হে_সখা #অক্ষরময়ী দ্বাবিংশ পর্ব

0
150

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দ্বাবিংশ পর্ব

ব্যবসায়িক কাজে দিদারকে শহরের বাইরে যেতে হয়েছে। সারাদিন কাজে কর্মে ব্যস্ত থাকার কারনে শর্মীর ইচ্ছে থাকলেও সময় করে উঠতে পারেনি। বাড়ি ভর্তি মানুষজন। দিনের বেলা কাজ না থাকলেও কেউ না কেউ আশেপাশে থাকে। আজকে রাতে দিদারের অনুপস্থিতিতে অপেক্ষিত সুযোগ এলো। সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো শর্মী। তারপর কল করলো রেহবারের ফোন নাম্বারে৷ ফোন রিসিভ হতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইলো,
– গুলিস্তার জ্বর কমেছে? কেমন আছে ও?

আকবর বাড়ির এই একজন সদস্যকেই রেহবারের পছন্দ। কথাবার্তা, চালচলনে বেশ অমায়িক মনে হয়েছে শর্মীকে। গুলিস্তাকেও ভীষণ স্নেহ করেন এই ভদ্র মহিলা।
– এখন আর জ্বর নেই। ভালো আছে ও।
– ঘুমাচ্ছিলে বুঝি? অসময় বিরক্ত করলাম। আসলে দিনের বেলা ফোন করার সম্ভব হতো না। লুকিয়ে কথা বলা ছাড়া উপায় নাই।
– জেগেই ছিলাম৷ অফিসের কিছু কাজ করছিলাম।
– বেশি সময় কথা বলতে পারবো না, ভাই। গুলিস্তাকে নিয়ে তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে, আমি জানি। ও আসলে অন্যসব স্বাভাবিক মেয়ের মতো না। ওর বয়সটা বাড়লেও, মন থেকে ও এখনো ছোট বাচ্চার মতোই। নিজের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবে না। যে যাই বলে তাতেই সম্মতি জানায়। ওকে দোষ দিয়ে লাভ নাই। আমাদের বাড়িতে যেকোনো মেয়েরই অবস্থা এমন। মেয়েদের আলাদা কোনো মতামত নেই। অভিভাবক যা ঠিক করবে, তাতেই সম্মতি জানাতে বাধ্য থাকতে হবে৷
– অন্য সবার থেকে ওকে একটু বেশি শাসন করা হচ্ছে না? আপনার শ্বাশুড়ি ওর নিজের মা তো?

