#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪
জাওয়াদ জামী জামী
পরদিন আশফি তিয়াসা কলেজে গেলোনা। হঠাৎই তিয়াসার শরীর খারাপ হওয়ায় ও যেতে পারলনা, তাই আশফিও গেলোনা। আসলে এই মুহুর্তে ওর কলেজে একা যাওয়ার সাহস নেই।
পুলক ওর দলবল নিয়ে কলেজের সামনে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কিন্তু আশফিকে না দেখে ফিরে গেল জেলা অডিটোরিয়ামে। যেখানে তার বাবার প্রোগ্রাম আছে।
অডিটোরিয়ামের বাহিরে পুলকের ছেলেরা দাঁড়িয়ে চারপাশে লক্ষ্য রাখছে। পুলক আছে ওর বাবার সাথে। পুলকের কাছে খবর আছে, আজকে কেউ ওর বাবাকে আক্রমন করতে পারে।
অডিটোরিয়াম ভর্তি লোকজন। আতিক মির্জা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। পুলত ওর বাবার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই ওর বেজে উঠল। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখল শাহেদের নাম।
” হ্যাঁ, বল। ”
” ভাই, বাইরে এসো। ” পুলক কিছু না বলে ফোন কেটে দিল। যাওয়ার আগে দু’জন গানম্যান আর সিকিউরিটিকে ভালোভাবে খেয়াল রাখতে বলল।
ও বাহিরে এসে দেখল, শাহেদ একজনের কলার ধরে রেখেছে। লোকটার দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পারল পুলক।
” তুই এক্স মেয়র ইমদাদুল এর ডান হাত, তাইতো? তোর নাম শফিক। এখানে কি কাজ তোর? ” শাহেদের হাত সরিয়ে দিয়ে পুলক লোকটার কলার ধরল।
” আমি অনুষ্ঠান দেখতে আসছি। ” শফিক ভয়ে ভয়ে জবাব দিল।
” ভাই, শালায় মিথ্যা বলছে। ওর কাছে মেশিন পাইছি, বেরেটা এম নাইন। এইযে দেখ। ” শাহেদ একটা পিস্তল বের করল।
” এইখানে কি মেশিনের শো অফ চলছে, যে তুই এইটা নিয়ে আসছিস? তুই অনুষ্ঠান দেখতে আসছিস ভালো কথা। কিন্তু সাথে মেশিন কেন? ” পুলক ঠান্ডা চোখে তাকায় শফিকের দিকে। রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। বুনো রাগ প্রকাশ পাচ্ছে চোখে।
পুলকের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঢোক গিলল শফিক। ও বুঝতে পারছে একমাত্র ক্ষমাই তাকে বাঁচাতে পারে পুলকের হাত থেকে। ও দেরি না করে পুলকের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পরল।
” ভাই, আমার ভুল হইছে। আমারে মাফ করেন। এমন ভুল আর ভবিষ্যতে হবেনা। ”
” না বুঝে ভুল করলে তার ক্ষমা হয়। কিন্তু জেনে-বুঝে ভুল করলে তার ক্ষমা আমার ডিকশনারিতে নেই। ” পুলক এক লাথিতে শফিককে ফেলে দেয়। এরপর ওর দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” বাপ্পি, তুই একে আমাদের বাগানবাড়িতে নিয়ে যা। দেখিস আপ্যায়নের যেন কোন ত্রুটি না থাকে। স্পেশাল মেহমান বলে কথা। ”
” আচ্ছা, ভাই। ” বাপ্পি নামের ছেলেটি শফিককে নিয়ে পুলকের জীপে উঠল। তার সাথে আরও চারজন জীপে উঠল। শফিকের হাজারও আকুতি ওদের কানে পৌঁছালনা।
