#ভালোবাসা_নামক_প্রিয়_অসুখ
#writer_sumaiya_afrin_oishi
#পার্টঃ৫০ বা (অন্তিম পর্বের প্রথম অংশ)
সোনালী রোদ্দুজ্বল আলোয় আলোকিত প্রকৃতি। সময়টা সকাল। আজ রাফিনে’র ক্যারিয়ার জীবনে’র সূচনা হতে চলছে। নিজ শহর বরিশাল সদর হসপিটালে নতুন জয়েন্ট হবেন সে। চাইলে ঢাকা হসপিটালেও যুক্ত হতে পারতো,কিন্তু তার স্বপ্ন ছিলো নিজ শহরে থেকে গরীব দুঃখী মানুষদের সেবা করা। ঢাকা’র শহরে তো অনেক বড় বড় ডক্টর রয়েছে। কিন্তু উপশহরে ভালো চিকিৎসক রয়েছে খুবই সীমিত। যার ফলে নিতান্ত সাধারণ মানুষগুলো বিনা চিকিৎসায় অকালে ঝরে যাচ্ছে। তাই তার এমন সিদ্ধান্ত, নিজের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করবে তাদের উন্নত চিকিৎসার। আজ তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে। হৃদয় জুড়ে ভালো লাগার শিহরণ বয়ে যাচ্ছে বারংবার! আজকে’ই হসপিটালের প্রথম দিন তার। দীর্ঘ দিন সিনিয়র ডক্টর’দের সাথে থেকে ট্রেনিং দিয়েছে রাফিন। এখন নিজে’ই একজন গাইনি চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। নিজের নামে’র সাথে যোগ হয়েছে ডক্টর উপাধি। রাফিন খুব ভোরে উঠে’ই ব্যয়াম করার জন্য বাহিরে ছিলো। বাসায় এসে ঐশী’কে রুমে না পেয়ে খুঁজতে লাগলো। রান্না ঘরে সানজিদা শেখ ও জামিলা বেগম সকালে’র জন্য নাস্তা তৈরী করছে। ঐশী’ও তাদের সহযোগিতা করছে। খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরে সাড়া পেলো কাঙ্খিত নারী’টির। রাফিন রান্না ঘরে কয়েকবার উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ঐশী’কে ডাক’তে চাইলো।কিন্তু মা- চাচিদে’র সামনে থেকে রুমে ডাকতে ইতস্তত বোধ করছে। তাই আর ডাকলো না, মলিন মুখে চলে গেলো রুমে। অতো কিছু না ভেবে গোসল করা’র জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো রাফিন। কেননা আর একটু পড়ে-ই তাকে বের হতে হবে।
প্রিয় মানুষে’র শরীরে অদ্ভুত একটা প্রেম প্রেম ঘ্রাণ রয়েছে।যেই গন্ধ অপর মানুষটি’কে আকৃষ্ট করে নাম না জানা ফুলে’র মতো। যেই গন্ধ নাকে আসলে’ই আপনি চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে পারবেন তার অস্তিত্ব কিংবা তার আগমন। কেউ খেয়াল না করলেও ঐশী’র চোখ এড়ায়নি যে, রাফিন এখানে এসেছিলো। কিয়াৎক্ষণ পরে একটা কাজে’র অযুহাত দিয়ে রুমে আসলো ঐশী। এখানে রাফিনে’র দেখা গেলো না। ওয়াশরুম থেকে পানি’র শব্দ পেয়ে বুঝতে পারলো মানুষটা ওয়াশরুমে আছে। বিভিন্ন ঝামেলার কারণে রাফিনে’র জন্য কেনা শার্ট’টি এখনো দেওয়া হয়নি। ইচ্ছে করেও দেয়নি শার্টটি। তার সাথে কেনা পাঞ্জাবি’টা দেখলেই বুক ভরা কষ্ট অনুভব করে ঐশী। বাবা’র কথা তখন খুব মনে পড়ে। আলমারি খুলে শার্ট’টি বের করলো ঐশী, সাথে পাঞ্জাবি’টা ও রয়েছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না, মুহূর্তে’ই বুকের বাঁ পাশে বাবা’র জন্য শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। পাঞ্জাবি’টা হাতে নিতেই বাবা’র হাস্যজ্বল মুখটা চোখে’র সামনে ভাসছে।চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসলো, অশ্রু গুলো বেরিয়ে আসতে চায়। বাবা’র মতো কেউ ভালোবাসলে’ও তার অভাব সারাজীবন অনুভব করে সন্তানে’রা। কেননা বাবা’র মতো করে গভীর ভাবে কেউ ভালোবাসে না। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো ঐশী। আজকে তার স্বামী’র বিশেষ দিনটা মাটি করতে চায়না সে।আজ বিশেষ দিনে সারপ্রাইজ’টা দিবার উপযুক্ত সময় বলে মনে হচ্ছে ঐশী। মৃদু হেসে, তড়িঘড়ি করে একটা ছোট্ট চিরকুট ও শার্টি বিছানায় রেখে চুপটি করে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে। হাতে রয়েছে পাঞ্জাবি’টা। এটা নিয়ে শ্বশুড়ে’র রুমের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো। বাবা’কে তো আর কস্মিণকালেও দেওয়া হবে’না। তাই শ্বশুড় নামক বাবা’কেই দিয়ে দিবে আজই।
.
.
কামাল চৌধুরী ভীষণ খুশী হয়েছে পাঞ্জাবি’টা পেয়ে। এদিকে রাফিন গোসল করে বের হয়ে বিছানা’র উপরে কালো রঙের একটা শার্ট ও চিরকুট দেখে অবাক হয়ে গেলো। তবে ধারণা করতে পারলো এটা তার মায়াবিনী’ই হবে। রাফিন হাস্যজ্বল মুখে দ্রুত কাগজটি খুলে পড়লো।
“প্রিয় শ্যামসুন্দ’র মানব!” আজ আপনার বিশেষ দিনে আপনার “মায়াবিনী’র” পক্ষ থেকে ছোট্ট একটি উপহার। যদিও এটা অতো দামী কোনো উপহার নয়। তবে ভালোবেসে কিনেছিলাম, আমার জীবনে’র প্রথম উপর্জন দিয়ে। পছন্দ না হলেও পড়বেন, আমি অপেক্ষায় রইলাম।”
রাফিন যেন সারপ্রাইজ হয়ে গেলো। মুহূর্তে’ই রাফিনে’র মুখশ্রী জ্বলজ্বল করছে। বারংবার শার্ট’টা হাতে নিয়ে নে’ড়ে’চে’ড়ে দেখছে। রাফিন যে বড্ড খুশী হয়েছে তা তার মুখে’র হাসি’ই বলে দিচ্ছে। প্রিয় মানুষটা’র দেওয়া উপহার সামান্য জিনিস হলেও সেটাই হয় পৃথিবীর দামী উপহার। এতে রয়েছে তার ভালবাসার ছোঁয়া। তেমনি রাফিনে’র কাছে এইটা শ্রষ্ঠ উপহার মনে হচ্ছে। হাসিমুখে দ্রুত রেডি হচ্ছে রাফিন। শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিলো, এরি মধ্যে ঐশী প্রবেশ করলো রুমে। রাফিনকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। শ্যামবর্ণ পুরুষটি’র গায়ে শার্টটা দারুণ মানিয়েছে , ক্ষীণ তৃপ্তিময় হাসি হাসলো। রাফিনের কাছে এসে নিজ হাতে বোতাম গুলো লাগিয়ে দিচ্ছে। বিনিময়ে রাফিন হাসলো। শেষে’র বোতামটা লাগিয়ে যেই না হাত সরিয়ে নিবে, অমনি রাফিন হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের বাহুডোর আবদ্ধ করে নিলো। ঐশী’র চুলে মুখ ডুবিয়ে কানে’র কাছে ফিসফিস করে বললো,
“আমি ভীষণ খুশী হয়েছি বউ!ধন্যবাদ তোমাকে। এত সুন্দর একটি দিন উপহার হিসেবে দিবার জন্য।”
ঐশী মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো,
“পছন্দ হয়েছে আপনার?”
