হে_সখা #অক্ষরময়ী দশম পর্ব

0
112

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দশম পর্ব

এলোমেলো চিন্তাদের মাথায় নিয়ে রেহবারের দিন কেটে যায়। নির্ঘুম রাত জেগে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয় ঘুমন্ত গুলিস্তার দিকে৷ লোকে শুনলে হয়তো বলবে, সমস্যা কোথায়? এতো চিন্তা ভাবনা না করে সেভাবে চলছে চলুক না। ঘরের বউ যতো চুপচাপ থাকে ততোই ভালো। মান অভিমান করছে না, রাগ-অভিযোগ কিছুই করছে না৷ এতো মশাই সাত কপালের ভাগ্য। এমন বউ সবাই চায়, আর তুমি পেয়েও সুখী নও। উল্টো আকাশ কুসুম চিন্তা করে মনের অশান্তি বাড়াচ্ছো। কিন্তু রেহবার তো এমন চায়নি। সে নিজে একজন প্রানোচ্ছ্বল মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই নিজের মতোই একজন জীবনসঙ্গীর কামনা সে করে। নিজের মতো না হোক, অন্তত আর পাচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো যদি হতো তবুও রেহবারের আপত্তি ছিলো না। যারা এমন বুলি কপচায় তারা নিজের সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর থেকে এমন রোবোটিক বিহেভিয়ার পেলে রেহবারের কষ্টটা বুঝতো। একজন মানুষ তার আশেপাশে আছে, কিন্তু আচরণ এমন করছে যেনো সে নেই। রেহবারের উপস্থিতি তাকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। পাশে থাকা, না থাকা খুব একটা ভাবায় না। এমন অবহেলা মেনে নেওয়া যায়?

রেহবার চায় গুলিস্তা তাকে অনুভব করুক, যেমনটা একজন স্ত্রী তার স্বামীকে করে৷ তারও তো ইচ্ছে করে অফিস থেকে ফিরে স্ত্রীর উদগ্রীব মুখের দর্শন পেতে৷ সেও চায় বাড়ি ফিরতে দেরী হলে গুলিস্তা একটা মেসেজ কিংবা একটা কল দিয়ে ওর খোঁজ নিক। হাস্যকর হলেও সত্যি, গুলিস্তা আজ পর্যন্ত ওর ফোনে কোনো কল বা মেসেজ করেনি৷ ফোন নাম্বারটা সেভ করা আছে কিনা সেটাই সন্দেহ হয়৷

বিছানার একপাশে গভীর ঘুমে মগ্ন গুলিস্তা। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে ঘুমাচ্ছে। ও খুবই পরিপাটি হয়ে ঘুমায়। ঘুমের মাঝে একটুও নড়াচড়া করে না৷ যেপাশে শোয়, ঘুম থেকে জেগে নিজেকে সেপাশেই পায়। রেহবার নিজেও বেশ পরিপাটি ছিলো। কিন্তু আজকাল নির্ঘুম রাত কাটার দরুণ, রাতভর এপাশ ওপাশ করতে থাকে। গুলিস্তার কপালে আলতো চুমু একে রেহবার মুচকি হেসে বিড়বিড় করলো,
– রোবট একটা।

আর ঘুম হবে না জেনে বিছানা ছাড়লো। মাথাটা দপদপ করছে। কফি খাওয়া দরকার৷ কিচেনে গিয়ে নিজের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো৷ ভোরের পরিশুদ্ধ বাতাস গায়ে লাগতেই শরীর ও মন দুটোই চনমনে হয়ে উঠলো। শীতের আগমনের বার্তা নিয়ে এসেছে সকালের মৃদু বাতাস। গা কেমন শিরশির করে উঠে। পাতলা সুতি পাঞ্জাবি গায়ে এমন বাতাস ঠান্ডা ছড়িয়ে দিলো। গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে রেহবার বাগানের মধ্যে খানিকক্ষণ পায়েচারি করে কাটিয়ে দিলো।