জীপ নিয়ে ওরা বেরিয়ে যেতেই শাহেদ এগিয়ে আসল পুলকের কাছে।
” ভাই, আশেপাশের অনেকেই শফিককে নিয়ে যেতে দেখল। এই খবর ইমদাদুল এর কানে পৌঁছাতে দেরি লাগবেনা। ”
” লোকজনের দেখার ভয় আমি করিনা। আর ইমদাদুলকে নিয়ে চিন্তার কিছুই নেই। ঐ শালাকে আমি-ই ফোন দিয়ে ওর পেয়ারের শফিকের খবর জানাব। তুই এদিকে ভালো করে নজর রাখ। ” পুলক অডিটোরিয়ামের দিকে যেতে যেতে পকেট থেকে ফোন বের করল। শাহেদ বুঝতে পারছে পুলক এখন ইমদাদুলকেই ফোন দেবে।
” আশফি, এই আশফি, ম’র’লি নাকি? অপদার্থ ছেমরি। কাজের বেলায় নাই। সারাদিন খালি ধেই ধেই কইরা উইড়া বেড়াইতে দিলে ভালো। ” উঠান ঝাড়ু দিতে দিতে আশফিকে গালি দিচ্ছে রিনা আক্তার।
মা’য়ের রাগী কন্ঠস্বর কানে যেতেই চাচার বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসল আশফি।
” এইতো আম্মা আমি এসেছি। ” হাঁপাচ্ছে আশফি।
” খুব কামাই করছ আইসা। রাতের খাবার বানান লাগবেনা? আমারে কি তর বাপের দাসী মনে হয়? সারাজীবন তোগোর রাইন্ধাই খাওয়ামু? সংসারের সব কামডি কইরা, আবার রাবনের বংশধরগো জন্য হাঁড়ি ভর্তি খাওয়ার রান্ধনের চুক্তি নিয়া আইছি এই বাড়িতে, তাইনা? ” রিনা আক্তার তেড়ে আসল আশফির দিকে।
” আমিই রান্না করব, আম্মা। কি রান্না করব বলে দাও। তুমি ঘরে যাও, রান্না শেষ করে আমি উঠান ঝাড়ু দেব। ”
” মাছের ঝোল, লালশাক ভাজি আর ডাল ভর্তা কর। তোর জমিদার ভাইয়ের আবার এক তরকারি হইলে গলা দিয়া ভাত নামেনা। এই রাবনের বংশধরগোর খাবার জোগান দিতে গিয়া বাপে যে ফকির হইতাছে সেদিকে কারো নজর নাই। ” হাতের ঝাঁটা উঠানে আছড়ে ফেলে কলপাড়ের দিকে হাঁটা ধরল রিনা আক্তার।
গমনরত মা’য়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আশফি। আট বছর বয়স থেকেই প্রতিনিয়ত এমন কটুক্তি হজম করে দিনাতিপাত করছে মেয়েটা। আজকাল আর চোখে পানিও আসেনা। বাবার কাছে কোন অভিযোগও করা হয়না। অভিযোগেরাও বুঝে গেছে এই বোকা মেয়েটার অভিযোগ, অভিমানের কোন মূল্য নেই বাবার কাছে। তাই অভিযোগ নিজের খাতা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছে।
রান্না শেষ করে বাড়ি-উঠান ঝাড়ু দিয়ে উঠতেই মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত হল। ঘেমে-নেয়ে একাকার আশফি কাপড় নিয়ে কলপাড়ে যায়। গোসল না করলেই নয়। তিয়াসা অসুস্থ থাকায় আজকে সব কাজ ওকে একাই করতে হয়েছে। নয়তো তিয়াসা থাকলে ওকে সাহায্য করত।
” আব্বা, আমি কাল ঢাকা যাব। কয়েকটা প্রতিষ্ঠানে এ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম। শুক্রবার পরীক্ষা আছে। ” রাতে খাবার সময় আশফির ভাই রিফাত ওর বাবা’কে বলল।
