আজ ওদের মন ভালো নেই
৭.
নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে ওয়াকম সিন্টিকে মগ্ন হয়ে আছে মৌনি। পাশে রাখা চা উত্তাপ হারিয়ে শীতল প্রায়। সপ্তাহখানেক আগে একটা কার্টুনের কাজ এসেছিল নামজাদা এক পত্রিকা থেকে। হাতেগুণা সময় এক সপ্তাহ। মৌনি বাকি ছয়দিনের তিনদিন কাটিয়েছে রাত জেগে বই পড়ে, চতুর্থ দিনের ব্যাপারটা মৌনির কাছে চক্রান্ত বলে মনে হয়। নয়তো সন্ধ্যায় একটু ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে বসতেই কী করে রাত তিনটে বেজে যায়? পঞ্চম দিনে কাজ-ফাজ করার ইচ্ছে মৌনির হয়নি। কার্টুন আঁকা ক্রিয়েটিভ কাজ। ইচ্ছে না হলে জোর করে তো সম্ভব নয়? মৌনি নিজেকে কখনও কোনোকিছুতেই জোরজবরদস্তি করে না। তার এই আত্মচিন্তাকে শাওন বলে ‘অলসতা’। ভেতরের মৌনি শাওনের সাথে কিছুটা একমত। ষষ্ঠ দিনটা কেটেছে এই ‘অতি অলসতা’ জাতীয় দুশ্চিন্তা করতে করতে। আজ সপ্তম দিন। ভোর হলেই ডেডলাইন। মৌনির মাথায় বজ্রপাত পড়ার মতো অবস্থা। এমনিতে সে রাতে ঘুমায় না। আজ ঘুমও বেইমানি করে দু’চোখ জুড়ে বসতে চাইছে। মৌনি বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটাটা আজ বড় অস্থির। চোখের পলকে একটা থেকে দুটোর ঘরে চলে যাচ্ছে। ভদ্রতাজ্ঞান বলতে নেই। এর মধ্যে মুঠোফোনটা বেজে উঠল, ট্যা ট্যা করে। মৌনি বিরক্ত হয়ে কয়েক সেকেন্ড ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিল, ফোন তুলবে কী তুলবে না? ঘড়িতে তখন তিনটা বাজে। এই ভোর রাতে টেলিফোন বাজার দুটো কারণ হতে পারে,
এক. কোনো দুঃসংবাদ আছে।
দুই. কলদাতা খুব একাকিত্বে ভুগছে। তার মৌনিকে প্রয়োজন। এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস মৌনি তাকে শুনবে।
মৌনি কারো বিশ্বাস ভেঙে দিতে রাজি না। তার ডেডলাইনের থেকে কারো একাকিত্ব ভ্যানিশ করে দেওয়া বেশি জরুরি। এই সুন্দর পৃথিবীতে একজন নিঃসঙ্গ মানুষকে জানিয়ে দেওয়া যাক, ‘হোয়েনএভার ইউ কল মি, আই উইল বি দেয়ার ফর ইউ।’ মৌনি ফোন তুলল। ধমক দিয়ে বলল,
‘ মিষ্টি নামের মেয়েরা মিষ্টি মিষ্টি ভুল করবে। আর তুই করেছিস ভয়ংকর ভুল। তুই কী আমাকে ফোন দেওয়ার আগে পাঁজি দেখতে বসিস? কখন কখন ফোন দিলে আমার কাজের বারোটা বেজে যাবে; দেখে দেখে সেই সময়টাই কী করে সিলেক্ট করিস?’
মৌনির জায়গায় অন্যকেউ হলে মিষ্টির খুব আঁতে লাগত। হয়ত মন ভার হতো। কিন্তু মৌনি এতো আন্তরিক স্বরে বলল, যেন ধমকের সাথেই উড়ে উড়ে এলো সূক্ষ্ম একটা প্রশ্রয়। সে প্রশ্রয় গমগম করে বলছে, ‘ইউ ক্যান এনোই মি মোর এন্ড মোর।’ মিষ্টি অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ ইশ! বুঝতে পারিনি। আচ্ছা, তুই কাজ কর। সকালে কথা হবে।’
মৌনি বিছানায় বাবু হয়ে বসে বলল,
‘ কোনো দরকার নেই। আমার কাজ আমি ম্যানেজ করে নিব। তুই বল, তোর কী অবস্থা? মন টন ভালো?’
মিষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
‘ বুঝতে পারছি না। এতো চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম আসছে না। ওহ, তোকে তো বলা হয়নি। আজ খালামণিদের সাথে শহরের বাইরে গিয়েছিলাম ঘুরতে। সাথে ছিল খালামণির এক দেবর। আমাদের মতোই বয়স। এই লোকের সাথে কী বিশ্রী একটা অকারেন্স ঘটে গেল!’
মৌনি ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ কেমন অকারেন্স?’
‘ সবাই মিলে হৈ-হৈ করে নৌকায় উঠছি হঠাৎ আমার হিলটা নড়বড় করে উল্টে গেল। পানিতে পড়ব পড়ব অবস্থা। সেই সময় কোথা থেকে উড়ে এসে আমার হাত ধরে ফেলল সেই ভদ্রলোক। সে নৌকায় দাঁড়িয়ে আর আমি তার হাত ধরে অর্ধেক নৌকা, অর্ধেক পানিতে ঝুলছি।’
মৌনি খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ ওরে বাবা! এ তো একেবারে সিনেমা!’
মিষ্টি একটু লজ্জা পেল। ইতস্তত করে বলল,
‘ ছেলেটা আমাকে পছন্দ করে। খালামণির বিয়েতে প্রথম দেখেছিল। খালামণি ইনিয়েবিনিয়ে তার পক্ষ থেকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেন। খালামণির এই সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই।’
মৌনি কৌতুক করে বলল,
‘ বাপরে! আমরা একটাও পাই না। আর তুমি তো দেখি মজনুদের সিরিয়াল লাগিয়ে দিয়েছ বন্ধু! ছেলে দেখতে কেমন? আমার ভ্রাতার থেকে সুদর্শন?’
মিষ্টি কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ আরে না! তবে খুব লম্বা।’
‘আমি ভাবছি নাহিদ তোর এই নতুন মজনুর খবর জানলে কী করবে সেই কথা।’
মিষ্টি বলল,
‘ কিছুই করবে না। ও আগেই জানে। ওখান থেকে ফিরে এসে সবার আগে ওকে বলেছি।’
মৌনি বিস্মিত কৌতুহল নিয়ে বলল,
‘ বলেছিস! ও কিছু বলেনি? প্রিয়তমের বুকে দাউদাউ হিংসা হয়নি?’
মিষ্টি হেসে ফেলে বলল,
‘ না। তোর ভাই তোর মতোই কুল। নাহিদ কখনও কোনো বাইন্ডিংস্ দেয় না। ও একদমই জাজমেন্টাল না। ওকে সব কথা বলে ফেলা যায়। আমি এসব বলার পর নাহিদ বরং খুব আগ্রহ নিয়ে সবটা শুনল। তোরা সব ভাই-বোনরাই কী এমন কুল?’
মৌনি উত্তর দিল না। নাহিদের এই নন-জাজমেন্টাল গুণের কথা জেনে কিছুটা বিস্মিত হলো । নাহিদকে মৌনি ভালো জানে না। ওকে আসলে কেউই তেমন বুঝতে পারে না। তাদের ভাই-বোনদের মধ্যে নাহিদ একমাত্র, যাকে ছোট-বড় কেউই তেমন একটা পছন্দ করে না। সবার মুখে মুখে এক রব, নাহিদ ভন্ড, মেয়েবাজ, চলাফেরা খারাপ, উজ্জ্বল ভবিষ্যতটাকে নিজের হাতে নষ্ট করা নষ্ট ছেলে। মৌনির ধারণা অবশ্য খানিকটা ভিন্ন। মৌনির দৃঢ় বিশ্বাস, নাহিদ যাই করুক, খারাপ ছেলে না। বরং সে নিজের প্রতি আশ্চর্যরকম সৎ। ইউনিভার্সিটির প্রথম দিকে নাহিদের সাথে দেখা হলেই নাহিদ একরকম কাঁধের উপর চড়ে বসত। কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে বলত,
‘ এই তুই মিষ্টিকে চিনিস? তোদের ইউনিভার্সিটিতেই তো পড়ে? চিনিস না? এটা কেমন কথা!’
