#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী জামী
তিয়াসা কোনমতে রুম থেকে বেরিয়ে এসে রিফাতকে ফোন দেয়। কিন্তু তিয়াসাকে কাঁদিয়ে ওপাশ থেকে সুমধুর স্বরে একটা কন্ঠ জানাল, এই মুহূর্তে রিফাতের ফোন বন্ধ রয়েছে। রাগে, হতাশায় তিয়াসা ফোন ছুঁড়ে মারল। অতিরিক্ত চিন্তায় ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। নয়তো ও একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারত, রিফাতের ফোনের ব্যাটারির চার্জ শেষ।
***
” আপনাদের কাছে হাতজোড় করে তিয়াসাকে শাহেদের জন্য চাইছি। আমাদের চাওয়া অপূর্ণ রাখবেননা, ভাই সাহেব। এতিম ছেলেটা এই প্রথমবার আমাদের কাছে কিছু চেয়েছে। আপনারা শাহেদ আর ওর পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখুন একবার। আমি গর্ব করে বলতে পারি ছেলেটা কিংবা ওর পরিবার সম্পর্কে কেউ নেগেটিভ মন্তব্য করতে পারবেনা। ” মল্লিকা মির্জা সত্যি সত্যিই হাতজোড় করলেন।
মল্লিকা মির্জার অনুরোধে তিয়াসার পরিবারের সবাই একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তারা কি উত্তর দেবেন ভেবে পাচ্ছেননা।
” এভাবে বলবেননা, আপা। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, শাহেদের সাথেই তিয়াসার বিয়ে হবে। আমরা খুব ভালো করেই শাহানা আপা আর জহির ভাইকে চিনতাম। তাই তাদের পরিবার সম্পর্কে নতুনভাবে খোঁজ নেয়ার কিছুই নেই। শাহানা আপা আর জহির ভাইয়ের ছেলে যে খারাপ হতে পারেনা, সেটা আমি জানি। ” তিয়াসার মা রত্না পারভীন কারও উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন।
তোফাজ্জল হোসেন স্ত্রী’র সিদ্ধান্তের ওপর কোন কথাই বললেননা। কারন তিনি জানেন তার স্ত্রী ভুল কিছুই বলেনি।
রত্না পারভীনের কথা শুনে সবাই একযোগে আলহামদুলিল্লাহ বললেন। এরপর তারা বিয়ে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
***
বাবা-মা’র সিদ্ধান্ত শুনে তিয়াসা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ও বারবার রিফাততে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু এখনো রিফাতের ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে।
” তিয়াসা, তোকে পুলকের আম্মু ডাকছে। একবার ঐ রুমে চল, মা। ” রত্না পারভীন তিয়াসার রুমে এসে বললেন।
” আম্মু, তোমরা এটা কি করলে? আমার জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত তোমরা একাই নিলে? একটাবার জিজ্ঞেস করলেনা, আমি এই বিয়েতে রাজি কিনা? তোমরা যখন আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি, তখন শুনে রাখ এই বিয়ে আমি করবনা। আমি অন্য কারও কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তোমরাও যেমন আমার কথা একবারও চিন্তা করোনি, তেমনি আমিও তোমাদের কোন কথা শুনবনা। ”
তিয়াসার কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসলেন রত্না পারভীন। এ কি বলছে তার মেয়ে! তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝড়ছে। তবে কি তিনি ঋণ শোধ করার কোন সুযোগই পাবেননা?
