কৃষ্ণচূড়া🍂 নুসরাত সুলতানা সেজুথি পর্ব–১২

0
168

#কৃষ্ণচূড়া🍂
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–১২

আমার নানুভাই,,,, রওনক হোসাইন একজন নামি ব্যাবসায়ী ছিলেন। তার বন্ধু ছিলেন ইন্ডাস্ট্রির সেসময় কার একজন খ্যাত পরিচালক কূনাল বড়ুয়া।
ওনাদের বন্ধুত্ব বেশ অনেকটাই গাঢ় ছিলেন। যার দরুন সেখানে নানুভাইয়ের আনাগোনা প্রায়সই থাকতো।

আমার মায়ের মধ্যেও আরাবির মত ফিল্ম নিয়ে অনেক আগ্রহ ছিলো। তবে হিরোইন হওয়ার মত অতটা নয়। বিনোদন প্রিয় মানুষ যেমনটা হয়ে থাকে ঠিক সেরকম।

মা-ও নানুভাইয়ের সাথে এফ ডিসিতে আসা যাওয়া করতো মাঝে মাঝে। আর সেখান থেকেই ওই লোকটার সাথে মায়ের আলাপ,,,,নানুভাইয়ের অগোচরে একটা সময় তাদের পরিনয় গড়ে ওঠে। ওই লোকটা তার মিষ্টি মিষ্টি কথার জালে খুব শক্ত ভাবে পেচিয়ে ফেলে আমার মাকে।

আর তার প্রভাব এতোটাই প্রবল ছিলো যে কাউকে কিছু না জানিয়েই ওনার এক কথায় মা ওনাকে বিয়ে করে নেন।
শুধু তাই নয়,, বিয়ের পর মাকে লুকিয়ে রাখার জন্য অন্যত্র ফ্ল্যাটে থাকার বন্দোবস্তও করে দিয়েছিলেন উনি।
উনি সব সময় না থাকলেও সপ্তাহে দিন তিনেকের মত আসা যাওয়া করতেন।

বিয়ের কথা না উনি ওনার পরিবার কে জানিয়েছিলেন আর না আমার মাকে তার পরিবারের কাছে জানাতে দিচ্ছিলেন। কিন্তু এতেও মায়ের বিন্দুমাত্র অভিযোগ ছিলোনা। শুধুমাত্র মাঝে মাঝে ওনার অগোচরে মন খারাপ করতো মা,,,,

অবশ্য বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার আরো একটি কারণ ছিলো। নানুভাই মায়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক করেছিলেন। কিন্তু তাও নিজের পরিবারকে ফিরে পেতে কে না চাইতো। একদিন সব ঠিক হবে এরকম স্বপ্ন মাও দেখতো।

ওনার কোনও অভাব রাখেননি আমার বাবা নামক লোকটি। আর মাও ওনার ভালোবাসা পেয়ে নির্দ্বিধায় সব মেনে নিতেন। বাইরের সোসাইটি থেকে মাকে লুকিয়ে রাখার কারণ টা পর্যন্ত কখনও জানতে চাননি।

মাঝে মাঝে উনি নিজেই বলতেন,,,,এই মুহুর্তে আমি বিয়ের কথা জানালে খুব বড় সমস্যায় পরতে হবে আমাকে।
ওনার সমস্যার কথা ভেবে মাও ব্যাপারটা ছেড়ে দিতেন। আর যাই হোক সেতো ভালোই আছে।

এভাবে দিনগুলো পার হতে থাকে,,এক পর্যায়ে বছর ঘুরতে মা নিজের মধ্যে কারো অস্তিত্বের জানান পায়।
সেদিন নাকি ওই লোকটা আমার আসার খবর পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলো জানেন। বিয়ের পর প্রথম বার মাকে নিয়ে বের হয়েছিলো। পুরো এক বছর পর আমার মা বাইরের মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিয়েছিলো সেদিন।

এরপর একদিন মা ওনাকে না জানিয়েই বেরিয়ে যায়। নানুভাইয়ের উদ্দেশ্যে।
নিজের অনাগত সন্তানের আগমনের খবর জানাতে। কিন্তু গেটের বাইরে থেকেই তাকে ফিরে আসতে হয়েছিলো সেদিন। কারন নানুভাই তার মুখ দর্শন ও করতে চাননি। আর তাই দারোয়ান তাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেননি।

এভাবে সময় পার হতে হতে আমি এলাম,,,আস্তে আস্তে বড় হলাম। আমার দু বছর পর আরাবির জন্ম হলো,,
সপ্তাহে তিন দিন বাবাকে কাছে পেয়েও আমরা অনেক খুশি ছিলাম জানেন।

