#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৪৬
জারা ঠোঁট ফুলিয়ে দুইটা ফুচকা খুব আরামসে খেলো কিন্তু বিপত্তি ঘটল শেষ ফুচকাটা মুখে দিতেই। চোখের মনির আকার বড় বড় করে চিৎকার করে উঠে মুখে থাকা ফুচকাটা তাড়াতাড়ি করে ফেলে দেয় নিচে। ঝালে জারার জিভ, ঠোঁট জ্বলে যাচ্ছে। কি করবে না করবে তা ভেবে দিশা হারিয়ে ফেলেছে নিজের। কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হচ্ছে। মাথা ঘুরছে, চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। টেবিলের উপরে থাকা গ্লাসের পানিটা পান করল কিন্তু পানি খাওয়াতে যেন ঝালের মাত্রাটা আরো দ্বিগুণ বের গেছে। নুহাশ বিল মিটিয়ে মানিব্যাগ প্যান্টের পকেটে রাখতেই জারার চিৎকার শুনে সামনের দিকে তাকাতেই থমকে যায় জারার এমন অস্থিরতা দেখে। নুহাশ দ্রুত পায়ে জারার কাছে এসে বিচলিত গলায় বলল।
“কি হয়েছে জারা?”
জারার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ঝাল.. খুব ঝাল লেগেছে। আহ সহ্য করতে পারছি। আমার জিভ জ্বলে যাচ্ছে।”
নুহাশ অস্থির গলায় বলল, “তুমি বসো আমি ঠান্ডা পানি নিয়ে আসছি।”
“না না ঠান্ডা পানিতে ঝাল কমবে না আইসক্রিম,,, আইসক্রিম খেতে হবে।”
নুহাশ আর এক মিনিটও দেরি করল না। দৌঁড়ে গিয়ে দোকান থেকে এক বোতল পানি আর দুইটা চকবার আইসক্রিম নিয়ে আসলো। জারা আইসক্রিম হাতে পেয়েই আইসক্রিম খেতে শুরু করল। এখন একটু আরাম লাগছে। ফুচকাওয়ালা মামা এসে জারাকে বলল।
“আমি আগেই কইছিলাম এত ঝাল খাইতে পারবেন না আপনি। কিন্তু আপনি আমার কথা হুনলেন না।”
জারা রেগে বলল, “ওইটা আমার জন্য ছিল না।”
নুহাশ হতবাক হয়ে জারার দিকে তাকায়। তাহলে এই মেয়ের পেটে পেটে এই ছিল। তাকে ঝাল দেওয়া ফুচকা খাওয়াতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘটনা তো উল্টে গেল। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে ফুচকাটা চেঞ্জ করেছিল না হলে এই অবস্থা তো তার সাথে হতো। আর জারা যেই মেয়ে তার ঝাল লাগতে দেখে একশো পার্সেন্ট সিউর জারা খুশি হতো যেহেতু নিজেই এত ঝাল দিয়ে ফুচকা বানিয়ে এনেছিল। কিন্তু তাকে ঝাল দেওয়া ফুচকা কেন খাওয়াতে চেয়েছিল এই মেয়ে? কিসের জন্য রেগে আছে তার উপরে? কোনো ভাবে কি একটু আগে প্রিয়ার সাথে কথা বলার জন্য রেগে আছে তার উপরে। এতোটা জেলাস এই মেয়ে। নুহাশ এসব ভেবে মনে মনে হেসে গলা খাকারি দিয়ে বলে।
“ঝাল কমেছে এখন?”
