আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৪.
‘পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে
বলিও আমার পরদেশী রে-’
পরদেশি মেঘকে ফিরে যাবার কথা বললেও আকাশে কোনো মেঘ দেখা যাচ্ছে না। ঝকঝকে নীল আকাশে চৈত্রের তান্ডব। আজ তো দূর আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আকাশে কোনো মেঘ দেখা যাবে বলে মনে হয় না। গরমে মিথির মগজ গলে যাচ্ছে। শুটিং দলের ছেলেরা শুকনো পাতার স্তুপে অর্ধ পা ডুবিয়ে নির্বিকার হেঁটে চলেছে। হাতে, কাঁধে শুটিংয়ের ভারী ভারী সারঞ্জাম। দরদর করে ঘামতে ঘামতেও কালো, লম্বাদেহী এক ছেলে গলা ছেড়ে গান ধরল,
‘ পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে..’
ঘন শালবনে শুনতে ভালো লাগছে। কিন্তু হাঁটতে ভালো লাগছে না। এই ভালো লাগা না-লাগার মধ্যে মিথির কানের ব্লুটুথ কথা বলে উঠল। কথা বলছে মেয়েলি কণ্ঠে। মেয়েলি কণ্ঠ জানাচ্ছে, ‘কালামণি’ ইজ কলিং। কাঁধে ভারী চটের ব্যাগ, হাতে বিরাট ফটোফ্রেম আর মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য নিয়ে মিথি প্রথমে ধরতেই পারল না, কালামণিটা কে? হু ইজ কালামণি? পরে বুঝল, কালামণি নয় খালামণি। ইংরেজ সফটওয়্যার বাঙালি খালামণিকে যথেষ্ট সম্মান দিতে ব্যর্থ। খালামণি ভয়ংকর মহিলা। তাকে এক ইংরেজকণ্ঠী বারংবার কালামণি বলে ডাকছে জানলে ব্লুটুথের ভেতর ঢুকে পড়ার চেষ্টা করাও ওনার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। মিথি মাথা বাঁকিয়ে কাঁধের চাপে ফোন রিসিভ করল। খালামণি অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ এই তুই আছিস কোথায়?’
‘ গাজীপুরে।’
খালামণি চিৎকার করে উঠলেন,
‘ গাজীপুরে! কাল তোর বিয়ে হলো আর সকালে উঠে তুই গাজীপুর গিয়ে বসে আছিস?’
‘ বসে নেই। হাঁটছি। শুটিংয়ের কাজে এসেছি।’
‘ তোর ওই শুটিংয়ের কাজ আমার জানা আছে। দুইদিন পর পর পেপারে ওই পরিচালক সেই পরিচালকের অপকর্মের কাহিনি ছাপে। ওই নায়িকার সাথে সেটিং, সেই নায়িকার সাথে ফিটিং। সত্যি করে বল তো, তুই কোনো নায়কের সাথে ঝুলে যাসনি তো?’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমি অতো বড়ো পরিচালকও হয়ে যাইনি যে আমি চাইলেই কোনো নায়কের সাথে ঝুলে পড়তে পারব। আমার প্রেকটেসিং পিরিয়ড চলছে। এসব নায়ক টায়ক আমাকে এখন চোখেও দেখবে না।’
খালামণি ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
‘ তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, নায়ক টায়ক তোকে চোখে দেখুক তার জন্য তুই মুখিয়ে আছিস? দেখ মিথি, তুই এখন বিবাহিত। কোনো নায়ক তোকে চোখে দেখলেও তুই দেখবি না। তোর চোখ মহাভারতের গান্ধারীর মতো বাঁধা থাকবে। ক্লোজ।’
মিথি দ্বিতীয়বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিয়ের কথাটা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। খালামণির কথায় কালকের রাতটা চোখের পর্দায় সিনেমা দৃশ্যের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল। খালামণি বললেন,
‘ এমন ফুটফুটে একটা বর ঘরে রেখে তুই কী করে বেরিয়ে গেলি বল তো? বুক কাঁপল না?’
মিথির বুক কাঁপেনি। নিজের স্বপ্ন ছাড়া আর কোনো কিছুই কোনোদিন তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। মিথি বলল,
‘ কালকের ছালচামড়া ছাড়া ছেলে আজ ফুটফুটে হয়ে গেল?’
‘ হলো। তোর বিয়ে শুনে আমি ঢাকা থেকে পাগলের মতো ছুটে এলাম অথচ তুই আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলি না। এদিকে শুনি, বুড়ো নাকি ওই ছেলেটাকে তোর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমার তো হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়। প্রেশার দপদপ করে বাড়ছে। সারাটা রাত এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। ভোরে তোর ঘরে ছুটে গিয়ে দেখি, দরজা খোলা। বিছানার উপর তোর বর ঘুমুচ্ছে। চেহারা ছবি খারাপ না। আমাকে দেখেই ধরফর করে উঠে বসল। আমি গম্ভীর স্বরে বললাম, আমি মিথির খালা। ছেলেটা কী করল জানিস?’
