#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
পঞ্চদশ পর্ব
ময়ূর কুঞ্জ কনভেনশন সেন্টারের লবি বেশ জাঁকজমকভাবে সাজানো হয়েছে। সাধারণত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে। তবে সৈকতের খোলামেলা জায়গা বেশি পছন্দ। তাই কর্তৃপক্ষকে লবিকে কেন্দ্র করে যাবতীয় আয়োজন করতে বলা হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে রঙিন আলোর পসরা সাজানো। নবদম্পতি বসে আছে মূল স্টেজের সাদা সোফাসেটে৷ হালকা গোলাপি থীম কালারের ডেকোরেশনে যুক্ত হয়েছে সাদা গোলাপ। তারই সামনে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। কালো বেন্ডউড চেয়ার, টেবিলের উপর সাদা কাভার। প্রতিটি টেবিলে ফুলদানিতে সুসজ্জিত সাদা অর্কিড। গুলিস্তাকে সাথে নিয়ে রেহবার যখন কনভেনশন সেন্টারে পৌছালো ততোক্ষণে অতিথিরা সবাই পৌছে গেছে। রেহবারকে দেখে সৈকত স্টেজ ছেড়ে নেমে এসেছে ওদের স্বাগত জানাতে।
– আজকের দিনটি আপনার জন্য বিশেষ। আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হবেন না৷
রেহবারের কথায় সৈকত নিজের স্থানে ফিরে গেলেও সৈকতের পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ রেহবার ও গুলিস্তার খাতিরযত্নে ব্যস্ত হয়ে গেলো৷ ছেলের অফিসের বস বলে কথা।
সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু আপাতত রেহবার-গুলিস্তা জুটি৷ হঠাৎ করে বিয়ে করায় রেহবারের স্ত্রীকে এতোদিন দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বিয়ের পর রেহবারের পক্ষ থেকে রিসিপশনের কোনো আয়োজন করা হয়নি৷ স্বল্প সময়ের মধ্যে মা ও ভাই বিদেশে পাড়ি জমানোর পরে রেহবার নিজেও আর এসবে আগ্রহে খুজে পায়নি৷
সৈকতের বিয়েতে অফিসের প্রায় সকল কলিগ উপস্থিত৷ তারা একঝলক বসের স্ত্রীকে দেখার জন্য এগিয়ে এলো। চতুর্দিকে মানুষজন, কোলাহল, ভীড় এসবের মাঝে গুলিস্তার ভীষণ হাসফাস লাগছে। সে রেহবারের হাতে হাত জড়িয়ে ধরে অস্বস্তিতে গাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রেহবার সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে, কুশল বিনিময় করছে।
– মাশাআল্লাহ, ম্যাম দেখতে ভীষণ সুন্দর।
উত্তরে গুলিস্তা কিছু বললো না৷ ওর হাত পা রীতিমতো কাঁপছে৷ কেউ কোনো কমপ্লিমেন্ট দিলে অনেক কষ্টে একটুখানি হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। রেহবার ওর হাতে একটু চাপ দিয়ে আশস্ত করে বললো,
– থ্যাঙ্কিউ।
– স্যার বুঝি এজন্য লুকিয়ে রেখেছিলেন এতোদিন! আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন না।
– বিয়েটা বেশ তাড়াহুড়ো করেই হয়েছে। এরপর আর সময় সুযোগ হয়ে উঠেনি৷ এখন তো বিয়ের অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। পুরনো কাপলদের কি আর রিসিপশনের আয়োজন সাজে!