জারা রাগী চোখে নুহাশের দিকে তাকাল। চোখ, মুখ লাল হয়ে আছে বেচারীর। নুহাশ যে তাকে বোকা বানিয়েছে এটা আর বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু নিজের পাতা ফাঁদে যে এভাবে নিজে পিছলে পড়ে যাবে এটা বুঝতে পারে নি। জারা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
“এই ঝাল আগামী সাত দিনেও কমবে না।”
কথাটা বলেই ধুপধাপ পায়ে চলে যায়। নুহাশ জারার যাওয়ার পানে তাকিয়ে সশব্দে হেসে উঠল। ইস ঝালে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে মেয়েটার। জারা ততক্ষণে গাড়িতে উঠে গেছে। নুহাশ চেঁচিয়ে বলে।
“আরে আমাকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছো তো।”
জারা মুখ ভার করে বসে আছে প্যাসেঞ্জার সিটে আর বার বার পানি খাচ্ছে। ঝাল বেশিটা কমলেও পুরোপুরি ভাবে কমে নি। পানি খেয়ে পেট ফুলিয়ে ফেলেছে সে। নুহাশ গাড়িতে উঠে সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে জারার দিকে তাকায়। জারার সারা মুখে বিন্দু বিন্দু পানির কণা জমে আছে মুখমন্ডলে পানির ঝাপটা দেওয়ার কারণে। জারা ভেজা হাত দিয়ে বার বার ঠোঁট জোড়া ভিজাচ্ছে। নুহাশের নজর পড়ে জারার লালচে হয়ে থাকা ঠোঁট জোড়ার উপরে। একে তো অতিরিক্ত ঝালের জন্য জারার ঠোঁট জোড়া লাল হয়ে আছে আর তার উপরে পানির জন্য ঠোঁট জোড়া কেমন রসালো হয়ে আছে। নুহাশ ধীরে ধীরে ঘোরের ভেতরে চলে যাচ্ছে। ফাঁকা ঢোক গিলে সাথে সাথে নজর সরিয়ে নেয় নুহাশ। শরীরের ঠান্ডা রক্ত গরম হয়ে উঠছে। মস্তিষ্কে ঝেঁকে বসছে এক অনবদ্য ইচ্ছা। নুহাশ জারাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও কখন অন্য নজরে দেখি নি। কিন্তু আজ যেন এই নজরটা বেহায়া নজরে পরিণত হয়েছে। বুকের ভেতরে অনিয়ন্ত্রিত গতিতে ঝড় বইতে শুরু করেছে। যেই ঝড়ের গতি চাইলেও নুহাশ সামলাতে পারছে না অন্য দিন গুলার মতো। নুহাশ শক্ত করে চোখ বুজে চোয়াল শক্ত রেখে স্টিয়ারিং এর উপরে কপাল ঠেকিয়ে দেয়। জারা নুহাশকে এভাবে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে।
“কি হলো এভাবে বসে আছো কেন গাড়ি স্টার্ট দাও?”
নুহাশ মাথা তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে নিচের অধর কাঁমড়ে ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল, “জারা তুমি কি আমার উপরে রেগে আছো?”
জারা শক্ত গলায় বলল, “হুম রেগে আছি।”
নুহাশ জারার দিকে ফিরে। জারা নুহাশের চেহারা দেখে আতকে উঠে। নুহাশের চোখ, মুখ যেন অন্য রকম লাগছে। জারা আনমনে ঢোক গিলল। নুহাশ মলিন গলায় বলল, “এই রাগের মাত্রাটা একটু বাড়িয়ে দেই।”
জারা নুহাশের কথার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বলে, “মানে?”