মিথি আগ্রহ পেল না। বিরস কণ্ঠে শুধাল,
‘ কী করল?’
‘ বেকুব ছেলে বলে কি-না, মিথি কে? বুঝ অবস্থা, কাল বিয়ে করে বাসর পর্যন্ত সেড়ে ফেললি আর ব্যাটা তুই বউয়ের নাম জানিস না?’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাব্বির তার নাম জানুক বা না-জানুক তাতে তার কোনো যায় আসে না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যায় আসছে। সাব্বির মিথির নাম জানে না অথচ মিথি সাব্বিরের নাম জেনে বসে আছে – এই বিষয়টা তাকে পীড়া দিচ্ছে। মেজাজটা কেমন চিড়বিড় করে ওঠছে। মিথি শান্ত স্বরে বলল,
‘ আমিও তো তার নাম জানি না, তাতে কী?’
খালামণি অবাক,
‘ নাম জানিস না? নাম না জেনেই সকল কর্ম সম্পাদন করে ফেললি?’
মিথি উত্তর দিল না। বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ ফোন রাখো তো খালামণি। আমি এখানে কাজে এসেছি। এতোক্ষণ ধরে ফোনে কথা বললে কাজ করব কখন?’
‘ রাখ তোর কাজ। আজ তোর শুটিং কোথায় বল, আমি যাব। মোবাইলে কথা বলা যাবে না সামনাসামনি কথা বলব। আমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। তুই আমাকে ঠিকানা দে।’
মিথি অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
‘ তোমার কী ধারণা আমি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সুদৃশ্য কামরায় বসে শুটিং করি? আমি এখন গাজীপুরের এক জঙ্গলে আছি। তুমি এখানে আসতে পারবে না।’
খালামণি আবার চিৎকার করে উঠলেন,
‘ জঙ্গল! কাল বিয়ে করে আজই তুই জঙ্গলে গিয়ে বসে আছিস? নতুন বউয়ের যেখানে একা একা টয়লেটে যাওয়া মানা সেখানে তুই জ্বিন-ভূতের আড্ডায় গিয়ে বসে আছিস! তোর কী কোনোদিন আক্কেল হবে না? এদিকে তোর বর নাকি তোর নাম জানে না। তুই তার নাম জানিস না। এভাবে সংসার টিকবে কী করে? আমার তো মাথা কাজ করছে না।’
মিথি কথার মাঝেই ফোন কাটল। খালামণির আহাজারি অসহ্য লাগছে। তার হৈ-চৈ দেখে মনে হচ্ছে, এই সংসার না টিকলে মিথি ভেসে যাবে। খালামণির বুঝা উচিত, এসব বিয়ে, সংসার, সাব্বির কোনোটাই মিথির দরকার নেই।
জঙ্গলের গহীনে শুটিং চলছে। গার্ডেন ছাতার নিচে কপাল কুঁচকে বসে আছেন পরিচালক মোখলেসুর আলম। তার মেজাজ চড়ে আছে। ক্যামেরা ম্যান থেকে শুরু করে সকলেই তটস্থ। একটু দূরে বিশাল এক হাতি দাঁড়িয়ে, পাশে তার মাহুত। হাতির থেকে বেশ খানিকটা দূর গাছের ছায়ায়, ছাতার নিচে বসে ম্যাগাজিন পড়ছে নাটকের নায়ক। মোখলেসুর আলমের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ নাটকের নায়িকা। নায়িকা অত্যন্ত আহ্লাদী। প্রতি কথায় কথায় তার আহ্লাদ। মোখলেসুর আলমের এতো আহ্লাদ সহ্য হচ্ছে না। এই অসহনীয় মেজাজ তিনি দেখাচ্ছেন মিথির ওপর। তীব্র ঝাঁঝের মুখে পড়েও মিথি কোনো প্রতিবাদ করছে না। মহিষের মতো খাঁটছে। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। মোখলেসুর আলম মিথিকে ডেকে শীতল কণ্ঠে বললেন,
‘ তোমাকে আধাঘন্টা সময় দেওয়া হলো। আধাঘন্টার মধ্যে তুমি একটা সমাধান খুঁজে বের করবে। আজকে শুটিং-এর কাজটুকু শেষ করতে না পারলে কাল থেকে তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই।’
মিথি শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ-মুখ দেখে বুঝার উপায় না থাকলেও দুশ্চিন্তায় তার মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। আজকের শুটিংয়ের দৃশ্য খুবই সাধারণ। কেতাদুরস্ত পোশাক, মাথায় হ্যাট আর হাতে ক্যামেরা নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে চলেছে নায়ক। নায়িকা তার বালিকা বোনকে নিয়ে সেই পথ ধরেই হেঁটে যাবে। হাতির পিঠে সুদর্শন যুবককে দেখে তারা বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াবে। সুদর্শন যুবক তাদের দিকে তাকিয়ে বলবে,
‘ তোমরা তো ভীষণ মিষ্টি দেখতে। একটা ছবি তুলি?’
