#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ১৮
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]
পরন্ত বিকেলে জোয়ার এসেছে সুবিশাল সমুদ্র তটে। সমুদ্রের নীলাম্বর জল ভলভলিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে দিগুণ। জোয়ারের তালেতালে নীলরঙা স্বচ্ছ পানির ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে আঁচড়ে পরছে বিস্তার বেলাভূমি জুড়ে। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে মহাসমুদ্রের গহীন থেকে উঠে তীরে এসে ঠাই নিয়েছে রঙবেরঙের ঝিনুকের দল। হুট করে একনজর দেখলে মনে হবে নীল রঙা অমৃতের মাঝে কেউ চকচকে হীরে-জহরত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। সুক্ষ্ম পায়ে এক কদম করে এগোতে এগোতে সেই অতিব মূল্যবান হিরে জহরতই কুড়িয়ে হাতে থাকা প্লাস্টিকের থলেতে ভরে নিচ্ছে অরু। শীপ থেকে নামার পরেই শুরু হয়ে গিয়েছে ওর এই কর্মকান্ড।ওদিকে বাকি সবাই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে, ঝিনুক কুড়াতে গিয়ে একাই পিছিয়ে পরেছে অরু। পরনে ওর ল্যাভেন্ডার কালারের ফিনফিনে লং ফ্রক, যা গোড়ালি অবধি নেমে এসে গাউনে পরিনত হয়েছে। একহাতে মুক্তা আর ঝিনুক দিয়ে তৈরি কিছু ব্যাংঙ্গলস। হাঁটু সমান লম্বা সিল্কি চুল গুলো শুধু একটা পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকানো। এক ঝলকে দেখলে মনে হবে, এই জনমানবহীন ছেড়া দ্বীপের আধিপত্য শুধুই ওর। ওই যুগযুগ ধরে সমুদ্রে বসবাসরত রূপকথার সেই সাগর কন্যা।যে কিনা এখন ঝিনুক কুড়াতে গভীর মনোযোগী।
অরু পিছিয়ে পরেছে দেখে এলিসা পেছন ঘুরে হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠল ওকে,
— অরু তারাতারি এসো, এতো পিছিয়ে গেলে কি করে?
এলিসার কথার মাথায় ক্রীতিকও এবার সামনে থেকে পেছনে একঝলক চোখ ঘোরালো। চোখে তার বিশাল আকৃতির রোদচশমা, লম্বা স্টাইলিস চুল গুলো সাগর তীরের ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে, বারবার ব্যাকব্রাশ করেও ঠিক রাখা যাচ্ছে না মোটেই। পরনে সাদা টিশার্টের উপর কেলভিন ক্লাইন খচিত ডেনিম ট্রাকস্যুটে গ্লোভাল সুপারস্টার দের মতোই সুপুরুষ লাগছে তাকে ।
এলিসার ডাকে অরু ঝিনুক কুড়ানো বাদ দিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওদের থেকে দূরত্ব কমালো। পেছন পেছন হাটতে হাটতে সুক্ষ্ম চোখে পরখ করতে লাগলো সাথে আসা সবাইকে, এলিসা আল্ট্রা মর্ডান ধাঁচের মেয়ে, এরকম জঙ্গলে ঘেরা দ্বীপে সমুদ্র বিলাশ করতে এসেও তার ফ্যাশনের পরিবর্তন হয়নি একটুও। স্কিনি লেদার প্যান্ট,পায়ে বুট, গায়ে ট্যাং টপ তার উপর লাল রঙা লম্বা কোটি। এলিসার সাথে রঙ মিলিয়ে অর্নব ও লাল রঙের শার্ট পরেছে। যা নিয়ে সেই কখন থেকে সায়র হাসাহাসি করে খিল্লি উড়াচ্ছে।
ওদের থেকে চোখ সরিয়ে অরুর চোখ গেলো ক্রীতিকের দিকে, যে সমুদ্র বিলাশে এসেও এক মনে ফোন ঘাটছে। তবে মজার বিষয় হলো, সাদা কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙে ক্রীতিককে এই প্রথম দেখলো অরু। এমন ব্যাতিক্রম স্টাইলে মানিয়েছেও তাকে বেশ। এই গ্রুপের মধ্যে সায়রই একমাত্র মানুষ যে কিনা পুরোপুরি অরুর মনের মতো।সায়রের মাথার স্ক্রু ওও সবগুলো ঠিক আছে মনে হচ্ছে। সায়র একজন গ্লোভাল মডেল তাই ওর ফ্যাশন আইডিয়াও বেশ ভালো, থ্রী কোয়ার্টারের সাথে ফ্লোরাল প্রিন্টেট শার্ট পরে এসেছে সে।