নুহাশ জারাকে এক মিনিটও ভাববার সময় না দিয়ে জারার ঘাড়ে নিজের শক্তপোক্ত হাত রেখে নিজের কাছে এনে জারার অধর জোড়ায় নিজের অধর জোড়া ছুঁয়ে দেয়। জারা হকচকিয়ে উঠে চোখ বড় বড় করে তাকায়। এতটা দ্রুত ঘটনা ঘটেছে যে জারা কি প্রতিক্রিয়া করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দম আটকে রেখেছে জারা। পুরো শরীর শক্ত হয়ে গেছে তার। হাত দুটো মুঠো বন্দি করে রেখেছে। বুকের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কেটে যায় কয়েক মুহূর্ত নুহাশ ধীরে ধীরে সরে আসে জারার নিকট থেকে। জারা হাফ ছেড়ে বাঁচে। এতক্ষণ দম আটকে রাখার জন্য বার কয়েক বার জারা জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। নুহাশ জারার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে সরে না গিয়ে জারার মুখটা নিজের দু হাত দিয়ে আবদ্ধ করে জারার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে দেয়। জারা চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। নিজের মুখের উপর আঁছড়ে পড়ছে নুহাশের উত্তপ্ত শ্বাস। কিয়ৎক্ষণ পরেই ভেসে আসে নুহাশের অপরাধী কন্ঠস্বর।
“সরি জান। আম রিয়েলি সরি। আমি এমনটা করতে চাই নি কিন্তু নিজেকে শত চেষ্টা করেও আটকে রাখতে পারলাম না।”
নুহাশ চোখ জোড়া বন্ধরত অবস্থায় কথা গুলা বলে। জারা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না সে কি বলবে বা তার কি বলা প্রয়োজন এই মুহূর্তে। আর এটাকে কি আদৌ কোনো গভীর চুম্বন বলে কিনা সন্দেহ? শুধু ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়েছে তাতেই নুহাশ নিজেকে এতটা অপরাধী মনে করছে।
কেটে যায় কয়েক মুহূর্ত জারার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নুহাশ সরে গিয়ে জারার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছে। নুহাশ হাসল। ঝালে নাকের অগ্রভাগ লাল হয়ে আছে। নুহাশ কিছু বলতে নিবে সাথে সাথে ফোন বেজে উঠে তার। নুহাশ জারাকে ছেড়ে দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে জাহিন কল করেছে। নুহাশ নিজেকে তটস্থ করে কল ধরতেই ওপাশ থেকে জাহিনের কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
“কই তুই? জানিস না আজ সমাবেশ আছে।”
“ভাই আসছি আমি দশ মিনিটের ভেতরে। জারাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
“জলদি আয়।”
নুহাশ কল কেটে দ্রুত হাতে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি ড্রাইভ করার ফাঁকে নুহাশ জারার দিকে তাকাল। মেয়েটা ঠোঁটের উপরে হাত ঠেকিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। রেগে আছে নাকি অভিমান করে আছে বুঝতে পারছে না নুহাশ। তার এখন নিজের উপরে ক্রোধ সৃষ্টি হচ্ছে। কেন নিজের হৃদয়ে জমে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না যদি করতো তাহলে তো এমনটা হতো না। নুহাশ জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল।
গাড়ি এসে থামল শেখ ভিলার সামনে। জারা নুহাশকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝড়ের বেগে পেছনের সিট থেকে কলেজ ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। নুহাশ জারা বলে ডাক দিতে গিয়েও থেমে যায়। অনিমেষ ভঙ্গিতে জারার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। জারা মিলিয়ে যেতেই দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় চেঁচিয়ে স্টিয়ারিং এ সজোরে হাত দিয়ে বারি মারে। হাতে ব্যথা পেলেও সেটা সহ্য করে নেয় দাঁত কাঁমড়ে। জারা কি তাকে খুব খারাপ ভাবছে! হয়তো ভাবছে না হলে এই ঘটনাটার পর একটি বারও তার দিকে ফিরে তাকায় নি। নুহাশ স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরে বলে।
“কি করে বসলি তুই এটা নুহাশ। কি করে সবটা ফেইস করবি এবার?”