নায়িকা জবাব দেবে না। তার মুখে ভয় আর লজ্জার একত্রিত আভা ফোটে উঠবে। বালিকা বোনের হাত ধরে ছুটে পালাতে পালাতে সে আরও দুয়েকবার অচেনা যুবকের দিকে ফিরে তাকাবে। নায়কের চোখে থাকবে তখন গাঢ় বিস্ময়। এতটুকুই। এতটুকুতেই বিশদ সমস্যা দেখা গেল। নায়িকা হঠাৎ জানাল, সে হাতির সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে না। হাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েও পড়তে পারবে না। হাতিতে তার ভয় আছে। হাতির কাছাকাছি গেলে তার প্যালপিটিশন হয়। হাতির জায়গায় ঘোড়া হলে চলবে। হাতির জায়গায় ঘোড়ার কথা শুনেই মোখলেসুর আলমের প্যালপিটিশন শুরু হয়ে গিয়েছে। মেজাজ পঁয়ষট্টি ডিগ্রী সেলসিয়াসে জ্বলছে। মিথি বুঝে পেল না, আধা ঘন্টার মধ্যে এই সমস্যার সমাধান সে কী করে করবে? নায়িকার মাথার ভেতর ঢুকে হাতিভীতি কমিয়ে ফেলার ক্ষমতা তো তাকে দেওয়া হয়নি। মিথির এই সহস্র যন্ত্রণার মধ্যে শুটিং সেটের এক ছেলে এগিয়ে এসে বলল,
‘ আপু? সাফাত ভাইয়ের জুসে নাকি মশা পাওয়া গিয়েছে। মরা মশা। ভাই খুব চেঁচামেচি করছেন। এখন কী করব?’
মিথি নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
‘ জুস থেকে মশা তুলে ফেলে দিয়ে সার্ভ করে দাও।’
ছেলেটি চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ কী বলছেন আপু! তার এসিস্ট্যান্টটা আমার পায়ে পায়ে ঘুরছে। ওই দেখুন, ওইখানে দাঁড়িয়েও এদিকেই তাকিয়ে আছে। এমন কিছু করলেই হল্লা বাঁধাবে।’
আর পারা যায় না। আর পারা যায় না। মেজাজ খারাপ লাগছে মিথির। ধমক দিয়ে বলল,
‘ তাহলে আমার মাথাটা কেটে জুস বানিয়ে দিয়ে দাও।’
ছেলেটি মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল। মিথি দেখেও দেখল না। কিচ্ছু করার নেই। মিথি উপরমহলের ঝাঁঝে পুড়ে যাচ্ছে। তার অধীনস্তরা তার ঝাঁঝে পুড়ে যাবে এটাই নিয়ম।
আকাশে সূর্যের তেজ বেড়েছে। মিথির ধরাবাঁধা সময় ফুরিয়ে আসছে অথচ কোনো আইডিয়া খুঁজে পাওয়া যায়নি। নায়িকাকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে মিথি। কিন্তু লাভ হয়নি, উল্টো তার মেজাজ সইতে হয়েছে। মিথি গাছ তলায় একটা চেয়ার নিয়ে বসল। দু’হাতে মুখ ঢেকে শান্ত মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করল।
‘ এক্সকিউজ মি?’
মিথি মুখ থেকে হাত সরিয়ে মাথা তুলে তাকাল। পকেটে দু’হাত গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে আছে সাফাত আরিয়ান। তার পেছনে তার এসিস্ট্যান্ট। হাত পাখা দিয়ে ক্রমাগত হাওয়া করছে।
‘ আজকে কী আদৌ শুটিং চলবে? নাকি প্যাকাপ হবে?’
