রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা #পার্ট_২৩ জাওয়াদ জামী জামী

0
331

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী জামী

” এমন খচ্চরের মত করছেন কেন? আমাকে ঘুমাতে দিন। ” পুলক আশফিকে জাপ্টে ধরতেই চেঁচিয়ে উঠল সে।

” আমার ঘুম হারাম করে তুমি ঘুমাবে, এটা হতে দিতে পারিনা। আগে আমি ঘুমাব, তারপর তুমি। ” পুলক আশফিকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

” আপনি আর রাতচোরা পাখির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আপনার ঘুমের অপেক্ষায় থাকলে আমাকে সারাজীবন না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে। এদিকে আপনি না ঘুমিয়ে কেম্নে বেঁচে আছেন সেটা আল্লাহই জানেন। ছাড়ুন আমাকে। ” আশফি চেষ্টা করেও পুলকের শক্ত বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারলনা।

” তিড়িংবিড়িং না করে আমার বুকে চুপটি করে শুয়ে থাক। দেখবে কখন ঘুমিয়ে গেছ টেরই পাবেনা। যতক্ষণ ঘুম না আসবে, ততক্ষণ আমার হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শোন। দেখবে প্রতিটি স্পন্দনে তোমার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। আমার হৃৎস্পন্দন থেকে শুরু করে প্রতিটি শিরা-উপশিরায় শুধু তোমারই নাম। ”

পুলকের ঘোর লাগা গলা শুনে কেঁপে উঠল আশফি। ওর মন ছেয়ে যায় ভালো লাগায়। মৃদু হেসে সে-ও চুপটি করে পুলকের বুকে শুয়ে রইল। অনুভব করতে থাকল পুলক মির্জার প্রতিটি হৃদস্পন্দন। সুনির্দিষ্ট লয়ে দ্রিম দ্রিম শব্দে হৃদস্পন্দনেরা তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

***

সোফায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে শাহেদ। ওর দীর্ঘদেহী শরীরটা সোফায় আটছেনা। ও একবার মনে করল স্টাডি রুমে গিয়ে ঘুমাবে। কিন্তু পরক্ষণেই তিয়াসার অনুনয় ভরা মুখটা চোখের সামনে ভাসতেই, সিদ্ধান্ত বদলালো। কষ্ট করেই শুয়ে রইল সোফায়। গত চার বছর যাবৎ এই মেয়েটাকে ভালোবেসেছে সে। যাকে দেখার জন্য হুটহাট ছুটে এসেছে এই শহরে। তিয়াসার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। চুপিচুপি দেখেছে তাকে। মেয়েটাকে চুপিচুপি এক ঝলক দেখেই দুচোখের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। বহু আকাংঙ্খিত সেই মেয়ের একটা চাওয়া পূরণ করতে না পারলে কিসের স্বামী হয়েছে সে!

তিয়াসার চোখে ঘুম নেই। জীবনের কঠিন সমীকরণ মেলানোর বৃথা চেষ্টা করছে সে। বারবার রিফাতের মুখটা মনে পরছে। তার হাসি, তার নেশাক্ত চাহনি সবকিছুই যেন চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। তিয়াসার ভয় হচ্ছে, একদিন না একদিন ওকে রিফাতের সামনে পরতেই হবে, সেদিন ওদের দু’জনের প্রতিক্রিয়া কি হবে? সেদিন দু’জন দু’জনকে দেখে কি ওরা মুখ ফিরিয়ে নিবে? রিফাত কি ওকে ঘৃণার চোখে দেখবে? আচ্ছা, রিফাত কি এখন থেকেই ওকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে? যেদিন ওর সাথে দেখা হবে, সেদিন কি রিফাত ওর সাথে কথা বলবে? রিফাত সেদিন মুখ ফিরিয়ে নিলে ও নিজেকে কিভাবে প্রোবোধ দেবে! কিভাবে সামলাবে নিজেকে। দু ফোঁটা অশ্রুবৃষ্টি ঝরল তিয়াসার আঁখি গহবর থেকে। গোপন এই অশ্রুবৃষ্টির ফোঁটা কেউই দেখলনা। কেউই জানলনা ওর গোপন ব্যথা। তিয়াসাও নিশ্চিত মনে অশ্রু ঝরাচ্ছে।