ততদিনে নাহিদের অসংখ্য গার্লফ্রেন্ডদের অসংখ্য গল্প শুনতে শুনতে ত্যক্ত বিরক্ত মৌনি মিষ্টির প্রসঙ্গে আরও তেতে উঠত। ইউনিভার্সিটিতে মিষ্টিকে দেখলেও মুখ হয়ে যেত গম্ভীর। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভীষণ সুন্দরী মেয়ে মিষ্টি। দেখলেই মনে হতো, দারুণ অহংকার। নাহিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এই অহংকারী মেয়েটির সাথে মৌনির আলাপ হলো ইউনিভার্সিটির এক ইভেন্টে। এবং চমৎকৃত হয়ে আবিষ্কার করল, এই মেয়েটির মতো নিরহংকার আর সরল মানুষ এই পৃথিবীতে দুর্লভ। এই দুর্লভ মেয়েটিকে নাহিদ কী করে আবিষ্কার করল সে কথা না জানলেও এতোটুকু জানল, মিষ্টিও তার মতো একই অত্যাচারে পিষ্ট। নাহিদ তাদের প্রেমালাপের মধ্যেও অন্তত বিশবার করে মৌনির প্রসঙ্গ টানে। প্রত্যেকবার একই কথা,
‘ আরে মৌনিকে চিনো না? আমার বোন মৌনি। তোমাদের ইউনিভার্সিটিতেই তো পড়ে। আশ্চর্য!’
যেন একই ইউনিভার্সিটিতে পড়া মৌনিকে চেনা মিষ্টির জন্য অবধারিত! নাহিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পরিচয় হলেও এই পরিচয়টা গড়িয়ে গেল বন্ধুত্ব পর্যন্ত। কয়েকটা বছর কেটে যাওয়ার পর সেই বন্ধুত্ব এতোটাই দৃঢ় হলো যে নাহিদ নিজেই সেখানে প্রায় অদৃশ্য। দীর্ঘ ফোনালাপ শেষে ঘড়ির দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল মৌনি। সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে। একটু পরেই আকাশ উজ্জ্বল করে হাসবে সূর্য। মৌনি বিছানার ওপর পড়ে থাকা ওয়াকম সিন্টিকের দিকে একবার তাকিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। চাঁদহীন আকাশটা অল্প একটু আলো হয়ে আছে। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল মৌনির। আজ শাওনের জন্মদিন। মৌনির মনে আছে অথচ শুভেচ্ছা জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মৌনি জানে, শাওনের মনে মৌনির জন্য চাপা একটা অনুভূতি আছে। জন্মদিনে উইশ করে সেই অনুভূতিকে হাওয়া দেওয়ার পক্ষপাতি সে না। তার থেকে একটু অবহেলা করে মুভ অন করায় সহযোগীতা করা যাক। শাওন যখন প্রথম প্রথম মৌনির জন্য ভয়ানক পাগলামো শুরু করল। মৌনি ভেবেছিল, এই ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলা উচিত। কিন্তু পরে বুঝেছে, ভালোবেসে ফেলা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যারা সহজেই ভালোবেসে ফেলতে পারে তারা বেঁচে যায়। যারা ভালোবাসতে পারে না তাদেরই যত দায়। মৌনি ভালোবাসতে না-পারাদের একজন। অভাগী একজন। শাওনকে সে ভালোবাসতে পারে না। শাওন তাকে ভালোবাসে ভাবতেও অসহ্য লাগে। গা ঘিনঘিন করে। কেন করে কে জানে? অথচ শাওনের জন্য তার কত মায়া! মৌনির চমৎকার বন্ধুদের মধ্যে শাওন অন্যতম। এই পৃথিবীতে কে এমন আছে যে শাওনের মত একজনকে চায় না? তারপরও মৌনির বুকে অনুভূতি জন্মায় না। মৌনিকে চমকে দিয়ে চারপাশ আলোড়িত করে ভেসে ওঠে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাওয়ার সুমধুর আহ্বান। ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আল্লাহু আকবর’….মৌনি শুনেছে এই সময় দোয়া কবুল হয়। সে চোখ বন্ধ করে বারবার একই কথা বিড়বিড় করে যায়,
‘ শাওন নামের ছেলেটির মন থাকে মৌনি নামটি মুছে দাও আল্লাহ। মুছে দাও। মুছে দাও। মুছে দাও।’