ক্লান্ত মিথি ঠোঁটে উষ্ণ হাসি টানার চেষ্টা করে বলল,
‘ এখনও বলা যাচ্ছে না ভাইয়া।’
তামাটে চেহারার, দীর্ঘদেহী সাফাত বিরক্ত হলো,
‘ বলা না গেলে কী করে বলা যায় তার ব্যবস্থা করুন। আপনাদের কাছে সময়ের দাম না থাকলেও আমার আছে। আমার আরও নাটকের শুটিং আছে। ঈদের আগে আগে কত কাজ থাকে সেটা আপনারা জানেন না? নতুন কোনো শিডিউল কিন্তু আমি দিতে পারব না।’
এসিস্ট্যান্ট মিথির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রিপিট করল,
‘ স্যার নতুন কোনো শিডিউল দিতে পারবেন না।’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অহংকারী সাফাত ফিরে যেতেই ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। একহাতে কপাল চেপে ধরে সেকেন্ড দুই বসে থেকে আচমকা উঠে দাঁড়াল। সাফাত তখন কয়েক পা এগিয়েছে। পেছন থেকে ডাক পড়ায় প্রচন্ড বিস্মিত হলো। ফিরে না তাকিয়ে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। মিথিই দৌঁড়ে তার কাছে এলো। বলল,
‘ ভাইয়া, একটা রিকুয়েষ্ট ছিল।’
সাফাত ভুরু উঁচিয়ে তাকাল। অর্থাৎ, সে রিকুয়েষ্টটা কী তা জানতে চায়। মিথি বলল,
‘ আপনি যদি একবার অর্ষা আপুকে বুঝিয়ে বলতেন। আপনি বললে আপু রাজি হয়ে যাবে।’
সাফাত হতবাক,
‘ আমি কেন বলব? আপনি কী টেকনিক্যালি, পুরো ব্যাপারটা আমাকে ম্যানেজ করতে বলছেন? আর্টিস্টদের কনভেন্স করার কাজ তো আমার নয়!’
এসিস্ট্যান্ট গুরুত্বপূর্ণ লাইনে বর্ডার টানার মতো রোবোটিক গলায় বলল,
‘ আর্টিস্টদের কনভেন্স করা স্যারের কাজ নয়।’
মিথি ভীষণ নরম স্বরে বলল,
‘ প্লিজ ভাইয়া। আপনি ছাড়া কেউ অর্ষা আপুকে ম্যানেজ করতে পারবে না। ওনি আর কারো কথা শুনবেন না। প্লিজ ভাইয়া, প্লিজ!’
সাফাত কিছু কড়া কথা বলতে গিয়েও মিথির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। পকেট থেকে একটা হাত বের করে নাকের ডগা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
‘ আপনার ধারণা, আমি বললেই অর্ষা রাজি হয়ে যাবে?’
মিথি মাথা নাড়ল,
‘ জি ভাইয়া। আই এ্যাম হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।’
সাফাত ঠোঁট উল্টাল। মিথির মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই আশ্চর্য করে দিয়ে বলল,
‘ ওকে! আই উইল টক উইথ হার।’
মিথি আশ্বস্ত হলো। কিন্তু তার এই স্বস্তি উড়িয়ে দিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হল শুটিংয়ের ছেলে, নবীন। এসে, সাফাতকে লক্ষ্য না করেই হড়বড় করে বলল,
‘ আপু! একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে।’
মিথি সাফাতের সামনে নিজেকে যথাসাধ্য ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল। শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ কী হয়েছে?’
‘ হাতি নিয়ে পড়েছি এক ঝামেলায়। এই হাতি প্রতিদিন একশো কেজির ওপরে খাবার খায়।’
মিথির ধৈর্য্যের বাঁধ বেলে মাটির মতো ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছে। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তাতে তোমার সমস্যা কী? তুমিও তার মতো একশো কেজি খাবার খেতে চাও? বিশাল বড় জঙ্গল। তোমরা দু’জনে মিলে দুইশো কেজির ওপরে খেলেও খাবার কম পড়বে না।’
নবীন বলল,
‘ সে কথা নয় আপু। হাতির নাকি এখন কলাগাছ খাওয়ার সময়। দুপুর ঠিক বারোটায় সে দুটো কলাগাছ খায়। কঠিন শিডিউল। নড়চড় হওয়ার সিস্টেম নেই।’
মিথি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ সেখানে আমি কী করতে পারি? জঙ্গল থেকে কলাগাছ কেটে এনে দিব? তুমি হাতিকে কোলে বসিয়ে খাওয়াবে?’
নবীন মন খারাপ করে বলল,
‘ এখানেই তো সমস্যা আপু। আশেপাশে তো কোথাও কলাগাছ দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে শুধু শালগাছ আর শালগাছ। ভেতরের দিকে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পদ কেটে ফেলব, বন বিভাগের লোক ধরে ফেলবে না?’
মিথি আর ধৈর্য রাখতে পারল না। ধমক দিয়ে বলল,
‘ তুমি আমার সামনে থেকে যাও। এক্ষুনি যাবে। যাও!’
নবীন মুখ কালো করে বলল,
‘ এর থেকে হাতি তরমুজের জুস খেলে ভালো হতো। আপু আপনার বুদ্ধি ভালো। মশাটা তুলে ফেলা দেওয়ার পর জুসটা ঝকঝক করছে। সাফাত ভাই দুই গ্লাস খেয়ে ফেলেছেন। এখনও এক বোতল আছে। হাতিকে খাইয়ে দেওয়া যেত। তা না কলাগাছ খাবে। এখন কলাগাছ পাই কোথায়!’