তখন আমার বয়স সাত কি আট বছর। আর আরাবির পাঁচ কি ছয় হবে।
হুট করেই সকাল থেকে আরাবি পার্কে যাওয়ার জন্যে জেদ ধরে বসলো। তাকে পার্কে না নিয়ে গেলে সে খাবেইনা।
মা ফোন করে বাবাকে বললে সে জানালো আর্জেন্ট কাজে আটকে আছেন তিনি। আজ আসা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। ওদিকে আরাবি কিছুতেই মানছিলোনা এসব।

শেষ মেষ মা ঠিক করলো আমাদের নিয়ে উনি একাই পার্ক থেকে ঘুরে আসবেন।
করলোও তাই। বেরিয়ে পরলো আমাদের দু বোন কে সাথে নিয়ে।

পার্কে পৌছে আমার আর আরাবির ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেলো। হুট করে আমার চোখ পরলো ভীড়ের মাঝে একটি লোকের দিকে। লোকটাকে অবিকল আমার বাবার মত দেখতে ছিলো।

সাথে সাথেই আমি মাকে গিয়ে দেখালাম। মাও তখন একিভাবে অবাক হয়েছিলো।
আসলে উনি আমার বাবাই ছিলেন। শুধু উনি একা ছিলেন না। ওনার কোলে আরাবির বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ে,,পাশে ওনার স্ত্রী। আর ওনার অন্য এক হাতের আঙুল ধরে ছিলেন ওনার কিশোর ছেলে। এর থেকেও অবাক লেগেছিলো যখন ওনার কোলে থাকা মেয়েটি ওনাকে বাবা বলে ডাকছিলো।

আমি তখন খুব একটা না বুঝলেও কিছুটা বুঝতাম। কিন্তু আরাবি বেশ অবুঝ থাকায় বাবাকে দেখেই ও দৌড়ে চলে গিয়েছিলো তার কাছে,,,

আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন?? লোকটা সেদিন আরাবির গালে চড় মেরেছিলেন ওনাকে ওভাবে জড়িয়ে ধরায়। উনি নাকি বাচ্চা মেয়েটাকে চেনেন ই না এমনটাই বলছিলেন ওনার স্ত্রীকে।
আরাবি কাঁদতে কাঁদতে যখন মায়ের কাছে এলো তখনই আড়চোখে তাকিয়ে মাকে দেখতে পান উনি।
কিন্তু তখন স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকা ছাড়া লোকটার আর কিছুই করার ছিলোনা। নড়লেই যে ধরা পরে যাবেন ওনার প্রথম স্ত্রীর কাছে।

সেদিন আমার মা বুঝতে পেরেছিলো,,,, কেনো এতো গুলো বছর আমার মাকে উনি ওনার পরিবারের কারো সাথেই কোনও রকম যোগাযোগ কিংবা দেখা করান নি।
কারণ তিনি পূর্বেই বিবাহিত ছিলেন এবং সেখানে তার সন্তান ও বর্তমান ছিলো।

আর তাই এতো দিন এতো লুকোচুরি।
আমার মায়ের আত্মসন্মান অনেক প্রবল ছিলো।সেই দিন সেই মুহুর্তে আমার মা ওনাকে না জানিয়েই আমাদের নিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যান।
নানুভাইয়ের কাছে তো যেতে পারবেন না ,,আর তাই কোনও রকম টুকিটাকি কিছু গয়না বিক্রি করে একটা ছোট্ট টিনের ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন আমাদের মাথা গোজার জন্য।

বড় ঘরের মেয়ে হয়েও মা শখের বশে অনেক হাতের কাজ শিখেছিলো,,,কে জানতো দুঃসময়ে এগুলোই তার কাজে লাগবে। অনেক কষ্ট করে একটা সেলাই মেশিন কিনে লোকজন এর জামা কাপড় সেলাই করে করে বড় করতে লাগলো আমাদের।
এরপর সেখান থেকে ছোট্ট একটা টেইলার্সের শপ। আমি বড় হওয়ার পর মাকে সাহায্য করার জন্য একটা শোরুমে কাজ নিলাম।তারপর আরাবির জোরাজুরি আর আমারও ইচ্ছে,,, সব মিলিয়ে বাসা পাল্টে ছাদ যুক্ত কামরা নিলাম। কিছুদিন আগেও যেটা আমাদের ঠিকানা ছিলো।

