#ভালোবাসা_নামক_প্রিয়_অসুখ
#writer_sumaiya_afrin_oishi
#পার্টঃ৪৭
অলস বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে ঐশী। আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে রাফিনের ফিরে আসার। হঠাৎ করে দরজা বাহির থেকে আওয়াজ আসছে, কেউ ঠকঠক করে কড়া নাড়াচ্ছে। আধো আধো কন্ঠে, ছোট্ট একটি কন্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছাতে’ই বুঝতে পেরেছে কে এসেছে। ঐশী দ্রুত দরজা খুলে ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো। এই কয়েক দিনে ছোট্ট “রিমি” নামক মেয়েটাকে বড্ড আপন করে নিয়েছে। ঐশী রিমির হাতে একটি চকলেট দিলো, বাচ্চা মেয়ে’টা খুশী হয়ে ঐশীর গালে টুপ করে চুমু খেলো। আধো আধো কন্ঠ বললো,
“আন্তি(আন্টি) তুমি মেলা(অনেক) ভালো।”
ঐশী মৃদু হেসে রিমি কে জিজ্ঞেস করলো,
” নানু বাড়ি থেকে, বাসায় কখন আসছো আম্মু? তোমাকে এই কয়েকদিন খুব মিস করেছি আমি!”
“তকালে (সকালে) আচছি আন্তি(আন্ট)। আমিও তোমাকে মেলা মিত করতি।”
ঐশী পরক্ষণে মলিন কন্ঠে বললো,
“আমরা কালকে বাসা চেঞ্জ করে চলে যাচ্ছি রিমি। আমর কথা মনে থাকবে তোমার?”
এরি মধ্যে রিমির আম্মুও রুমে আসলো, উনি পিছন থেকে বলে উঠলো,
“চলে যাচ্ছ মানে? কোথায় যাবে তোমরা? এই বাসায় সমস্যা কি?”
“এতো বড় ফ্লাট আমাদের মতো মধ্যবিওদের জন্য নয় ভাবি। আমরা এক রুমের একটা বাসা নিয়েছি, কালকে সকালেই চলে যাচ্ছি এখান থেকে।”
দু’জন মিলে আরো কিছু কথা বললো।এই মহিলা সব সময় একটা আভিজাত্য নিয়ে চলে, কথার মধ্যে মানুষকে ছোট করতে যেন পৈ’শা’চি’ক মজা পায়। যা ঐশীর একদম ভালো লাগেনা, মুখের উপরে অসম্মান মূলক কথা বলে মানুষকে ছোট করতে চায় না ঐশী, তাই চুপচাপ থাকে প্রায় সময়ই। হঠাৎ রিমি’র আম্মু তাচ্ছিল্য করে ক্ষীণ হেসে বললো,
“তা ঐশী স্বামী’র সংসারে সুখে আছো তে? তোমার হাসবেন্ড যে জব’টা করে তাতে আর কয় টাকা পায়, ভালো আর কি করে থাকবে। নিশ্চয়ই তোমার ভীষণ কষ্ট হয় চলতে।”
ঐশী মুচকি হেসে বললো,
“সংসার জীবনে সুখী হতে কী অনেক টাকার প্রয়োজন হয় ভাবি। আমার হাসবেন্ডের যেটুকু আছে তাতেই আমি সন্তুষ্ট। জীবনে ভালো থাকতে গেলে আসলেই বেশি কিছুর প্রয়োজন পড়ে না।
শুধু এমন একজন থাকলেই চলে, সন্ধ্যা নামলেই যে ঘরে ফেরা পাখিদের মতো হাতে একটা বাজারে’র ব্যাগ নিয়ে দরজায় এসে কড়া নাড়বে। সারাদিনে’র কর্ম ব্যস্ততায় যার কপালে সদ্য ওঠা ব্রণ গুলো স্পষ্ট হবে,তবুও ক্লান্ত মুখে প্রিয় মানুষটাকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে জড়িয়ে নিবে নিজের বুুকের সাথে। যে শার্টের বুক পকেট থেকে একটি গোলাম কিংবা বেলি ফুলের মালা বের করে দিয়ে বলবে,