সাফাত এতক্ষণ আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনছিল। জুসের প্রসঙ্গে সে বিস্ময়ে, আতঙ্কে, ক্ষোভে চিৎকার করে উঠল,
‘ আপনি আমাকে মশার জুস খাইয়েছেন! মশা!’
এসিস্ট্যান্টের হাতের পাখার গতি দ্রুত হলো। সেও চিৎকার করে বলল,
‘ আপনারা স্যারকে মশার জুস খাইয়েছেন! মশা!’
তারপর মুখ নামিয়ে সাফাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘ স্যার আপনার পেটের ভেতর তখন একটা ফরফর ফরফর আওয়াজ শুনেছিলাম। মনে হচ্ছে, সেটা মশার আওয়াজ। মশা নির্বিঘ্নে উড়াউড়ি করছে। আমি কী আবার একটু শুনবো স্যার? কান পাতলেই শোনা যাবে।’
সাফাত তার দিকে তাকিয়ে কঠিন একটা ধমক দিল, ‘ শাট আপ!’ তারপর হড়বড় করে বমি করে ফেলল। হতভম্ব নবীন-মিথিকে শেষ ঝটকাটা দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,
‘ আমার মনে হচ্ছে, আমার ফুড পয়জনিং হয়ে গিয়েছে। শুটিং প্যাকাপ। এই নাটকে কাজ করার প্রশ্নই আসে না। আপনাদের নামে আমি মামলা করব।’
ও মাই গড! ও মাই গড! ও মাই গড! মিথি সরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল। গত রাতে সাব্বির যেমন মাথা চেপে বসে ছিল। মিথিও ঠিক সেভাবেই মাথা চেপে বসে আছে। তার মাথার ভেতরটা ধপধপ করছে। মনে হচ্ছে, সকল নার্ভ ছিঁড়ে যাবে। উফ! তার জীবনেই এতো সমস্যা কেন!
____________
চড়া রোদে রাস্তার পিচ গলে চটির নিচে পরত পড়ছে। চটচটে ঘামে ভিজে গিয়েছে চুলের গোড়া। কপাল-গলা বেয়ে সেই ঘাম একসময় জামার তলায় হারিয়ে যাচ্ছে। মৌনী এসেছে নীলক্ষেত। রাস্তার ধারে পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে ভেসে আসছে ভ্যাপসা গন্ধ। সে গন্ধ গরমের নাকি বইয়ের কে জানে? একটা দোকানে মৃদু লয়ে বাজছে নজরুলের কোমল গান –
‘ আমায় নহে গো
ভালোবেসো শুধু ভালোবেসো মোর গান-’
মৌনি একটা দোকানের সামনে দাঁড়াল। এখানে ভালো বই পাওয়া যায়। একবার খুঁজতে খুঁজতে মুরাকামির ফার্স্ট এডিশনের একটা বই পেয়ে গেল। শাওন ওটা দেখে বিশ্বাসই করল না। মুখের উপর বলে দিল, ‘ধুর! এটা নকল বই।’
শাওনের সাথে মৌনির প্রথম দেখা কবে হয়েছিল, সে কথা বলা মুশকিল। বোধহয় তাদের জন্মের পর পরই। শাওন মৌনির ছোট খালামণির ছেলে। মৌনির ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় কেটেছে নানার বাসায়। শাওনের দুই/আড়াই বছর বয়সে হঠাৎ তার বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট খালামণিও উঠে এলেন বাবার বাড়ি। শাওন আর মৌনির বন্ধুত্বটা জমে উঠল তখন থেকেই। শাওন মৌনির নানাবাড়ির দিকের একমাত্র সমবয়সী কাজিন। সমবয়সী হলেও শাওন ভীষণ গম্ভীর। মৌনির মতো কলকল করে কথা বলা, হো-হো করে হেসে উঠা তার ধাতে নেই। সে ঘরবন্দী, নির্ভেজাল মানুষ। এই ঘরবন্দী, নির্ভেজাল মানুষটি কলেজে পা দিয়েই একটা ভয়ংকর কাজ করে বসল। আচমকা মৌনিকে প্রপোজ করে বসল। প্রপোজাল পেয়ে মৌনির এতো দুঃখ হলো যে সেদিন দুপুরে সে ভাত পর্যন্ত খেলো না। শাওন ততদিনে তার দারুণ বন্ধু। এই চমৎকার বন্ধুত্বটা হারিয়ে যাবে ভেবেই বিষণ্ণ লাগছিল। মৌনির প্রত্যাখ্যান পেয়ে শাওনের মতো স্বল্পভাষী ছেলেটাও কেমন উন্মাদ হয়ে গেল। স্বভাবের বাইরে গিয়ে মৌনির জন্য এই সেই কবিতা লিখে একাকার অবস্থা। পড়াশোনা লাটে উঠিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে দুই সাবজেক্টে ফেইল। শাওনের এই আবেগের বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে