রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা #পার্ট_২ জাওয়াদ জামী জামী

0
260

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_২
জাওয়াদ জামী জামী

” সরি ভাইয়া, ওর ওপর রাগ করবেননা। ও বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা এত গভীর। আসলে আশফি একটু জনদরদী টাইপের। এই ভাইয়াকে সরি বল। ” তিয়াসা আশফির হাত ধরে একে পুলকের কাছে নিয়ে গিয়ে নিজেও সরি বলল, আবার আশফিকেও সরি বলতে বলল।

তিয়াসার কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে আশফির পাঁজর জ্বলে যাচ্ছে। তবুও সে আপাতত ঐদিকে নজর দিলনা। মুখ কাঁচুমাচু করে তাকালো পুলকের দিকে।

” সরি ভাইয়া, আমি বুঝতে পারিনি আপনি এই হতভাগা রেপিস্টকে ক্যালাচ্ছিলেন। আমি জানলে রাস্তায়ই একে দু ঘা দিতাম। আ… ” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল আশফি। কিন্তু আবারও তিয়াসার কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে ওকে থামতে হয়।

” সরি এগেইন, ভাইয়া। এই মেয়েটা কিসব বলে সেটা ও নিজেও জানেনা। এই ঠিকঠাক সরি বলবি ভাইয়াকে? ” তিয়াসা ভয় পাচ্ছে যদি পুলক মির্জা আশফির ওপর রেগে যায় তবে ওর কপালে দুঃখ আছে।

পরেরবার তিয়াসার গুঁতো খেয়ে আশফির টনক নড়ে। ও বুঝতে পারল তিয়াসার বারবার সরি বলতে বলার পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারন আছে।

” স.. সরি, ভাইয়া। আর কখনোই এমন উজবুকের মত কাজ করবনা। ”

পুলক মির্জা আশফির কথায় পাত্তা না দিয়ে তিয়াসার দিকে তাকালো।

” কোন কলেজে পড়াশোনা করেন, ম্যাম? কোন সাব্জেক্ট, কোন ইয়ার? ”

” এন জি কলেজে ইকনোমিকস সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি আমরা দু’জনেই। ”

” ওহ্। আপনাদের বাসা কোথায়? ”

” ফুলতলা গ্রামের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? আমাদের বাড়ি সেখানেই। আমরা চাচাতো বোন। ”

” গুড। শাহেদ ইনাদের রিক্সা ঠিক করে দে। ওর সাথে যান আপনারা। ” পুলক মির্জার কথা শুনে তিয়াসা হাঁফ ছাড়ল। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে আজকে। ওরা আর দেরি না করে ইমারজেন্সী থেকে বেরিয়ে যায়।

” ভাই, এটা কি হল! আপনি ঐ মেয়েদের যেতে বললেন কেন? ঐ মেয়েটা শাহেদ ভাইকে থাপ্পড় মারল, আপনাকেও দু-চার কথা শুনিয়ে দিল। ওকে এমনিতেই ছেড়ে দিলেন! ”

দলের একজন এগিয়ে এসে পুলক মির্জার কাছে অভিযোগ জানাল। কিন্তু সাথে সাথেই ছেলেটা নিজের ডান গালে তীক্ষ্ণ জ্বলুনি টের পেল। ওর কানে শুধু ‘ ঠাস ‘ শব্দই গেছে। পরে তীক্ষ্ণ জ্বলুনি টের পেয়ে বুঝল পুলক মির্জা ওর গালে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় মেরেছে। বেচারা হতভম্ব হয়ে তাকায় তার অতিপ্রিয় দলনেতা ভাইয়ের দিকে।
ততক্ষণে পুলক মির্জা ছেলেটার কলার ঠিক করে দিয়ে ওর গালে হাত বুলিয়ে দেয়। এরপর ওর চুল ঠিক করে দিয়ে বলল,

” আরে বোকা, ভাবীর সম্পর্কে এই ধরনের কথা কেউ বলে? ঐ দু’জনের একজন তোদের ভাবী আর একজন তোদের বেয়ান। এখন থেকে তাদের খেয়াল রাখার দ্বায়িত্ব তোদের। ভাবীকে সম্মান করবি বুঝলি। ”

প্রিয় ভাইয়ের কথা শুনে ছেলেটার মুখে হাসি ফুটল। ওর হতভম্ব ভাবও কেটে গেছে।

” ভাই, দু’জনের মধ্যে কোনটা আমাদের ভাবী? ”

” যে শাহেদকে থাপ্পড় মেরেছে সে-ই। ” গাল চুলকে হাসিমুখে বলল পুলক।

” জি ও ভাই, জি ও। অবশেষে আমরা ভাবী পেয়েই গেলাম। কালকে থেকে দেখবেন ভাবীর সম্মান কাকে বলে। ” দলের বাকি ছেলেরা হৈ হৈ করে এগিয়ে এসে পুলককে কাঁধে তুলল।

ডক্টরসহ ইমারজেন্সীতে দ্বায়িত্বরত সকলে একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এ কোন বিপদের সম্মুখীন হলো তারা। রুগীকে নিয়ে কি করবে সেটা তাদের ভাবাচ্ছে।

