রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা #পার্ট_৯ জাওয়াদ জামী জামী

0
181

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৯
জাওয়াদ জামী জামী

” পুলক, তুমি কি কালকে ফ্রি থাকবে? ” পুলকের সাথে গল্পের এক পর্যায়ে কামরান মির্জা জিজ্ঞেস করলেন। তারা কামরান মির্জার অফিসে বসে কথা বলছিল।

” না চাচ্চু, আমি কাল সকালেই বেরিয়ে যাব। সিটি কর্পোরেশনের মধ্যেই একটা স্পোর্টস ক্লাবের উদ্বোধন করে, এরপর যাব আরেক জায়গায়। সেখানে একটা যুব সংঘের উদ্বোধন করব। বিকেলে মহিলা কলেজের অডিটোয়ামের কিছু উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করব। এরপর টুকিটাকি কিছু কাজ করতে হবে। ”

পুলকের কথা শুনে কামরান মির্জা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন তার ভাতিজার দিকে। তার ভাতিজা এত জনপ্রিয় হয়েছে এটা তিনি জানতেনইনা।

” সাব্বাস। এই না হলে আমার ভাতিজা। চালিয়ে যাও। সামনে তোমাকে আরও উঁচু স্থানে দেখতে চাই। ” কামরান মির্জা ভাতিজার পিঠ চাপড়ে দিলেন।

” স্যার, আপনার সাথে দেখা করতে কয়েকজন এসেছে। আগে থেকেই তাদের সিডিউল নেয়া ছিল। ” কামরান মির্জার সেক্রেটারি এসে বলল।

” পাঠিয়ে দাও। ”

” চাচ্চু, তোমরা কথা বল। আমি এখন আসছি। ”

” ওকে, বেটা। ”

পুলক বেরিয়ে যেতেই কয়েকজন লোক কামরান মির্জার অফিসে ঢুকল। তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করল।

” স্যার, আমরা এসেছি আমাদের গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের একটা অনুষ্ঠানের বিষয়ে কথা বলতে। আসলে প্রতি বছরই আমাদের স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এবারেও হবে। আর সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে আপনাকে আশা করছে গ্রামবাসী। ”

কামরান মির্জা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কথা বললেন।

” কবে অনুষ্ঠান? ”

” আগামী ছাব্বিশ মার্চ। আপনি সেদিন উপস্থিত থাকলে আমার স্কুলের সকল শিক্ষার্থীর মনের আশা পূরণ হতো। তারা আপনার সকল উন্নয়নমূলক কাজ দেখেছে, সুফল ভোগ করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আপনাকে চোখে দেখেনি। এটা ওদের আফসোস। ”

” সেদিনতো আমার নানান জায়গায় যেতে হবে। আচ্ছা আমি যাব। তবে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবনা। বড়জোর আধাঘন্টা থাকতে পারব। ”

” এতেই হবে, স্যার। আমার স্টুডেন্টরা আপনাকে সামনাসামনি দেখতে চায়। আপনি একবার তাদের সামনে গেলেই তারা খুশি হবে। ”

” ওকে, আপনাদের প্রোগ্রাম কখন শুরু হবে, সেটা আমার সেক্রেটারিকে জানিয়ে দিয়েন। সে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবে। ”

” আরেকটা কথা, স্যার। আমরা পুলক ভাইকেও সেই অনুষ্ঠানে নিতে চাই। সে বর্তমান জেনারেশনের কাছে আইডল। তাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে চাচ্ছে ওরা। সে এর আগেও আমাদের স্কুলে গেছে। সেদিন তার আচরণে মুগ্ধ হয়েছিল শিক্ষার্থীরা। তাই আপনার মাধ্যমেই তার সাথে আমরা কথা বলতে চাই। ”

এবারেও অবাক হয়ে গেলেন কামরান মির্জা। তিনি জানতেই পারেননি তার ভাতিজা এখন সমাজে পরিচিত মুখ।

