আর একটিবার পর্ব-২৬

0
272

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২৬

সাঈদ হাত এগিয়ে দিলো ইরিনার দিকে। ইরিনা মুখ বাচ্চাদের মতো করে সাঈদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাঈদ ভ্রু কুঁচকে কোমড়ে হাত রেখে বলল,
“এই মেয়ে, সমস্যা কি তোমার? তুমি কী আমাকে বিশ্বাস করো না?”
ইরিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সাঈদ মুচকি হেসে আবার হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আছি, তুমি ধীরে ধীরে হেটে আসার চেষ্টা করো।”
“না আমি পড়ে যাব।”
ইরিনার কান্না করার মতো অবস্থা। চেয়ার শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পা থরথর করে কাঁপছে তার। কিভাবে সাঈদের দিকে এগিয়ে যাবে? পড়ে গিয়ে যদি ব্যাথা পায়? আর মাত্র ১৫ দিন পর তাদের বিয়ে। বিয়ের আসনে আহত রোগীদের মতো বসে থাকতে হবে। সাঈদ এবার বিরক্ত হলো। এগিয়ে গিয়ে ইরিনার চোখে চোখ রেখে বলল,
“কি যেন বলেছিলে তুমি আমাকে? ‘সাঈদ তুমি হুটহাট পাবলিক প্লেসে আমাকে কোলে তুলে নাও আমার খুব লজ্জা করে। যত পর্যন্ত আমি ঠিক মতো হাঁটতে না পারবো আমরা বিয়ে করবো না।’ এখন যেহেতু তুমি ধীরে ধীরে হাঁটতে পারছো তো ভয় পাচ্ছো কেন?”
“তুমি আমাকে বকছো কেন?”
সাঈদ কপালে হাত দিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলে খাটে বসলো। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে ইরিনার দিকে তাকাল। ইরিনা মন খারাপ করে রেখেছে। সাঈদ ইরিনার হাত ধরে তাকে নিজের পাশে বসালো। ইরিনা এখনো মন খারাপ করে রেখেছে। সাঈদ ইরিনার হাত৷ নিজের এক হাতের মুঠোয় নিয়ে আর এক হাত দিয়ে কান ধরে বলল,
“আচ্ছা সরি, কান ধরে ক্ষমা চাইছি। রাগ করো না প্লিজ।”
ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর ন্যাকামো করতে হবে না। আমি রাগ করিনি। আমার ভয় করে হাঁটতে। মাটিতে দাঁড়ালে মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে।”
সাঈদ দাঁড়িয়ে হেটে গিয়ে ইরিনার দিকে ঘুরলো। ইরিনা সাঈদের কান্ড দেখে তাকিয়ে রইল। সাঈদ দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এই দেখো, আমি তোমার সামনে। তুমি হেটে আমার কাছে আসবে। কার কাছে আসবে?”
“তোমার কাছে”
“তো আসো।”
ইরিনা হার মানলো। এই ছেলে তাকে আজ হাঁটিয়েই ছাড়বে। ইরিনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। এক আগাতেই পা কাঁপতে শুরু করলো। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষটা সামনে। যে তার খুব খেয়াল রাখে। তার তো যেতেই হবে মানুষটার কাছে। ইরিনা ধীর গতিতে পা বাড়াচ্ছে। সাঈদের মুখে বড়ো হাসও ফুটে উঠল। ইরিনা এলোমেলো পায়ে হেটে সামনে আসতেই পড়ে যেতে নিলো। সাঈদ দ্রুত তাকে নিজে বাহুতে আবদ্ধ করে নিলো। সাঈদ ইরিনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“লক্ষী মেয়ে, আমি জানতাম তুমি পারবে।”
ইরিনা সাঈদের বুকে গাল ঠেকিয়ে হাসছে। মাথা তুলে সাঈদকে দেখলো। এত ভালো কেন এই মানুষটা? তার পরিবারটাও খুব ভালো। সাঈদের মা তাদের সম্পর্ক মন থেকে মানলেও বাবা মানেনি। কিন্তু উনি ভীষণ ভালোবাসেন নিজের ছেলেকে। ইরিনাকেও নিজের মেয়ের মতো দেখেন। ইরিনা মেয়ে হিসেবে অনেক ভালো তাই রাজি হয়েছে। সমাজে উনার খুব সুনাম আছে। হয়তো এই বিয়ের পর অনেক কথার সম্মুখীন হবেন উনি। কিন্তু ছেলের জন্য সহ্য করে নিবে। সাঈদ ইরিনাকে ধরে নিয়ে এসে খাটে বসালো। হাঁটু গেড়ে ইরিনার পাশে বসতেই ইরিনা পা খাটের তুলে নিয়ে বলল,