তিয়াসার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে চমকায় শাহেদ। এটা স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের শব্দ নয়। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় তিয়াসার দিকে তাকায়। মেয়েটা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। থেকে থেকেই ওর ফুলে উঠছে। শাহেদ বুঝল, তিয়াসা কাঁদছে। অপরাধবোধ ওকে ঘিরে ধরল। বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে। কেন সে আগে থেকেই তিয়াসার সম্পর্কে জেনে নিলনা? কেন তিন তিনটা জীবন নিয়ে বাজী ধরল? ওর একটা ভুলের জন্য মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো ওকে ভালোবেসে সেই পুরুষও আজ বিবাগী হয়েছে। কান্নার সাথে সন্ধি করেই হয়তো সে-ও বেঁচে আছে! নিজেকে ধিক্কার দিল শাহেদ। আজ নিজেকে তুচ্ছ কীট বৈ কিছুই মনে হচ্ছেনা। এই রুমে আর থাকতে পারবেনা সে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কান্নারা দলা পেকে গলায় এসে আটকে আছে। তাদের আজ মুক্ত না করলে সে বাঁচতে পারবেনা কিছুতেই। শব্দ না করে সোফা থেকে নেমে দরজা খুলল সে।

দরজা খোলার শব্দ পেতেই পেছনে ঘুরে তাকায় তিয়াসা। শাহেদকে বাহিরে যেতে দেখে অবাক হয় ভিষণই।

” কোথায় যাচ্ছেন? ” ভারি গলায় জিজ্ঞেস করল।

” স্টাডি রুমে। আমি সেখানেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ” চোখ মুছে বলল শাহেদ।

” যাবেননা প্লিজ। দাদু জানলে আমি তার সাথে মিথ্যা বলতে পারবনা। ” হুট করেই কেঁদে উঠল তিয়াসা। অনেকতো লুকোচুরি করল। গোপনে আর কতইবা কাঁদা যায়।

তিয়াসাকে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দেয় শাহেদের। তিয়াসার চোখের পানি ওর বুকের পাঁজরে তীব্র আঘাত করেছে।

” আপনি শুয়ে পরুন। আমি ছাদ থেকে আসছি। ” পেছন ফিরে না তাকিয়েই বলল শাহেদ। এরপর ও ছাদের দিকে পা বাড়ায়।

শাহেদ চলে গেলে তিয়াসা বিছানায় পিঠ ঠেকায়। তখনো ওর কান্না বন্ধ হয়নি।

ছাদে এসে অসীম অন্তরীক্ষের পানে তাকায় শাহেদ। ঐ দূর অন্তরীক্ষে নিজের বেদনা সোপর্দ করে একটু হালকা হতে চায়। এই ধুলার ধরনীর বুকে আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। একা, অসহায় এক পুরুষ যে কিনা সব পেয়েও অপূর্ণার গহীন সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। বদলে গেছে জীবনের সব দিক, মুছে গেছে সব রং। একবার বাবা-মা’ কে হারিয়ে কোনরকম বেঁচে আছে। এবার ভালোবাসার মানুষকে যদি হারিয়ে তবে কি নিয়ে বাঁচবে সে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল ছেলেটা। আজ বাবা-মা’কে প্রথমবারের মত স্বার্থপর মনে হচ্ছে। কেন তারা ওকে একা করে চলে গেল? কেন নিজেদের সাথে নিয়ে গেলনা? তাদের ছেলে স্বার্থপর এই পৃথিবীতে কিভাবে বেঁচে থাকবে সেটা কেন একবারও ভাবলনা?

ছাদে সটান হয়ে শুয়ে পরল শাহেদ। তাকিয়ে আছে সুদূরে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা নক্ষত্ররাজির দিকে। তখনও ওর চোখ দিয়ে অনর্গল ঝরছে বেদনার নোনা জল।

***

” মল্লিকা, তোমার পুত্রধন কোথায়? সে গতকাল তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে আমার প্রতিপক্ষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভাংচুর করেছে, সেটাকি জানো? তুমি কি তাকে ভালো হতে বলবেনা? ” আতিক মির্জা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তার সামনে বসে আছেন মল্লিকা মির্জা।