সবাইকে একে একে পরখ করা শেষ হলে অরুর চোখ গেলো বিস্তার বেলাভূমি ছাপিয়ে গহীন অরন্যের দিকে। প্রথমে কয়েক ধাপে সারিসারি নারিকেল গাছ তারপর থেকে শুরু হয়েছে গহীন জঙ্গল। লোকালয় থেকে কয়েকক্রোশ সমুদ্রপথ পারি দিয়ে তবেই হদিস মেলে অপার সৌন্দর্য বেস্টিত এই ছেঁড়া দ্বীপের। সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত এখানে দেশি-বিদেশি মানুষের তুমুল জমজমাট লক্ষনীয়। যে যার মতোন করে নিংড়ে নিচ্ছে সমুদ্র তীরের ধুলো ময়লা বিহীন পরিস্কার অক্সিজেন মিশ্রিত বায়ু।কেউ কেউ আবার মেতে উঠেছে ঢেউ খেলানো সমুদ্র স্নানে। চিরাচরিত একঘেয়ে জীবন থেকে খানিকটা ফুরসত পেয়ে চারিদিকের সবাই কেমন শিশু সুলভ আচরণ করছে। তবে এতোক্ষন যাবত একনাগাড়ে হেঁটে হেঁটে ওরা ঠিক কোথায় যাচ্ছে সেটাই এখন আপাতত দেখার পালা ।
*****************************************
— আমাদের হাতে সর্বোচ্চ সময় থাকবে দশ মিনিট। এই দশ মিনিটে ওদের ক্লাবের ওয়াইফাই, ইলেকট্রেসিটি,ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আর ওদের নিজস্ব ওয়েবসাইট সবগুলো একই সাথে হ্যা’ক করবো আমি। জেকে বাইক নিয়ে ক্লাবের বাইরে থাকবে, আর সায়র, তুই হবি এলিসার এসিসট্যান্ট। যখন সবগুলো সাইট একযোগে হাতছাড়া হয়ে যাবে, তখন ওরাই নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল লাগাবে,সেই ফাঁকে তুই এলিসা আর ওর বাবাকে গিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরে বেরিয়ে আসবি। এইটা হলো শর্টকাট রাস্তা।জেকে ঠিক এই পজিশনে ওয়েট করবে।
কথাটুকু শেষ করে সায়রের দিকে ল্যাপটপ এগিয়ে দিলো অর্নব।
সায়র ল্যাপটপে চোখ বুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— সবই বুঝলাম কিন্তু আমি কেন এলিসার এসিসট্যান্ট হতে যাবো, তুই হ,আফটার অল তোর পেয়ারে লাল হলো এলিসা।
এলিসা তখন উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের মালা দেখায় ব্যাস্ত। সেদিকে একনজর তাকিয়ে
দাঁত কটমট করে অর্নব বললো,
— তাহলে হ্যা’কিং এর কাজটা বরং তুই কর, দেখি কোন ঘোড়ার ডিম পারিস।
ক্রীতিক ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করতে করতে বললো,
— বাচ্চাদের মতো সিল্যি ঝগড়াঝাটি বন্ধ করে আমার জন্য KTM 390 রেন্ট করার ব্যাবস্থা কর। যেনতেন বাইক রাইড করে মজা পাইনা আমি।
অর্নবের বিরক্তি মাখা চোখ দুটো এবার সায়রের দিক থেকে ঘুরে ক্রীতিকের দিকে গেলো। হেলদোলবিহীন ক্রীতিককে উদ্দেশ্য করে অর্নব তেতে বলে উঠলো,
— তুই কোনো রাইডিং কম্পিটিশনে আসিসনি জেকে, যে তোকে পছন্দের বাইকটাই রাইড করতে হবে।
— ক্রীতিক ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ভাবলেশহীন মুখে বললো,
— দুটো জিনিসে আমি কম্প্রোমাইজ করিনা অর্নব,আর কোনোদিন করবোও না, তারমধ্যে একটা হলো বাইক।
সায়র আগ বারিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— আরেকটা?