রাফিন ঐশী’কে আরো গভীর ভাবে শক্ত করে আলিঙ্গন করলো, মোহনীয় কন্ঠে বললো
“অবশ্যই দারুণ হয়েছে মায়াবিনী! তোমাকে বুঝতে পারবো না, কতোটা খুশী হয়েছি আমি। মানুষ কাউ’কে কতো’টা ভালোবাসলে, সীমিত উপর্জন দিয়ে, নিজের জন্য না কিনে প্রিয়জনে’র কথা ভাবে।বিশ্বাস করো বউ! তোমাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়ে, নিজেকে সব থেকে ভাগ্যবান পুরুষ মানুষ বলে মনে হচ্ছে। এরথেকে আনন্দে’র, কিংবা বিশেষ পাওয়া পুরুষ মানুষে’র কিছুটি হতে’ই পারে না! আমার জীবনে’র শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে রয়ে যাবে এটা। তোমাকে না পেলে হয়তো কখনো উপলব্ধি’ই করতে পারতাম না, এতোটা গভীর ভাবে কোনো নারী কোনো পুরুষ’কে ভালোবাসতে পারে! সৃষ্টিকর্তা’র দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি! আবারো ধন্যবাদ বউ! এক মুঠো রোদ্দুর হয়ে আমার জীবনে আসার জন্য।”
বলে’ই রাফিন ঐশী’র কপালে অধর ছুঁয়ে দিলো। ভালোবাসা’র স্পর্শ এঁকে দিলো সমস্ত মুখশ্রী’তে।
ঐশী লাজুক হাসলো। স্বামী”র মুখ থেকে প্রশংসা শুনতে সব মেয়ে’র ভালো লাগে। ঐশী’র ভীষণ ভালো লাগলো তার শ্যামসুন্দর পুরুষ’টি তার কাছে সুখী রয়েছে। একজন স্ত্রী হিসেবে এটা’ও বিশেষ পাওয়া।
ঐশী নিজে’কে ছাড়িয়ে নিতে নিতে স্মিথ কন্ঠে বললো,
“কি শুরু করছেন ছাড়ুন তো? তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে আসুন। নিচে সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”
রাফিন হেসে ঐশী’কে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ তাইতো। দেখছো তোমাকে কাছে পেলে সব ভুলে বসে থাকি। তোমাকে দেখলে’ই শুধু প্রেম প্রেম অনুভব হয়! সারাদিন আদর করতে ইচ্ছে করে।”
ঐশী ক্রোধিতো চোখে তাকালো। মৃদু রাগ দেখিয়ে বললো,
“নির্লজ্জ লোক! মুখে কিছু আঁটকে না আজকাল।”
রাফিন হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বললো,
“বউয়ে’র কাছে লজ্জা’র কি আছে হুহ?”
ঐশী আর কথা বাড়ালো না। রাফিনে’র গায়ে সাদা এপ্রোন পড়িয়ে দিলো। তীক্ষ্ণ গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“একদম পারফেক্ট ডক্টর সাহেব! দারুণ লাগছে আপনাকে!”
বলেই সামান্য পা উঁচু করে রাফিনে’র কপালে অধর ছুঁয়ে দিলো।
.
.
রাফিন সবার সাথে নাস্তা সেরে মা-বাবা, চাচা-চাচি’র থেকে দোয়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লো তার কর্ম জীবনে’র উদ্দেশ্য।
.