” এভাবে আর কতদিন পরীক্ষা দিয়ে কাটাবে? চাকরিতো হয়না। এদিকে আমারই একজন ছাত্র এবার বিসিএসে টিকেছে। কিন্তু আমার ছেলে হয়ে তোমাকে চাকরির পরীক্ষা দিয়েই যেত হচ্ছে। তারপরও যখন যেতে চাচ্ছ, যাও। ”
” ঠিকই বলেছ। শুধু চাকরির পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু কিছুই হচ্ছেনা। তোমার ছাত্রের মত কপালতো আমার নয়। ক্লাস টেন থেকে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেকেই বহন করতে হচ্ছে। এখনও কোচিং করিয়ে দুই ভাইবোনের খরচ চালাচ্ছি। তোমার ছাত্রদের শুধু পড়াশোনার চিন্তা করলেই চলে। কিন্তু আমার নিজের পাশাপাশি বোনেরও চিন্তা করতে হয়। আমাদের দু’জনে খরচও জোগাতে হয়। এতসব চিন্তার মাঝে পড়াশোনা আর হয় কই। ” রিফাত খেতে খেতে কথা বলছে।
” দেখছ তুমি, তোমার ছেলের সাহস কত! বাপে যদি খরচ নাই দিত তবে দুনিয়ায় এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কইয়া চলবার পারত? এতবড় হইছে তাও তার সব খরচ বাপেরই দেওয়া লাগব? বাপের তো আর ছেলেমেয়ে নাই। তারাই সব গ্রাস করব। বাপের লাইগা দুনিয়ায় আসছে, বাপেই খাওয়াইছে, পড়াইছে তা-ও বাপেই খারাপ। বেইমানের ঘরের বেইমান। ”
” ভুল বললে তুমি, ছোটমা। আব্বা জন্ম দিয়েছে, বড় করেছে ঠিকই। কিন্তু সেটা ক্রাস নাইন পর্যন্ত। ক্লাস টেন থেকে নিজের সব খরচ নিজেই বহন করছি। আর সেই সাথে আশফির সব খরচও আমিই দেই। তাই আমাদের মানুষ করার পেছনে, বড় করার পেছনে আব্বা’র অবদান আছে এটা তোমার ভুল ধারনা। হ্যাঁ, আব্বা একটা উপকার আমাদের করেছে, সেটা হলো তার বাড়িতে আমাদের থাকতে দিয়েছে। অবশ্য তার সন্তান হিসেবে এতটুকু অধিকার আমাদের আছে। তাইনা, আব্বা? ” রিফাতের এমন প্রশ্নে মাথা নিচু করল তার বাবা আফজাল হোসেন। ছেলের এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই।
” ভাইয়া, কথা না বলে খাওতো। তুমি কাল কখন যাবে? আমি কি তোমার জন্য রুটি করে দেব? তুমিতো আবার টাকা বাঁচাতে গিয়ে কিছুই খাওনা। ” আশফি চাচ্ছেনা কথা বাড়ুক। ওর আর এসব ভালো লাগেনা।
” ঘরে যতটুকু ময়দা আছে, ঐগুলা পিয়াসের জন্য রাখছি। আমার ছেলেটা পরোটা খাইতে চায় তুই জানিসনা? আবার পৃথায় ও কইছে সে পরোটা খাইব। ” রিনা আক্তার আশফির কথার মাঝেই খেঁকিয়ে উঠল।
” আশফি, আমি যে আজ ময়দা, চিনি, লবন, ডালসহ আরও জিনিসপত্র এনেছি সেগুলো দেখাসনি ছোটমাকে? ”
” আমি সেসব রান্নাঘরেই রেখেছি। আম্মাকে এখনও বলিনি। ”
” আব্বা, আমি পুরো মাসের বাজার এনেছি। আশা করছি আগামী মাস সেগুলো দিয়েই আমাদের দুই ভাইবোনের হয়ে যাবে। ” রিফাত তীক্ষ্ণ গলায় বলল।