___________
সারারাত না ঘুমিয়েও মৌনির চোখে-মুখে খুব একটা ক্লান্তি নেই। সে দমবন্ধ করে কাজ করছে। বিরক্ত হয়ে বারবার ঘড়ির কাটা দেখছে। উফ! সময়টাকে কয়েক ঘন্টার জন্য আটকে ফেলা যায় না? এই দমবন্ধকর কাজের চাপে ফোন করলেন মা। মৌনির মেজাজ বিগড়ে গেল। দুনিয়ার সকলকে তার জীবন-মরনের সন্ধিক্ষণেই কেন ফোন করতে হবে? কেন? মৌনি ফোন তুলে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল,
‘ কী বলবে ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে বলে ফেলো। আমি প্রচন্ড ব্যস্ত। নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় নেই।’
মৌনির মা স্কুলে পড়ান। মৌনি যতটা অস্থির, তিনি ততটাই শান্ত। তিনি অবাক হয়ে শুধালেন,
‘ তুই সবসময় এতো ব্যস্ত থাকিস কেন? কখনও ঘুমে ব্যস্ত, কখনও বই পড়ায় ব্যস্ত, কখনও লেখালেখিতে ব্যস্ত, কখনও মন খারাপকে সময় দিচ্ছিস বলে ব্যস্ত। এতো ব্যস্ততা তুই পাস কোথায়?’
মৌনি লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ উফ! উফ! আম্মু। এটুকু কথা বলে আমার ত্রিশ সেকেন্ড কিল করে ফেলেছ তুমি। ফোন রাখো।’
মা ফোন রাখলেন না। চাপা স্বরে বললেন,
‘ নাহিদ নাকি পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে, জানিস?’
অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে থমকাল মৌনি। অবাক হয়ে বলল,
‘ পুলিশ ওকে তাড়া করবে কেন? পুলিশকে ও কী করেছে?’
মা চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ কে জানে কী করেছে? খারাপ বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘুরে ঘুরে নষ্টের চূড়ান্ত হয়েছে। শুনলাম, গুলি টুলি খেয়ে অবস্থা খারাপ। খুব ঠাঁট নিয়ে চলাফেরা করে। এই টাকা আসে কোথা থেকে? কোনো খারাপ কিছু করছে কি-না কে জানে? আমাদের বংশের কোনো ছেলেই তো এমন নষ্ট হয়নি। ও এমন নষ্ট হলো কেন কে জানে?’
মায়ের কথা মিথ্যা না। দাদাভাইয়ের বাড়িতে শিশুদের বেড়ে উঠা অদ্ভুত রকমের। গায়ে হাওয়া দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। স্কুল ফাঁকি দেওয়া। সিনেমা দেখা। দুষ্টুমি করা। বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, সেখানে কোনো ঘটনা না। কেউ খোঁজ নিয়েও দেখবে না। দাদার মন-মেজাজ খারাপ থাকলে সবকটাকে ধরে একদিনেই মুরগী ছোলা করে ফেলবে। এছাড়া স্বাধীন। কেউ ওখানে পড়তে বসার জন্য জোর-জবরদস্তি করে না। রেজাল্টের খোঁজ নেয় না। শুধু কলেজ পাশ করার পর খরচ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মৌনিদের বাবা-মায়েরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু পিতৃ শ্রদ্ধায় অন্ধ। কোনো এক অদ্ভুত কারণে দাদাভাইয়ের নিয়মের খেলাপ কেউ করে না। তার থেকেও অদ্ভুত বিষয়, এই সীমাহীন স্বাধীনতা পেয়েও ছেলেমেয়েদের কেউ উচ্ছন্নে যায় না। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে না। কারো রেজাল্ট ফেইলের ঘর ছুঁয় না। স্ট্রাগল করে টিকে থাকার একটা নেশা দৌঁড়ে বেড়ায় তাদের প্রত্যেকের শরীরে। কষ্ট হয়। দাদাভাইকে গালাগাল করে কিন্তু দিনশেষে এই জীবনটা তারা উপভোগও করে। নাহিদও উপভোগ করছে। তা যেভাবেই করুক। ক্ষতি কী? মৌনি শুধাল,
‘ তুমি জানলে কী করে?’