“তুমি কেন সবসময় আমার পায়ের সামনে বসো বলো তো। আমার খুব অস্বস্তি হয়।”
সাঈদ হেসে বলল,
“তুমি বুঝবে না। তো বলো বিয়ের শপিং দেখেছো সব? পছন্দ হয়েছে?”
ইরিনা আর কিছু বলল না। সাঈদ জেদি। মনে যা আসে তাই করে। তাকে ভালোবাসার ইরিনার কাছে হাজারো কারণ আছে। কিন্তু সবচেয়ে মুগ্ধকর কারণ হচ্ছে সাঈদ তাকে ভীষণ সম্মান করে। বসে দুজন গল্প করতে লাগলো। বাসায় তারা ছাড়া আর কেও নেই। আজ শ্রাবণকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং তার শা*স্তি শোনানো হবে। ইর্তেজা আর মাহা সেখানেই গিয়েছে।
.
.
ইর্তেজার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে মাহা। ইর্তেজা কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে। শ্রাবণের শা*স্তি শোনানো হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আজ থেকে ঠিক ৭ দিন পর শ্রাবণকে ফাঁ*সি দেয়া হবে। ইর্তেজা অনেক চেষ্টা করেছে যাতে শা*স্তি বেশি না হয়। কিন্তু পারলো না। শ্রাবণের বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। পেয়েছে বললে ভুল হবে। শ্রাবণ নিজেই সব বলেছে। মাহা ইর্তেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তুমি নিজেকে সামলাও প্লিজ। আমরা চাইলেও কিছু করতে পারতাম না। শ্রাবণ নিজেই নিজেকে শা*স্তি দিতে চাচ্ছে।”
ইর্তেজা মাথা তুলে মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি জানি না আমার কেন এত খারাপ লাগছে। আমার সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আমার পাশে ছিল শ্রাবণ। আমি এটা কখনো ভুলতে পারবো না। এই মানুষটার মধ্যে খারাপ-ভালো দুটোই দিক আছে। সবাই শুধু খারাপ দিকটাই কেন দেখছে।”
“কারণ তার খারাপ দিকটাই ফুটে উঠেছে সবার চোখে। এটাই নিয়ম, তুমি হাজার ভালো কাজ করলেও কেও দাম দিবে না। একটা খারাপ কাজ করো, তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলবে।”
“ঠিক বললে। কিন্তু মাহা, সাগরিকাকে কি বলবো আমরা? সাগরিকা আমাকে বলেছিল তাকে শা*স্তির সম্পর্কে জানাতে। আমি কিভাবে বলবো?”
“তাকে বলতে হবেই ইর্তেজা।”
ইর্তেজা চিন্তায় পরলো। তখনই একজন পুলিশ এসে ইর্তেজাকে ডাকলো। ইর্তেজা তাকে দেখে দাঁড়াল।
“আপনাকে একটা সাহায্য করতে হবে মিস্টার ইর্তেজা।”
“জি ইনস্পেক্টর বলুন।”
“আমরা শ্রাবণ আহমেদের সকল সম্পত্তির রিসার্চ করেছি। সবগুলো অবৈধ। আমরা তার সব সম্পত্তি সিল করবো। তার বাড়ি, গাড়ি সবকিছুর দলিল লাগবে। আপনি শ্রাবণ আহমেদের সাথে দেখা করে নিন। আজই দেখা করার শেষ দিন। এরপর উনাকে সেন্ট্রাল জেল নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কারো সাথে দেখা করার পারমিশন সরকার দেবে না।”
“জি”
“আপনি আসুন আমার সাথে।”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকাল। মাহা ইশারায় তাকে যেতে বলল। ইর্তেজা মাথা নিচু করে সেই পুলিশের সাথে হাঁটা ধরলো। শ্রাবণের সাথে আজই তার শেষ দেখা। এরপর একেবারে তার লা*শ নিতে আসবে। ভাবতেই ইর্তেজার বুক কেঁপে উঠল।