আজ ভার্সিটিতে আসছে জান্নাত। সাথে এসেছে সিয়াম। দুইমাস আগে তাদে’র বিয়ে হয়েছে। সিয়াম নিজে’র ভালোবাসা দিয়ে জান্নাতে’কে আগলে নিয়েছে। জান্নাত ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করছে এখন, আদিত্য নামক কালো অধ্যায়’টি তার জন্য অ’ভি’শ’প্ত ছিলো। মনে মনে আদিত্য’কে ধন্যবাদ দিচ্ছে হাজার বার। হয়তো ঐদিন তাকে ছেড়ে না দিলে,কখনো জানতে’ই পারতো না একজন পুরুষ মানুষ এক নারী’তে গভীর ভাবে আসক্ত হতে পারে। সিয়াম’কে পেয়ে ভীষণ সুখী সে।এই মানুষটা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। তাকে প্রতিনিয়ত অনুভব করায়”জীবন আসলেই সুন্দর”! যদি মানুষটা সঠিক হয়।
দু’জন মিলে ফুসকা খেয়ে, হাত ধরে মাঠে হাঁটছিল। দূর থেকে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেলো জান্নাত। ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সিয়ামে’র হাতটা শক্ত করে ধরলো।পরক্ষণেই সিয়ামে’র দৃষ্টি গেলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি’র দিকে। লোকটি আর কেউ নয় আদিত্য। যে এক দৃষ্টিতে জান্নাতে”র দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টি দৃষ্টি গোচর হতেই সিয়ামে’র বুকে অজানা ভয় হলো। তবে কী আদিত্য ডাকলে তাকে ছেড়ে যাবে জান্নাত? কেননা আদিত্যে’র দৃষ্টিতে ছিলো অসহায়ত্ব, গভীর ভালোবাসা। ছেলে হয়ে চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার। না আর ভাবলো না সিয়াম, জান্নাতের হাত নিজের সাথে শক্ত ভাবে জড়িয়ে নিলো। বিষয়টা এমন যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। জান্নাত মুচকি হাসলো, মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আচ্ছা চলুন না আজ মার্কেটে যাই। আমার ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না আজ। আপনার সাথে ঘুরবো সারাদিন।”
সিয়াম যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। জান্নাতে’র হাতটি ছাড়লোই না, দ্রুত হাত ধরে আদিত্যে’র পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে দু’জন । আদিত্যে’র মুখে’র দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেলো জান্নাত।
যেই হাসি আদিত্য’র হৃদয়’টা ত’ছ’ন’ছ করতে যথেষ্ট ছিলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো আদিত্য। জান্নাতে’র সাথে কথা বলার সাহস হলো না। তবে মনে মনে বললো,
“তুমি’তো ভীষণ সুখে আছো জান্নাত। আমি ভালো নেই, একদম ভালো নেই। তোমার বলা কথা গুলো সত্যি হলো। “আল্লাহ ছাড় দেয় তবে ছেড়ে দেয় না।” তোমাকে ঠকিয়ে আমিও ঠকে গিয়েছি ভালোবাসা’র কাছে। খাঁটি সোনা না চিনে, চাকচিক্যের পিছনে ছুটে ঠকে গিয়েছি। তোমার বলা কথা, উপরওয়ালা অ’ভি’শা’প হিসেবে দ্বিগুন ফেরত দিয়েছে আমাকে। এখন আমার আফসোস হয়, কেনো তোমাকে চিনলাম না! তোমার মতো করে কেউ ভালোবাসেনি! একবুক ভালোবাসা পেয়েও অপমান, অপদস্ত করেছি। আজ তোমার একটু ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করছে খুব করে। শুধু আজ না সেই কবে থেকে উপলব্ধি করছি তোমাকে। কেউ আর আমার কথা গুলো মন দিয়ে শোনে না তোমার মতো করে। কারো সময় হয় না! আমার কথা গুলো শোনার। কত কথা জমে আছে বুকে। অথচ কাউকে বলতে পারি না। আমার কষ্টে কেউ আর চোখে’র জল, নাকের জল একাকার করে কাঁদেনা! কেউ কষ্ট অনুভব করে না আমার জন্য । এসব আমি কাকে বলবো? আর “তুমি” টাও তো নেই! আমার ঘুম নেই, খাওয়া হয় না ঠিক মতো। কেউ আর জোর করে বলে না’ খেয়ে নেও! তুমি না খেলে আমিও খাবো না! আমার বুকে বড্ড ব্যথা জান্নাত! তোমাকে ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে করছে! জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু, তোমাকে বুঝতে দেরী হয়ে গেলো যে! তুমিও তো আর শুনবে না। সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। আমি না হয় তোমার স্মৃতি নিয়ে থাকবো! তবে সৃষ্টিকর্তা’র নিকট প্রার্থনা রইলো, তুমি ভীষণ সুখী হও!”