এভাবেই চলছিলো আমাদের জীবন। ভালো ছাত্রী হওয়ার দরুন আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু তার জন্যে তো,ভালো টিচার,,বই,,কোচিং এসবের দরকার।বুঝতে পারলাম আমার কপালে আমার স্বপ্ন পূরন লেখা নেই।
কিন্তু চেয়েছিলাম আরাবি ওর স্বপ্ন পূরন করুক। যদিও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ও হিরোইন হোক।তাও বোনের খুশি দেখতে চেয়েছিলাম। আর তাই রাজি হয়েছিলাম ওর আর্জিতে। অথচ কি থেকে কি হয়ে গেলো।

(একটু থেমে)

আমি মনে করি কি জানেন তো,,আমাদের এতো কষ্ট করে বড় হওয়ার পেছনে শুধুমাত্র আমার বাবাই দ্বায়ী ছিলেন। উনি যদি ঠিক হতেন তবে আমাদের জীবন টাও কত সুন্দর,, স্বাচ্ছন্দ্যে ময় হতো। না আমি আমার বোন কে এভাবে হারিয়ে ফেলতাম,আর না এতো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো আমাকে।
ওই লোকটা আমার মায়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনও শেষ করে দিলো।
কোনও দিনও ক্ষমা করবোনা ওই লোকটা কে আমি। কোনও দিনও না।

কাদতে কাদতে বসে পরেছে ছবি।
এতক্ষন উল্টো পাশে দাড়িয়ে ছবির কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছিলো কাব্য।
ছবির কান্না দেখে তার খারাপ লাগলেও সেই অভিব্যাক্তি অপ্রকাশিত রাখলো সে।
এগিয়ে গিয়ে দুহাতে ছবির বাহু ধরে উঠে দাড় করালো ওকে।

—- একজন স্ট্রং ব্যাক্তি কখনও এভাবে কেদে কেদে তার এনার্জি লস করেনা।আমিও আপনাকে স্ট্রং ভেবেছিলাম,,, বাট ইউ আর নট এনাফ স্ট্রংগার। এন্ড আ’ম অলসো রং।

কাব্যর কথা শুনে চোখ উঠিয়ে ওর দিকে তাকালো ছবি।ফলশ্রুতিতে নিজের হাত ছবির বাহু থেকে ছাড়িয়ে দূরে সরে দাড়ালো কাব্য।

— আমি মানছি আপনার মায়ের সাথে খুব খারাপ করেছেন আপনার বাবা। এমন কি আপনাদের সাথেও অন্যায় করেছেন তিনি। কিন্তু এটাই ভাগ্য মিস ছবি। এরকমটাই লিখে রেখে ছিলেন উপরওয়ালা।

তাও কিছু ব্যাপার আমাদের কর্মের ওপরও নির্ভরশীল। যে যেমন কাজ করবে সে তেমনটাই ফল পাবে এটাই স্বাভাবিক।

আপনার বাবাকে ভালোবাসা অব্ধি ঠিক ছিলো,,,কিন্তু আপনার মাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটাতে আমি বলবো যে আরো সচেতন হওয়া উচিত ছিলো,ওনার বাড়িতে জানানো উচিত ছিলো।
আপনার বাবা জানাতে নিষেধ করলেন আর উনিও শুনে নিলেন? এরকম টা একজন শিক্ষিত মেয়ের থেকে আশানুরূপ নয়।
ইউ নো না,,,বিশ্বাস ভালো কিন্তু অন্ধবিশ্বাস নয়।

আর দেখুন ওনার বোকামির ফল শুধু ওনাকেই নয়,, ওনার সন্তানদের ও ভুগতে হচ্ছে। এন্ড দ্যাটস ফর লাইফটাইম।

জবাবে কিছু বললোনা ছবি। আবারো বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে ব্যাথা নাড়া দিয়ে উঠেছে তার।
কথা বলা তো দূর,,, দাড়িয়ে থাকার শক্তি টুকুও পাচ্ছেনা সে।

কাব্য এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে,,যেগুলো ছবির কান অব্ধি পৌছাচ্ছে নাহ।
কাব্যকে বিষ্ময়কর এক মুহুর্ত উপহার দিতে ছবি ওভাবেই ঢলে পরলো মেঝেতে। সাথে সাথে নিষ্প্রান হয়ে এলো তার চোখের পাতাগুলো। ঝাপসা করে দিয়ে অন্ধকারে মোড় নিলো ছবির আলোকিত পৃথিবী।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here