‘ গুলি খেয়ে ইশতিয়াকের বাসায় নাকি উঠেছিল। ডাক্তার বলেছে, পা কেটে ফেলে দিতে হবে। ওই পা আর চলবে না।’
বাইরে ঝকঝকে রোদ দেখা যাচ্ছে। মৌনি ব্যস্ত হয়ে ঘড়ি দেখল। খাইছে! একটু আগে দশটা পয়তাল্লিশ ছিল চোখের পলকে হয়ে গেলো এগারোটা! মৌনি তাড়া দিয়ে বলল,
‘ ফেলে দিতে হলে ফেলে দিবে। আমার পা তো আর কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে না। রাখো তো ফোনটা।’
ওপাশ থেকে মায়ের বিস্মিত কণ্ঠ ভেসে এলো,
‘ কী নিষ্ঠুর রে তোরা। এতো অসামাজিক হচ্ছিস…’
মৌনি মায়ের কথার মাঝেই ফোন রাখল। সময়ের মধ্যে তার কাজ শেষ করতে হবে। নাহিদের পা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার জন্য স্বয়ং নাহিদ আছে। ওর পা মৌনির দুঃশ্চিতার বিষয় না।
_____________
ঠিকানা দেখে দেখে মিথি যে বাড়িটির সামনে থামল, সেটা একটা পুরোনো দু’তলা বাড়ি। গেইট খুলতেই মরচে পড়া কড়কড়ে শব্দ হলো। গেইটে কোনো দারোয়ান নেই। মিথি এখানে কেন এসেছে বুঝতে পারছে না। ভেতর থেকে ফিরে যাওয়ার একটা তাড়না বোধ করলেও কোথাও একটা আটকে যাচ্ছে। ফিরে যেতে পারছে না। মিথি দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে চারদিকে তাকাল। গেইট আর মূল বাড়ির মাঝে বিস্তৃত একটা লন। খুব একটা যত্ন করা হয় বলে মনে হয় না। সমস্তটা ঘাসে ভর্তি। ঘাসের মাঝে প্রায় বিলিন হয়ে যাওয়া দু’পায়ে ইটের রাস্তা ধরে বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বিপুল দেহী এক মহিলা। মহিলার গা থেকে ভুরভুর করে মশলার গন্ধ বেরুচ্ছে। মিথিকে দেখেই কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘ কারে চান?’
মিথি শুধাল,
‘ এখানে সাব্বির নামে কেউ থাকেন?’
মশলা গন্ধী মহিলা সন্দিহান চোখে মিথিকে দেখল। চোখ ছোট ছোট করে বলল,
‘ আপনে স্যারের কী লাগেন?’
মিথি অপ্রস্তুত বোধ করল। মিথি সাব্বিরের কী লাগে তা চাইলেই ফট করে বলে ফেলা যায়। কিন্তু মিথি বলতে পারল না। এমন একটা অর্ধ ঝুলন্ত, দ্বিধান্বিত সম্পর্কের কথা চড়া গলায় বলাও মুশকিল। মিথি প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
‘ সাব্বির সাহেব বাসায় আছেন?’
মশলা গন্ধী মহিলা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলল,
‘ না, নাই। এই সময়ে স্যার বাসায় থাকেন না।’
সাব্বিরের পেশা সম্পর্কে অজ্ঞাত মিথি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ ওনি কখন আসবেন?’