” আসার সময় হঠাৎ চোখে পড়লো,তোমার কথা মনে পড়তেই নিয়ে আসলাম।”
সংসার জীবনে সুখী হতে আসলেই অনেক টাকার দরকার পড়ে না। শুধু এমন একটা নিজের মানুষ থাকলেই চলে, যার জন্য হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ, চোখে গাঢ় কাজল,আর আটপৌড়ে একটা শাড়ী পড়ে অপেক্ষা করা যায়। কারণ বিশ্বাস আছে তার প্রতি, সে ফিরবেই আমার কুঁটিরে। শুধু একান্ত একজন মানুষ থাকলে, খুব বেশি কিছু প্রয়োজন পড়ে না। যে প্রত্যহ ঘুম ভাঙা সকালে আলতো করে গাল ছুঁয়ে বলবে,
“শুভ সকাল!”যার কবিতায় বিষন্ন বিকেলেটাও চায়ের চুমুকে হয়ে উঠবে প্রানবন্ত। যার সাথে শীতের কনকনে ঠান্ডা সকালেও হিমশীতল বাতাসে, শিশির ভেজা দুর্বা ঘাসে পায়ে পা মিলিয়ে নির্দ্বিধায় অতিক্রম করা যায় সীমান্তের পর সীমান্ত। জীবনে ভালো থাকতে বেশী কিছু আমার প্রয়োজন নেই,
এক জোড়া বিশ্বাস্ত ও ভরসার হাত থাকলেই চলে, যে হাত জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত আঙুলের শূন্য স্হানের পূর্ণতা দিবে।যার চোখের মায়ায় সকল ক্রোধেরা পরাজয় স্বীকার করে নিবে।যার হাসিতে আরো কয়েক জনম বাঁচতে ইচ্ছে করবে।
সংসার জীবন উপভোগ করতে সত্যিই বেশী কিছু লাগেই না, শুধু একান্তই ব্যক্তিগত একজন মানুষ পাশে থাকলেই জীবন অনায়সে চলে, যার সাথে রোজকার রুটিনে আলু ভর্তা,, ডালেও তৃপ্তি আছে, যা মাছ -মাংসেও থাকে না। একটা মধ্যবৃও সংসার করা যায় খুশী মনে একান্ত ঐ মানুষটার সাথে , যে মানুষটার পবিত্র ভালোবাসায় ছাপোষা ইচ্ছেরাও পূর্ণতা পায়। একটা নারী সুখী হতে এসবই যথেষ্ট, যা আমি প্রতিদিন রুটিনের ন্যায় পেয়ে থাকি। আমার হাসবেন্ডের টাকা নেই, আমার সংসারের বিলাসিতা নেই, তবে রয়েছে আমার হাসবেন্ডের অসীম ভালোবাসা। যা টাকা -পয়সা আভিজাত্যপূর্ণ সংসারে নেই। আপনার হাসবেন্ড হয়তো মাস শেষে আপনাকে হাত-ভর্তি টাকা দিতে পারে, কিন্তু এমন ভালোবাসা দিতে পারে ক’জন। আমার একান্ত মানুষটার সাথে আমি কুঁড়ের ঘরেও অনায়াসে সুখে জীবন কাটিয়ে দিবো।
কথা গুলো বলেই আবারো হাসলো ঐশী, রিমির আম্মু’র মুখখানা মুহুর্তেই চুপসে গেলো। ইতস্তত বোধ করে বললো,
“আমার একটু কাজ আছে ঐশী, আসি এখন।”
কথা গুলো বোধ হয়ে কাজে লেগেছে, মহিলার মুখের অবস্থা নাজেহাল। ঐশী মনে মনে হাসলো খুব, নিজেকে সংযোত রেখে মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বললো,
” ঠিক আছে ভাবি। আবার আসবেন। ”
.
.