স্বামীর কথা শুনে মল্লিকা মির্জা চিন্তিত বদনে বসে থাকলেন। স্বামীর ন্যায় তিনিও চান তার ছেলে বদলাক। রাজনীতি ছেড়ে, মারামারি, হিংসা ছেড়ে একজন দ্বায়িত্বশীল পুরুষে পরিনত করুক নিজেকে। কিন্তু তার ছেলে কিছুতেই এই পথ থেকে এক কদমও দূরে সরছেনা।

” ভাইজান আজ বাসায় আসলে আমরা সবাই মিলে পুলকের সাথে কথা বলি। যেভাবেই হোক ওকে এসব থেকে দূরে রাখতে হবে। বউমা এসব শুনলে কি ভাববে, সেই চিন্তায় আমার মাথা ঘুরছে। ” মল্লিকা মির্জা মৃদু গলায় বললেন।

” কোথায় তোমার ছেলে? ”

” কোন একটা মিটিংয়ে যাবে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে সকালেই। ”

” বাহ! সকালে বেরিয়ে গেছে, অথচ এখন সন্ধ্যা হতে চলল, কিন্তু সেই নবাব এখনো বাসায় আসেনি! সে কি সারাজীবন এভাবেই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দিনাতিপাত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? তাকে বলে দিও, বসে বসে খেলে রাজার ভান্ডারও নিঃশেষ হয়ে যায়। ”

” আহ্ এভাবে বলোনাতো। রাগ না করে ওকে সবাই মিলে বুঝিয়ে বলি আগে। তারপর দেখ ও কি করে। তারপর দোষারোপ করো। ”

” আমি এখন বাহিরে যাব। বাসায় ফিরব দশটার দিকে। তোমার পুত্রধন আসলে আমাকে খবর দিও। ভাইও আজ তারাতারি আসবে। ভাই আসলেই তাকে বলে রেখ। ” চা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন আতিক মির্জা।

***

আন্টি, তুমি আজকের পর থেকে আর বোয়াল মাছ রান্না করোনা। তোমাদের নতুন বউয়ের বোধহয় বোয়াল মাছে এলার্জি আছে। ” শাহেদ দাদুর পাশে বসে রাতের খাবার খাচ্ছে। আরেকটা চেয়ারে তিয়াসা বসেছে।

শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা বেশ অবাক হয়েছে। ও এ বাড়ির কাউকেই বলেনি ওর বোয়াল মাছে এলার্জি আছে। আন্টি ওর জন্য ভালোবেসে বোয়ালমাছ ভুনা করেছিল। তাই ও না করতে পারেনি। এক টুকরা মাছ খেয়েছিল। আর তাতেই ওর পুরো শরীর ফুলে গিয়েছিল। তবে কাকতালীয়ভাবে ড্রেসিংটেবিলের ওপর এ্যালার্জির ঔষধও পেয়েছিল। সেটা খাওয়ার পরই ওর এ্যালার্জি কমে যায়। এখন তিয়াসা বুঝতে পারছে শাহেদ কোনভাবে বুঝতে পেরেছিল ওর সমস্যা হচ্ছে, আর সে-ই ঔষধ রেখেছিল। কিন্তু তিয়াসা এটা বুঝতে পারছেনা শাহেদ জানল কিভাবে?

” কি কও বাবা, আমারে তো নতুন বউ একবারও কয়নাই তার বোয়ালমাছে এ্যালার্জি! আমারে একবার কইলে আমি বোয়ালমাছ রান্নাই করতামনা। ও নতুন বউ, তুমি আমারে কইবানা? ” হায়হায় করে উঠল খাদিজা আন্টি।

” না আন্টি, আমার তেমন কিছু হয়নি। আপনি এত উদগ্রীব হবেননাতো। আপনি আমার জন্য কত ভালোবেসে রান্না করেছেন, কিন্তু আমি সেটা খাবনা সেটা কি করে হয়! হোকনা একদিন এ্যালার্জি, তবুও তো আপনার হাতের মজার রান্না খেতে পেরেছি। ”

তিয়াসার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন খাদিজা আন্টি।

” আন্টি, আজকের পর থেকে বোয়ালমাছ, পুঁইশাক, বাদামের তৈরী যেকোন খাবার বাসায় তৈরী করবেননা। আপনাদের নতুন বউয়ের এসবে এ্যালার্জি আছে। ”

এবারও তিয়াসা শাহেদের কথা শুনে চমকায়। এতকিছু শাহেদ জানল কিভাবে সেটা ভেবেই ওর মাথা ঘুরছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here