আদিত্যে’র চোখ দিয়ে অশ্রু গুলো গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে । দূর থেকে একপলক জান্নাত’কে দেখার জন্য’ই মূলত এখানে এসেছিলো আদিত্য। আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সে। জান্নাতে”র বিপরীত রাস্তায় আনমনে হাঁটছে। মুহূর্তে’ই চোখে’র সামনে ভেসে উঠলো জান্নাতে’র সাথে করা অন্যয় গুলো। তার অসহায় কথাগুলো কানে বাজছে যেন। আদিত্যে’র চোখ দিয়ে ঝর্ণার ন্যায় অশ্রু কণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে। সময় একরকম যাবে না কারো। আজ আপনি কাউকে ঠকিয়ে হাসছেন। তবে অপেক্ষা করুণ আপনিও বাজে ভাবে ঠকে যাবেন, আপনিও কাঁদবেন। সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে এর বিচার করেন।যে করেই হোক, আপনাকেও দ্বিগুণ ভাবে ফেরত দিবে। কারো চোখে’র পানি’র কারণ আপনি হলে, কস্মিণকালেও আপনি সুখী হতে পারবেন না। সাময়িক সময়ের ব্যবধান হলেও রিভেঞ্জ হিসেবে সৃষ্টিকর্তা দিবেই। তেমনই আদিত্য কে দিয়েছে, ভালোবাসে ঠকে গিয়েছে একজনকে। আগের সেই স্মার্ট ছেলেটা আর এখন নেই। শুকিয়ে গিয়েছে, চোখে’র নিচে কালো দাগ পড়েছে। শরীরে কালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে। জান্নাতে’র সাথে করা অন্যয় গুলো প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে হৃদয়টা র’ক্তা’ক্ত করছে তার। চারদিক শূন্যতা, অভাব বোধ করছে জান্নাতে’র। এজন্যই সময় থাকতে মূল্য দিতে হয়। নাহয় পড়ে আফসোস করতে করতে জীবন পাড় করতে হয়। যেমনটা আদিত্য করছে।
.
._____________________
সময়ে”র পরিক্রমায় পৃথিবীর প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। পাল্টে যায় মানুষ, পাল্টে যায় মানুষের আচার-আচরণ, সমজ ব্যবস্হা। সময়তো প্রবাহমান! হাসি আনন্দে কেটে গিয়েছে জীবন থেকে আরো চার- চারটি বছর। সেই সাথে সবার জীবনে’র রঙ বদলে গিয়েছে। ঐশী’র অনার্স কমপ্লিট হয়ে গিয়েছে। কঠোর পরিশ্রম ও সততার জন্য, রাফিন এখন একজন নামি-দামি গাইনি চিকিৎসক। বন্ধু মহলে’র রবিন বাদে, সবারই বিয়ে হয়েছে,সংসার হয়েছে। ছয় মাস আগে আলিফে’র সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে মিতু’র। এদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে দুই পরিবারই।মিতুও ভীষণ সুখী আছে স্বামী’র সংসারে। অনার্স শেষ হতেই আলিফের ব্যাংকে চাকরি হয়েছে। ভালো স্টুডেন্ট দেখে এক চান্সেই হয়েছে। রবিন ও একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। রিয়া’র ও বিয়ে হয়েছে সুজনে’র সাথে বছর খানিক হয়েছে। জান্নাতে’র একটা মেয়ে হয়েছে। শ্বশুর বাড়ি’র সবার চোখে’র মনি যেন জান্নাত। সবার জীবনে’র মোড় ঘুরে গিয়েছে। আগে’র মতো আর আড্ডা কিংবা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। সময়ে’র পরিবর্তনে সবাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বলতে গেলে সবাই সুখী। এতো এতো হাসি আনন্দের মধ্যেও