হে_সখা #অক্ষরময়ী সপ্তম পর্ব

0
99

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
সপ্তম পর্ব

রেহবারদের বাড়ি হতে খানিকটা দূরে একটি সুপারশপ আছে। বাজারসদাই করতে গুলিস্তাকে বেশিদূর যেতে হয়না।
আলমারির একটি ড্রয়ারে রেহবার নিত্যদিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করার জন্য এবং গুলিস্তার নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট ক্যাশ রেখে দেয়। অন্যদিন গুলিস্তা মালাকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করে নিয়ে আসে। আজকে রেহবার বাড়িতেই আছে। মালাও কাজে আসেনি। এদিকে সবজি শেষ হয়ে গেছে। হলরুমে বসে রেহবার ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো। স্টাডিরুমে বসে কাজ করতে পারতো কিন্তু নিচে কিচেনে গুলিস্তা একা একা কাজ করবে তাই ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এখানে বসেই কাজ করছে। যদিও দুজনে নীরবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। শুধু মাঝেমধ্যে রেহবারের অবাধ্য চোখ গুলিস্তার দিকে চলে যাচ্ছে। ভেজা চুলগুলো এখন পিঠে ছড়িয়ে দেওয়া। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে থালা বাসন ধুচ্ছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। খানিক বাদে গুলিস্তা এলো এক কাপ ব্ল্যাক কফি হাতে। টেবিলের উপর না রেখে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সময় হলে ভীষণ ধীরে শব্দ না করে টেবিলের উপর রেখে চলে যেতো। যাতে রেহবারের কাজে ডিস্টার্ব না হয়। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেহবার বুঝে নিলো, ও কিছু বলতে চায়। এমন ছোটখাটো অব্যক্ত ভাষা, নীরব ইশারা সে বুঝতে শিখে গেছে কয়েক মাসের সাংসারিক জীবনে। ল্যাপট্যাপ হতে চোখ সরিয়ে হাত বাড়িয়ে কফি নিতে নিতে বললো,
– কিছু বলবে?

সামান্য সময় ব্যয় না করে গুলিস্তা উত্তর দিলো,
– সবজি শেষ হয়েছে। সুপারশপে যেতে হবে। আপনি কিছুক্ষন একা থাকতে পারবেন না?

কফির কাপে চুমুক দিয়ে রেহবার নিজের হাসি আটকালো। সে কি ছোট বাচ্চা যে নিজের বাড়িতে একা থাকতে ভয় পাবে?
– সেকি! আমি একা থাকবো মানে? একা থাকতে ভয় লাগবে। আমাকেও সাথে নিয়ে চলো প্লিজ।

রেহবারের নাটকীয় ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো শুনে গুলিস্তা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। ওর তাকানো দেখে রেহবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। হো হো করে ঘর ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। গুলিস্তার হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে হাতের কফির কাপটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলো।
– তুমি এখানে বসে কফি খাও। আমি চট করে রেডী হয়ে আসি।

সাদা টি শার্টের উপর গ্রে কালারের শার্ট চাপাতে গিয়ে রেহবারের মনে হলো, ও ব্ল্যাক কফি খেতে পারে তো? খেতে বললাম দেখে চোখ মুখ শক্ত করে ওই অখাদ্য গলাধঃকরণ করছে না তো?
ঝটপট রেডি হয়ে নিচে এসে দেখলো, মুখটা বাংলা পাঁচের মতো বাঁকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে গুলিস্তা। তারপর চোখ মুখ খিঁচিয়ে সেই কফিটুকু গিলে ফেলছে। রেহবার দ্রুত ওর হাত থেকে মগটি নিয়ে বাকি কফিটুকু একবারে খেয়ে নিলো।

