ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল আদিত্য। ভাঙা কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ তুই এখানে?
রঞ্জন ধৈর্য হীন কন্ঠে বলল,
‘ আসবোনা? কাকু কাকি প্রত্যেকে তোকে নিয়ে অস্থির হয়ে আছে।আমি জানতাম তোকে এখানেই পাওয়া যাবে,তাও ওনাদের কিচ্ছু বলিনি।যতবার জিজ্ঞেস করেছে বলেছি জানিনা।
আদিত্য ক্ষীন কন্ঠে উত্তর দিলো,
‘ ভালো করেছিস।
রঞ্জন আদিত্যর এক বাহু টেনে বলল,
‘ চল।বাড়ি চল।তিথি হয়তো বাসায় নেই।তালা ঝুলছে দেখিস নি?
আদিত্য ফিচেল হেসে বলল,
‘ দেখেছিলাম।কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি আমার তিথি আমায় রেখে অন্য কারো কাছে চলে যাবে।
রঞ্জন ভ্রু কুঁচকে বলল
‘ মানে?
আদিত্য রাশভারি কন্ঠে বলল,
‘ তিথি তন্ময়ের কাছে চলে গিয়েছে রঞ্জন।
রঞ্জন সরু চোখে তাকালো। মনে করার চেষ্টা চালিয়ে বলল,
‘ তন্ময়?কে তন্ময়? উম…ওহ ওই তিথির বন্ধু?
আদিত্য আস্তে করে মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।রঞ্জন বলল
” তুই কি করে জানলি?
” তিথিকে ফোন করেছিলাম।তময় তুলেছে।
রঞ্জন ছোট করে বলল,
‘ ওহ
রঞ্জন আবার বলল,
‘ শুনতে অশোভোনীয় হলেও এখানে ভুল কিছু নেই।এটাই স্বাভাবিক।
রঞ্জনের কথার অর্থ আদিত্য বুঝতে পারলোনা।বোঝার চেষ্টাও করলোনা।উঠে দাঁড়ালো।ঠান্ডা স্বরে বলল,
‘ চল বাড়ি ফিরি।সবাই সবার জীবন গুছিয়ে নিচ্ছে যখন আমি আর বাকি থাকবো কেন?
_______
সুচিত্রা এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।যে মেয়ে তার বিশ্বাস না রেখে তাকে ঠকিয়েছে সেই মেয়ের সাথে আর কখনও কথা না বলার সিদ্ধান্ত।কিন্তু মাতৃ মন অটল থাকতে পারেনি। সন্তান হারানোর শোকে তার মেয়ে যখন উন্মাদের মত চিৎকার করছিলো তখন সেই ছুটে এসে মেয়েকে বুকের সাথে চেঁপে ধরলো।
তিথি ফোপাচ্ছে তখনও। পরপর এত গুলো আঘাতে চোখের জল শুকিয়ে খরস্রোতা নদী হয়েছে। পাশে মুখ উদাস করে দাড়িয়ে আছে তন্ময়।তিথির বাচ্চা মারা যাওয়ার খবরটা দেয়ার সাহ্স তার হয়নি বলে,নার্স কে দিয়ে বলিয়েছিলো।কিন্তু যা ভেবেছে ঠিক তাই।মেয়েটা গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। চিৎকার করে ভারি করে তুলেছে হাসপাতালের পরিবেশ টা।
সুচিত্রা মেয়েকে সামলাচ্ছেন।মাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে তিথি। যত কাঁদছে হালকা হওয়ার বদলে বুক ভাড় লাগছে আরো৷ আদিত্য নামক মানুষ টা যে সব কেঁড়ে নিলো তার! সুখ শান্তি, সন্মান,সন্তান সব কিছু। একে কি ক্ষমা করা যায়? আদৌ?
____
বাড়ি ফিরে আদিত্য সোজা নিজের ঘরে চলে গেছে। পুতুল কে এখনও নেয়া হয়নি সেখানে।পুতুল আছে শকুন্তলার সাথে।হিসেব মত আজ, কাল -রাত্রী পালন করে কাল ফুলসজ্জ্বা হবে। আদিত্যর মায়ের কঁড়া নির্দেশ, তার ছেলেকে কেউ যেন বিরক্ত না করে। ছেলে ঘরে ফিরেছে এই অনেক।
কিন্তু সমিরন পরেছে মহা বিপদে। রিসিপশন করবেন কি করবেন না ভুগছেন দোটানায়। ছেলের যা মতিগতি, যদি মাঝপথে রেখে চলে যায়? তখন ভুঁড়ি ভুঁড়ি মেহমানদের সামনে নাক কাঁটা যাবে যে!