শ্রাবণ দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কত মাস হয়ে গেল সাগরিকাকে দেখে না। মন ছটফট করছে এক নজর তাকে দেখার জন্য। ইর্তেজা বলেছিল সাগরিকা তার সাথে দেখা করতে চায় না। শ্রাবণ চোখ খুলল। সে জানে সে খারাপ। তাই বলে কি একবারো তার সাথে দেখা করা যায় না। শ্রাবণের মনের কোণায় অভিমান জমলো। যদি মৃ*ত্যুর আগে একবার সাগরিকার দেখা পায় সব অভিমান ভুলে যাবে। তখনই পুলিশ এসে বলল শ্রাবণকে কেও এসেছে তার সাথে দেখা করতে। শ্রাবণ ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কে এসেছে? নিশ্চয়ই সাগরিকা। শ্রাবণ দ্রুত হেটে সামনে আসলো। ইর্তেজা আসলো এগিয়ে। শ্রাবণ ইর্তেজার আশে পাশে দেখে বলল,
“সাগরিকা কোথায়? ও এসেছে তাই না?”
ইর্তেজা ঢোক গিলল। কান্না আসছে তার। মাথা নিচু করে ফেলল। ইর্তেজার ভাবসাব জবাব দিয়ে দিলো শ্রাবণকে। সাগরিকা আসে নি। শ্রাবণের চোখ বেয়ে পানি পরলো। দ্রুত চোখ মুছে বলল,
“কিছু বলবে ইর্তেজা?”
ইর্তেজা মাথা তুলে শ্রাবণের দিকে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনার সম্পত্তি সব সিল করবে। জায়গা জমিনের দলিল চাচ্ছে তারা।”
“ওহ, আমি দলিলপত্র সব সাগরিকার কাছে দিয়েছিলাম। সে-ই সব সামলিয়ে রাখতো। জানতো না সব অবৈধ। আর আমরা যে বাসায় থাকতাম সেটাও অবৈধ এটাও জানতো না।”
বলেই শ্রাবণ শব্দ করে হাসলো। কিন্তু ইর্তেজার হাসি আসছে না। সে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ হাসি থামিয়ে বলল,
“একটা কথা বলি তোমায়? আসলে একটা রিকুয়েষ্ট করতে চাই।”
“জি”
“থানায় আসার পর আমি অনেক গুলো হাদিস পড়েছি। কবরের আজাবের সম্পর্কে পড়ে আমার ভয় যেন বুক থেকে কমছে না। আমি কখনো নামাজ পড়ি নি৷ ফাঁ*সির থেকেও হাজারো গুণ কষ্ট সহ্য করতে হবে। কেও ধর্মের পথে কখনো আসতেই বলেনি। মা বাবা থাকলে হয়তো আমাকে মানুষের মতো মানুষ বানাতো। কি করবো! উনাদের এখন বদদোয়াও দিতে পারবো না জন্মের পর আমায় রাস্তায় ফেলে দেয়ার জন্য। ইর্তেজা, তোমরা সবাই আমার সব ভুলের জন্য আমায় ক্ষমা করে দিও। সাগরিকা যদি দেখা করতে আসে তার কাছ থেকেও মাফ চাইবো। আর যদি না আসে, তাকে বইলো আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়। অনেক কষ্ট দিয়েছি তাকে।”
ইর্তেজা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।মুখ চেপে ধরে কাঁদছে সে। শ্রাবণ হাত বাড়িয়ে ইর্তেজার গালে হাত রেখে বলল,
“কান্না থামাও ইর্তেজা, তোমাকে আমি শুধু ভাই ডাকি নি মেনেছিও। ইরিনা আপু, মাহা সবাইকে বইলো আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়।”
ইর্তেজা শ্রাবণের হাত ধরে নিজের কপালে ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো। শ্রাবণ তার আর এক হাত দিয়ে ইর্তেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“যাও ইর্তেজা।”
“আমি পারলাম না আপনার শা*স্তি কম করাতে। ক্ষমা করে দিয়েন আমায়।”
“আমি তোমাকে বলেছি আমাকে বাঁচাও ইর্তেজা? না, আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। কেন যেন বাঁচতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