রাত এগারোটা চৌধুরী বাড়ির মহিলারা রান্না ঘরে ছোটাছুটি করে ডাইনিং টেবিলের খাবার সাজাচ্ছে। রাতের খাবারটা সবাই এই সময় এক সাথেই খেয়ে থাকেন, বহুদিন ধরে এটাই যেন একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছে। সবাই খেতে বসেছে, শুধু নাজমা কামাল বসলো না, উনি খাবার সার্ভ করছে। আজ গরুর গোশ ও গলদা চিংড়ি ভুনা করছে, এই খাবার গুলো রাফিনের ভীষণ পছন্দের। নাজমা কামালের আর গলা দিয়ে এই খাবার নামবে না, বারবার রাফিনের কথা মনে পড়ছে আজ। চোখ দু’টো ভরে উঠছে বারংবার। ছেলেটা কি খায় না খায় জানা নেই তার, ছেলে খারাপ অবস্থায় থাকলেও মায়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলে কোনো অভিযোগ ছাড়াই, রাফিনের স্বভাব সম্পর্কে অবগত তিনি। নাজমা কামাল স্বামীর কাছে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে কিছু বলার জন্য, কিন্তু চাপা ভয়ের কারণে বলতে ইতস্তত বোধ করছে। কামাল চৌধুরী বিষয়টি লক্ষ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তুমি কিছু বলবে নাজমা?”
উনি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আসলে একটা কথা বলতে,,,
” এতো আসলে নকলে না করে দ্রুত বলো। কথা গুড়িয়ে পেঁচিয়ে বলাটা আমার পছন্দ না।”
উনি সাহস নিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“যদি একটু রাফিনকে বাড়ি আসতে বলতেন। আর কতদিন বাবা-ছেলের মধ্যে মনমালিন্য রাখবেন। ছেলে যদি ঐ মেয়েকে নিয়ে সুখী হতে পারে,তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায়? না-হয় একটা ভুল করেছেই, তাছাড়া মেয়ে সব দিক দিয়ে আমার ছেলের যোগ্য। আপনার দাম্ভিকতার জন্য আমার একমাত্র ছেলেটা আজ বাড়ি ছাড়া। মা হয়ে আমি এসব আর সহ্য করতে পারছি না রাফিনের বাবা। আমার ছেলে-ছেলের বউসহ শেষ বয়সটায় একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই।”
কথাগুলো বলতে বলতে চোখ দিয়ে অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়লো তার। কামাল চৌধুরী কিছু বললো না, খাবার ছেড়ে উঠে পড়লেন। নাজমা চৌধুরী স্বামীর যাওয়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
____________________
আজ শুক্রবার গোধূলির বুকে বিকেলের আভা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রাকৃতি জুড়ে বসন্তের রঙিন আমেজ। রাস্তার পাশ ধরে হাঁটছে জান্নাত ও সিয়াম। মাঝে মাঝে টুকটাক কথাও বলছে। হাঁটতে হাঁটতে জান্নাত কে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে সিয়াম। এই কয়েকটি মাস জান্নাতকে মানসিক ভাবে সব রকমের সাপোর্ট করেছে সিয়াম। আজ ছুটির দিন থাকায় বিকেলের দিকে বাহিরে নিয়ে আসেছে, আবহাওয়ার পরবর্তনে বাহিরে বের হলে মন ভালো হয়ে যাবে বলে। যদিও জান্নাত আসতে চায়নি, বাবা’র জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে এসেছে। এই কয়েকটা মাসের মধ্যে মেয়েটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে, শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটা চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে ঘরের কোণে, প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না।নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখতে চায় জান্নাত, কিন্তু বে’ঈ’মা”ন’দের কি এতো সহজে ভুলা যায়। মনের এক কোণায় ঠিকই থেকে যায়।এক বুক চাপা কষ্ট নিয়ে বাবা-মায়ের জন্য নিজেকে স্ট্রং দেখালেও রাতের কাছে হেরে যায়,পুরোনো ক্ষ’ত গুলো জীবিত হয়ে হাতছানি দেয়। জান্নাতকে অন্যমস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে সিয়াম গলা খাঁকারি দিয়ে ক্ষীণ স্বরে ডাকল,
“জান্নাত….
হকচকিয়ে উঠে জান্নাত, নিজেকে স্বাভাবিক করে সিয়ামের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“জ্বি বলুন।”
“চুপ করে আছো যে? ভালো লাগছে না এখানে?”
“হ্যাঁ ঠিক আছে সমস্যা নেই।”
“কি খাবে অর্ডার করো?”