” আজ এই যে তুই বেঁচে আছিস, আমি বেঁচে আছি কাদের জন্য জানিস? তুই হয়তো বলবি, আল্লাহ হায়াত দিয়েছেন তাই বেঁচে আছি। কিন্তু অনেক সময় আল্লাহপাক মানুষকে উছিলা হিসেবে পাঠান। আর তোর আমার বেঁচে থাকার পেছনে উছিলা হলো শাহেদের বাবা-মা। ”
তিয়াসা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর আম্মুর দিকে। আম্মুর কথা ওর বোধগম্য হচ্ছেনা। এদিকে রত্না পারভীন বলেই চলেছেন,
” তোর জন্মের সময় আমি খুবই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। তোর বাবা চাকরি পদে ফেলে দিনরাত আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তিন ছেলেকে রেখেছিলাম রিফাতের মা’য়ের কাছে। যেদিন তোর জন্ম হলো, তার কয়েকদিন আগে থেকেই দেশে রাজনৈতিক অরাজকতা চলছিল। হরতাল, মারামারি, ভাঙ্গচুরের জন্য বাড়ি থেকে বের হওয়া দায় হয়ে পরেছিল। এদিকে আমার রক্তের প্রয়োজন। তোর আব্বু হন্যে হয়ে রক্ত খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু হরতাল থাকায় রক্তের জোগাড় করতে পারছিলনা। তখনই আমাদের বিপদে এগিয়ে আসে শাহানা আপা আর জহির ভাই। শাহানা তোর বাবা’র অফিসের বস ছিল। সে কোনভাবে জানতে পেরেছিল আমাদের বিপদের কথা। শাহানা আপা একসাথে দুই ব্যাগ রক্ত দিয়েছিল সবার বারণ স্বত্বেও। সেদিন আমি সুস্থ হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু অসুস্থ হয়েছিলি তুই। তোর রক্তে কোন একটা সমস্যা দেখা দেয়। ডক্টর জানায়, তোকে ঢাকা না নিলে বাঁচবিনা। কিন্তু হরতালের মধ্যে কেউ রাজি হচ্ছিলনা ঢাকা যেতে। কোন গাড়ি পাচ্ছিলামনা। এদিকে তোর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। তখনও ত্রানকর্তা হয়ে এগিয়ে আসল শাহানা আপা আর জহির ভাই। তারা নিজেদের গাড়িতে করে আমাদের ঢাকা নিয়ে যায়। পথিমধ্যে সকল সমস্যা থেকে উদ্ধারও করল। নিজের বাবা-ভাইদের পরিচয় দিয়ে আমাদের নিরাপদে ঢাকা পৌঁছে দিল। সেখানে থাকার ব্যবস্থাও করল। একমাস সেখানে ছিলাম। হরতালের মধ্যে চলাচলের জন্য বিশেষ পাসের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। আর সেই যাত্রায় তুই বেঁচে গিয়েছিলি। ”
তিয়াসা স্তব্ধ হয়ে শুনছে রত্না পারভীনের কথা। সেই সাথে কাঁদছে অঝোরে। বাবা-মা’র ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে কি ওকে এবার ভালোবাসা বিসর্জন দিতে হবে! কিন্তু ওর পক্ষে সম্ভব নয়। রিফাতকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব।
তিয়াসাকে চুপ থাকতে দেখে ওর মাথায় হাত রাখলেন রত্না পারভীন। তিনি মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। কিন্তু তিনি শাহানার পরিবারের কাছে ঋণি। সুযোগ এসেছে সেদিনের উপকারের প্রতিদান দেয়ার। কিন্তু ক্রন্দনরত মেয়েকে দেখে তার বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। তবুও তিনি মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
” মা রে, আমি জানি তোর মনে কি চলছে। যাকে কথা দিয়েছিস তাকে ভুলে যাওয়া হয়তো তোর পক্ষে কঠিন। কিন্তু একসময় দেখবি তার অস্তিত্বের ছিঁটেফোঁটাও তুই মনে করবিনা। মনে করতে চাইবিনা। তোর কাছ থেকে না শুনে তাদেরকে কথা দেয়া আমার ভুল হয়েছে এটা আমি স্বীকার করছি। আর সেটা করেছি সেদিনের উপকারের প্রতিদান দিতে। এখন যদি তোর মনে হয় আমি ভুল করেছি, তবে আমি তাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইব। ” হু হু করে কেঁদে উঠলেন রত্না পারভীন।
তিয়াসা প্রতিদান আর ভালোবাসার মাঝে আটকে হাঁসফাঁস করছে। বিশ বছর আগের উপকারের প্রতিদান দিতে হলে ওকে ওর তিন বছরের ভালোবাসা ছাড়তে হবে। যেটা ভাবতেই ওর কলিজা হিম হয়ে আসছে। আর ভাবতে পারছেনা তিয়াসা। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল।
” আমি যে তাকে ভালোবাসতে পারবোনা, আম্মু। আমার ভালোবাসা শুধু একজনের জন্যই বরাদ্দ। আমাকে বিয়ে করলে সেই মানুষটাকে ভালোবাসাহীনতায় কাটাতে হবে আজীবন। আর ভালোবাসাহীনতায় বেঁচে থাকা মানে, প্রান ছাড়া শুধু শরীরসর্বস্ব জীব হয়ে বেঁচে থাকা। ”