” ও তো এখনই বেরিয়ে গেল। আমি ওকে ফোন করছি। ”

কামরান মির্জা কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখলেন। এরপর আবারও কথা বললেন।

” ও নিজের অফিসেই আছে। আপনারা সেখানেই ওকে পাবেন। কাজ পরে যাওয়ায় এখন ও এখানে আসতে পারছেনা। ”

কামরান মির্জার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে আগন্তুকরা বেরিয়ে যায়।

***

” মল্লিকা, তুমি কি পুষ্পিতাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে যাবে? নাকি আমি গাড়িসহ কাউকে পাঠিয়ে দিব? ” আতিক মির্জা স্ত্রী’কে জিজ্ঞেস করলেন।

” আমি যেতে পারবনা। আমার বড় ভাবী আসতে চেয়েছে। হয়তো সে কালকেই আসবে। বাসায় মেহমান রেখে আমি কিভাবে যাব। তুমি বরং পুলককে বল। ”

” তোমার ছেলে যাবে বলে তোমার মনে হয়? তার নাকি পিছুটান আছে। তার পিছুটানকে একবেলা না দেখলে সে বাঁচতে পারেনা। আরও কত কিছু। ” আতিক মির্জা ব্যাঙ্গ করে বললেন।

” তুমি চুপ করবে? আমার ছেলের পেছনে কাঠি নাড়ার স্বভাব এখনো তোমার গেলোনা! ছেলে বড় হয়েছে, সে কাউকে পছন্দ করতেই পারে। এতে তোমার সমস্যা কোথায়? তুমিওতো প্রেমে পরার পর সারাদিন আমার পেছন পেছন ঘুরঘুর করতে। আমাকে না দেখলে নাকি তোমার ঘুম হতোনা, খেতে পারতেনা। এখন ছেলের বেলায় উল্টো স্বরে কথা বলছ কেন? ” মল্লিকা মির্জা ছেলের বিপক্ষে কোন কথা শুনতে রাজি নন।

স্ত্রী’র কথা শুনে আতিক মির্জার মুখ কালো হয়ে যায়। মনে মনে ভাবলেন, এই মহিলার জন্য কিনা তিনি তিনমাস দেবদাসের মত এদিকওদিক ঘুরেছেন! এই মহিলাকে নিজের করে পেতে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষায় জানপ্রাণ দিয়ে পড়াশোনা করে ফার্ষ্ট ক্লাস অর্জন করেছিলেন! আর এই মহিলাই কিনা সব সময় স্বামীর বিপক্ষে কথা বলে! রাগে নিজের গালে নিজেরই চপেটাঘাত করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু আপাতত তিনি নিজের ইচ্ছেকে দমন করলেন। কারন এতে তার প্রানপ্রিয় স্ত্রী কষ্ট পাবে। আর তিনি কিছুতেই স্ত্রী’কে কষ্ট দিতে চাননা।

” মাফ চাই, ছেলের মা আর আমার শত্রু। তোমার ছেলের বিষয়ে কোন কথাই আমি বলবনা। সে যা খুশি করুক। ”

” কেন ছেলের বিষয়ে কথা বলেবেনা? ও তোমার নিজের ছেলে নয়? তুমি ওর আপন বাবা নও? ছেলের প্রতি কোন দ্বায়িত্ববোধ তোমার নেই? ” মল্লিকা মির্জা খেঁকিয়ে উঠলেন।

” আমি ওর আপন বাবা কিনা, সেটা তুমিই ভালো জানো। তবে মাঝেমধ্যে আমার সন্দেহ যে হয়না এমনটাও নয়। ছেলে সব সময়ই শুধু মা’য়ের হয়েই সাফাই গায়, এটা অবশ্য চিন্তার বিষয় আমার কাছে। বাপকে যেন সে চেনেইনা। ” নিরাপদ দুরত্বে সরে গিয়ে বললেন আতিক মির্জা। কারন তিনি ভালো করেই জানেন এরপর কি হতে চলেছে।