দেয়াল ঘড়িতে সময় সাতটা। গুলিস্তা তখনো ঘুম থেকে উঠেনি। হয়তো এক্ষুনি উঠে পরবে। রোজ এই সময় ওর ঘুম ভেঙে যায়। কোনো এলার্ম ছাড়া আপনাআপনি জেগে উঠে।

দোতলায় নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। হাতে যেহেতু কোনো কাজ নেই, ব্রেকফাস্ট বানিয়ে ফেলা যাক। রোজ তো গুলিস্তা তৈরী করে। আজকে ও একটু বিশ্রাম করুক। ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে সেগুলো ফেটিয়ে তাতে খানিকটা লবণ মিক্সড করে পাউরুটি ভিজিয়ে নিলো। ফ্রাইপ্যানে তেল গরম হতে দিয়েছে৷ হঠাৎ পাশ থেকে গুলিস্তা বললে উঠলো,
– আমি ভেজে দিচ্ছি।

রেহবার চমকে উঠলো। নিস্তব্ধ বাড়ির মধ্যে হালকা শব্দ হলেও গা ছমছম করে উঠে। এদিকে রেহবারের পুরো মনোযোগ ছিলো ডিম পাউরুটির দিকে৷

রেহবার ওর ছুটতে থাকা হৃৎপিন্ডের উপর হাত রেখে নিজেকে শান্ত করলো।
– তুমি কখন এলে? এভাবে হঠাৎ করে কেউ কথা বলে! হাটাচলা তো করো বিড়ালের মতো একটুও আওয়াজ পাওয়া যায় না।

উত্তেজনার কারনেই হয়তো রেহবারের কথাগুলো মিষ্টি সকালে একদম তেতো এবং জোরালো শোনালো। আজকাল আবার মনের অবস্তাও ঠিক নেই৷ যাকে দেখলে এতোদিন মনের ভেতর প্রশান্তি বয়ে চলতো, ফুলেল স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পরতো এখন তার উপস্থিতি মনের ভেতরটায় ভীষণ পোড়ায়। মস্তিষ্কে আলোড়ন ছড়িয়ে দিয়ে অহেতুক প্রশ্নের ঢেউ তুলে দেয় নিশ্চুপ সমুদ্রে৷

গুলিস্তা অবাক চোখে চেয়ে আছে রেহবারের দিকে। ঘুম থেকে উঠার কারনে ওর চোখ মুখ খানিকটা ফুলে আছে। ভীষণ আদুরে দেখাচ্ছে। ওর ফোলা চোখগুলো গোল গোল হয়ে চেয়ে আছে রেহবার এর দিকে। নীরবে যেন প্রশ্ন করছে, এমন করছেন কেনো?

রেহবার তড়িতে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মেজাজের রাশ টেনে ধরলো। এভাবে চিল্লানো উচিত হয়নি।
– স্যরি। হঠাৎ করে কথা বললে তো। ভড়কে গিয়েছিলাম।

গুলিস্তা জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে ছিলো। এবার মিনমিনিয়ে বললো,
– আপনি ডাইনিং এ গিয়ে বসুন। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি। বেশিক্ষণ লাগবে না।

ফ্রাইপ্যানে ব্রেড ভাজতে দিয়ে গুলিস্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রেহবার বললো,
– ব্রেকফাস্ট আমি তৈরি করে নিচ্ছি৷ তুমি হেল্প করতে চাইলে ফ্রুট জুসটা তৈরি করতে পারো।

ক্ষীণকাল বিলম্ব না করে গুলিস্তা ফ্রিজ হতে ফল বের করে জুস তৈরি করতে লাগলো। ওর ছুটে ছুটে কাজ করা দেখে রেহবার নিজের কাজ বন্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা নিজে থেকে কিছু বলবে না। ও হয়তো ভাবছে ওর ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে। রেহবারের নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে তাই নিজেই ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে শুরু করেছে। এসবের কারন নিজের ঘুম থেকে উঠতে দেরী হওয়া। মেয়েটা নিজের ভুল ভেবে এখন কষ্ট পাচ্ছে৷ রেহবার ওর কাছে গিয়ে দু কাধে দু হাত রেখে বললো,
– হেই, রিলেক্স৷ ইউ আর নট লেইট। আমার তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তাই ভাবলাম ফ্রি আছি যেহেতু, ব্রেকফাস্টটা আমি তৈরি করি। প্রতিদিন তুমি তৈরি করো। আজকে আমার হাতের ব্রেকফাস্ট করে দেখো। জুস তৈরি হয়ে গেলে ওটা নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসো। আ’ম কামিং উইথ ব্রেকফাস্ট।

