আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে #লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো #বারোতম_পর্ব

0
167

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#বারোতম_পর্ব

অনিন্দ্য এই ধরাধামে যা কিছু ঘটে তার বেশিরভাগই রহস্য বটে। আর সবচেয়ে রহস্যময় হচ্ছে মানুষের মন। এই মন কখন কি বলে। কখন কি চায়, বলা মুশকিল। বোঝা মুশকিল। এই মনের চাওয়ার কত রুপ। কত ধরণ। কত ধৃষ্টতা। কারো মন চায় ভালো থাকতে; কেউ বা চায় ভালো রাখতে। কেউ বা চাই নিজেও ভালো থাকব না কাউকে থাকতেও দিবো না। কি অদ্ভুত!

রুপক কেবিনের বেডে শুয়ে আছে। তার মা ইসমত আরা বেগম ছেলের মাথা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। পায়ের টিউমারটা অনেক আগেই অপারেশন করার কথা ছিল। আজ করছি, কাল করছি, করতে করতে করাই হয়ে ওঠে না। গত সপ্তাহে ফুটবল খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিল।
সেই ব্যথা কম তো দূর বেড়েই যাচ্ছিল। ডাক্তারের কাছে এলে উনি বলে দ্রুত টিউমার অপারেশন করে নিতে। ভয়ের কিছু নেই টিউমারের অবস্থা ভালো। তবে অসুখ শরীরে পুষতে নেই। কখন কি হয় বলা যায়। একথা শুনে ইসমত আরা বেগম সেদিনই অপারেশনের ডেট ঠিক করে আসেন। আর সুযোগ বুঝে কাজটা আজ সেরে নিলেন। আল্লাহর রহমতে কোনো
সমস্যা হয় নি। কয়েকদিন রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। রুপক চোখ বন্ধ করে আছে। স্যালাইন চলছে৷ তখন ইসমত আরা বেগম বললেন,
-‘আব্বু ঘুমিয়েছিস?’
-‘না আম্মু। বলো শুনছি।’
-‘খুব কষ্ট হচ্ছে?’
-‘অবশ ছুটছে বোধহয় তাই..! ‘
-‘ঠিক হয়ে যাবে বাবা। কষ্টের পরেই স্বস্থির দেখা মিলে তাই না?’
-‘হুম। কুহু বাসায় ফিরেছে?’
-‘হুম। রিদওয়ান ফোন করে জানাল তারা কেবল বাসায় ফিরল।’
-‘ওহ।’
-‘একটা কথা বলব বলব করেও..!’
-‘ভয় নেই। রিদওয়ানের জান চলে যাবে তবুও আমাদের সন্মানে ঠুনকো আঘাত হানতে দেবে না। তুমি ওকে না চিনলেও আমি চিনি আম্মু। ওই ঠিক নারিকেলের মতো। উপরে শক্ত খোলসে আবৃত আর ভেতরটা খুব নরম।’
-‘সেটাও বুঝেছি আমি। ছেলেটাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমার। পাত্র হিসেবে মন্দ হবে না তাই না?’
মায়ের কথা শুনে রুপক ঝট করে চোখের ঝাঁপি খুলে ফেলল। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল একরাশ বিষ্ময় নিয়ে। মায়ের কথার অর্থ বুঝতে তার সময় লাগল না। ছেলেকে এভাবে তাকাতে দেখে ইসমত আরা একটুও ভড়কালেন না। বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক থেকে বললেন,