বহুতল ভবন বিশিষ্ট শপিংমলটির নিচতলায় সুপারশপ। ক্রেতারা ভারী পণ্য যাতে সহজেই বহন করতে পারে তাই নিচতলার পুরোটা জুড়ে বিভিন্ন সেকশনে কাঁচা বাজার, গ্রোসারি, বেবি ফুড, ক্রোকারিজ, ফাস্টফুড, স্পাইসেস, ড্রিংকস, ফ্রোজেন ফুড, ফ্রুটস, মাছ-মাংস ইত্যাদি রাখা হয়েছে। আন্ডার গ্রাউন্ডে পার্কিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। রেহবার সেখানে কার পার্ক করে গুলিস্তার হাত ধরে সুপারশপে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে গুলিস্তা অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা কাঁচা বাজারের সেকশনে গিয়ে প্রয়োজনীয় সবজি নিতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। চর্তুরদিকে এতো এতো লোভনীয় খাবার দেখে রেহবারের জিভে জল চলে আসার উপক্রম অথচ তার স্ত্রী সেদিকে ফিরেও তাকালো না। রেহবারের ভীষণ লজ্জা পাওয়া উচিত। কিছুক্ষণের মধ্যে গুলিস্তা ফিরে এলো কয়েকটা ক্যাপসিকাম, রেড ক্যাবেজ, টমেটো নিয়ে। স্যালাড তৈরি করার জন্য এসবের নিত্য ব্যবহার করা হয়। নিত্যদিনের খাবার মেনুতে হাঁপিয়ে উঠেছিলো রেহবার। হঠাৎ করে মাথায় একটা আইডিয়া এলো। সে সামনে থেকে একটি কার্ট ট্রলি এনে গুলিস্তার হাত থেকে সবজিগুলো নিয়ে সেখানে রাখলো। গুলিস্তাকে বললো,
– ড্রয়িং রুমের জানালার পর্দাগুলোর রং ফিকে হয়ে গেছে। সুপারশপে অপরপাশে দেখো একটা শপ আছে। ওখানে কার্টেইনস পাবে।

পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে ওর হাতে দিয়ে বললো,
– এখানে আমার কিছু কেনাকাটা আছে। এই ফাঁকে তুমি জানালার জন্য কার্টেইন নিয়ে এসো।

গুলিস্তা একবার রেহবারের হাতে থাকা কার্ডের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার রেহবারের মুখের দিকে। দ্বিধা দ্বন্দ শেষে কার্ডটি হাতে নিয়ে বললো,
– আমি কিনবো?
– হ্যাঁ। তুমি কিনবে। খুঁজে না পেলে সেলসম্যানকে বললেই হেল্প করবে। তাড়াতাড়ি যাও।

রেহবার একপ্রকার ঠেলে গুলিস্তাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ছুটলো কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। ব্রকোলি, বিনস্, গাজর, মটরশুঁটি, চিংড়ি মাছ, মুরগির মাংস কিনতেই অনেকখানি সময় কেটে গেলো। এর মাঝে গুলিস্তা ফিরে এলে শুকনো মুখ করে। যেনো তার উপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেছে। আইসক্রিম কর্ণার থেকে রেহবার দুটো কোন আইসক্রিম কিনে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।

বাড়ি ফিরে শপিংব্যাগ হতে কার্টেইনস বের করে রেহবারের চক্ষু চড়াক গাছ। ড্রয়িংরুমের জানালায় সাদা রঙের দুটো কার্টেইনস ঝুলানো ছিলো। সাদা কাগড়ের উপর অফ হোয়াইট রঙের কিছু পানপাতার নকশা ছিলো। গুলিস্তা যে দুটো কার্টেইনস নিয়ে এসেছে সেই দুটো হুবহু আগের কার্টেইনস এর মতোই। সে মূলত আগের কার্টেইনস এর নতুন এক জোড়া কিনে নিয়ে এসেছে। তাহলে নতুন কার্টেইনস এর দরকারই কি ছিলো! রেহবার তার বিগড়ে যাওয়া মেজাজকে বিড়বিড়কে বললো, কুল ডাউন। কুল ডাউন।

কার্টেইনস একপাশে সরিয়ে রেখে বলল,
– এগুলো এখন রাখো। জানালা অনেক উঁচুতে। আমি রাতে এসে সেট করে দিবো। তুমি পারবে না।