গুলিস্তা অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে রেহবারের কথা শুনলো। হু, বলে জুস তৈরিতে আবার মনোযোগ দিলো।

রেহবার আজকাল নিজে থেকে কিছু এক্সপেরিমেন্ট করছে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর রেহবারের জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আসে গুলিস্তা। কফির কাপ রেখে আবার নিজের কাজে ফিরে যেতো। কিন্তু এখন আর রেহবার তাকে ফিরে যেতে দেয় না। ব্যালকনিতে বসে যতোক্ষণ কফি খায় গুলিস্তাকে পাশে বসিয়ে রাখে, বিভিন্ন ধরনের কথা বলে।
– বাড়ির কথা তোমার মনে পরে না? বিয়ের দিন চলে এলে তারপর থেকে এখানেই আছো।

রেহবারের পাশে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে আছে গুলিস্তা। ওর সতর্ক দৃষ্টি রেহবারের দিকে। সবসময় এমন সতর্ক থাকার কারণে রেহবারের ভীষণ অস্বস্তি হয়৷ তবুও সে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, ওদের মধ্যে সবকিছু যেনো স্বাভাবিক হয়। কিন্তু গুলিস্তা বললো,
– মাঝেমধ্যে পরে।
– তুমি চাইলে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারো৷ না মানে, তোমার যদি যেতে ইচ্ছে করে।
– নাহ। আমি এখানেই ঠিক আছি।

এরপর রান্নার অজুহাতে যেখান থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতিদিন এমনই টুকটাক আলাপচারিতায় খুব একটা পরিবর্তন আসে না৷ রেহবার প্রতিবার অনেক উৎসাহ নিয়ে গুলিস্তার কাছে যায় কিন্তু গুলিস্তার শীতল প্রতিক্রিয়া তাকে হতাশ হয়ে ফিরতে বাধ্য করে। এমন করে প্রতিনিয়ত একটু একটু ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে রেহবার। তবুও কোথা থেকে যেনো মনে সাহস চলে আসে। তারপর আবার নতুন কোনো পন্থায় খুঁজতে শুরু করে প্রিয়তমার হৃদয়ের কাছাকছি পৌছানোর পথ।

অফিস থেকে ফেরাদ পথে ফুলের মার্কেট হয়ে আসতে হয়। প্রতিদিন সেখানে ফুলের দোকানের ফুল দেখে গুলিস্তার কথা মনে পরে৷ আজকে কয়েকটি হালকা গোলাপি রঙের গোলাপ চোখে পরায় রেহবার সেগুলো কিনে নিয়েছে৷ ঘরে প্রবেশ করে সেগুলো গুলিস্তার দিকে এগিয়ে দিলো৷ গুলিস্তা খানিকক্ষণ থমকে তাকালো তারপর হাত বাড়িয়ে সেগুলো গ্রহণ করে চিরচেনা রোবোটিক ভয়েসে বললো,
– থ্যাঙ্কিউ।

মুখে না আছে কোনো লজ্জাময় হাসি, না কোনো উজ্জ্বলতা। কন্ঠে নেই কোনো উচ্ছাস কিংবা ভালোলাগা। ফুলগুলো নিয়ে ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখে কিচেনে চলে গেলো। ডাইনিং টেবিলের উপর সাদা চিনামাটির ফুলদানীতে খিলখিলিয়ে হাসছে হালকা গোলাপী রঙের ফুলগুলো। তা দেখে রেহবারের ইচ্ছে হলো এই বিচ্ছিরি ফুলগুলোকে তুলে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলতে৷ যেই ফুল প্রিয়তমার মুখে হাসি ফোটাতে পারে না তাদের পায়ে পিষে ফেলা উচিত৷

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here