ভদ্রমহিলা পান চিবোতে চিবোতে বড় তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,
‘ কওন যায় না। সন্ধ্যায় আইতে পারে। আবার রাইতও হইতে পারে। কিন্তু আপনার লগে স্যারের সম্পর্ক কী? স্যারের সঙ্গে কখনও কেউ দেখা করতে আসে না। আপনি পয়লা মানুষ।’
মিথি কিছু বলল না। তার কেন যেন মনে হচ্ছিল, সাব্বিরের একা থাকাটাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে অন্য কেউ থাকে শুনলে বরং ব্যাপারটা অদ্ভুত শুনাত। মিথি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ সাব্বির সাহেব না আসা পর্যন্ত আমি বসব। আপনি তার ঘরটা দেখিয়ে দিন।’
মহিলা উটকো ঝামেলায় অত্যন্ত বিরক্ত হলো। মুখ পানসে করে বলল,
‘ স্যারের অনুমতি ছাড়া আপনারে ঘরে নেই কেমনে? আমারও কাম শেষ। আরেক বাড়ি যামু কাম করতে। আপনারে একলা রাইখা গেলে আপনি যদি চুরি কইরা পলান? তখন তো দোষ হইব আমি কমলার মায়ের।’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমাকে দেখে চোর চোর মনে হচ্ছে?’
মশলা গন্ধী মহিলা মিথিকে ভালো করে দেখল। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ রোদের তাপে গোলাপি আভা ছড়াচ্ছে। নীল শাড়িতে তাকে দেখাচ্ছে ফুটন্ত পদ্মের মতো। এমন রূপবতী তরুণীকে চোর বলতে গলা কাঁপে। চোর হলেও তাকে চোর বলতে ইচ্ছে হয় না। মশলা গন্ধী গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ আজকাল চেহারা দেইখা চরিত্র বুঝুনের উপায় নাই।’
মিথি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ আমি চুরি করে পালাব এমন ধন-সম্পদ আপনার স্যারের নেই। আপনি ঘর খুলুন।’
মিথির কণ্ঠে কী ছিল কে জানে? মশলা গন্ধী কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে দিল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ আপনেরে ভরসা কইরা ঘর খুইলা দিলাম। বেইমানি করলে আল্লাহ সাক্ষী।’
মিথি প্রত্যিত্তরে কিছু না বলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরটা আশ্চর্য রকম শীতল। মশলা গন্ধী ঘরের আলো জ্বেলে দিতেই মিথির মনে হলো, সে বোধহয় রবিবাবুর কোনো গানের ভেতর ঢুকে পড়েছে। অথবা শরৎচন্দ্রের কোনো উপন্যাসে। মিথি বুক ভরে একটা শ্বাস নিয়ে আশেপাশে তাকাল। চারদিকে বাহুল্য কিছু নেই। একেবারে সাধারণ অথচ কী চমৎকার! দেওয়ালে দেওয়ালে রুচিশীলতার ছাপ। দুটো বেতের চেয়ার, ছোট্ট কফি টেবিল, বই ভর্তি দুটো তাক। একপাশের দেয়ালে দৃষ্টিনন্দন কিছু পেইন্টিং। অপর পাশটা জুড়ে জানালা। জানালার কাছে নানান ধরনের ইনডোর প্লান্ট। প্লান্টের পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপছে। মিথির এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, তারা মিথিকে অভিবাদন জানাচ্ছে। মিথি এগিয়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে স্বচ্ছ জানালাটা খোলে দিল। সাথে সাথে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা উড়িয়ে দিল মিথির এক গুচ্ছ চুল। মিথি বাইরের দিকে চোখ রেখেই শুধাল,
‘ আপনার নামটা যেন কী?’