-‘সব মায়েরা চান মেয়েকে সুপাত্রের হাতে পাত্রস্থ করতে। আমার চাওয়া এর ব্যক্তিক্রম নয়। ছেলে ভালো। কর্ম করে। নেশাভান করে না। বিনয়ী।
পরিবারও ছোটো। হ্যাঁ তার পরিবারটা এতদিন ভাঙাচোরা থাকলেও খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। সুপাত্র হিসেবে আর কি চাই?’
-‘তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি কাকে নিয়ে কি বলছো? রিদওয়ান আমার বন্ধু। ছোটোবেলার বন্ধু! আর কুহু আমার বোন! বন্ধু আর বোন
একসঙ্গে ভাবতেই পারি না আমি।’
-‘কেন পারিস না? সে তোর ছোটোবেলার বন্ধু বলেই তো তুই ভালো করে জানবি রিদওয়ান আসলে কেমন। তার নেগেটিভ দিকগুলোও জানবি।
এবার তুই রিদওয়ান কেমন হবে আমাদের কুহুর জন্য?’
-‘রিদওয়ান ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো। এ নিয়ে আমার অভিযোগ নেই।
কিন্তু ওর একটাই সমস্যা ভীষণ রাগ ওর। রেগে গেলে কনট্রোল করতে পারে না। ওর রাগের মাত্রা এতটা ভয়াবহ তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’
-‘ঠিক আছে মেনে নিলাম। আর তোর বোন কি? কোনো গুন আছে তোর বোনের? তার কি রাগ জেদ কম? পড়াশোনায় ভালো? ভালো রেজাল্ট? চেহারা সুরুৎ সুন্দর হলেই হয় না৷ গুন থাকা লাগে। যার গুন আছে তার চেহারা সুরৎ ভালো না হলেও সে পড়ে থাকে না। আর যার গুন নাই সে আহামরি সুন্দর হলেও সংসার টেকাতে পারে না। আমি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি হয়তো কিন্তু আমার মনে হয় কুহুর মতো পাজিকে একমাত্র রিদওয়ানই সামলাতে পারবে। আমি তোকে জানালাম শুধু। তুইও ভেবে
দেখ।’
-‘এজন্যই কি জোর করে ওকে হোটেল থেকে বাসায় এনেছিলে?’
-‘না। ভালোবেসেই এনেছি। আর এসব চিন্তা করেছি কিছুক্ষণ আগে।
কুহু আর সে বাসা একা আছে এটা নিয়ে টেনশন করব বলে রিদওয়ান কি বলেছে জানিস? বলেছে আমরা বাসায় না ফেরা অবধি যেন কলে থাকে। কথাটা শুনে আমি নিজেও অবাক হয়েছিলাম। পরে আমি যখন বারণ করি তখন কি করল জানিস? প্রতি ঘন্টায় কুহুর আপডেট দিচ্ছে আমায়। ছেলেটা ভালো না হলে এমন করতো?’
-‘কিন্তু ওকে বলবো কিভাবে আমি? আর কি বা বলব’ বন্ধু তুই আমার বোনকে বিয়ে কর।’ এটা বলা যায়?
-‘তা বলবি কেন? এসব কিছু বলতে হবে না। যদি দেখি রিদওয়ান নিজে আগ্রহী তবেই আমরা এগোবো। এখন শুধু তোকে জানিয়ে রাখলাম যে ছেলেটাকে আমি মেয়ে জামাই করতে ইচ্ছুক।’
-‘রিদওয়ান আর তোমার মেয়ের কোপাকুপি সম্পর্ক। তোমার মেয়ে পারে না রিদওয়ানকে খুন করতে। আর তুমি বলছো তাকে মেয়ে জামাই বানাবা। আর তুমি বলবা আর তোমার মেয়ে সুরসুর করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে। এত সোজা?’
-‘ বলছি মানে এই তো যে তাকেই মেয়ে জামাই বানাব।’