পেছনে থেকে কেউ একজন সজোরে বলে উঠলো,
– বিয়ে শুধু প্রথমদিনেই মজা লাগে। এরপর থেকে শুরু হয় যন্ত্রণা।
– বিয়ে করে পস্তায়নি এমন পুরুষ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ আফসোস বেশিরভাগ মেয়েরাই করে, কেনো যে তোমাকে বিয়ে করলাম! বিয়ে করে আমার জীবনটাই ধ্বংস হয়ে গেলো।
– আরে মেয়েরা বললে দোষ নেই। আমরা ছেলেরা শুধু একবার এই কথা উচ্চারণ করে দেখি। সাথে সাথে বউ ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে। তখন আবার বউকে ফিরিয়ে আনতে আরেক হ্যাপা সামলাও।
ভীড়ের মাঝে পুরুষ-মহিলা সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। গুলিস্তা শুধু অবাক চোখে সবার দিকে চেয়ে আছে। পাশ থেকে লিতুন বললো,
– ছেলেরা একখানে হলে এভাবেই মেয়েদের ক্রিটিসাইজ করতে থাকে। আমরা নম্র-ভদ্র বলে আর তর্কে গেলাম না। না হলে আমাদের কাছেও অভিযোগ করার অনেক কিছু আছে।
– সে তো মেয়েদের কাছে সবসময় থাকে। অভিযোগ করতে মেয়েরা সর্বদা সেরা। কেউ তাদের হারাতে পারবে না।
এ মুখ ও মুখ হতে যুক্তি তর্ক বাড়তেই থাকলো। লিতুন এগিয়ে এসে গুলিস্তাকে বললো,
– পুরুষ মানুষের এই আলোচনা চলতেই থাকবে। আপনি বোর হয়ে যাবেন। আমরা মেয়েরা ওপাশের টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আপনি আমাদের জয়েন করতে পারেন, ম্যাম।
রেহবার তাকালো গুলিস্তার দিকে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে দম আটকে বসে আছে। খুব শীঘ্রই খোলা বাতাস দরকার। না হলে দম আটকে মরে যাবে। রেহবার, লিতুন দুজনে ওর দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। তাই গুলিস্তা তার রিনরিনে কন্ঠস্বরে জানতে চাইলো,
– আলাদা টেবিল? কোনদিকে?
লিতুন হাতের ইশারায় একপাশের ড্রিংকস কর্ণারের দিকে দেখিয়ে দিলো। গেস্টদের উপচে পরা ভীড় সেখানে। যে যার পছন্দমতো ড্রিংকস নিচ্ছে। তারই পাশে দুটো টেবিল একখানে করে বসেছে মহিলাদের আড্ডার আসর। কয়েকজন সেখানে বসে উচ্চস্বরে হেসে চলেছে। সেদিকে একনজর তাকিয়ে গুলিস্তা ভীত চোখে তাকালো রেহবারের দিকে। দুপাশে মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানালো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেহবার দ্রুত বলল,
– আমরা মাত্র এলাম। এখনো ব্রাইটের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। আগে স্টেজ থেকে ঘুরে আসি।
লিতুন সায় দিয়ে চলে গেলো।
স্টেজে বর বধূর সাথে কুশল বিনিময় করে ফটো সেশন শেষ করে একটি টেবিলে বসলো রেহবার ও গুলিস্তা। এমন অনুষ্টানে স্বভাবই অনেক বিজনেসম্যান উপস্থিত হয়েছে৷ রেহবারের সাথে আলাপচারিতার সুযোগ খুঁজছে অনেকেই। রেহবার নিজেও প্রয়োজনবোধ করছে। কিন্তু গুলিস্তা এসবে অভ্যস্ত নয়। রেহবার ওকে সাথে নিতে পারছে না, আবার এখানে একা বসিয়েও রাখতে পারছে না।
তবুও ওকে টেবিলে বসিয়ে রেখে খাবার আনতে গেলো। গুলিস্তার থেকে দূরে গেলেও রেহবার সেখান থেকে গুলিস্তাকে লক্ষ্য করছে। কয়েকজন মেয়ে ওর সাথে কথা বলছে কিন্তু গুলিস্তা সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে রেহবারকে খুঁজছে। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখুনি কেঁদে ফেলবে। রেহবার দ্রুত ফিরে এলো। টেবিলে খাবার রেখে মেয়েদের উদ্দেশ্যে অমায়িক হেসে বললো,
– হ্যালো লেডিস।
স্কাই ব্লু কালারের ফরমাল শার্টের উপর মিডনাইট কালারের স্যুট প্যান্টে বলিষ্ট দেহের রেহবারকে দেখে মেয়েগুলো কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইলো।কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে রেহবার সামান্য কেশে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে আবারও জিজ্ঞাসা করলো,
– কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো জানতে পারি?
ওদের মধ্যে একজন মেয়ে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো ,
– আপনার ওয়াইফ?
রেহবার মাথা দুলিয়ে সায় জানাতেই পাশের মেয়েটি বলে উঠলো,
– হাউ স্যাড!