এক বছরের জন্য শাওনের সঙ্গে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিল মৌনি। শাওন মৌনির সাথে যোগাযোগের সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে শান্ত হলো। মৌনিকে সমঝোতাপত্র পাঠাল, সে সমঝোতা চায়৷ মৌনিকে আর কখনও সে ভালোবাসার কথা বলবে না, প্রেমের কথা বলবে না, কবিতা লিখবে না। তার বিপরীতে মৌনি তার সাথে কথা বলা অব্যহত রাখবে। মৌনি এই পৃথিবীর সেই চমৎকার মেয়েটি, যার এই পৃথিবীর কারো সাথে কোনো বিরোধ নেই। কোনো এক অদৃশ্য উপায়ে সকলের সাথে তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। অতএব, মৌনি রাজি হলো। তারপর থেকে চার বছর কেটে গিয়েছে। শাওনের অনুভূতি আর মৌনির অনুভূতিহীনতা দুইয়ে মিলে তাদের বন্ধুত্ব কী করে যেন আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। মৌনির ফোন বাজল। একটা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে ফোন তুলল। সাথে সাথেই মোবাইলের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো শাওনের শান্ত কণ্ঠ,
‘ কোথায় আছ? আমি দুই ঘন্টা ধরে কফি শপে বসে আছি ম্যাডাম৷ এ পর্যন্ত আট কাপ কফি খাওয়া শেষ। আর কয় কাপ খাব?’
আত্মভোলা মৌনি আঁতকে উঠে কাঁধ আর মাথার চাপ ছেড়ে ফোনটা হাতে ধরল। প্রায় চিৎকার করে বলল,
‘ আরে! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।’
অন্যকেউ হলে রেগে যেত। শাওনের মধ্যে রাগের সিস্টেম নেই বলে সে হেসে ফেলল। বলল,
‘ এখন তো মনে পড়ল? এখন চলে আসো। তুমি আসতে আসতে আরও দু’কাপ কফি খেয়ে দশ কাপ পরিপূর্ণ করে ফেলি, কী বল?’
মৌনি হেসে ফেলল। কফি শপে পৌঁছে দেখল শাওন মনোযোগ দিয়ে গেইম খেলছে। মৌনিকে দেখে সে একটু হাসল। ফোনটা রেখে বলল,
‘ কী খবর?’
মৌনি শাওনের অসীম ধৈর্যশক্তিতে বরাবরের মতো বিস্মিত হলো। মৌনির কথা বলার প্রতিভা যেমন অসীম, রাগ করার ক্ষমতাও তেমন অসীম। কখন সে বারুদের মতো দপ করে জ্বলে উঠবে সে প্রশ্নের উত্তর বিধাতা ভিন্ন স্বয়ং মৌনির পক্ষেও দেওয়া অসম্ভব। অন্যদিকে শাওন শান্ত। এই বাইশ বছরের জীবনে মৌনি তাকে কখনও রেগে যেতে দেখেনি। সর্বদা সে ধীর, স্থির। মৌনি একটা চেয়ার টেনে বসে বলল,
‘ খবর ভালো। তোমার কী অবস্থা? টাঙ্গাইল থেকে কবে এলে? সেমিস্টার ফাইনাল শেষ?’
‘ আমি ভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি গ্রাজুয়েশন করব না।’
মৌনি অবাক,
‘ সে কি! কেন? আর মাত্র দুটো বছর বাকি ছিল।’
শাওন হেসে বলল,
‘ আমার এয়ারফোর্সে সিলেকশন হয়ে গিয়েছে। তোমাকে বলিনি, ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দিব।’
মৌনি উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ কী বলছ! কবে এপ্লাই করলে? পরীক্ষায় বসলে কবে? আশ্চর্য!’
শাওন তার স্বভাবসুলভ হাসল। মৌনি চুলগুলোকে চুড়ো খোঁপা করে উন্মুক্ত ঘাড়ে ঠান্ডা হাওয়া লাগার সুযোগ করে দিয়ে বলল,
‘ তোমার প্রেমের কী অবস্থা? কিছু হলো? ওই জুনিয়র মেয়েটার কী খবর?’
শাওন খাবার অর্ডার করতে করতে হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মতো উড়িয়ে দিল কথাটা। বলল,
‘ ধুর! ওসব আমার দ্বারা হবে না। কৈশোরে এক ছ্যাঁকা খেয়েই আমার সব সিস্টেম নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই সিস্টেম পুনরুদ্ধারের সময় এখন নেই। এখন ফুল ফোকাস আমার ক্যারিয়ারে। তারপর বাচ্চা একটা মেয়ে দেখে একেবারে বিয়ে করে ফেলব।’
‘ বাচ্চা মেয়ে?’