সবসময় ঐশী একটা বাচ্চা’র অভাব বোধ করছে। যদিও দু’জনার কারো কোনো সমস্যা নেই। তবুও সৃষ্টিকর্তা তাদের একটা সন্তান দিচ্ছে না। এজন্য পাড়া প্রতিবেশী’র কত কানা-ঘুষা শুনতে হয়। যদিও রাফিনে’র পরিবার এ-সব বিষয় নিয়ে কখনো কিছু বলে না। তবে প্রায় সময়ই মন খারাপ থাকে ঐশী’র। সে খুব করে চায় তার ছোট্ট একটা বাবু হোক। যার ছোট ছোট হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরবে, আধোঁ আধোঁ কন্ঠে “মা” বলে ডাকবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় সবদিক থেকে কাউকে পরিপূর্ণতা দেয়না। তেমনি ঐশী’কে সব দিয়েছে, শুধু একটা সন্তান দিচ্ছে না। এসব নিয়ে রাফিনে’র কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তার আল্লাহ্’র প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে, তাদের একটা সন্তান দিবে। অবশ্য’ই আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্হা নিয়ে ধৈর্য ধারণা করলে আল্লাহ বান্দাকে নি’রা’শ করে না। ঐশী এ বিষয় মন খারাপ করলে, উল্টো প্রচুর রাগ হয় রাফিন। দু’জনের প্রতি দু’জনার বিশ্বাস, ভালোবাসা সময়ে’র সাথে সাথে আরো গভীর হচ্ছে। বাচ্চা না থাকলেও সংসার জীবনে ভীষণ সুখী সে। তবুও মা হবার ইচ্ছে’টা মাতৃত্বের সাধ সব মেয়ে’ই অনুভব করতে চায়।
সকাল থেকে মনটা বেশ ফুরফুরে ঐশী’র। আজ তিহানে’র মেয়ে’র তৃতীয় জন্ম বার্ষিকী। ঘরোয়া ভাবে একটি আয়োজন করেছে তিহান। সবথেকে বড় বিষয় হচ্ছে বন্ধু মহলে’র সবাই উপস্থিত থাকবে পার্টিতে। তিহান ওদের কে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। রাফিনের বন্ধু’কে ও বলে ছিলো। কিন্তু আরাফ আসতে পারছে না তার সেই পিচ্চি প্রেমিক মেয়ে’টা, যদিও ও এখন বড় হয়েছে তবুও পিচ্চি বলে ডাকে আরাফ। সেই পিচ্চি আজ তার স্ত্রী, এমনকি তার বাচ্চার মা হতে চলছে। তাই আসবে না আগেই জানিয়ে দিয়েছে।
আরাফ বাদে সবাই-ই বিকেলে আসছে, তাই আজকে বেশীই ভালো লাগছে ঐশী’র।
.
.
অনেকদিন পড়ে বন্ধু মহল কে পেয়ে সবাই হৈচৈ করে, একে অপরের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করছে। এখনো সবাই আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। একজায়গায় হলো পরিবেশ কোলাহলে পূর্ণ হয়ে যায়। বন্ধুদের পেয়ে কেউ আর হাসবেন্ড’দের পাওা দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে এদের চিনেই না। তারা আর কি করবে? বউ পাওা না দিলে কী করা’র থাকে! রাফিন, সুজন, সিয়াম ও সাইফ মিলে নিজেদের মতো কথা বলছে। জান্নাত সেই কখন মেয়ে’কে সিয়ামে’র কাছে রেখে ছাদে আড্ডায় ব্যস্ত। মেয়ে কাঁদছে কিন্তু মায়ে’র আর খবর নাই। একটা সময় অধৈর্য হয়ে সিয়াম ছাদে আসলো। সাথে সুজন, সাইফ ও রাফিন ও আসছে। সিয়াম জান্নাত’কে মৃদু ধমক দিয়ে বললো,
“বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছো অথচ কোনো কান্ড জ্ঞান নেই তোমার। মেয়ে কাঁদছে সেই কখন থেকে। আর তুমি পড়ে পড়ে আড্ডা দিচ্ছো।