রেহবারের প্রশ্নে শর্মী হেসে ফেললো।
– নিজেরই মেয়ে৷ আসলে সমস্যার শুরু আমার শ্বাশুড়ি মায়ের থেকেই। চার ছেলের পর অনেক বছর বাদের অনাকাঙ্খিত প্রেগন্যান্সির কারনে অনেকটা ভেঙে পরেছিলেন। গ্রামের মানুষের হাসাহাসি, কটুক্তিমূলক বাক্যে বিভ্রান্ত হয়ে এবরশনের চেষ্টাও করেন। বিধাতার দয়ায় গুলিস্তা স্বাভাবিকভাবেই জন্ম গ্রহণ করলেও ততোদিনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন আমার শ্বাশুড়ি। গ্রামের মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে তেমন একটা সচেতন নয়। ডেলিভারির পর পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন ধীরে ধীরে ভয়াল রুপ নেয়। উনার খিটখিটে মেজাজ, আক্রমনাত্মক আচরণ কেউ আমোলে নেয়নি। এর উপর হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন আমার শ্বশুর। সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেন আমার শ্বাশুড়ি। গুলিস্তার প্রতি অনীহা বেড়ে গিয়ে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। সামান্য কারনে গুলিস্তাকে মারপিট করতে থাকেন, বকাবকি করেন। তাই মায়ের হাত থেকে রক্ষা করতে এক পর্যায়ে একঘরে করে দেওয়া হয় ছোট মেয়েটিকে।
– সমস্যার শুরু তাহলে উনার থেকে!
– হ্যাঁ। উনার কারনেই গুলিস্তা স্বাভাবিক শৈশব পায়নি। মানসিক বিকাশের বয়সে ওর দিন কেটেছে আতংকে। ঘরে কথার বলার মতো কেউ ছিলো না, বাইরেও যেতে দেওয়া হতো না। কৈশোরের কৌতূহলকালীন সময়েও কাউকে পাশে পায়নি।
একলা ঘরে মন মরা হয়ে দিন কেটেছে। ধীরে ধীরে ও নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, কথা বলা এবং মানুষের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। জীবনের প্রতি ওর আগ্রহ নেই বললেই চলে। আমি যখন প্রথম এ বাড়িতে এলাম তখন তো ও ঘরের ভেতরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো। ওকে দেখে আমার ভীষণ ভয় হতো৷ না জানি কখন নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। ডিপ্রেশনে মানুষ প্রায় নিজের জীবন নিজেই কে*ড়ে নেয়।
– ও সু*ইসাইডাল নয়৷
– সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানী, গুলিস্তা এমন নয়। এতো কিছুর পরেও ওর মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায়নি। এর মানে হচ্ছে, ও ভীষণ লড়াকু। একটু সাহায্য পেলেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে৷ ও একা একা অনেক কিছু সহ্য করেছে, লড়াই করেছে। কাউকে পাশে পায়নি। তুমি ওকে একটুখানি সাহায্য করো। দীর্ঘ সময় বদ্ধ ঘরে, অসুস্থকর পরিবেশে কাটানোর পর হঠাৎ করে ওর থেকে স্বাভাবিক আচরণের প্রত্যাশা করা উচিত নয়। ওকে কিছুটা সময় দেও। খানিকটা বুঝার চেষ্টা করো। আমার বিশ্বাস যথাযথ কাউন্সিলিং নিলে ও দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
– আপনি চিন্তা করবেন না। ওকে সুস্থ করার জন্য যা কিছু করা সম্ভব আমি করবো। তবুও যদি সুস্থ না হয়, তাতেও আমার সমস্যা নেই৷ ও এখন আমার দায়িত্ব। নিজ দায়িত্বের কোনো অবহেলা করবো না।
– শুধু দায়িত্ব থেকেই ওকে সাহায্য করছো?
– আপনি যদি ওর প্রতি আমার অনুভূতি নিয়ে সামান্যতম দ্বিধায় ভুগছেন, তাহলে বলে রাখি। আমি আমার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসি, ভাবি।

রেহবারের কথা শুনে ফোনের অপরপাশে শর্মী খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো। বিয়ের পর গুলিস্তার ফিরে আসায় রেহবারের উপর ভরসার ভীতটি নড়বড়ে হয়ে উঠেছিলো। খুব জানতে ইচ্ছে করলো, ভালোবাসলে মাঝপথে একলা ছেড়ে দিলো কেনো? অন্যের বৈবাহিক জীবনের সব রহস্য উদঘাটন করতে নেই। নিজের কৌতুহল দমিয়ে রেখে মন খুলে দোয়া করলো,
– তোমরা সুখী হও। দোয়া করি।
– আপনি কীভাবে এই জেলখানায় ফেঁসে গেলেন, বলুন তো?
– সবই ভাগ্যের ফের৷ বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিলো, এসে গেলাম এই জেলখানায়৷

শর্মী খানিকটা হেসে গুমোট আবহাওয়া স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।
– আজ রাখছি। মাঝেমধ্যে কল দিয়ে তোমাকে বিরক্ত করবো। কিছু মনে করো না। মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়৷

***

ল্যাপটপের স্ক্রীনে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকা রাহিল ও আম্বিয়া খাতুনের দিকে চেয়ে রেহবার অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
– এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?