” আতিক্কা রে , তোর কলিজা আমি টেনে ছিঁড়ব। তুই আমার নামে দুর্নাম রটাচ্ছিস? আমার চরিত্রে দাগ লাগাচ্ছিস? তোকে আমি শেষ করে ফেলব। ” মল্লিকা মির্জা রাগে এদিকওদিক তাকালেন। কিন্তু হাতের কাছে কিছু না পেয়ে সোফা থেকে কুশন নিয়ে ছুঁড়ে মারলেন স্বামীর ওপর।

” ছিহ্ সোনা, এসব বলেনা। আমি না তোমার একমাত্র স্বামী!, স্বামীকে কেউ তুইতোকারি করে! দিনদিন তোমার স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে বোধহয়। হায় আল্লাহ, এই শেষ বয়সে এসে পাগল বউকে নিয়ে কাটাতে হবে আমার! ”

মল্লিকা মির্জা স্বামীর কথা শুনে কেঁদে উঠলেন। তিনি কখনোই স্বামীর সাথে ঝগড়া করেননি। কখনো কারও কথায় কষ্ট পেলে তিনি উচ্যবাচ্চ করেননা। নীরবে চোখের পানি ফেলেন। ঝগড়া তার ধাতে নেই।

স্ত্রী’কে কাঁদতে দেখে তার কাছে এগিয়ে গেলেন আতিক মির্জা। ভালোবেসে হাত রাখলেন স্ত্রী’র কাঁধে। এখন তাকে আদর্শ স্বামীর ডিভটি পালন করতে হবে।

” কাঁদেনা আমার, মল্লিকা মালতী। তোমার সাথে আমি মজা করেছি। আমার মল্লিকা মালতী দেখছি মজাও বোঝেনা। কয়দিন পর ছেলে বউ আসবে বাসায়। সে এসে যদি দেখে তার শ্বাশুড়ি স্বামীর সাথে রাগ করে কান্নাকাটি করে, তবে এটা কি তোমার জন্য লজ্জাজনক হবেনা? ছেলের বউ ভাববেনা, তার শ্বাশুড়ি ছিঁচকাদুনি? ” আতিক মির্জা অতি সাবধানে বললেন।

” আচ্ছা আর কাঁদবনা। কিন্তু তুমি আর কখনোই এমন কথা বলবেনা। আমার ছেলেমেয়ের একমাত্র বাবা তুমি। বিশ্বাস না হলে ডিএনএ টেস্ট করিও। ” হেঁচকি তুলে বললেন মল্লিকা মির্জা।

” আমি বিশ্বাস করি তোমার ছেলেমেয়ের একমাত্র বাবা আমি। আমিতো শুধু তোমার সাথে মজা করেছি। ”

” কি চলছে এখানে? এ কি আম্মু, তুমি কাঁদছ কেন? কি হয়েছে তোমার? ” ড্রয়িংরুমে বসে মা’কে কাঁদতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে যায় পুলক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আতিক মির্জার দিকে।

” আমি কিছুই করিনি। বিশ্বাস না হলে তোমার আম্মুকে জিজ্ঞেস কর। ” দুই হাত ওপরে তুলে আত্নরক্ষার ভঙ্গিতে বললেন আতিক মির্জা।

” তোমার কি হয়েছে, আম্মু? কে কি বলেছে সেটা আমাকে বল। ” বাবার কথার প্রত্যুত্তর না করে আবারও জিজ্ঞেস করল মল্লিকা মির্জাকে।

” আমার কিছু হয়নি, বেটা। এসব বাদ দাও। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আর ভাইজাই বা কোথায়? ডিনার করবেনা তোমরা? ” আঁচলে চোখ মুছে বললেন মল্লিকা মির্জা।

” চাচ্চু বাহিরে ডিনার করবে। আমিও একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই আসতে দেরি হলো। তুমি টেবিলে খাবার দাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”