এই জন্যই নুহাশ নিজের অনুভূতি গুলা জারার কাছে ব্যক্ত করতে চায় নি। আগে তাও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারত এটা ভেবে জারা তার মনের কথা জানে না, কিন্তু এখন জারা সবটা জানে যার জন্য নুহাশের অনুভূতি গুলা পেয়ে বসে। মরিয়া হয়ে উঠে জারার সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য। আগেভাগেই তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে জারার কাছেপিটে তাকে এখন থেকে কম যেতে হবে না হলে অঘটন একটা ঘটিয়ে দিবে সে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাকে সমাবেশে পৌঁছাতে হবে তাই আর দেরি না করে সমাবেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
জারা দৌঁড়ে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে বিছানাতে বসে বুকের বা পাশটা শক্ত করে চেপে ধরে হাঁপাতে থাকে। অধর জোড়া কাঁমড়ে ধরে। ধীরে ধীরে ঠোঁটের উপরে নিজের বা হাত নিয়ে যায়। এখনও মনে হচ্ছে যেন নুহাশের অধর জোড়ার নরম পরশ তার অধরে ছুঁয়ে আছে। নুহাশ তার ঠোঁট ছুঁয়েছে এটা ভেবেই জারার কায়া কেঁপে উঠছে। হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। নুহাশের সামনে কি করে যাবে এবার সে? গেলেই তো লজ্জায় লাল হয়ে যাবে। জারা এসব ভেবে বালিশে মুখ গুঁজে পা দুটো নাচাতে শুরু করে। এটা কি হয়ে গেল তার সাথে আজ?
________
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গোটা দুনিয়া জুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। দুনিয়াতে যেমন অন্ধকার নেমে এসেছে তেমনি শেখ বাড়ির সকলের মুখ আঁধারে ডুবে গেছে। খবর এসেছে জাহিন যেই সমাবেশের ডাক দিয়েছিল সেখানে গোলাগুলি হয়েছে। গোলাগুলির মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে পুলিশের ফোর্স পর্যন্ত নামনো হয়েছে। বাড়ি থেকে জাহিনকে কল করলেও নুহাশ কল ধরে শুধু ”আমরা ঠিক আছি” বলে কল কেটে দেয়। এরপর হাজার কল করলেও কেউ কল ধরে নি। তবে মাঝ খানে একবার জাহিন কল করে কড়া গলায় বলে দিয়েছে, “বাড়ি থেকে যেন কেউ এক পাও বের না হয়।” যে যেখানে আছে সেখানে থাকার জন্য বলে। রিহান বের হতে চেয়েছিল কিন্তু ভাইয়ের হুমকি শুনে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাহস পায় নি। দেখা যাবে নিজে বাড়ি থেকে বের হয়ে সমস্যা কমার বদলে সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিবে। তখন জাহিনকে ওকে রক্ষা করার জন্য ছুটাছুটি করতে হবে।
সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল, বিশাল বিস্তৃত মাঠের এক পাশে বড় করে স্টেজ বাঁধা হয়েছে। সেই স্টেজের সামনে সারিসারি বেঁধে ময়মুরুব্বী থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে জাহিনের ভাষণ শোনার জন্য। চারিদিক থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে সবাই অপেক্ষায় আছে তাদের নেতা কখন এসে স্টেজে উঠবে। সবার অপেক্ষার পালা শেষ করে দিয়ে জাহিন স্টেজে উঠে মাইক হাতে নিয়ে প্রথমে সবাইকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর ভারী গলায় সালাম দেয়। জনগণরাও সকলে সালামের জবাব দিয়ে চুপ করে জাহিনের ভাষণ শুনছে। সবকিছুই ভাল চলছিল কিন্তু হঠাৎ করেই মাঠের এক কোণা থেকে ভেসে আসলো এক বিকট শব্দ যেই শব্দে পুরো এলাকাটা কেঁপে উঠে। সবাই হুড়াহুড়ি করা শুরু করে দিয়েছে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য। জাহিন বিস্ময়কর দৃষ্টি ফেলে মাইক হাতে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে এখানে? নুহাশ দৌঁড়ে এসে জাহিনকে বলল।
“ভাই চলো এখান থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে।”
জাহিন চেঁচিয়ে বলে উঠে, “এসব হলো কি করে?”