” রুগীর কি করব? এর চিকিৎসার দরকার। ” ডক্টর পুলক মির্জার দিকে এগিয়ে এসে বললেন।

” ডক্টর, এর প্রাথমিক চিকিৎসা বোধহয় কিছুটা হয়েছে? এবার একে আমার হাতে ছেড়ে দিন। আপনার বউমা এসে পরায় এর আপ্যায়ন ঠিকঠাক করতে পারিনি। এদিকে আমার হাত-পা নিসপিস করছে। ”

ডক্টর কিছু না বলে চুপচাপ থাকলেন। পুলক মির্জা বাম ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে ডক্টরের দিকে। ও ডক্টরের মন পড়ার চেষ্টা করছে। কয়েক সেকেন্ড পর পুলক মির্জা হাসিমুখে এগিয়ে যায় ডক্টরের কাছে।

” কোন ভয় নেই, ডক্টর। আপনার কিছুই হবেনা। কেউ আপনার দিকে আঙুল তোলার সাহস পাবেনা। ”

ডক্টর আর ভাবলেননা। তিনি রুগীকে ছেড়ে দিলেন।

পুরো রাস্তা তিয়াসা আশফিকে গালি দিতে দিতে গেল। ওদের প্রথম ক্লাস মিস হয়ে গেছে। পরের ক্লাসগুলো কোনরকম শেষ করে বাড়িতে ফিরল। আশফির অনুরোধে তিয়াসা বাড়িতে কিছুই বললনা।

পরদিন ওরা কলেজের পথে রওনা দিল। বাড়ি থেকে বেরিয়েই ওরা দেখল একটা অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন ওদের পনের মিনিট হাঁটতে হয় তবেই রিক্সা অথবা অটোরিকশা পায়।কিন্তু আজ ওদের ভাগ্য ভালো। ভ্যাপসা গরমে পনের মিনিট রাস্তা হাঁটতে হলোনা।

” মামা, যাবেন? এন জি কলেজে যাব। ”

” হ যামু। উঠেন। ”

” কত নিবেন? ” তিয়াসাই কথা বলছে অটোওয়ালার সাথে। কারন আশফি এসব করতে গেলে ঠকে যায়।

” যা ভাড়া তাই দিয়েন। ”

” এখান থেকে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া হয় কিন্তু। পরে আবার ঝামেলা করবেননা বলে দিলাম। ”

” আমারে কি পাগলে কামড়াইছে যে ভাড়া নিয়া আপনাদের সাথে ঝামেলা করমু! উঠেন পৌঁছায় দিয়া আসি। ”

ওরা ফুলতলা গ্রামের ছোট্ট বাজার অতিক্রম করতেই একটা বাইক ওদের অটোরিকশার পাশে চলতে থাকল। তিয়াসা কপাল কুঁচকে তাকায় বাইকের আরোহীর দিকে। কিন্তু ওদের মাথায় হেলমেট থাকায় চেহারা দেখতে পায়না।

” আসসালামু আলাইকুম ভাবী। ভালো আছেন? নিশ্চিন্তে কলেজে যান, আমরা আপনার পাশেই আছি। ” বাইকের পেছনের আরোহী হেলমেট খুলে আশফির দিকে তাকিয়ে বলল।

ছেলেটার কথা শুনে আশফির মাথা গরম হয়ে গেছে। ও ছেলেটাকে দেখেই চিনতে পেরেছে। গতকাল এরাই মারছিল রেপিস্ট লোকটাকে। একে দেখেই রাগে কান গরম হয়ে গেছে আশফির।

” ঐ চামচিকে, কিসের ভাবী? কে ভাবী? কার ভাবী? ”

” আপনি ভাবী। মনে আমাদের বড় ভাইয়ের ভাবী। আপনি ভালো আছেন, বেয়ান? ” ছেলেটা আশফির সাথে কথা বলে তাকায় তিয়াসার দিকে।

” ঐ চামচিকে, কি বললেন? আমি আপনারও ভাবি আবার আপনার বড় ভাইয়েরও ভাবী! আপনার বড় ভাইয়েরও যদি ভাবী হই, তবে আমার ভাগ্যবান জামাইটি কে? আপনার বাপের বাপ বুঝি? যাকে আপনি ভাই বলে ডাকেন? ” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল আশফি।

এদিকে তিয়াসা যা বোঝার বুঝে গেছে। ও আশফির হাত চেপে ধরে ওকে কথা বলতে নিষেধ করছে। কিন্তু আশফি সেটা বুঝতে পারলে তো।

” ছিহ্ ভাবী, এসব কি বলছেন! আমার বাপের বাপ সেই কবেই টপকেছে। আপনি আমার বড় ভাইয়ের হবু বউ মানে আমাদের ভাবী। ”

” প্লিজ ভাইয়া, আমাদের যেতে দিন। আমরা এই গ্রামের মেয়ে। এভাবে রাস্তার মধ্যে আপনার সাথে কথা বলতে দেখলে গ্রামের মানুষজন খারাপ ভাববে। ” তিয়াসার অনুরোধে ছেলেদুটো বাইক ছুটিয়ে চলে গেল।