গুলিস্তা বাধ্য মেয়ের মতো সেগুলো গুছিয়ে বেড রুমের আলমারিতে তুলে রাখতে গেলো। এই ফাঁকে রেহবার গ্রোসারি নিয়ে কিচেনে গেলো। ফ্রিজ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে একে একে সবকিছু গুছিয়ে নিলো।
গুলিস্তা ফিরে এসে কিচেনের যেতে গিয়ে থমকে গেলো। কিচেন এপ্রোন পরে রেহবার দক্ষ রাঁধুনির মতো পেয়াজ কাটছে। গুলিস্তা দ্রুত পায়ে কিচেনে এসে দেখলো সেখানে এলাহি কান্ড কারখানা চলছে। পুরো কিচেন জুড়ে বিভিন্ন ইনগ্রিডিয়েন্ট সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এই সামান্য সময়ে রেহবার এতো কিছু গুছিয়ে নিয়েছে দেখে গুলিস্তা অবাক হলেও স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলো,
– আপনি এখানে?

এর মধ্যে চুলায় বসানো পানি গরম হয়ে গিয়েছে। টগবগ করে ফুটতে থাকা গরম পানিতে বাসমতি চাল ছড়িয়ে দিয়ে রেহবার বললো,
– আজকে স্পেশাল শেফ এর হাতে রান্না খাওয়ানো হবে তোমাকে।

অন্য কেউ হলে নিশ্চিয়ই বলতো, রান্না খাওয়ার যোগ্য হবে তো? কিন্তু গুলিস্তা বিচলিত হলো না। শুধু এগিয়ে এসে নাইফ হাতে নিয়ে বললো,
– আমি কেটে দিচ্ছি।

রেহবার ওর হাত থেকে নাইফটি বেশ সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে সবজির ঝুড়িটি হাতে ধরিয়ে দিলো।
– রান্নায় কোনো বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি। তুমি বরং সবজিগুলো ধুয়ে এনে দেও।

সবজি ধুয়ে নিয়ে এসে রেহবারের হাতে তুলে দিতেই রেহবার গুলিস্তাকে টুলে বসিয়ে দিলো বললো,
– তুমি এখানে বসে আমাকে কোম্পানি দেও। সেই সাথে এই মটরশুঁটির খোসা ছড়িয়ে দেও।

খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে গুলিস্তা রেহবারকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। তখন টগবগে গরম পানিতে চাল দেওয়ার সময় সে খেয়াল করেছে রেহবার বেশ সুনিঁপুণ ভাবেই গরম পানিতে চাল ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। যেনো সে এসবে অভ্যস্ত। এখন সবজিগুলো কাটছে দক্ষ হাতে। আরেকপাশে চিকেন মেরিনেট করে নিয়েছে। সেটা ফ্রিজে তুলে রাখলো।
নিস্তবদ্ধতা রেহবারের পছন্দ নয়। নিঃশ্বাসের শব্দও যেনো কানে বাজে। গুলিস্তা তো কিছু বলবে না। কৌতুহল হলেও জানতে চাইবে না। রেহবারের প্রতি আদোও তার কৌতুহল সৃষ্টি হয় কিনা সে জানে না। তাই নিজেই বলা শুরু করলো,
– ছোটবেলা থেকে রাহিল আর আমি ভীষণ মা ভক্ত ছিলাম। আমাদের বাইরে তেমন কোনো বন্ধু-বান্ধব তৈরি হয়নি। স্কুল ছুটি হতেই দৌড়ে বাড়ি চলে আসতাম। মা সংসারী মানুষ, দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে রান্নাঘরে । মায়ের সাথে আমাদের দুই ভাইয়েরও অনেকটা সময় এই রান্নাঘরেই কেটে গেছে। যখন ছোট ছিলাম, তখন মায়ের পাশে এমন করে টুলে বসে থাকতাম। মা নানান গল্প বলতো, আর আমরা দু ভাই মায়ের গল্প শুনতাম আর রান্না দেখতাম। এই ফুল, তুমি গল্প জানো?