আম্বিয়া খাতুন নিজেকে সামলে নিলেও রাহিল বললো,
– তুমি শিওর, ওই মহিলা ভাবীর নিজের মা? আমার তো মনে হচ্ছে ভাবীর শ্রদ্ধেয় পিতা মহাদয়ের অন্য কোথাও চক্কর ছিলো। ভাবী সেই পক্ষের মেয়ে৷ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা গেলো। তারপর বেচারা বাবা সদ্য জন্ম নেওয়া অবুঝ সন্তানকে এনে তুলে দিলো প্রথম স্ত্রীর হাতে। আজ থেকে ওর দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। নিজের সন্তান মনে করে ওকে বড় করো।

আম্বিয়া খাতুন ছেলের মাথায় চাটি মেরে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
– আজগুবি গল্প বানানো বন্ধ কর। সারাক্ষণ সিনেমা দেখে মাথাটা পুরো গেছে।

রাহিলকে থামিয়ে দিয়ে রেহবারকে বললেন,
– সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। দীর্ঘদিন ধরে রোগ পুষে রাখলে সে রোগ নিরাময় করতে একটু বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে তোকে প্রচুর ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে৷ তোর কাছে একটি কথা জানতে চাইবো রেহবার। ভেবে উত্তর দিবি
গুলিস্তাকে বিয়ে করায় তোর কি এখন আফসোস হচ্ছে?

গুলিস্তার মানসিক সমস্যা সম্পর্কে যা কিছু জানা ছিলো সবটাই আম্বিয়া খাতুন এবং রাহিলকে ভিডিও কলের মাধ্যমে জানিয়েছে রেহবার। ওর একার পক্ষে গুলিস্তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। পুরো পরিবার এগিয়ে এলো, সহজেই একটা ব্যবস্থা করে ফেলা যাবে। গুলিস্তার দীর্ঘ চিকিৎসা, কাউন্সিলিং এবং মানসিক সাপোর্ট এর প্রয়োজন। এই নিয়ে কথা হচ্ছিলো পারিবারিক অনলাইন মিটিং এ।
মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে এক মুহুর্ত দেরী করলো না রেহবার।
– আফসোস কেনো হবে মা! সত্যি বলতে আমি খুব একটা বিচলিত বোধও করছি না৷ বরং এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে। বিয়ে করলাম, সুখের সংসার করলাম। ব্যাপারটা কেমন সাদামাটা হয়ে যেতো না?
– এই কঠিন মুহূর্তগুলো, ধেয়ে আসা বিপদগুলো আমাদের বেঁচে থাকার প্রকৃত স্বাদ দেয়। যতো বেশি সমস্যার মুখোমুখি হবে, জীবন ততো বেশি রঙিন হয়ে উঠবে। একাধারে সুখে দিন কাটলে জীবনের প্রতি বিরক্তি এসে যায়। তাই তো দুঃখ আসে, বিপদ আসে। যা ক্ষণস্থায়ী। এই কথা সারাক্ষণ মাথায় রাখবি। কখনো হতাশ হবি না৷

মায়ের সাথে কথা বললে যেকোনো দুশ্চিন্তা নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। মা যেনো ম্যাজিক পার্সোন। যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখার চমৎকার গুণ রয়েছে ইতিবাচক চিন্তাধারী এই মানুষটির। এমন মায়ের সন্তান হিসেবে জন্ম নেওয়ার সুযোগ প্রদান করায় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিনিয়ত শুকরিয়া জানায়।

পারিবারিক আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো গুলিস্তাকে দ্রুত মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। ডাক্তার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো রাহিলকে। এই সুযোগে আম্বিয়া খাতুন আবদার করলেন, গুলিস্তার চিকিৎসা যেনো ফ্লোরিডায় করানো হয়। দেশে তেমন ভালো কোনো সাইকোলজিস্ট পাওয়া মুশকিল। ফ্লোরিডা এলে উন্নত চিকিৎসাও পাওয়া যাবে। আবার দীর্ঘদিন পর পুরো পরিবার একসাথে সময়ও কাটাতে পারবে।