ইর্তেজা মাথা তুলে চোখের পানি মুছলো। কি বলবে আর? এখন তার কাছে কিছুই বলার নেই।
.
.
সাগরিকা বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। হেরিং এর সময় ছিল ১২ টা। এখন ১ বাজতে চলেছে। ইর্তেজা এখনো কল দিচ্ছে না। সাগরিকা বিছানা থেকে নেমে পায়চারি করতে লাগলো। বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে খুব। সূর্য সাগরিকাকে ডেকে দরজা ঠকঠক করলো। সাগরিকা দ্রুত বিছানায় বসে মোবাইল হাতে নিলো। সূর্যকে বুঝতে দেয়া যাবে না সে শ্রাবণকে নিয়ে চিন্তিত। সূর্য জানতে পারলে রেগে যাবে। শ্রাবণকে একটুও সহ্য করতে পারে না সূর্য। সূর্য দরজা ঠেলে ভেতরে আসলো। সাগরিকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু বলবি?”
“ইর্তেজা ভাই এসেছে।”
সাগরিকা দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামলো। মোবাইল খাটের উপর ধপ করে দেখে দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকা ইর্তেজাকে দেখে নিজেকে শান্ত করলো৷ মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“কেমন আছো ইর্তেজা?”
“ভালো, কিছু বলার ছিল আপনাকে।”
“বলো, আর দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”
“না, বস বলল সম্পত্তির সকল দলিল আপনি সামলিয়ে রেখেছেন।”
সাগরিকা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
“বাড়ি-ঘর, গাড়ি, অফিস, ফ্যাক্টরি সব অবৈধ। পুলিশ সব সিল করে ফেলেছে। দলিলপত্র লাগবে।”
“ওহ, সব তো বাসায়। আমাদের.. মানে শ্রাবণের ঘরের আলমারির লক-আপে।”
“ঠিক আছে, আসি তাহলে।”
বলেই ইর্তেজা ঘুরে দাঁড়াল। সাগরিকা সাথে সাথে বলল,
“লক-আপে আমার ফিংগার প্রিন্ট দেয়া। খুলবে কিভাবে তুমি?”
ইর্তেজা সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি জানি আপনি কি করতে চান?”
সাগরিকা অপ্রস্তুত হলো। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে। ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আগামী এক সপ্তাহের পর উনাকে ফাঁ*সি দেয়া হবে।”
সাগরিকা যেন তার বুকে ধাক্কা অনুভব করলো। এলোমেলো লাগছে নিজেকে। কিছুই ভাবতে পারছে না। মাথা খালি খালি লাগছে।ইর্তেজা আবার বলল,
“উনি মাফ চেয়েছেন আপনার কাছ থেকে। মাফ করে দিয়েন উনাকে। যাতে উনার আজাব একটু হলেও কম হয়।”
সাগরিকার মাথা ঘুরছে। সাথে সাথে সোফা ধরে মাথা নিচু করে ফেলল। হাত পা কাঁপছে। ইর্তেজা ঘড়ি দেখে বলল,
“রাতে উনাকে সেন্ট্রাল জেল নিয়ে যাবে। তারপর আর দেখা করতে পারবো না। আপনি আমার সাথে চলুন। দলিলপত্র সব নিয়ে আমাকে যেতে হবে দ্রুত।”
সাগরিকার গলা যেন কেও চেপে ধরেছে। কিছুই বলতে পারছে না। আর না পারছে কাঁদতে। ধীরপায়ে হেটে ইর্তেজার সামনে গেল। ইর্তেজা কিছু বলল না। ঘুরে হাঁটা ধরলো। সাগরিকা চুপচাপ তার পিছু নিলো। দূর থেকে সূর্য অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণের ফাঁ*সি হয়ে যাবে। সে এইটাই চাইতো। কিন্তু এটা শোনার পর খারাপ লাগছে হঠাৎ।