আদিত্য এসে থেকে ঘরে খিল দিয়েছে। রঞ্জনের থেকেও কোনো উত্তর পাচ্ছেন না সমিরন। ছেলেটি সর্বদা তার ছেলের সাথে ছায়ার মত ঘুরে বেড়ালেও উত্তর দেবার বেলায় এই ছেলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে।
সমিরন বাধ্য হয়ে আদিত্যর ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। আদিত্য জেগেই ছিলো।এমন মরা মন নিয়ে কি আর ঘুম আসে? দরজায় বেশ কয়েকবার টোকা পরলে উঠে গিয়ে দরজা খুলল সে। ওপাশটায় বাবাকে দেখে অবাক হলো। এ মানুষটা অপ্রত্যাশিত। তাও এই সময়।সমিরন গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ ভেতরে আসতে পারি ?
আদিত্যর ভ্রু কুঁচকে এলো। অতি দ্রুত বিস্ময় কাঁটিয়ে উঠে মৃদূ মাথা নেড়ে” হ্য ‘জানালো।
সমিরন পেছনে দুহাত বেঁধে ভেতরে এসে নিজেই দরজা আটকে দিলেন তারপর। ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ কি চাইছো তুমি?
আদিত্য অবাক চোখে তাকালো। এই প্রশ্নের উত্তর কি সত্যিই তার বাবার জানা নেই?
সমিরন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন ছেলের দৃষ্টিতে। গলা ঝেঁড়ে বললেন,
‘ দেখো আদি,তুমি আমার একমাত্র ছেলে।আমার বিশ্বয় -আশ্বয় সব সম্পত্তির মালিক একমাত্র তুমি। তুমি ভালো থাকবে সেই কাজই আমি করেছি ভবিষ্যতেও করবো। একটা কথা জেনে রাখো, সংসার ভাঙা মায়ের মেয়েরা সংসারের মূল্য জানেনা।সেটা তোমার থেকে অন্তত একটু হলেও ভালো আমি জানি।আমি তাই ওই তিথি…
আদিত্য মাঝপথে বাবাকে থামিয়ে দিলো। ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ পুরোনো কথা বাদ দিন বাবা। নতুন কিছু বলার থাকলে বলুন।
সমিরন একটু অবাক হলেন ছেলের কথায়।ছেলের ভাব ভঙ্গি বোঝা মুশকিল। তাও ভালো যদি সে পুরোনো জিনিস ভুলে নতুনকে নিয়ে বাচতে চায়।পুরনো মানেই তিথি, আর নতুন মানেই তো পুতুলের মত ঘরলক্ষী। এটাই তো সে চাইছিলো। এত কাঠখড় পোড়ানো সফল হলেই মঙ্গল।সমিরন শান্ত ভাবে বললেন,
‘ হিসেব মত কাল তোমাদের বৌভাত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তোমার খামখেয়ালির জন্যে ঘরের বৌ আমাকে বিয়ের দিনেই তুলতে হয়েছে।তাই আমি ভাবছি বৌ ভাত আজই হোক। এখন কথা হলো তোমার মতামত কি?
আদিত্য স্ফীত হেসে বলল,
‘ আমার মতামত আপনার সত্যিই দরকার বাবা?
সমিরন থতমত খেয়ে বললেন,
‘ না মানে আমি বলতে চাইছি কালকে বিয়ে শেষে যেভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে আজ অন্তত সেভাবে যেওনা।পুরো অনুষ্ঠানে থেকো। বাবার সন্মানের এটুকু পরোয়া অন্তত করো। বাবাকে নিয়ে পাঁচটা লোক হাসবে তা নিশ্চয়ই তুমি চাইবেনা?
‘ না চাইবোনা।আপনি ভাববেন না। আপনি আয়োজন করুন। যা যা করতে চান সব কিছুর আয়োজন করুন।আমি আছি এখানেই।কোথাও যাবোনা।যাওয়ার জায়গাই নেই। বৌভাত ফুলসজ্জা সব হবে।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
আদিত্যর একদমে বলা কথাগুলোয় বুক ভরে শ্বাস নিলেন সমিরন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে খুশি খুশি কন্ঠে বললেন,
‘ আমি জানতাম,তুমি আমার কথা ফেলবেনা।বড় হও অনেক বড় হও।
সমিরন ঘড় ছেড়ে বেরিয়ে গেলে আদিত্য গিয়ে ধড়াম করে দরজা চাপালো আবার। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো।হঠাৎ মনে হলো তার চোখ দুটো জ্বলছে।হাতের দুটো আঙুল চোখের কোনে ছোয়ালো। সব টুকু জল শুষে এলো আঙুলের ডগায়।আদিত্য সেটাকে ছিটকে ফেলল দূরে। ক্ষীন হেসে বলল,
‘ তোমার যদি তন্ময় থাকতে পারে,আমার কেউ কেন নয়?
চলবে,