জান্নাত মেয়ে’কে কোলে নিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“তুমি কেমন বাবা হুহ? মেয়ে কাঁদছে অথচ বাবা হয়ে থামাতে পারছো না।এটা কোনো কথা হ্যাঁ ! একটা দিন মেয়ে’কে রাখার যোগ্যতা নেই। আসছে আমাকে কথ শুনাতে।”
“আশ্চর্য এভাবে কথা বলছো কেনো? মেয়ে কাঁদছে কী আর সাধে? ক্ষুধা লাগছে তাই। ওকে খাইয়ে দেও। মেয়ে বড় হলে কী তোমার কাছে আসতাম নাকি? আমার মেয়ে আমিই রাখতে পারতাম। ভাব নিয়ে বললো সিয়াম। তা,দেখে জান্নাত মুখ বাঁকাল। ”
এদের দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া দেখে বাকিরা হাসছে। রাফিন আড় চোখে বারবার ঐশী’কে দেখছে। মেয়েটা অনেক দিন পড়ে প্রাণ খুলে হাসছে। রাফিনকে কিছু না বললেও, রাফিন বুঝতে পারে ঐশী’র বাচ্চা হয় না বলে ভীষণ আপসেট। রাফিন ও মনেমনে চায় ঐশী মা হোক। সবসময় সৃষ্টিকর্তা নিকট প্রার্থনা করে একটা বাচ্চা’র জন্য।
এবার সবাই মিলে আবাও কথা বলছে, আড্ডা দিচ্ছে। এদের সাথে যোগ হয়েছে চৈতী। এতক্ষণ মা ও বড় ভাবিকে কাজে সাহায্য করেছিলো, তাই আসতে পারেনি। এখানে সবাই’ই কাপল। এদের মধ্যে রবিন নিজেকে ভিন্ন গ্রহের প্রাণী বলে মনে হচ্ছে।
রবিন গালে হাত দিয়ে বসে বসে ঝিমাচ্ছে। তা দেখে ঐশী রবিন কে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কিরে! তুই বসে বসে ঝিমাচ্ছিস কেনো? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলি কেন?”
সবার দৃষ্টি রবিনের মুখের দিকে। রবিন মুখটা করুণ করে বললো,
“শরীরে’র কষ্ট হয় কিনা জিজ্ঞেস করলি? মনে’র কষ্ট’টাতো বুঝিস না!”
সবাই অবাক হয়ে গেলো রবিনের এমন কথা শুনে। মিতু ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর আবার কিসের কষ্ট? কী হয়েছে প্লিজ বল আমাদের!”
সবাই উত্তরে শুনবার অপেক্ষায় রইলো। রবিন একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
“শোন তাইলে দুঃখের কথা! কেউ বুঝে বা মনে’র ব্যথা! এতো এতো কাপলদে’র মধ্যে নিজেকে অসহায় লাগে। শ্বশুড়ে’র মেয়েটা’যে কোন বাড়ি’তে থাকে, আজ পর্যন্ত একটা কল দিয়ে বললো না। “আমি আর বাপের বাড়ি থাকবো না তোমার কাছে নিয়ে নেও!” এটা কোনো কথা হইলো বল? তাইলে কি আজ সিঙ্গেল থাকা লাগতো। আমার ও একটা বউ থাকতো।”
সবাই সিরিয়াসলি কথা ভেবে নিয়েছিল। এমন উওরে’র জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না। রবিন থামতে দেরী হলো, বন্ধু’দের কি’ল-ঘু’ষি পিঠে পড়তে দেরী হলো না। এদের কান্ড দেখে হ’তা’শা’র শ্বাস ছাড়লো রাফিন। বিড়বিড় করে বললো,
“এরা পারেও বটে!”
.
.
দু’দিন পড়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে যার যার সংসারে ফিরলো। ঐশী দুপুরের জন্য রান্না করছিলো। হঠাৎ শুনতে পেলো পাশের বাসার এক আন্টি কথা বলছে। উনি সানজিদা শেখ’কে উসকানিমূলক খোঁ’চা দিয়ে, মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“তা ভাবি ছেলে বিয়ে’তো করলো কত বছর হয়ে গেলো। নাতি-নাতনিদের মুখ কি দেখা যাবে না!”