ক্রীতিক এবার নিঃশব্দে অরুর দিকে তাকালো, যে এই মূহুর্তে খুবই মনোযোগ সহকারে ভেজা বালুর আস্তর দিয়ে ক্যাস্টল বানাতে ব্যাস্ত। অরুকে বালু দিয়ে ক্যাস্টল বানাতে দেখে সায়রও এগিয়ে গেলো সেদিকে, অরুর পাশে গিয়ে বসে আগ্রহীস্বরে বললো,
— আমি হেল্প করবো?
অরু উল্টো প্রশ্ন করে শুধালো,
— সত্যিই করবেন?
সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে অরুর হাতে হাত লাগায়। অরুকে সাহায্য করতে করতে সায়র খেয়ালই করেনি যে, কেউ একজন ওকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। সেই সাথে অরুকেও।
.
বালুর ক্যাস্টলটা তখন প্রায়ই তৈরি হয়ে গিয়েছে, দুজন মিলে মিশে করায় বেশ সুন্দর ভাবেই ফুটে উঠেছে ডিজাইনটা,এবার ফিনিশিং এর পালা। বালুর আস্তরে আলতো করে হাত বুলাতে গিয়ে অরুর হাতে একটুখানি স্পর্শ লেখেছে কি লাগেনি তৎক্ষনাৎ কয়েক মিটার দূর থেকে কর্কষ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো ক্রীতিক।
— সায়রের বাচ্চাআআ।
আচমকা চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠে পেছনে চাইলো সায়র, কয়েক মিটার দূরত্বে হাত মুঠি করে দাড়িয়ে থাকা ক্রীতিকের মুখ ভঙ্গিমা দেখেই ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছে। ক্রীতিকের রাগে র’ক্তিম হয়ে যাওয়া চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় ও গত আধঘন্টা যাবত সুক্ষ্ম নজরে এদিকেই তাকিয়ে ছিল। আর এই মূহুর্তে সায়রের খবর আছে, নিজেকে বি’পদ মুক্ত করতে সায়র তৎক্ষনাৎ বাম হাত দিয়ে টোকা মে’রে এতোক্ষণ ধরে একটু একটু করে সযত্নে তৈরা ক্যাস্টলটা ঠাস করে ভেঙে ফেললো। এবার শুধু ক্রীতিকের নয় অরুর মেজাজও সপ্তম আসমানে চড়ে গেলো। এক ঘু’ষিতে সায়রের নাক ফা’টিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো শালা ভিতুর ডিম একটা।
সায়র ভয়ার্ত চাহনি নিয়ে একবার ক্রীতিকের দিকে তাকালো তো আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে অরুর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিকের আওয়াজ ভেসে এলো,
— আবার ওইদিকে চোখ দিয়েছিস?
এদের কাহিনি দেখে অরু বিরক্ত হয়ে ধাপ ধাপ পা ফেলে সেখান থেকে চলে গেলো। রাগে দুঃখে কান্না পাচ্ছে ওর, সবাই সব সময় ওর মনটাই কেন ভে’ঙে দেয় কে জানে?