” দেখলিতো তোর মানবসেবার ফলাফল? তোর একদিনের মানবসেবার প্রভাব আমাদের ওপর পরেছে কিভাবে দেখলি? আমি ডিরেক্ট বেয়ান আর তুই ভাবী হয়ে গেছিস। এতকিছুর পরও তুই ওদের সাথে ঐভাবে কথা বলছিলিস কেন? তোর কি শিক্ষা কোনদিনও হবেনা? ” ছেলেদুটো চলে যেতেই তিয়াসা আশফির ওপর রেগে উঠল। ও ভবিষ্যতে কি হবে সেটা ভেবে ভয় পাচ্ছে।

” আমি কি বেশি কিছু বলেছি! আমিতো শুধু জানতে চেয়েছি ভাইটা কে। সেটা জানার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে। হুদাই যে কেউ এসে আমাকে ভাবী ডাকবে সেটাতো হতে দিতে পারিনা। আমাকেতো জানতেই হবে সেই ভাইটা কোন হ্যাবলা-ছ্যাবলা নাকি স্মার্ট। ” আশফি মুখ ভার করে বলল।

” গাধী, তুই এখনও বুঝিসনি ওরা কার কথা বলছে! ওরা মেয়রের ছেলের জন্য তোকে ভাবী ডাকছে। এরপর তোকে ওরা ভাবী ডাকলে তুইও ওদের দেওরা ডেকে ঋণ শোধ করিস। তুই যে এত গাধী হবি সেটা যদি ছোট চাচী আগে জানত, আমি নিশ্চিত তোর পড়াশোনা না করে এতদিন অন্যের হেঁসেল সামলাতে হতো। ” তিয়াসার রাগ কিছুতেই কমছেনা।

” ঐ তিয়ু, মেয়রের ছেলে খুব খারাপ তাইনা? সত্যিই কি ও আমাদের পিছু নিয়েছে? এবার আমাদের কি হবে? ” আশফি এবার একটু ভয় পাচ্ছে।

” আমাদের নয় বল তোর পিছু নিয়েছে। না বুঝে কাজ করার ফলাফল দেখ। প্রতিদিনই তোকে কত বোঝাই, কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবিনা কারো উপকার করতে যাবিনা। কিন্তু তুই কখনো শুনেছিস আমার কথা? ”

তিয়াসার রাগ দেখে আশফি চুপসে গেছে।

” আর এমন ভুল করবনা। ” শুধু এতটুকুই বলল।

ওরা শহরে প্রবেশ করতেই আবারও একটা বাইক ওদের অটোরিকশার পাশাপাশি চলতে শুরু করল।

” স্লামালেকুম ভাবী। কেমন আছেন? রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নিতো? ”

আশফি তিয়াসা তার কথার উত্তর না দিয়ে নিরব থাকল।

কলেজের গেইটে অটোরিকশা থামলে ওরা নেমে আসে। অটোরিকশা থেকে নামতেই ওরা স্তব্ধ হয়ে যায়। পুলক মির্জা ও তার বাহিনী অদূরেই বসে আড্ডা দিচ্ছে।

ওদের দেখে কয়েকজন একযোগে ওদের সালাম দিল।

” আসসালামু আলাইকুম, ভাবী। আপনার কোন চিন্তা নেই, আপনার দেখভালের জন্য আমরা সর্বদাই এখনে আছি। ”

আশফি ওদের কথা পাত্তা না দিয়ে তাকালো চেয়ারে বসে থাকা পুলক মির্জার দিকে। সে অবশ্য অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ওর সাঙ্গপাঙ্গরা যে আশফিদের টিজ করছে সেটা যেন সে শুনতেই পায়নি। তাদের প্রত্যেকের হাতে সফ্ট ড্রিংকসের বোতল। পুলক মির্জা নিশ্চিত মনে বোতলে চুমুক দিচ্ছে।

আশফি এই প্রথম পুলক মির্জার দিকে তাকাল। কালো টি-শার্ট আর জিন্স পরিধান করে আছে সে। চোখে কালো সানগ্লাস। ঝিরিঝিরি বাতাসে তার সিল্কি চুল এলোমেলো হতেই সে একটু পরপর হাত দিয়ে ঠিক করছে। আশফি শুধু তার একপাশ দেখতে পাচ্ছে। এতেই সে বুঝতে পারছে ছেলেটা বেশ ফর্সা। আর দেখতেও খারাপ নয়। তবে এই মুহুর্তে আশফির মন-মেজাজ প্রচন্ড রকমের খারাপ থাকায় পুলক মির্জার সৌন্দর্য ওর চোখে ধরা দিলনা।

কলেজে ঢুকতেই ওরা আরেকবার ঝটকা খায়। কলেজের প্রায় সব ছেলেরাই আশফিকে ভাবী বলে সম্মোধন করছে। গতকাল পর্যন্ত যারা ওর পিছুপিছু ঘুরত তারাও আশফিকে ভাবী ডাকছে। বিরক্তিতে আশফির কান্না পাচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here