“সানজিদা শেখ মৃদু হেসে বললো,
“আল্লাহ যেদিন দিবে অবশ্য’ই দেখবো। এতো তাড়া কিসের ভাবি?”
“বয়সতো আর কম হয় নাই আপনাদের। কয়দিন আর বাঁচবেন। কেমনে দিবে? শুনলাম বউয়ের নাকি বাচ্চা হয় না। শেষ পযর্ন্ত ছেলেটা’র কপালে জুটলো একটা ব’ন্ধা বউ। আহারে!”
সানজিদা শেখ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“ছিহ্! এসব কি বলেন ভাবি? মেয়েটা’র বয়স বা কত? বাচ্চা হয় না এখানে মেয়েদের কি দোষ? আল্লাহর উপরে কারো হাত নেই। সবকিছু উপরওয়ালা ইচ্ছায় চলে। এসব যেন আর না শুনি খবরদার । আমাদের যা আছে তাতেই চলবে।”
মহিলা সানজিদা শেখে’র উসকানি না পেয়ে কাজের অযুহাতে চলে গেলো। ঐশী এদের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতে’ই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে টপটপ করে । এখানে তার কোনো হাত নেই, অথচ এই সমাজ কোনো মেয়ে মা হতে না পারলে নারী’কেই দোষারোপ করে।
.
.
গভীর রাতে কারো ফুঁপিয়ে কান্না”র শব্দে ঘুম হালকা হয়ে গেলো রাফিনের। ডিম লাইটে’র মৃদু আলোতে, চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখতে পেলো ঐশী মোনাজাতে কাঁদছে। আল্লাহ নিকট কেঁদে কেঁদে একটা সন্তান ভিক্ষা চাইছে। এটা নতুন কিছু না, প্রায় সময়’ই শুনতে পায় রাফিন। কিন্তু কিছু বলে না কখনো।দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়লো রাফিন।
.
.
এভাবেই চলছে তাদের দিনগুলো। কয়েকমাস পড়ে নিজে’র মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করছে ঐশী। রাফিনে’র দৃষ্টি এড়ালো না ঐশী’র পরিবর্তন গুলো। আজ নিজে’র সাথে করেই হসপিটালে নিয়ে আসছে ঐশী’কে টেষ্ট করানোর জন্য। ঐশী আসবে না বলে জেদ করলো, কেননা বারবার নিরাশ হয়। কিন্তু রাফিন ও নাছোড় বান্দা, বাধ্য হয়ে আসতেই হলো ঐশী’কে।
.
.
রাফিনে’র ক্যাবিনে মন খারাপ করে বসে আছে ঐশী। কিছুক্ষণ পড়ে রাফিন রিপোর্ট নিয়ে থমথম মুডে ক্যাবিনে প্রবেশ করলো। ঐশী রাফিনে’র এমন মুখ দেখেই বুঝে নিয়েছে বরাবরের মতো’ই হতাশ। তাই কিছু জিজ্ঞেস করলো, চোখ দু’টো ভিজে গেলো তার। হুট করে রাফিন এসে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ঐশী’কে। তার চোখেও পানি , ঐশী মলিন কন্ঠে বললো,
“কষ্ট হচ্ছে রাফিন? আমি কখনো হয়তো আপনাকে একটা সন্তান দিতে পারবো না। আল্লাহ কেনো আমাদের কথা শুনছে না রাফিন? আমি হতে চাই রাফিন! মা হতে চাই আমি! বলে কান্নায় ভেঙে পড়লো ঐশী । তার আক্ষেপ গুলো যেন চার দেয়ালে ভা’রী খাচ্ছে।
রাফিন হুট করে ঐশী’কে ছেড়ে দিয়ে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,……
#চলবে…….
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ!]
কেমন হয়েছে তোমাদের মতামত শুনার অপেক্ষায় রইলাম পাঠক মহল। সবাই’কে বসন্তে’র শুভেচ্ছা!