আকাশে সূর্যের তীর্যক আলো মিয়িয়ে গিয়ে গোধূলি নেমেছে। সোনালী আলোর ছটায় ঢেউ খেলানো সমুদ্রের পানিগুলো চিকচিক করছে, সাগরের পার ধরে হাটতে হাটতে ওদের থেকে অনেকটা দুরে চলে এসেছে অরু, তবুও হাটার গতি থামায়নি। ভালো লাগছে না ওর,সবাইকে কেমন পর পর লাগছে,ছোট্ট বাচ্চারা যেমন আম্মুর কাছে যাবো বলে বায়না ধরে, অরুরও তেমন বলতে ইচ্ছে করছে আপার কাছে যাবো। কিন্তু ও তো এখন আর ছোট নয়, তাই সেসব বলে নিজের আত্মসম্মানের বারোটা বাজানোরও কোনো ফুরসত নেই।
ওদিকে সায়র কে ইচ্ছেমত কতগুলো ঝাড়ি দিয়ে, অনেকটা দূরত্ব রেখেই অরুর পিছু নিয়েছে ক্রীতিক। মনে মনে বলছে
—দেখি কতদূর যেতে পারিস, আমি আটকাবো না, আটকাতে গেলে তোর খবর আছে আজ।
এরমাঝেই ক্রীতিক মোবাইল চেইক করে দেখতে পায় ওরা নেটওয়ার্কের বাইরে চলে এসেছে,ওদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে তাই ও এবার দ্রুত পা চালাতে লাগলো অরুকে নিয়ে আসবে বলে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই একটা অযাচিত দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলো ক্রীতিক, দেখলো অরু একটা অচেনা থাই লোকের সাথে একটা পার্স ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। টানাটানি বললে ভুল হবে একপ্রকার জোর জ’বরদস্তি করছে লোকটার সাথে । অরুর পাশেই দাড়িয়ে আছে অদ্ভুত দেখতে একটা কুঁজো বৃদ্ধা মহিলা,যার বিনুনি করা সাদা চুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কুচকুচে কালো চুল। মহিলার ভাবভঙ্গিমাও ভারী অদ্ভুত । ক্রীতিক খানিকক্ষণ দূর থেকে দাড়িয়েই সবটা বোঝার চেষ্টা করলো, তারপর এগিয়ে গিয়ে ফট করে অরুর হাত টেনে ধরে ব্যাগটা থাই লোকটার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— আ’ম এক্সট্রিমলি সরি,ইউ ক্যান গো নাও।
লোকটা ক্রীতিককে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যেতেই, ক্রীতিক তীক্ষ্ণ নজরে ছদ্মবেশী বৃদ্ধার দিকে তাকালো। ওর বাঁজপাখির মতো ধারালো চোখে এক পলক চোখ পরতেই শুষ্ক ঢোক গিলে উল্টো পথে হাটা দিলো বৃদ্ধা।
তৎক্ষনাৎ হিং’স্র বাঘিনীর ন্যায় তেতে উঠলো অরু, কন্ঠে একরাশ বিরক্তি আর ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
— আপনি কেমন লোক বলুন তো? একটা হাইজ্যা’কারের হাতে ওই বৃদ্ধা মহিলার সব টাকা পয়সা তুলে দিলেন? এতোটা নির্দয় কেন আপনি? উনি আপনার মা হলে এই কাজটা করতে পারতেন কখনো? মায়ের শাষণ বারণ ছাড়া উশৃংখল জীবনে বড় হলে এই হয়।
রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে কি থেকে কি বলে ফেলছে অরু তা নিজেও জানেনা। তবে কথার মাঝ পথেই ক্রীতিকের শক্ত হাতের চপেটা’ঘাত এসে আঁচড়ে পরলো ওর নরম তুলতুলে গালে। চ’ড়ের আ’ঘাতটা এতোই জোরে ছিল যে অরুর মনে হলো ওর গালটা এক্ষুনি খসে পড়বে। উরন্ত অ’গ্নিস্ফুলিঙ্গ বি’স্ফোরণের মতোই ব্যাথায় ঝলসে যাচ্ছে গালটা।
— আগে মানুষ চিনতে শেখ, পরে জাজ করতে আসিস ইডিয়েট।