“আপাতত একটা কফি হলেই চলবে,ক্ষুধা নেই এখন।”
সিয়াম দুইটা কফির অর্ডার দিলো। জান্নাতকে এটা সেটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।এক পর্যায় জান্নাত স্বাভাবিক হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি সব কিছু জেনেও আমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন কেনো সিয়াম? আপনার খারাপ লাগছে না এটা ভেবে, আপনি ছাড়া ও আপনার হবু স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়ানো ছিলো।”
সিয়াম মৃদু হাসলো, জান্নাতে’র দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“উঁহু মোটেও খারাপ লাগছে না।
আমি কখনো জানতেও চাইবো না তোমার প্রথম প্রেমিক কে? অথবা তুমি কয়টা সম্পর্কে জড়িয়েছো। কিংবা কার সাথে তোমার মন আদান-প্রদান করেছিলে।তোমার অতীত সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে চাই না আমি।তোমার অতীতে যেই থাকুক না কেনো,তা নিয়ে বিন্দুমাএ মাথা ব্যথা নেই আমার।
কিন্তু যখন তুমি আমায় ভালোবাসবে তখন শুধু আমাকেই ভালোবাসো। অন্য কাউকে কল্পনাতে ও আনবে না।তোমার সকল ভাবনা জুড়ে শুধু আমাকেই রেখো।আমাতেই তুমি সীমাবদ্ধ থেকো।তোমার মনের মালিকানা শুধু আমার নামে করে দিও। আমি তোমার প্রথম হতে চাইনা,আমি তোমার শেষ ভালোবাসা হতে চাই জান্নাত। যে ভালবাসাময় তুমি একটা জন্ম অবলীলায় কাটিয়ে দিতে পারো। আমি যুগ যুগ ধরে তোমার অপেক্ষায় কাটিয়ে দিতে পারি, যদি তুমি নিশ্চয়তা দেও দীর্ঘ অপেক্ষার পর তুমি শুধু আমার হবে।”
থামলো সিয়াম, জান্নাত মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সিয়ামের প্রত্যেকটা কথা। হৃদয় জুড়ে বয়ে গেলো ভালোলাগার শিহরণ। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পুনরায় আবার বললো,
“এসব কি মনের কথা, নাকি একান্তই আবেগ? পুরুষ মানুষ তো পা’ক্কা অভিনেতা, তাদের মিষ্টি কথাও তেঁতো লাগে এখন। এসব নিতান্তই হাস্যকর মনে হয় !”
সিয়াম এবার থমথমে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“দেখো জান্নাত তুমি আমাকে নাই বা ভালোবাসলে,কিন্তু আমার স্বচ্ছ অনুভূতিকে অসম্মান করার কোনো অধিকারও তোমার নেই।”
“স্যরি! রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি এমনি’ই একটু মজা করলাম। আর অবশ্য’ই আমি রেসপেক্ট করি আপনার অনুভূতিকে।”
সিয়াম কিছু বললো না, বার কয়েক কফিতে চুমুক দিচ্ছে। জান্নাত পুনরায় মলিন কন্ঠে আবার বললো,
“দেখুন সিয়াম বাবা আগামী মাসে বিয়ের ডেট ফিক্স করতে চাচ্ছে। আমাকে আরো কিছু দিন সময় দিন প্লিজ! আমি মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই, তাই আরো কয়েকটা মাস সময় দিন। আপনি একটু ম্যানেজ করুন বাবাকে।”
“তোমার চিন্তা করতে হবে না এসব, তোমার অমতে কিছু হবে না। তোমার যত ইচ্ছে সময় নেও। যত ইচ্ছে উড়ে বেড়াও, উড়তে উড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে ডানা ঝাপটে নিচে পড়ে যাবে, তখন না-হয় আমার কাছে ফিরে এসো। আমি দীর্ঘদিন না হয় অপেক্ষা করবো তোমর জন্য।”
কথাগুলো বলে ক্ষীণ হাসলো সিয়াম। জান্নাত কিছু বললো না চুপ করে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। সিয়াম অপলক নয়নে চেয়ে রইলো জান্নাতের মুখশ্রী’র পানে। তার মনে হচ্ছে অদ্ভুত কোনো মায়াবী নারী তার চোখে’র সামনে বসে আছে। আর সে মুগ্ধ নয়নে তাকে দেখছে। সিয়াম’কে এভাবে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে জান্নাত মনে মনে আওড়ালো,
“পুরুষ তোমরা পারোও বটে! একপুরুষ সীমাহীন ভালোবাসা পেয়েও তা পায়ের নিচে পিষে চলে গেলো। আর এক পুরুষ ফেলে দেওয়া জীর্ণ-শীর্ণ মানবীকে পথ থেকে কুঁড়িয়ে, দামী মুক্তা ভেবে বুক পকেট রেখে দিবার জন্য ম’রি’য়া হয়ে যাচ্ছে।”
“কি এতো ভাবছেন ম্যাম?”