গুলিস্তা মনোযোগ দিয়ে রেহবারের কথা শুনছিলো আর রেহবার কীভাবে চিকন করে এক সাইজে বিনস্ কাটছে সেটাই দেখছিলো। হঠাৎ করে ওর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে রেহবার যখন ওর দিকে তাকালো, গুলিস্তা খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
– গল্প! না, জানি না।

রেহবার আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বললো,
– যা ভেবেছিলাম। তো আমি কি যেনো বলছিলাম?
– টুলে বসে থেকে গল্প শুনতেন আর রান্না দেখতেন।

গুলিস্তা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে দেখে রেহবার পুলকিত হলো। বক্তা হিসেবে আনাড়ি হলেও গুলিস্তা শ্রোতা হিসেবে ভীষণ ভালো। সে গল্পে ফিরে গিয়ে বলতে লাগলো,
– ছোটবেলায় তো এসব ধারালো ছু*রি, চা*কু হাতে নেওয়া বারণ ছিলো। এরপর ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। মায়ের কাজে টুকটাক হেল্প করা শুরু করলাম। আমি কলেজের উঠার পর মায়ের থেকে রান্না শিখেছিলাম। আমরা দু ভাই প্রায় সব ধরনের রান্না পারি। এখন তো কাজের চাপে রান্নাঘরে আসা হয়না। আগে এটাই ছিলো আমাদের আড্ডাস্থান। রান্না জানলেও মা কখনো রান্নাঘর আমাদের ভরসায় ছেড়ে দেয়নি। আমি বা রাহিল শখ করে কখনো কোনো রেসিপি ট্রাই করতে চাইলে মা যদিও পারমিশন দিতো কিন্তু স্ট্রিক গার্ডের মতো পাশে দাঁড়িয়ে পাহাড়াও দিতো। তার শখের রান্নাঘরের কখন, কোন সর্বনাশটা করে ফেলি বলা যায় না। আমি তোমার রান্নাঘর অগোছালো করে ফেলিনি তো আবার?

গুলিস্তা চারপাশে তাকিয়ে রান্নাঘরের হালচাল দেখে নিলো। কেবিনেট থেকে সকল মশলার কৌটা নিচে নামিয়ে রাখা হয়েছে। থালা বাসন দিয়ে চারপাশ ভরে আছে। সবকিছু একসাথে না নামিয়ে গোছালো ভাবেও কাজ করা যেতো। যাই হোক, রান্নাঘরে হঠাৎ করে আসা অতিথি একটু এলোমেলো তো করবেই। তাই সে বললো,
– গুছিয়ে নিলেই আবার আগের মতো হয়ে যাবে।

রেহবার তাকিয়ে দেখলো রান্নাঘরটি তে অনেকগুলো জিনিসপত্র দিয়ে ভরে গেছে। দেখতে একদম সবজি বাজারের মতো লাগছে।
অল্প সময়ের মধ্যে রেহবার মিক্সড ফ্রাইড রাইস, চিকেন রোস্ট, গলদা চিংড়ি ভুনা রেঁধে ফেলেছে। সেগুলো ডাইনিং এ সাজিয়ে রান্না ঘরে ফিরে দেখলো গুলিস্তা ক্যাবিনেটে কৌটাগুলো তুলে রাখছে। রেহবার নিজেও রান্নাঘর গুছানোর কাজে হাত লাগালো। অপরিষ্কার বোল, প্যানগুলো বেসিনে রেখে দিলো। উচ্ছিষ্ট অংশ, সবজির খোসা ডাস্টবিনে ফেলে, কিচেন পরিষ্কার করে ফেললো।
খেতে বসে গুলিস্তা প্রথম লোকমা মুখে তুলতেই রেহবার ভীষণ আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকালো। কেমন হয়েছে জানতে চাইতে লজ্জা লাগছে। কিন্তু তার রান্না গুলিস্তার ভালো লেগেছে কিনা জানার জন্য মন অস্থির হয়ে আছে। গুলিস্তা বুঝি সেই অস্থিরতা বুঝলো। ছোট্ট করে বললো,
– ভালো হয়েছে।
এইটুকু কথাতেই রেহবারের মনে হলো বুকের উপর থেকে কোনো ভার নেমে গেলো। সে হাসি মুখে নিজের প্লেট হতে খাবার তুলে মুখে দিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here