মশলা গন্ধী বলল,
‘ নাম মনে নাই আপা। তেরো বছর বয়স থাইকা সবাই ডাকে কমলার মা। আপনেও তাই কন।’
মিথি প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। কমলার মা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিদায় নিলো। দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই এই নিঝুম বাড়িতে একেবারে একলা হয়ে গেল মিথি। বসার ঘরের মাঝখানে চিত্রার্পিত হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবল, ভাগ্যিস সাব্বির অনুপস্থিত। নয়ত হঠাৎ আগমনের কী ব্যাখ্যা দিত মিথি? যদি সাব্বির তাকে চিনতেই না পারত? নাম শুনে আশ্চর্য হয়ে বলত, মিথি! মিথি কে? তখন কী বলত সে? সে-ও কী হঠাৎ সাক্ষাৎ-এ চিনতে পারত সাব্বিরকে? সেদিন রাতে যে চেহারাটা দেখেছিল তা অনেক ভেবেও আর মাথায় আসছে না। শুধু মাথায় আছে হিজল তলার দিঘির মতো ঠান্ডা টলটলে দুটো চোখ। কেবল দুটো চোখ দেখে কী মানুষ চেনা যায়? মিথি বেতের চেয়ার স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। উপরের তলায় বোধহয় কোনো পরিবার থাকে। একটা অল্প বয়সী মহিলার কণ্ঠ ভেসে আসছে। তার সাথে ভেসে আসছে টুক টুক করে কথা বলা একটা শিশুর গলার স্বর। মিথি কিছুক্ষণ স্থির বসে থেকে বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখল। দুটো শোবার ঘর, এক চিলতে বারান্দা, একটা ছোট্ট বসার ঘর, ডাইনিং স্পেস, দুটো বাথরুম আর রান্নাঘর নিয়ে বাসা। ছোট্ট কিন্তু মনোরম। মিথি ঘুরতে ঘুরতে রান্না ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। হাঁড়ি, কড়াইয়ের ঢাকনা তুলে তুলে দেখল, কী রান্না হয়েছে? দুপুরে তার খাওয়া হয়নি। এমন নিঝুম বাড়িতে, শীতল রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে পেটের ক্ষুধাটা চাঁড়া দিয়ে উঠছে। মিথি কড়াইয়ের ঢাকনা তুলে দেখল, তেল, পেঁয়াজ, মরিচের আধিক্যে মাংস ভূনা করা আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, অখাদ্য। খাবার থেকে ভুরভুর করে মশলার গন্ধ আসছে। মিথি ঘুরে ঘুরে ফ্রিজ, কেবিনেট খুলে খুলে দেখল। শাক-সবজির উপস্থিতি পর্যাপ্ত। মিথির হঠাৎ কী হলো, কে জানে? এই গুছানো, মনোরম রান্নাঘরে কিছু একটা চট করে রান্না করে ফেলতে ইচ্ছে হলো। হল জীবনে বহু রান্নাবান্না করেছে মিথি। কিন্তু খালামণির বাসায় এসে উঠার পর আর ইচ্ছে হয়নি। মিথির অনধিকারচর্চা ভালো লাগে না। খালামণির রান্নাঘরটা তার কখনও নিজের মনে হয়নি। সেই বাড়িটা বাড়ি মনে হয়নি। নিজেকে মনে হয়েছে কেবলই ভাসমান পদ্ম। আজ হঠাৎ করে এই অপরিচিত নিবাসে কেন তার এই ধরনের সাধ জাগল মিথি বুঝে উঠতে পারছে না৷ এই প্রথম সে তার অন্যায় ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিল। বাড়ির মালিকের অনুমতি ব্যতিত কোমরে আঁচল গুজে খুব যত্ন করে রান্না করতে বসল। মুরগীর মাংসের পাতলা ঝোল, গরুর মাংস ভূনা, কড়া করে কাতলা মাছের ভাজা, টক দিয়ে ডাল। রান্না শেষে খাবারগুলো যত্ন করে গুছিয়ে রাখল টেবিলে। বহুদিন পর সব ভাবনা ভুলে তৃপ্তি নিয়ে খেলো। আকাশে ধূসর গোধূলি নেমে আসতেই কফি টেবিলের উপর ছোট্ট একটা চিরকুট রেখে বেরিয়ে পড়ল। চিরকুটে লিখল,
‘ অনুমতি না নিয়ে আপনার খাবারে ভাগ বসিয়ে ফেলেছি। কী কী খেয়েছি তার স্পষ্ট হিসেব আমার কাছে আছে। যদি দেখা হয়, সেই ঋণ পরিশোধ করব।’
সম্বোধন, পরিচয় ছাঁটাই করা ছোট্ট একটা চিরকুট একাকি পড়ে রইল টেবিলে। মিথি খেয়াল করল না, চিরকুটটি একা নয়। তার সাথে পড়ে রইল নাহিদের দেওয়া সেই লাল গোলাপ। এই অবহেলায় পড়ে থাকা গোলাপটি কী তার ঠিকানা পাবে? মিথিকে চিনে চিনে তার কাছে পৌঁছে যাবে কী একদিন? নাকি অবহেলায় ঝরে যাবে? মিথির প্রতি এক বুক অভিমান নিয়ে হারিয়ে যাবে জন্মের ইতিহাস থেকে?
# চলবে….
নৌশিন আহমেদ রোদেলা