“তেমন কিছু’ই না। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, চলুন বাসায় যাবো এখন।”
“আচ্ছা চলো।”
.
.
আজ সপ্তাহখানিক হয়েছে নতুন বাসায় এসেছে ঐশী ও রাফিন। এখানে দিব্বি ভালো যাচ্ছে দিন। এখানের মানুষগুলো সবাই মধ্যবিও, কারো মধ্যে অহেতুক মিথ্যা অহংকার নেই। কয়েক জন মিলে এক চুলায় একটা তরকারি রান্না করে খাচ্ছে, তবুও সবার মুখে কী সুন্দর প্রশান্তির ছাপ, মুখে রয়েছে স্বচ্ছ হাসি। এদের সাথে দিনগুলো বেশ যাচ্ছে ঐশী’র। রাফিন আজ তাড়াতাড়ি বাসায় এসেছে, রাতের খাবারটা খেয়ে সেই থেকে গভীর মনযোগ দিয়ে লেপটপে কাজ করছে। ঐশী কতক্ষণ এসব দেখে বিরক্ত হয়ে গিয়েছে, বিরক্তিকর মুখ করে হুট করে লেপটপ অফ করে দিলো।
রাফিন কিছু’টা চেঁচিয়ে ধমকের সুরে বললো,
“এটা কি করলে ঐশী? এগুলো কোন ধরনের বাচ্চা’মো হ্যাঁ। কতক্ষণ বসে এতগুলো কাজ কমপ্লিট করলাম, আর তুমি অসময়ে লেপটপ’টা অফ করে দিলে। রাফিন আবারও লেপটপ অন করে কাজের মধ্যে ডুবে গেলো।”
রাফিনের এমন ব্যবহারে ঐশী ভীষণ কষ্ট পেলো। প্রিয় মানুষের থেকে এইটুকু উঁচু কন্ঠ শুনলে অপর প্রান্তের মানুষটার মন’টা বিষাদে ভরে যায়। কেননা প্রিয় মানুষের কাছে সবাই আহ্লাদি আদুরে বিড়াল ছানার মতো। তাদের একটু আদর কম পড়লে যেমন, নিজেকে গুটিয়ে রাখে,নারীরাও সঙ্গী’র কাছে তেমন আদুরে হয়ে থাকতে চায়। নাহয় নিজেকে একদম গুটিয়ে নিরব হয়ে থাকে, যতদিন না তার অভিমান না ভাঙানো হয়। ঐশী আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না রাফিনের কাছে, বিছানায় এসে মুখ ডেকে সুয়ে পড়লো। চোখ দিয়ে অশ্রু গুলো গাল বেয়ে পড়ছে। তবে কি তার ভালোবাসা এই ক’দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছে?এখন আর আমাকে বোধ হয় ভালো লাগে না তার। ঠিক আছে আমিও আর ধারেকাছেও ঘেঁসবোনা। এক আকাশ সমান অভিমান জন্ম হলো রাফিনের প্রতি। কারো ফুঁপিয়ে কাঁদা’র শব্দ কানে আসতেই হকচকিয়ে উঠে রাফিন। বুঝতে আর বাকি রইলো না ঐশী কাঁদছে। এভাবে ধমক দেওয়া একদম উচিত হয়নি, নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে ঐশী। রাফিন দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে, ধীর পায়ে ঐশীর কাছে গেলো। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অন্য পাশ ফিরে সুয়ে পড়লো। রাফিনও ঐশীর পাশ ঘেঁষে সুয়ে, পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ঐশী নিজেকে বারবার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, আর রাফিন আরো আ’ষ্ট’পি’ষ্ট ভাবে জড়িয়ে নিচ্ছে। ঐশী এবার চেঁচিয়ে অভিমানী কন্ঠে বললো,
“ছাড়ুন আমাকে। আপনি আপনার কাজ করুন। আর কখনো কোনো প্রকার ডিসটার্ব করবো না। পুরনো হয়ে গিয়েছি, তাইতো এখন আর আমাকে ভালো লাগেনা আপনার। এখন আমার উপস্থিতিও বাজে লাগে আপনার কাছে। আমি কালকেই বাড়ি…..।