রুপক আর জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ আগে একটা নার্স এসে হিপের উপর একটা
ইনজেকশন দিয়ে গেল। বলে গেল ব্যথা কমে যাবে। কই কমছে না তো।
এই জ্বালাপোড়া কখন থামবে? চিনচিনে ব্যথাতে পা নড়ানোই যাচ্ছে না।
নার্সটাকে কি আবার ডেকে আনাবে? এলে কি বলবে, ব্যথা কমছে না? একথা বললে যদি আবার হিপের উপরে ইনজেকশন দেয়? বার বার কাউকে হিপের দেখানোর মতো বেশরম হয়নি এখনো সে। তখন লজ্জা পেয়েছিল ভীষণ। আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করানোর ইচ্ছে নেই তার। এরচেয়ে চুপ করে কাঠ মেরে পড়ে থাকা উত্তম।

কুহু বাজার থেকে ফিরে ধপ করে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পড়ল। যেন বাজারের ব্যাগগুলো সেই টেনে এনেছে৷ এনার্জি লস হয়ে এমন নেতিয়ে পড়েছে। রিদওয়ান দুইহাতে থাকা ব্যাগগুলো রান্নাঘরে রেখে এলো। সে নিজেও ঘেমে নেমে একাকার। বাইরে যা রোদ। না ঘেমে উপায় আছে?
আগে ফ্রেশ হওয়ার দরকার। একথা ভেবে সে ফ্রেশ হতে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে দেখে কুহু মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বসেছে। গপগপ করে মিষ্টি মুখে পুরছে। টিভিতে সিরিয়াল চলছে। গতরাতে দেখতে পায় নি তাই পূর্ণপ্রচার দেখছে। রিদওয়ান দাঁড়াল না ভদ্রভাবে রান্নাঘরে চলে গেল। এই পাগলকে না ক্ষ্যাপানোই উত্তম। যা করছে করুক। করে তাও স্থির থাকুক। সে সবজিগুলো আগে গুছিয়ে নিলো। তারপর কেটে আনা মাছের তাকিয়ে ভাবল, মাছ রান্না করবে মাংস? এই বাসার আসার পর সে খেয়াল করেছে কুহু মাছ খায় না। তার পাতে মাছ তুলে দিলে বাহানা শুরু করে। এককাজ করা যাক কুহুকেই জিজ্ঞাসা করা যাক। সে যেটা বলবে সেটাই রান্না করবে। রিদওয়ান এসব ভেবে সরল মনে ড্রয়িংরুমে গেল। কুহু টিভির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। হিরো আর হিরোইন খুব কাছাকাছি। ঠোঁট ছুঁই ছুঁই অবস্থা। রোমান্টিক গানের টোন বাজছে। সে বিরক্ত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তারপর জিজ্ঞাসা করল,
-‘লাঞ্চে কি খাবে? মাছ নাকি মাংস?’
-‘উম ক কি..স।
-‘হুয়াট!’
কারো উচ্চকন্ঠে বলা ‘হুয়াট’ শব্দ শুনে কুহু অবাক হয়ে তাকাল। টিভিতে তখন পুরোদমে লিপকিস চলছে। এই লোক আবার কখন এসে দাঁড়াল?
সে মুখ কাঁচুমাচু করে রিমোট খুঁজতে লাগল। খুঁজে পেলে ঠিকই কিন্তু চড় থাপ্পড় মেরেও রিমোটে কাজ করল না। এ কোন জ্বালা! সে বিব্রত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে রিমোটে আরো দুটো থাপ্পড় লাগিয়ে টিভি কোনোমতে বন্ধ করল। তখন রিদওয়ান ভ্রুঁ কুচকে বলল,
-‘লাঞ্চে কি খাবে? কিস?’
-‘না, না, কিস না, মিসমিস।’
-‘মিসমিস? এটা আবার কি?’
-‘মিসমিস না ইয়ে মানে কিসমিস! তখন এটাই বলতেই চেয়েছি, হে হে। ‘
-‘লাঞ্চে শুধু কিসমিস খাবে? আর কিছু না?’
-‘আপ না মানে আমি স..ব সব খাই। সমস্যা নেই। যা ইচ্ছে রান্না করুন।’
-‘ওকে।’
রিদওয়ান আবার চলে গেল রান্নাঘরে। তারপর মাংস রেখে মাছ ফ্রিজে তুলে রাখল। সবজি কেটে রাখল। তখন গুঁটি গুঁটি পায়ে কুহু এসে এক কোণে দাঁড়াল। তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে জিজ্ঞাসা করল,
-‘আমি হেল্প করি?’
-‘করো।’
-‘ রাইসকুকারে ভাত বসিয়ে দেই?’
-‘দাও।’
কুহু রাইস কুকারে ভাত বসিয়ে দিলো। পেঁয়াজ কেটে দিলো। রিদওয়ান মাংসের মশলা রেডি করতে করতে আড়চোখে তাকাল। তারপর মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলল,
-‘সাফিক্স পিফিক্স পারো?’
-‘একটু একটু।’
-‘তাহলে বলো, ‘লাভ’ এর সাফিক্স কি হবে?’
-‘এটা পারি আমি। কিন্তু এখন পেটে আসছে মুখে আসছে না।’
-‘ওহ আচ্ছা। রোমান্স তো ভালোই বুঝো। দিনরাত ড্যাবড্যাব করে ওসব দেখো। ‘রোমান্স’ এর পিফিক্স পারবে নিশ্চয়ই, তাহলে বলো শুনি।’
-‘স্যার থুরি রিদ ভাইয়া আমার ফোন বাজছে। আমি আসছি।’