“নিশ্চয়ই কোনো বিরোধিতা দল এমনটা করেছে।”
ধীরে ধীরে গোলাগুলির মাত্রা বাড়তে শুরু করল। জাহিন দ্রুত পায়ে স্টেজ থেকে নামতে গেলে কোথা থেকে ভারি এক পাথর এসে কপালে লাগে। মুহূর্তের মাঝে কপাল ছুঁয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল রক্তের ধারা। নুহাশ আঁতকে উঠে বলে।
“ভাই।”
জাহিন দাঁত দাঁত চেপে চোখ মুখ কুঁচকে বলে, “আমি ঠিক আছি নাম তাড়াতাড়ি।”
কিন্তু জাহিন গাড়িতে গিয়ে বসতে পড়লো না তার আগেই তার নজরে পড়ল পাঁচ ছয় বছরের একটা বাচ্চার উপরে। বাচ্চাটা এই গোলাগুলির ভেতরে আটকে গেছে। ভয়ে বাচ্চাটা অঝোরে কান্না করছে। কোন দিকে যাবে দিশা পাচ্ছে না। জাহিন তা দেখে নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে গোলাগুলির ভেতরে ঢুকে বাচ্চাটাকে কোমর বাঁকিয়ে কোলে তুলতে নিবে তখনই পিঠের উপরে অনুভব করল কেউ সজোরে বাঁশ দিয়ে বারি মেরেছে তাকে। আকস্মিক এভাবে বারি মারার জন্য জাহিন নিজের টাল সামলাতে না পেরে এক হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। আঘাতকারী পুনরায় জাহিনকে মারতে উদ্ধত হতে নিবে সাথে সাথে জাহিন বাঁশের আগা শক্ত হাতে ধরে ছিনিয়ে নিয়ে আঘাতকারীর পেটে লাথি মারে। জাহিনের দলের ছেলেরা ছুটে আসে তাকে রক্ষা করার জন্য। জাহিন বাচ্চাটাকে মাসুমের কোলে দিয়ে বলে।
“ওকে নিরাপদ জায়গাতে রেখে আয়।”
মৌ মাছির মতো জাহিনের দিকে তেড়ে আসছে কয়েকজন। বোঝাই যাচ্ছে তাদের একমাত্র লক্ষ্য জাহিন। জাহিনকে এভাবে শক্ত চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুহাশের বুঝতে বাকি নেই জাহিনের পরবর্তী ধাপ কি? কোনো ভাবে কি জাহিন এদের সাথে লড়তে চাইছে নাকি। কিন্তু লড়তে গেলে নিজের ক্ষতি করে বসবে যেটা নুহাশ হতে দিবে না। জাহিনের উপরে একজন এসে হামলে পড়তে নিলে নুহাশ জাহিনকে সেইফ করে বলে।
“ভাই চলো এখান থেকে জলদি।”
নুহাশ এক চুলও নড়লো না। হাতে থাকা বাঁশের লাঠিটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। চোয়াল শক্ত করে রেখেছে। রাগে কপালের পাশের রগগুলা ফুলে উঠেছে। নুহাশ চোখ বড় বড় করে কিছু বলতে নিবে তৎক্ষণাৎ জাহিন নিজেই এগিয়ে গিয়ে যাকে হাতের কাছে পাচ্ছে তাকেই পিটাতে শুরু করেছে। নুহাশ হতবাক হয়ে জাহিনের এই ভয়ংকর রুপ দেখছে। জাহিনকে থামানো দরকার না হলে নিজের বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে।
নুহাশ আর বাকি সবাই মিলে জাহিনকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে নিয়ে বাসায়। কিন্তু কোনো ভাবে জাহিনকে থামিয়ে রাখতে পারছে না। বার বার গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাইছে। জাহিন হুংকার ছেড়ে বলল।
“ছাড় আমাকে ওদের আমি আজ মেরেই ফেলব।”