” রিফাত, তোমার এত জেদ কিসের সেটা আমি বুঝিনা। মা হয়ে ছেলেমেয়েদের একটুআধটু শাসন রিনা করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তুমি আলাদাভাবে বাজার করবে? একই বাড়িতে দু’জনে বাজার করছি এটা খারাপ দেখায়না? তুমি আর এরপর থেকে বাজার করবেনা। আমি এখনো চাকরি করি। বাপ-দাদার সম্পত্তি পেয়েছি। চার ছেলেমেয়েকে চালানোর মত সামর্থ আমার আছে। ” আফজাল হোসেন ধমকে উঠল।
” তুমি থামবা? যে দিন-দুনিয়া আসছে তাতে তোমার বেতন দিয়া সংসারে টানাটানি যায়না। তার উপর পিয়াস পৃথার পড়াশোনার খরচ। ওগোর শখ-আল্লাদ নাই? তাছাড়া তোমার ঔষধ কিনতে টাকা লাগে। তোমার ধারনা আছে সংসারে কত খরচ হয়? তোমার বড় ছেলের ইনকামে যদি সংসারে একটু উপকার হয় তাতে ক্ষতি কি? আশফিরও তো খরচ কম না। সে ইনকাম করতাছে এতে তোমার উপকার হইতাছে। আর রিফাতে তো আমাগো কিছু দেয়না, ওরা দুই ভাইবোনের খরচ চালায় শুধু। ”
রিনা আক্তারের কথা শুনে রিফাত হাসল। যত দিন যাচ্ছে ছেলেটা ততই মানুষ চিনতে শিখছে। সেই সাথে শিখছে, এই স্বার্থপর দুনিয়ায় চলতে গেলে টাকার কোন বিকল্প নেই। টাকাই সকল সম্পর্কের মাপকাঠি।
” মল্লিকা, মল্লিকা। পুলক বাসায় এসেছে? ” আতিক মির্জা বাসায় ঢুকেই জোড়ে জোড়ে ডাকলেন তার স্ত্রী’কে।
” এত চ্যাঁচাচ্ছ কেন! মাথা এত গরম কেন তোমার? এখানে বস, আমি আইস ব্যাগ নিয়ে আসছি। এটাই তোমার মাথা ঠান্ডা করতে পারবে। ”
” ইয়ার্কি করছ? তোমার ছেলে কোথায়? এতদিন তোমার ছেলে আমার অর্ধেক মাথা খারাপ করে দিয়েছে, এখন তুমি এসেছ পুরোটা খারাপ করতে। এতদিন শুনেছি পুরুষদের মাথা খারাপ করে তার ছেলেমেয়েরা। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে উল্টো ঘটেছে। আমার বউ-ছেলে মিলে আমার মাথা খারাপ করছে। ” আতিক মির্জা দুই হাতে কপালের দু’পাশ চেপে ধরলেন।
” কি করবে বল, সবার ভাগ্যে তো তোমার বউয়ের মত বউ জোটেনা। তাই তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের মাথা খারাপ করে। এবার চুপচাপ বস, আমি কফি নিয়ে আসছি। ” মল্লিকা মির্জা রান্নাঘরের দিকে যেতেই আবারও কথা বললেন আতিক মির্জা।
” তোমার ছেলে কোথায়? ”
” বাসায় আসেনি আমার রাজপুত্র। ”
” এখন রাত এগারোটা বাজে। আর তোমার রাজপুত্র এখনও বাসায় আসেনি? মানতেই হবে দিনদিন তার অধঃপতন বেশ ভালোভাবেই হচ্ছে। সে আজ কি করেছে সেটা তুমি জানো? ”
” কি করেছে? ” মল্লিকা মির্জা চিন্তিত বদনে জিজ্ঞেস করলেন।
” এক্স মেয়র ইমদাদুলের লোককে কিডন্যাপ করেছে। মৌচাকে হাত দিয়েছে তোমার ছেলে। বাগানবাড়িতে খোঁজ নিয়েছি কিন্তু সেখানে ও নেই। তাকে নিয়ে কোথায় গেছে সেটা এখনও জানতে পারিনি। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর যেন খারাপ কিছু না ঘটে। ”
স্বামীর কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পরলেন মল্লিকা মির্জা।
চলবে…