একথা বলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আসলে ফোন টোন কিছু বাজছে না। পালানোর অজুহাত মাত্র। ওকে পালাতে দেখে রিদওয়ান ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে এসএসসি পাশ করল কিভাবে ভেবে পায় না সে। তারপর রান্নার কাজে মন দিলো। রুপককে কল করে খোঁজ খবর নিলো।

মজনু মিয়ার চায়ের দোকানে চলছে জরুরি আলোচনা। আলোচনার মধ্যেমণি স্বপন। পাড়ার টোকাই মাস্তান। বড় বড় চুলে পেছনে মোরগ ঝুঁটি করা। মোরগ ঝুঁটি নাম ফেলেছে কুহু। কারণ মোরগের লেজেও নাকি এমন ঝুঁটি থাকে। স্বপনের গলায় চেইন। চেইনের সঙ্গে ঝুলছে একটা ব্লেড। ব্লেড ঝুলানোর কারণ সেটা মুখে নিয়ে ভাব নেওয়া যায়।
এতে নাকি গ্যাংস্টার গ্যাংস্টার ফিল আসে। আসলে গ্যাংস্টার দূর তাকে দেখতে তখন মদন মদন লাগে। তার সব শার্টের রং কালো। কারণ সে ব্ল্যাক লাভার। ব্ল্যাক হচ্ছে রাজকীয় রং। যারা ব্ল্যাক লাভার তারা নাকি
উদার মনের হয়। দেশ সামলানোর ক্ষমতা রাখে৷ এজন্য আগে আকাশি রং পছন্দ করলেও বর্তমানে সে খাঁটি ব্ল্যাক লাভার। পায়ের জুতো থেকে শুরু করে ফুটপাত থেকে কেনা হাতের আংটিটাও কালো। এমনিতে সে দেখতেও কালো, পরেও কালো। কালো মানুষ কালো পরতে পারবে না এমন কোনো বিধান নেই। তবে মার্জিত ভাব থাকা প্রয়োজন। তার মধ্যে সেটা কখনো দেখা যায় নি। তার শার্টের বোতাম সব সময় থাকে খোলা। তাও একটা না, উপরে তিনটে বোতামই খোলা। হাঁটলে বা বসলে খোলা শার্টের ফাঁকে দেখা যায় তার বুকের হাঁড় গুলো। দেখতে গাঁজাখোরের মতোই লাগে। টি-শার্ট পরলে টেনে বড় করে। দেখে মনে হয় মেয়েদের টপস্ পরেছে। তো সে এখন তার মহামূল্যবান ভাষণ পেশ করছে,

-‘আমাগো পাড়ার মাইয়া কুহু। হেরে চক্ষের সামনে বড় হইতে দেখছি।
হেই এহন ডাঙ্গর মাইয়া। পাড়ার এক নাম্বার সুন্দরী। ভদ্র। ও শিক্ষিত।
ওরে ভালোবাসার প্রস্তাব দিসি এর ওর মাধ্যমে। হেতি গ্রহন করে নাই। এই নিয়ে আমার মুৃনে দুঃখও নাই। কিন্তু আমাগো চক্ষের সামনে থাকা খাওন অন্য কেউ থাবা বসাবে মানুম না আমরা। এহন আমরা কুহু গো বাসায় যামু। বাসার ভিত্রে ঢুকমু। ওই ছোকড়া আর কুহু সুন্দরী যেমন অবস্থাতেই থাকুক ওগোরে একলগে কইরা আমি চিৎকুর দিমু। লোক জড়ো করুম। কমু হেরা আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়ছে। আমি নিজে দেখছি। তখন তরাও আমার লগে তাল মিলাবি।’

To be continue……!!

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here