সাগরিকা চুপচাপ রাস্তায় হাঁটছে। এই সময় তার কী করা উচিত সে জানে না। শ্রাবণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার কি দেখা করা উচিত হবে? দেখা করলে যদি নিজেকে শক্ত রাখতে না পারে? এই সময় তার মানসিক শান্তির প্রয়োজন। শ্রাবণকে দেখলে ভেতরের অশান্তি বেড়ে যাবে। বাসায় পৌঁছে সাগরিকা মাথা তুলে পুরো বাড়িতে চোখ বুলালো। কেও জানতো না এই সুন্দর বাড়ির ভেতরটা কেমন। এই বাড়িতে থেকে সাগরিকা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। শ্রাবণ তাকে মানসিক, শারীরিক সব ধরণের অত্যাচার করেছে। তার তো খুশি হওয়া দরকার শ্রাবণের শা*স্তি পেতে চলেছে৷ কিন্তু না, কষ্ট হচ্ছে তার। ভীষণ কষ্ট। সাগরিকা আর ইর্তেজা ভেতরে গেল। বাড়ির দরজা খুলতেই সাগরিকা থমকে গেল। এই কয় মাসে ধুলোয় ভরে গিয়েছে। বাড়ির এক এক কোণা সাগরিকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতো। সাগরিকা এগিয়ে গেল। এই পরিচিত বাড়িটাও হঠাৎ করে অচেনা লাগছে। সাগরিকা দাঁড়িয়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। ইর্তেজাও থামলো। সাগরিকার মনের অবস্থা সে বুঝতে পারছে। সাগরিকা চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। ইর্তেজা তার পিছু পিছু যাচ্ছে। সাগরিকা ঘরের দরজার সামনে গিয়ে চোখ বুলালো দরজায়। দরজায় খুব সুন্দর করে শ্রাবণ ও সাগরিকার নাম লিখা। সাগরিকা নামের উপর হাত বুলিয়ে ধলো মুছে দিলো। দরজা খুলে ভেতরে গেল। ঘর যেমন রেখে গিয়েছিল ঠিক তেমনই আছে। আলমারির সামনে গিয়ে দরজা খুলে লক-আপ থেকে দলিলপত্র বের করে ইর্তেজার দিকে এগিয়ে দিলো। ইর্তেজা সব চেক করে বলল,
“চলুন, আপনাকে বাসায় দিয়ে আমি থানা যাব।”
সাগরিকা জবাব দিলো না। হঠাৎ একটা কিছু মনে আসতেই আলমারির ভেতরের ড্রয়ার খুলে একটা ফাইল বের করলো। ফাইলটা দেখে সাগরিকার চোখের কোণায় পানি জমে গেল। এটা সেই জমিনের কাগজ যেখানে শ্রাবণ অনাথ আশ্রম বানাতে চেয়েছিল। সাগরিকা ইর্তেজাকে বলল,
“ইর্তেজা একটা হেল্প করবে?”
“জি বলুন”
“এই জায়গাটার সম্পর্কে খোঁজ করতে পারবে? মানে বৈধ না-কি অবৈধ। এটা সেই জায়গা যেটা শ্রাবণ মাহার চাচুর কাছ থেকে কিনেছে।”
“পারবো”
“তাহলে এইটাও নিয়ে যাও। যদি বৈধ হয় প্লিজ আমাকে দিয়ে যেও।”
“ঠিক আছে, আমি বসকে বলবো নি যদি জায়গা বৈধ হয় আপনার নামে করে দিতে।”
সাগরিকা মাথা নাড়াল।