কথা বলা শেষে রেহবার ঘড়ির দিকে তাকালো। ডিনারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। মোবাইলটি হাতে নিয়ে গুলিস্তাকে ফোন করলো। স্টাডিরুম থেকে গলা ছেড়ে হাঁক দিয়েই গুলিস্তা ছুটে চলে আসবে। তবুও আজকাল ওকে ইচ্ছে করেই বিরক্ত করতে ভালো লাগে। ও বিরক্ত হয় কিনা বুঝা যায় না। তবুও রেহবার ইচ্ছে করে খোঁচায়।

সারাক্ষণ ছোট এই ডিভাইসটি নিজের সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ভীষণ অপছন্দ গুলিস্তার। তবুও রেহবারের আদেশ, ফোন যেনো কাছছাড়া না হয়৷ রান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিলে খাবার গুছিয়ে রাখছিলো, এমন সময় বিকট শব্দে ফোন বেজে উঠলো। ব্যস্ত হাতে ফোন তুলে নিয়ে দেখলো রেহবারের কল। অবাক হয়ে দোতলার স্টাডিরুমে তাকিয়ে কল রিসিভ করলো।
– রান্না শেষ তোমার?
– হ্যাঁ। মাত্র শেষ হলো।
– এখনি খেতে ইচ্ছে করছে না। একটা কাজ করো। এক কাপ কফি দিয়ে যাও।
– দিচ্ছি।

কফি চাইতে কল করার কী প্রয়োজন, ভেবে পেলো না। একটু পরেই তো ডিনারের জন্য ডাকতে যেতো, তখন বললেই হতো। বেশি ভাবনা চিন্তা না করে দ্রুত কফি বানিয়ে স্টাডিরুমের দিকে গেলো৷
কফির কাপ হাতে নিয়ে রেহবার ওকে বসতে বলেছে। ডেস্কের অপরপাশে অযথা বসে থেকে নখ খুটছে গুলিস্তা। রেহবার ধীরে সুস্থে কফির কাপে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে। গুলিস্তা বুঝতে পারছে না, ওকে এভাবে বসিয়ে রাখার কারন কি? ওকে উশখুশ করতে দেখে রেহবার ভীষণ মজা পাচ্ছে। কাজের তো বাহানা মাত্র। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গুলিস্তাকে নিজের কাছাকাছি রাখা। ল্যাপটপের দিকে মুখ করে চোরাচোখে গুলিস্তা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। কখনো মাথা নিচু করে বসে কোলের মধ্যে রাখা হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলছে, আবার কখনো ডানপাশের দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, রেহবারের পেছনে থাকা জানালা দিয়ে অন্ধকার দেখছে কিন্তু ভুলেও রেহবারের দিকে তাকাচ্ছে না। রেহবারও নাছোড়বান্দা। প্রয়োজন হলে আজকে রাতের অর্ধপ্রহর এভাবেই বসে কাটিয়ে দিবে তবুও এর শেষ দেখে ছাড়বে। খানিকবাদে কফির কাপ খালি হয়ে গেলে রেহবার সেটা পাশে রেখে দিলো। ক্ষণিকেই গুলিস্তা উঠে দাঁড়িয়ে কফির কাপ হাতে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই রেহবার অবাক হয়ে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?
– নিচে।
– এখানে বসতে বলেছি না তোমাকে? বসো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেয়ারে বসে গুলিস্তা মিনমিন করে বললো,
– বসে কি করবো?
– আমাকে দেখো৷

রেহবারের স্বাভাবিক উত্তর। কফির কাপ হাতে নিয়ে সেটা নাড়াচাড়া করে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হলে গুলিস্তাকে বাধ্য হয়ে বলতেই হলো,
– খাবারগুলো ডাইনিং এ রেখে এসেছি। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো রেহবার৷ গুলিস্তার কথায় মাথা তুলে ঘড়ির দিকে তাকালো। নয়টা পেরিয়ে গেছে। অনুরোধের সুরে জানালো,
– আর দু মিনিট। কাজ প্রায় শেষ।

( চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here