” ওকে। শোন বেটা, তুমি কি পুষ্পিতাকে আনতে যেতে পারবে? ও কাল রাতের ফ্লাইটে দেশে আসবে। ”

” কালকে আমি ব্যস্ত থাকব, আম্মু। তবে তুমি চাইলে সন্ধ্যার পর রওনা দেব। প্লেনে ঢাকা যাব। তাহলে ঠিক সময়েই পৌঁছাতে পারব। ”

” তাহলে সেটাই কর। অন্য কারো ওপর ভরসা করে মেয়েটাকে আমি ছাড়তে পারবনা। দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি। ”

” আমি থাকতে কারও ওপর পুষ্পিতার দ্বায়িত্ব দেয়ার প্রয়োজনও দেখিনা। ওর প্লেন ল্যান্ড করার আগেই আমি ঢাকা পৌঁছে যাব। ”

” থাংকস, বেটা। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে এস। ” মল্লিকা মির্জা ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললেন।

***

পরদিন পুলকের ব্যস্ততায় কাটল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক জায়গায় প্রোগ্রামের পর ও সন্ধ্যার পরপরই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ব্যস্ততার দরুন আশফির সাথে দেখা করা হয়না। কিন্তু ওর ছেলেদের ঠিকই বলে রেখেছে আশফির দিকে নজর রাখতে।

আশফিও পুলককে না দেখে মনে মনে খুশিই হয়। বেশ কয়েকদিন থেকেই ও খুব একটা পুলকের দেখা পাচ্ছেনা এতেই ও খুশি। কিন্তু ওর এই খুশি যে খুব বেশিদিন টিকবেনা সেটা ও জানেনা।

” বইন, কয়দিন থেকেই খুব শান্তি শান্তি লাগছে বুঝলি? ঐ গুণ্ডা ছেলেটা চোখের সামনে আসছেনা এতেই আমার শান্তি। ” আশফি তিয়াসাকে বলল। ওরা কেবলই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কলেজের উদ্দেশ্যে।

” বেশি শান্তি পাওয়ার দরকার নেই। আমার মনে হয় ঐ গুণ্ডা ছেলেটা তোকে সত্যিই ভালোবাসে। আর সে যেমন প্রকৃতির মানুষ, আমার মনে হয়না তুই খুব সহজে তার হাত থেকে রেহাই পাবি। তাই শান্তির কথা চিন্তা না করে আল্লাহ আল্লাহ কর।” তিয়াসা নির্বিকারচিত্তে বলল।

এদিকে তিয়াসার কথা শুনে আশফির বুকের ভেতর কলিজা লাফ দিয়ে উঠল। চোখমুখে আঁধার নেমে আসল। মনে হচ্ছে এইমাত্র এক গ্লাস করলার জুস কেউ জোর করে পান করিয়েছে ওকে।

” এসব কি বলছিস! তুই আমার সাথে মজা করছিস তাইনা? আরে ওই লোকটা তো গুণ্ডা। ওরা এমন অনেক মেয়ের সাথেই করে থাকে। ও বইন, বলনা তুই আমার সাথে মজা করছিস। ”

‘ যার সাথে মজা করে আনন্দ পাওয়া যায়, মানুষ তার সাথেই মজা করে। আমার মনে হয়না এযাবৎকাল কেউ তোর সাথে মজা করে আনন্দ পেয়েছে। আমি ভাবছি পুলক মির্জা কি দেখে তোর প্রেমে আছড়ে পরল। বেচারার জন্য আমার এখন থেকেই মায়া হচ্ছে। সারাজীবন তাকে নাকের জলে চোখের জলে এক করে তোর সাথে কাটাতে হবে। ” তিয়াসার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে আশফি।

কথা বলতে বলতে ওরা বাহিরের উঠানের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই ওদের সামনে একটা রিক্সা এসে দাঁড়ায়। রিক্সা দেখেই তিয়াসা আশফির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়। যার অর্থ, কি বুঝলি?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here