জেলের ভেতর মাটিতে একটা মাদুর বিছানো শুধু। কোনো বালিশও নেই। মাথার নিচে হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে শ্রাবণ। দুপুর বেলা কিছু খায়নি। ক্ষুধা সহ্য করতে পারছিল না বলে জোর করে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয় মানুষটা তার স্বপ্নে হানা দিয়েছে। সাগরিকার হাতে হাত রেখে রাস্তায় হাঁটছে শ্রাবণ। পথ সামনে, কিন্তু তার দৃষ্টি সাগরিকার দিকে। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তাকিয়ে আছো কেন?”
“আমার প্রিয় মানুষটাকে দেখে মনের পিপাসা মেটাচ্ছি।”
সাগরিকা হেসে দাঁড়াল। শ্রাবণও দাঁড়াল তার দেখাদেখি। সাগরিকা শ্রাবণের আর একটু কাছে গিয়ে বলল,
“কাছে থেকে দেখো, দ্রুত মিটে যাবে।”
শ্রাবণ হেসে সাগরিকার গালে হাত রেখে বলল,
“সাত জন্মেও মিটবে না।”
সাগরিকা শব্দ করে হাসলো।

ইর্তেজার ডাকে শ্রাবণের ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে আশে পাশে দেখলো। সাগরিকা নেই। শ্রাবণের বুক ভারী হয়ে আসলো। পছন্দের স্বপ্ন ভেঙে গেলে খুব কষ্ট হয়। শ্রাবণ উঠে ইর্তেজার দিকে গেল। তার সাথে একজন উকিলও আছে। শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আবার আসলে কেন তুমি? বাসায় যাও। আপুর বিয়ে সামনে আর তুমি থানায় চক্কর লাগাচ্ছো বার বার।”
ইর্তেজা এই কথার উত্তর দিলো না। শ্রাবণের দিকে জায়গার কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পুলিশ খোঁজ করে দেখেছে এই জায়গাটা বৈধ। আপনি এটা সাগরিকার নামে করে দিন। উকিল সাথে নিয়ে এসেছি।”
শ্রাবণ কাগজ হাতে নিয়ে চোখ বুলালো। জীবনে প্রথম খোলা চোখে ভালো স্বপ্ন দেখেছিল৷ সেটা পূরণ করতে পারলো না। খুব আফসোস হলো তার। ইর্তেজা শ্রাবণের দিকে কলম এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ সাগরিকার নামে লিখে দিলো জায়গা। দলিলে চোখ বুলিয়ে মুচকি হাসলো। যাকগে, চলে যাওয়ার আগে ভালো কিছু সাগরিকাকে দিয়ে যেতে পারলো। এখন নিশ্চিন্তে দুনিয়া ছাড়তে পারবে সে।

————

সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে ভয় তত বাড়ছে। এখন রাত ১০ টা বাজছে। সকাল ঠিক ১০ টায় শ্রাবণকে ফাঁ*সি দেয়া হবে। হাতে মাত্র ১২ ঘন্টা সময় আছে। মনের কোনো এক কোণায় আশা বাঁধছে শ্রাবণ। হয়তো এই ১২ ঘন্টা ফুরানোর আগে সাগরিকা আসবে। একবার তাকে দেখতে পারবে শ্রাবণ। মন যে চাচ্ছে এই জেল ভেঙ্গে সাগরিকার কাছে চলে যেতে। সাগরিকার পা ধরে বলতে ইচ্ছে করছে আর একটিবার সুযোগ দাও সাগরিকা। ওয়াদা করছি নিরাশ করবো না এবার। শ্রাবণ চোখ খুলল। আজ সারারাত জেগে থেকে অপেক্ষা করবে। সাগরিকার অপেক্ষা। কারণ ১২ ঘন্টার পর তো সারাজীবনের জন্য ঘুমিয়ে যাবে। পারবে না আর প্রিয় মানুষটাকে দেখতে। তার কন্ঠ শুনতে, তাকে ছুঁয়ে দেখতে, তাকে অনুভব করতে। কারাগারের একদম উপরে ছোট্ট একটা জানালা আছে। সেখান থেকে একটুখানি আকাশ দেখা যায়। শ্রাবণ দেখানে তাকিয়ে রইল। আজ হয়তো আকাশে মেঘ জমেছে। যেমনটা তার মনে জমে আছে। শ্রাবণ গান ধরলো। সাগরিকার প্রিয় গান। যেটা সাগরিকা সবসময় শুনতো ও গাইতো,
“শুধু তোকে ঘিরে
শত স্বপ্নের ভিড়ে
এখন আমার বসবাস,
তুই এলে জীবনে
পাবো বাঁচার মানে
পাবো সুখেরই আভাস।

অভিমানী মন আমার
চায় তোকে বারেবার,
অভিমানী মন আমার
চায় তোকে বারেবার,
তাই বলি আয় রে ছুটে আয়।
ঐ উদাসপুরের বৃষ্টিতে
আজ ভিজবো দু’জনায়।

তোর মন পাড়ায়
থাকতে দে আমায়,
আমি চুপটি করে দেখবো
আর ডাকবো ইশারায়।
তুই চাইলে বল
আমার সঙ্গে চল,
ঐ উদাসপুরের বৃষ্টিতে
আজ ভিজবো দু’জনা।

গান শেষ হতেই সাগরিকা চোখ খুলে তাকাল। গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে কান্নায়৷ আর কত কান্না করলে বুকের কষ্ট শেষ হবে বুঝতে পারছে না। শ্রাবণের শা*স্তির কথা শোনার পর থেকে সে বলতে পারবে না শান্তির নিশ্বাস ফেলেছে একবারো। এমন কোনো রাত নেই, যে রাতে ঘুমিয়েছে। কি করবে? যাবে শ্রাবণের কাছে? গিয়ে কি বলবে? ‘মাফ করে দিয়েছি তোমাকে। আমার কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছাড়া। ফিরে আসো আমার কাছে’। বললেই কি শ্রাবণ আসতে পারবে। শ্রাবণকে দেখলে সে-ই পারবে না তাকে ছাড়া থাকতে।