” তোর আজ এই কথা মনে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু একদিন দেখবি আজকের বলা কথাগুলোর জন্য তুই কষ্ট পাবি। দু’জন মানুষ পাশাপাশি থাকতে থাকতেই কখন যে দু’জনের মধ্যে ভালোবাসা জন্ম নেয়, সেটা তারা নিজেরাই বুঝতে পারেনা। এমন যদি না হতো তবে যুগে যুগে স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক টিকে থাকতনা। কতজন নিজের ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পেয়েছে সেটা চারপাশে তাকালেই বুঝতে পারবি। ”
” আমাকেও সেই কতজনের মধ্যে ফেলছ তুমি, আম্মু! কেন? কেন আমি ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পাবোনা? তোমরা তো বাকি সব অভিভাবকদের মত নও। তারপরও কেন এত অবুঝ হচ্ছ? ” তিয়াসা একটু কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল।
” ঠিক আছে, আমি ওদের নিষেধ করে দিচ্ছি। আমার কাছে তোর সুখই আগে। নিজের মেয়েকে সুখী দেখতে আমি না হয় অন্যদের কাছে একটু ছোটই হলাম। ”
তিয়াসা একনজর রত্না পারভীনের দিকে তাকালো। তার চেহারায় মেঘের ঘনঘটা লক্ষ্য করে ওর বুক কেঁপে উঠল। রত্না পারভীন উঠে দাঁড়াতেই তিয়াসা তার হাত টেনে ধরল।
***
আশফি তিয়াসাকে অবাক করে দিয়ে ওদের বিয়ে আজকেই হয়ে গেল। ওরা দু বোন বিশ্বাসই করতে পারছেনা হুট করেই ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। আশফি ঘোরের মধ্যে আছে, আর তিয়াসা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিন বছরের ভালোবাসা এক মুহূর্তেই বিসর্জন দিয়েছে মেয়েটা। রিফাতের সাথে কথা বলার জন্য মন বড্ড উচাটন করছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে রিফাতের নম্বরে ফোন করল।
রিফাত মনমরা হয়ে বসে ছিল। ছোট বোনের বিয়েতে ভাই হয়ে থাকতে পারছেনা এর থেকে বড় কষ্ট আর হয়না। আফজাল হোসেন মেয়ের বিয়ের আনন্দে তিয়াসার বিয়ের কথা রিফাতকে জানাতেই ভুলে গেছেন।
তিয়াসার ফোন পেয়ে হাসি ফুটল রিফাতের ঠোঁটে।
” কি ব্যাপার ননদের বিয়েতে আনন্দ করা বাদ দিয়ে তুই আমাকে দিয়েছিস যে? মিস করছিলি? ”
রিফাতের গলা শুনেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তিয়াসা। তিয়াসার কান্নার আওয়াজ পেয়ে রিফাত উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল কি হয়েছে?
” আমাকে মাফ করে দিও। তোমার ভালোবাসা ধরে রাখতে পারিনি আমি। আমি বেইমানী করেছি তোমার সাথে ” কান্নার দমকে কথা বলতে পারছেনা তিয়াসা।
” তিয়ু পাখি, কাঁদছিস কেন? আমাকে বল। কি হয়েছে তোর? বড়মা তোকে বকেছে? প্লিজ কাঁদিসনা। তোর কান্নার আওয়াজে আমার বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে। আর কাঁদিসনা। ” রিফাত আদুরে গলায় তিয়াসাকে কান্না থামাতে বলছে।
অনেকক্ষণ পর তিয়াসা কান্না থামিয়ে একে একে সব খুলে বলল রিফাতকে। সব শুনে রিফাত স্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর হৃৎস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। মাথাটা বনবন করে ঘুরে উঠল। ফোন হাত থেকে কখন পরে গেছে সেটা বুঝতেই পারেনি। দু হাতে চুল খামচে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তিয়াসা কানের সাথে ফোন চেপে ধরে রিফাতের সাথে সাথে নিজেও কাঁদতে থাকল।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে বলতে পারেনা কেউই। একটু ধাতস্থ হয়েই রিফাত ফোন হাতে নেয়। ও দেখল তিয়াসা তখনো লাইনে আছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে কথা বলল রিফাত,
” নতুন জীবনে স্বাগত। দোয়া করি তোর সুখের সংসার হোক। স্বামী সোহাগি হ। হয়তো আর তোর সাথে দেখা হবেনা। কিন্তু আমার দোয়া সব সময়ই তোর সাথে থাকবে। আজকে যেমন একজন দ্বায়িত্ববান মেয়ের কাজ করেছিস, তেমনি আজীবন দ্বায়িত্বশীল স্ত্রী হয়ে কাটাবি এটাই চাইব তোর কাছে। আজকের পর থেকে আমি নামক মানুষটাকে ভুলে যাবি। আমাদের সম্পর্কের ছায়া সংসার জীবনে পরতে দিসনা কখনো। তাকে অভিযোগ করার কোন সুযোগ দিবিনা কভু। ভালো থাকিস, ভালো রাখিস সবাইকে। ” ফোন কেটে দিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রিফাত। আজ থেকে ওর কান্নার জীবন শুরু হলো।
চলবে…