হেসে ফেলল মৌনি। শাওন বলল,
‘ তোমার খবর বলো। ভার্সিটিতে এখন ক’জন ছেলের মাথা ঘুরাচ্ছ?’
মৌনি যেন কথা বলার সাবজেক্ট ফিরে পেল। বার্গারে মস্ত কামড় বসিয়ে সে মনের আনন্দে কথা বলে চলল। সামনে বসে থাকা শাওন চিবুকে হাত ঠেকিয়ে নীরব শ্রোতার মতো মৌনির চঞ্চল মুখের দিকে চেয়ে রইল। তার চোখদুটোতে খেলা করছে বিশুদ্ধ মুগ্ধতা। এই মুগ্ধতা কাটিয়ে ছেলেটা কী করে নতুনের দিকে হাত বাড়াবে? চার বছর ধরে মৌনি তার একটা সফল প্রেম করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্যই বুঝি মৌনির সব চেষ্টা ব্যর্থ? এজন্যই শাওনের শেষ পর্যন্ত আর কাউকে পছন্দ হয় না!
_____________
ছোটবেলায় ভূগোলের বই পড়তে বসে গা দুলিয়ে দুলিয়ে মুখস্থ করেছিল নাহিদ, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব পনেরো কোটি কিলোমিটার। এখন মনে হচ্ছে সব ভোগাস। সূর্যের আসল অবস্থান মহাখালী, ইশতিয়াকের কোয়াটারের বারান্দায়। নাহিদ বিছানা থেকে উঠে বসল। বিছানাটা তাওয়ার মতো তেতে আছে। সে নাহিদ না হয়ে ডিম হলে এতোক্ষণ তার নাম হয়ে যেত এগ ফ্রাই। নাহিদ বিছানা হাতিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা আবিষ্কার করল বালিশের তলায়। অবশিষ্ট সিগারেটটা ধরিয়ে সৌধকে বলল,
‘ সিগারেট শেষ। চল, বাইরে যাই।’
সৌধ ফোন ঘাঁটছিল। বন্ধুর কথায় বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে দাঁড়িয়েই আবার চট করে বসে পড়ল। চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ পাগল! ইশতিয়াক ভাই তোকে বেড রেস্ট দিয়েছে। আপাতত সাত দিন বিছানা ছাড়া যাবে না।’
নাহিদ ঠোঁট গোল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিজের পায়ের দিকে তাকাল। পায়ে মোটা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ব্যান্ডেজের পুরুত্বে টাওজার পরতে সমস্যা হয় বিধায় ইশতিয়াক তাকে একটা লুঙ্গি ধার দিয়েছে। নাহিদের লুঙ্গি পরার অভ্যাস নেই। সে কোমরের কাছে একটা বেল্ট লাগিয়েছে। নাহিদ বলল,
‘ আমার গুলি লেগেছে কোন পায়ে?’
সৌধ অবাক হয়ে বলল,
‘ কোন পায়ে আবার? বাম পা।’
‘ তাহলে রেস্ট কোন পায়ের দরকার?’
সৌধ বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
‘ বাম পায়ের।’
‘ তাহলে শুধু শুধু বাকি শরীরকে রেস্টে রাখার প্রয়োজন কী? যার রেস্ট দরকার সে রেস্ট পেলেই তো হলো।’
‘ সারা শরীরকে রেস্ট না দিয়ে শুধু বাম পা’কে রেস্ট দেওয়া কী সম্ভব? তুই কী বাম পা খুলে বিছানায় রেখে বেরিয়ে যেতে চাইছিস? বাম পা এখানে শুয়ে ঘুমাল৷ তুই রাষ্ট্র ঘুরে এসে চট করে আবার লাগিয়ে ফেললি। আর সে-ও ভালো মানুষের মতো লেগে গেল!’
নাহিদ মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ তেমন না। ইশতিয়াক ভাই কী বলেছে চিন্তা কর। বলেছে, পা মাটিতে ফেলবি না। আমি যদি পা মাটিতে না ফেলে হাঁটতে পারি তাহলে সমস্যা কোথায়?’
সৌধ অবাক,
‘ মাটিতে পা না ফেলে হাঁটবি কী করে?’