সকাল ৯ টা,
ইর্তেজা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহাকে নিয়ে আসেনি। ইরিনার সাথে মাহা রয়েছে। সাঈদ এসেছে ইর্তেজার সাথে। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণকে নিয়ে বাহিরে বের হলো দুজন পুলিশ। ইর্তেজা সোজা হয়ে দাঁড়াল। শ্রাবণ ইর্তেজাকে দেখে এদিক সেদিক চোখ বুলালো। আসে নি সাগরিকা। এত পাষাণ তো ছিল না সে। শ্রাবণ তবুও তার মনের অভিমান শেষ করে ফেলল। কেন অভিমান থাকবে তার মনে? ভালোবাসে সে সাগরিকাকে। সাগরিকা তার জায়গায় একদম সঠিক। শ্রাবণ ইর্তেজার দিকে এগিয়ে গেল। ইর্তেজার চোখে অশ্রু জমে আছে। শ্রাবণ ইর্তেজার গালে হাত রাখলেই ইর্তেজা মাথা নিচু করে ফেলল।
“খেয়াল রেখো নিজের।”
ইর্তেজা মুখ শক্ত করে রেখেছে। শ্রাবণ সাঈদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“আমার কোনো বোন নেই। ইর্তেজার বোন আমার বোনের মতোই। আপুর খেয়াল রেখো।”
সাঈদেরও কষ্ট হচ্ছে খুব। শ্রাবণের কথা শুনে মাথা নাড়াল। শ্রাবণ ইর্তেজার নাম ধরে ডাকতেই ইর্তেজা শ্রাবণকে জাপ্টে ধরলো। শ্রাবণ হেসে ইর্তেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার কথা মনে আসলেই আমার কবর দেখতে চলে যেও। যদি মাসে একবারো আসো আমার ভালো লাগবে।”
ইর্তেজা শ্রাবণকে ছেড়ে নাক টানতে টানতে বলল,
“প্রতিদিন যাব।”
“তাহলে তো নিজেকে সৌভাগ্য মনে হবে আমার।”
শ্রাবণের মুখের হাসি দেখে ইর্তেজার বুক ফেটে যাচ্ছে। পুলিশ এসে শ্রাবণকে বলল তাদের সাথে যেতে। শ্রাবণ মাথা নাড়িয়ে তাদের সাথে চলে গেল। ইর্তেজা তাকিয়ে আছে শ্রাবণের যাওয়ার পথে।

ঘড়িতে ১০ টা বেজে ১৫ মিনিট। আইনের নিয়ম, সময়ের মতো সবসময় শা*স্তি দেয়া। সাগরিকা থমকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। গালে অশ্রুের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ তার মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলকে এক নজর দেখে ধীরপায়ে হেটে গেল। হাতে নিয়ে দেখে ইর্তেজার কল। হৃদয়ের স্পন্দন তো অনেক আগে থেকেই বেড়ে আছে। এখন তো শুধু বিস্ফোরণ হওয়ার অপেক্ষা। সাগরিকা কল রিসিভ করে কানে ধরলো। অপরপাশ একদম স্তব্ধ। সাগরিকা সব বুঝে গিয়েছে। ইর্তেজা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“চলে গিয়েছেন উনি।”
সাগরিকা মোবাইল কান থেকে সরিয়ে ধপ করে খাটে বসলো। চোখ ঝাপসা লাগছে। মাথাটাও ঘুরছে খুব। বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া অনুভূতি হচ্ছে খুব। সাগরিকা বুকের বা পাশে হাত রেখে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলল। না, কষ্ট তো বেড়েই চলেছে। সহ্য করতে পারছে না। কি করবে এখন? কিছু বুঝতে না পেরে শ্রাবণের নাম ধরে চিৎকার করে উঠল।

চলবে…….

[অনেকের কাছে অপছন্দের পর্ব হতে পারে এটা। নিজের অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না। অপেক্ষায় থাকবো আমি আপনাদের অনুভূতি পড়ার জন্য❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here