নুহাশ জাহিনকে আঁকড়ে ধরে বলে, “ভাই শান্ত হও প্লিজ। এভাবে মাথা গরম করো না। যদি তোমার কিছু হয়ে যায় তাহলে কি হবে বুঝতে পারছো। একবার বাড়ির সকলের কথা চিন্তা করো। ভাবির কথা চিন্তা করো।”
নুহাশের কথাটা শুনে জাহিন ধীরে ধীরে শান্ত হলো। হাত পা ছেড়ে দিয়ে মাথাটা হেলিয়ে দেয় সিটের উপরে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠে অয়ন্তির মায়াভরা হাসিখুশি চেহারাটা। সত্যি তো তার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে অয়ন্তির কি হবে? তাকে অনেক সাবধানে থাকতে হবে নিজের জন্য না হোক নিজের পরিবারের জন্য সাবধানে থাকতে হবে।
________
ত্রিনভ কাঁচের ফুলদানিটা হাতে তুলে নিয়ে সেটা সজোরে আছাড় মারে। ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে ছোট ছোট কাঁচের টুকরা। তার সামনে যারা দাঁড়িয়ে ছিলো তারা ভয়ে দু কদম পিছিয়ে যায়। ত্রিনভ হুংকার ছেড়ে বলল।
“এত জন মিলে আক্রমণ করার পরেও একটা আঁচড়ও কাটতে পারিস নি ওই জাহিন মাদা**** এর গায়ে।”
একজন ভয়ে ভয়ে বলে, “ভাই ওই জাহিনের শরীরের ষাঁড়ের মতো শক্তি। ও একাই আমাদের শুয়াইয়া দিছে। ওর দলের ছেলেরা পর্যন্ত ভয়ে ওর কাছে ঘেষতে পারে নি।”
ত্রিনভ পাগলের ন্যায় আচরণ করে বলে, “ঠিক আছে একবার টার্গেট মিস হয়েছে তো কি হয়েছে? সময় আরো আছে ওকে শেষ করে দেওয়ার জন্য।”
কথাটা বলে নিজের বা গালে হাত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “ও আমার গায়ে হাত তুলছে জনসম্মুখে এর প্রতিশোধ তো আমি তুলবোই যেকোনো মূল্যে।”
_______
শেখ বাড়ির সকল সদস্য নির্জীব হয়ে আছে। জোহরা বেগমের আহজারি কমেছে যখন শুনেছেন ছেলে একদম ঠিক আছে কোনো ক্ষতি হয় নি। জাহিন রাত দশটার দিকে বাড়ি ফিরে। যারা যারা আহত হয়েছে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে আর জাহিন নিজে থেকে সকলের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে যেহেতু ওর সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্যই সকলে আহত হয়েছে। গাড়ির শব্দ শুনে জোহরা বেগম বসা থেকে উঠে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার জন্য উদ্ধত হতে নিবেন তখনই জাহিন ভেতরে প্রবেশ করে। ছেলেকে দেখে জোহরা বেগম নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে ছেলের বুকে হামলে পড়ে কাঁদতে শুরু করে। অয়ন্তি স্বামীকে অক্ষত অবস্থায় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। দেয়ালের সাথে শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এতটা সময় নিজেকে কিভাবে যে শক্ত রেখেছে একমাত্র ও ছাড়া কেউ জানে না। জাহিন মাকে শান্ত করার জন্য বলে।
“মা আমি ঠিক আছি একদম ঠিক আছি দেখো কিচ্ছু হয় নি আমার।”
জোহরা বেগম মাথা তুলে ছেলের পানে তাকিয়ে ধরা গলায় বলেন, “তাহলে কপালে কিসের ব্যান্ডেজ তোর?”