রাফিন আর বলতে দিলো না মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো।মুখটা করুন করে বললো,
” এসব কি বলছো বউ? স্যরি! আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। একদম সবকিছু ডিলিট হয়ে গিয়েছিলো তাই মাথাটা ঠিক ছিলো না। আর এমন ধমক দিবো না, প্লিজ সোনা কান্না করো না। আর এসব আজে-বাজে কথা কখনো যেন না শুনি।”
“শুনতে হবে না আপনার। আমি কি শুনতে বলছি আপনাকে। আপনি গিয়ে কাজ করুন আপনার, তাহলে তো আর শুনতে হবে না। ছাড়ুন আমাকে।”
“স্যরি বললাম তো এমন করছো কেনো জান। দিনশেষে তোমার কাছেই তো আসবো বউ, তুমি ছাড়া আর কেই বা আছে আমার বলো? আদর ও করবো আমি আর শাসন ও আমি করবো, কারণ তুমি পুরোটাই আমার দখলে একান্তই আমার। বলেই চোখে’র উপরে অধর ছুঁয়ে দিলো।
প্রিয়জনের আলিঙ্গন আদুরে স্পর্শ পেয়ে ঐশী এবার শব্দ করে কান্না করে দিলো, কান্না মিশ্রিত কন্ঠে অভিযোগ করে বললো,
“আপনি ইদানিং সারাদিন ব্যস্ততা দেখান, আমাকে মোটেও সময় দেন না। আপনি আড়াল হলে, ব্যস্ততা দেখালে আমার কেমন লাগে জানেন?
আপনি আড়াল হলেই আমার ভাল্লাগেনা, সত্যি’ই ভাল্লাগেনা। আপনি আমার চোখের আড়াল হলে শূন্য অনুভব করি খুব, বুঝাতে পারবো না কতটা মন খারাপিতে দেই ডুব।
আপনি কারণে অকারণে যখন ব্যস্ত থাকেন ভুলে যান আমার কথা, আর আমি ব্যস্ত থাকলেও আপনাকে মনে করি খুব। কি স্নিগ্ধতা তাইনা! এটা না বুঝতে পারবেন না আপনি,আমি একা একা আপনাতেই মুগ্ধতা আঁকি! আর আপনি দিব্বি ভালো থাকেন ব্যস্ততা নিয়ে।
” এভাবে বলতে নেই বউ পাখি! বুকে ব্যথা লাগে খুব। আমিও সেম ভাবে তোমাতেই মুগ্ধতা খুঁজি বউ। আর কখনো তোমাকে ব্যস্ততা দেখাবে না, এই যে কান ধরলাম (কানে হাত দিয়ে)। আসলে কয়েকদিন কাজের চাপটা বেশি ছিলো। আচ্ছা শোনো লক্ষ্মী’টি? কালকে সারাদিন তোমার, তোমাকে নিয়ে ঘুরবো তবুও ক্ষমা করো আমাকে, কেঁদো না এভাবে!”
ঐশী নিরুওর। কিন্তু গুনগুন করে কাঁদছে। এবার রাফিনের মেজাজ বিগড়ে গেলো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো বললো,
“আচ্ছা তুমি একা একা মন প্রাণ ভরে কাঁদো, আমি বাসা থেকে চলে যাচ্ছি, রাতে আর আসবো না।”
বলেই উঠে দাঁড়াল রাফিন, একরোখা জেদী লোকটা সম্পর্কে অবগত ঐশী। নিজের কান্না থামিয়ে রাফিনের হাত ধরে বললো,
“আচ্ছা আর কাঁদবো না।”
রাফিন মুচকি হেসে বললো,
এইতো আমার লক্ষ্মী বউ! বলেই অধর ছুঁয়ে দিলো ঐশীর কপালে। কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসি বউ!”
ঐশী নাকের নোনা জল রাফিনের টিশার্টে মুছে ফিক করে হেসে বললো,
“ভালোবাসি শ্যামসুন্দর মানব!”
চলবে……..
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ! ]