মনে মনে বলতে চেয়েছিলো হয়তো। মনের ভাবনা জোরে বলে ফেলায় সাথীদের নিকট হতে কনুইয়ের গুতাও খেতে হলো। মেয়েগুলোর বয়স খুব বেশি নয়। বড়জোর সতোর কিংবা আঠারো হবে। ওদের কান্ড দেখে রেহবার নিজেও হেসে ফেললো। পরিস্থিতি সামাল দিতে আরেকজন হড়বড়িয়ে বললো,
– উনার গায়ের শাড়িটা ভীষণ সুন্দর। কোথা থেকে নিয়েছে, প্রাইজ কেমন ডিটেইলস জানতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু উনি কিছু বলছেন না। যাই জিজ্ঞাসা করি, বলছেন ‘আমি আসলে জানি না।’
রেহবার তাকালো গুলিস্তার দিকে। মেয়েটির কথা শুনে মাথা নিচু করে বসে আছে। রেহবার হাত বাড়িয়ে ওর একটা হাত জড়িয়ে ধরলো।
– আমি গিফট করেছি, তাই ও জানে না।
– ওয়াও! আপনার পছন্দ দারুণ।
রেহবার নিজেই শাড়িটির ডিটেইলস মেয়েগুলোর সাথে শেয়ার করলো।
রেহবারের একদম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি কন্ঠে খানিকটা মাদকতা মিশিয়ে জানতে চাইলো,
– আপনার পারফিউমটি কোন ব্র্যান্ডের? কী দারুণ ঘ্রাণ!
আকস্মিক ব্যক্তিগত প্রশ্নে রেহবার খুকখুক করে কেশে উঠলো। গুলিস্তা নিজেও চোখজোড়া গোল গোল করে মেয়েটির দিকে তাকালো।
– মেল পারফিউমের ডিটেইলস জানার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। বিয়েশাদি করো, তারপর স্বামীর এর থেকে মেল পারফিউম এর অনেক নাম জানতে পারবে।
মেয়েগুলো খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেলো। কিশোরী বয়সী মেয়েদের এই এক সমস্যা। খানিক কথাতে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। এরা একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পরে হাসতে পারে কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই। ওরা চলে যেতেই রেহবার খাবার প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
– চলো খেয়ে নেই৷
গুলিস্তা প্লেটের দিকে তাকিয়ে আবার রেহবারের দিকে তাকালো। রেহবার কিছু বুঝতে না পেরে শুধালো,
– কি?
গুলিস্তা উত্তর দিলো না৷ রেহবারের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর ঘাড়ের কাছে মুখ দিয়ে ঘ্রাণ নিলো৷
তারপর সোজা হয়ে নিজের টেবিলে বসে খাবারের প্লেট নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে বললো,
– একদম বাজে ঘ্রাণ।
খাওয়া দাওয়া শেষে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে ওরা অনুষ্ঠান উপভোগ করলো। স্টেজে কেউ নাচছে, কেউ গাইছে। তরুণ-তরুণীদের কন্ঠে উত্তাল ময়ূর কুঞ্জ। গুলিস্তা কিছুক্ষণ সেগুলো উপভোগ করলেও এখন একটু পরপর আশেপাশে তাকাচ্ছে। বিষয়টি লক্ষ্য করে রেহবার প্রশ্ন করলো,
– হোয়াটস রং?
– ওয়াশরুমে যাবো।
ওয়াশরুম বিল্ডিং এর ভেতরে হওয়ায় রেহবার ওকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু তখুনি ওদের দিকে এগিয়ে এলো এসএম কো. এর সিইও সাইফুল ইসলাম। সিলেট শহরের তুখোড় বিজনেসম্যানদের মধ্যে একজন। তিনি নিজে থেকে রেহবারের সাথে কথ বলতে এসেছেন। উনাকে তো এড়িয়ে যাওয়া কিংবা অপেক্ষা করানো সম্ভব নয়। রেহবার উপায় না দেখে ওয়েডিং ম্যানেজমেন্ট টিমের একটি মেয়েকে ডেকে বললো,
– ক্যান ইউ এসিস্ট হার?
– শিওর। দিজ ওয়ে প্লিজ।
মেয়েটি বিনয়ের সঙ্গে গুলিস্তাকে পথ দেখালো। গুলিস্তা একবার রেহবারের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখশ্রীতে খানিকটা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে ভিতরে চলে গেলো।
চলবে…