“ওইটা আসলে দরজার লৌহার সাথে লেগে একটু ছিলে গেছে।”
“মায়ের সাথে একদম মিথ্যা কথা বলবি না।”
“সত্যি বলছি আমি।”
জারা দরজার পানে তাকিয়ে আছে। একটা টেনশন থেকে মুক্তি পেয়েছে ভাই তার সুস্থ আছে কিন্তু নুহাশ আসছে না কেন এখনও? নুহাশের আবার কোনো ক্ষতি টতি হয়ে যায় নি তো। এমন সময় নুহাশ এসে ভেতরে প্রবেশ করে। নুহাশকে অক্ষত দেখে জারা চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। কারো কোনো ক্ষতি হয় নি বাঁচা গেল। জোহরা বেগম আরেক ছেলেকে সুস্থ সবল দেখে জাহিনকে ছেড়ে নুহাশের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন।
“ঠিক আছিস বাবা।”
নুহাশ মৃদু হেসে বলল, “ঠিক আছি বড় মা।”
জোহরা বেগম এবার রেগে বলেন, “তোদের জন্য চিন্তা করতে করতে একদিন আমি স্ট্রোক করে বসবো দেখে নিস।”
জাহিন কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “উফফ মা কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো বলো তো। আমরা একদম ঠিক আছি।”
আযহার শেখ সহজ গলায় বলল, “ভাবি এবার ওদের ছাড়ো ওরা গিয়ে একটু বিশ্রাম নিক। ধকল তো কম যায় নি ওদের উপর দিয়ে।”
“হুমম তোরা ঘরে যা।”
জাহিনের নজর পড়ে বাবার দিকে। আজমল শেখ ছেলের চোখের সাথে চোখ মিলতেই নিজের রুমে চলে যান। জাহিন টের বুঝতে পারছে তার বাবা তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। মুখে যাই বলুক ছেলের জন্য সারাক্ষণ ভীত হয়ে থাকেন সেটা মুখ দেখলেই বুঝা যায়। জাহিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা অয়ন্তির দিকে তাকাল চিন্তায় মেয়েটার মুখ একটু খানি হয়ে গেছে। জাহিন ধীর পায়ে হেঁটে অয়ন্তির কাছে আসে। অয়ন্তি হাজার চেষ্টা করেও চোখের পানিটা ধরে রাখতে পারে নি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল। জাহিন আলতো হাতে চোখের পানিটা মুছে ধীরে বলল।
“রুমে চলো।”
জাহিন অয়ন্তির ছোট হাতটা নিজের হাতের মুঠোও নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। জোহরা বেগম ছেলে আর ছেলের বউয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মৃদু হাসল। জাহিন আর অয়ন্তির সম্পর্কটা যে এত জলদি পূর্ণতা পাবে এটা ভাবেন ওনি।
নুহাশ জারাকে পাশ কেটে চলে যেতে নিলে থেমে গিয়ে বলে, “জারা তুমি ঠিক আছো?”
জারা নুহাশের দিকে না ফিরে আস্তে করে বলে, “হুম।”
“সরি। সরি ফর এভরিথিং।”
কথাটা বলেই নুহাশ সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। জারা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আর কতবার সরি বলবে এই লোক? কি এমন অন্যায় করছে যার এতটা ডেসপারেট হতে হবে।এবার কি এই একটা সামান্য কারণের জন্য তাদের মাঝে দূরত্ব বাড়িয়ে দিবে নুহাশ। রিহান ভ্রু কুঁচকে বোনের দিকে তাকায়। বোনকে এমন উদাস হতে দেখে বোনের কাছে এসে বলে।
“কি হয়েছে?”
“কিছু না।”
জারা কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না ত্রস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। রিহানের কেমন জানি সন্দেহ লাগছে বোনের হাবভাব দেখে। রিহান বিড়বিড় করে বলে উঠে।
“ভাইয়ের মতো তুইও কি কারো প্রেমে পড়েছিস জারা?”
কথাটা বলে কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলে, “প্রেমে পড়িস না বোন আমার প্রেমে পড়িস না। এই প্রেম যে বিষের থেকেও ভয়ংকর। একবার এই বিষ পান করলে পুনরায় এই বিষ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়।”
#চলবে
প্রকাশিত আগের পর্ব গুলা
https://www.facebook.com/100063894182680/posts/879180814221717/?app=fbl
আমার সব গল্পের লিংক একত্রে
https://www.facebook.com/110256437345301/posts/309897647381178/?app=fbl