‘ এক পায়ে হাঁটব। আরেক পা তোর পায়ের সাথে স্কচটেপ দিয়ে আটকে দিব। আমাদের হবে দুই দেহ তিন পা।’
লোকে বলে, জাতে জাত না মিললে বন্ধু হয় না। নাহিদ আর সৌধর জন্য বোধহয় সে কথা বেদবাক্যের ন্যায় সত্য। অতএব, সৌধ যে নাহিদের আশ্চর্য পরিকল্পনায় খুব আগ্রহ নিয়ে রাজি হবে সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দুই দেহ তিন পা নিয়ে হিচড়ে পাছড়ে তারা যখন দরজার কাছে দাঁড়াল তখনও তারা ধারণা করতে পারেনি বন্ধ দরজার ওপাশে তাদের মতোই কেউ অপেক্ষা করছে। সৌধর দরজা খোলা আর ওপাশের ব্যক্তির দরজায় টোকা দেবার জন্য বাড়ানো হাত একই টাইমটেবিল মেপে চলল বলেই হয়ত, দরজার টোকা দরজায় না বেজে বাজল সৌধর কপালে। আকস্মিক এই ঘটনায় চমকে গিয়ে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল সৌধ। সৌধর চিৎকারে নাহিদ এবং তাদের দু’জনের সম্মিলিত চিৎকারে সামনের জনও আকাশ-বাতাস অন্ধ করে গলা ফাটাল। মেয়েলি চিৎকারে থেমে গিয়ে সচেতন চোখে তাকাল নাহিদ। সৌধর মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘ মেয়ে দেখে চেঁচাস, বেকুব!’
সৌধ সামনে তাকিয়ে বোকা বনে গেল। বুকে থু থু ছিটিয়ে গালভর্তি নির্বোধ হাসি নিয়ে বলল,
‘ এটা তো মেয়ে, বন্ধু। মেয়ে! ’
নাহিদ কটমট করে বন্ধুর দিকে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ ওহ তাই? তুই না বললে তো জানতেই পারতাম না!’
তারপর কণ্ঠ নিচু করে ষড়যন্ত্র করার মতো করে জানাল,
‘ খবরদার, বেশি নড়াচড়া করবি না। মনে হচ্ছে, লুঙ্গিটা বেল্ট থেকে ছুটে গিয়েছে। এই মেয়ের সামনে লুঙ্গি খুলে গেলে সর্বনাশ।’
সৌধ বন্ধুর ইজ্জত বাঁচাতে বন্ধুর কোমরের কাছে ঝাপটে ধরল। এদের মোচড়া মুচড়ি দেখে আগুন্তকঃ ভুরু বাঁকিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে শুধাল,
‘ আপনারা কে?’
সৌধ ততোধিক তীর্যক কণ্ঠে শুধাল,
‘ আপনি কে!’
আগুন্তকঃ তাদের উপর-নিচ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে খুব দম্ভ ভরে বলল,
‘ আমি প্রভা।’
নাহিদ নির্বিকার মুখে বলল,
‘ আমরা সৌনাহি।’
প্রভা অবাক,
‘ সৌনাহি! এটা আবার কী?’ নাহিদ-সৌধকে আরও একবার আগাগোড়া নিরক্ষণ করে প্রভা বলল, ‘কোনো জাতিগোষ্ঠীর নাম?’
‘ জি না। মানুষের নাম।’
‘ মানুষের নাম! কী আশ্চর্য! তাহলে “আমরা সৌনাহি” বলছেন কেন? আপনাদের মধ্যে কার নাম সৌনাহি?’
‘ দু’জনের নামই সৌনাহি।’
‘ দু’জনের নামই?’
‘ হু। সৌধ নাহিদ ইকুয়ালটু সৌনাহি। ও সৌধ , আমি নাহিদ।’
প্রভা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ সেটা আগে বলতে পারেননি?’
‘ না, পারিনি। প্রচন্ড গরম করছিল। আমরা গরমের দিন কম কথা বলি।’
প্রভা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ তো এখন গরম লাগছে না?’
নাহিদ মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ জি না। এখন খুবই ঠান্ডা লাগছে। শীত। কোল্ড।’
প্রভা মেজাজ খারাপ করে তাকাল। সৌধ ফিক করে হেসে ফেলতে নিয়েও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নাহিদ খুব বিনয়ী কণ্ঠে বলল,
‘ কেন ঠান্ডা লাগছে জিজ্ঞাসা করবেন না?’
প্রভা কিছু বলবে না বলবে না করেও দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,
‘ কেন?’
নাহিদ মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ এটা সম্পূর্ণই একটা গাণিতিক ব্যাপার। অঙ্ক করতে গিয়ে পড়েছেন নিশ্চয়, মাইনাসে মাইনাসে প্লাস? ঠিক সেরকম। ওয়েদার হট, আপনি হট। হটে হটে কোল্ড। শীত। ঠান্ডাআআ।’
সৌধ আর ধৈর্য রাখতে পারল না। ফিক করে হেসে উঠল। প্রভা নিস্ফল ক্রোধে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দিল। নাহিদ তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বড় আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ আশ্চর্য! মেয়েটা রেগে গেল কেন?’
সৌধর ফিক ফিক হাসি অব্যহত রইল। প্রভা কেবল দরজাটা লাগিয়ে দেওয়ার আগে বলল,
‘ অসভ্য!’
#চলবে….