নিজ গালে হাত দিয়ে ছলছলে নয়নে ক্রীতিকের অ’গ্নিমূর্তির দিকে তাকালো অরু। অস্ত যাওয়া সূর্যের সিঁদুর রাঙা আলোয় ওর মুখটা ভ’য়ানক দেখাচ্ছে। ফর্সা আকর্ষনীয় গৌড় মুখটা মূহুর্তেই কেমন লালচে বর্ন ধারন করেছে। তীক্ষ্ণ চোয়ালটা জিদের তোপে তিরতির করে কাঁপছে।অরু মুখ উঁচিয়ে ওর কথার পাছে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ক্রীতিক দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— আমার চোখের সামনে থেকে যা অরু, নয়তো আরও মা’র খাবি।এই মূহুর্তে তোর মুখটাও আমি দেখতে চাইনা।
ক্রীতিকের কথায় পারদের মতো তেজ ছড়িয়ে পরলো অরুর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মাথার মধ্যে আ’গ্নেয়গিরির জলন্ত লাভার মতোই রাগ উগরে উঠছে ভলভল করে, রাগের তোপে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ওর কথা শেষ হতে না হতেই হনহন করে উল্টো পথে হাটা দিলো অরু। ক্রীতিকেরও মাথায় আকাসম জিদ চড়ে আছে, তাই ও নিজেও অরুর কথা চিন্তা না করেই হাটা দিলো অরুর বিপরীত দিকে ।
*****************************************
পুরো একটা দিনের ইতি ঘটেছে হাসপাতালের ছোট্ট কামরায় বসে বসে। সারাদিনের ছোটাছুটি শেষে সন্ধ্যা হতেই ঝরঝরিয়ে ক্লান্তি নেমেছে র’ক্ত মাং’সের তৈরি যন্ত্রের মতো শরীরটায়। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে অনু,গন্তব্য ক্রীতিকের ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়িতে গিয়ে ঘুমালে হয়তো ক্লান্তি কাটবে খানিকটা। বাস স্টপেজ থেকে নেমে দ্রুত হেটে ক্যাফিটেরিয়া পর্যন্ত এলেও ক্লান্তিতে এখন হাঁটার গতি ধীর হয়ে গিয়েছে ওর। মনের মাঝে জমে থাকা একরাশ অভিমান,ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর, প্রতিদিন ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মতো হসপিটালে টু বাড়ি সব কিছু ছাপিয়েও ওর মনে ভেসে বেরাচ্ছে খুশির লাবডুড।আর তো মাত্র কিছুদিন, তারপর মা ঠিক আগের মতো,হাটবে,চলবে,কথা বলবে ওদের দু’বোনকে শাসন করবে, আদর করবে। ও আর অরু আবারও বয়সের মাপকাঠি ভুলে মায়ের আদুরে বাচ্চা হয়ে যাবে।এর চেয়ে খুশির আর কিইবা হতে পারে। এতোসব ভাবনার মাঝেও অনুর অযাচিত মনে এক সুক্ষ্ম কৌতুহল হানা দেয়, মনেমনে ভাবে,
— আচ্ছা মায়ের সুস্থতার পর সব কিছু একই রকম থাকবে তো?
অনু যখন সোডিয়ামের আলো ছায়াকে পেছনে ফেলে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো,তখন আবারও সেদিনের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুখ দু’টো সামনে চলে আসে ওর। রাস্তার পাশেই গাড়ির ডিকিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যয়,তার মুখোমুখি সেদিনের সেই সুন্দরী মেয়েটা। বেশভুসা তার অত্যাধুনিক। কার্ল করা ঢেউ খেলানো চুল গুলো বাদামি রঙের হলেও দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা পশ্চিমাদেশের কোনো সাদাচামড়া নয়, বরং এশিয়ান কোনো দেশের হবে হয়তো, প্রত্যয়ের সাথে যেহেতু দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশীও হতে পারে।
অনু কয়েকমূহুর্ত দাড়িয়ে সবটা পরখ করলো,তারপর এমন ভাবে ওদের অতিক্রম করে চলে গেলো যেন প্রত্যয়কে ও চেনেই না। কিন্তু প্রত্যয় অনুকে দেখা মাত্রই ওর পিছু নিয়েছে।প্রত্যয় পেছন পেছন এগিয়ে আসছে দেখে অনু হাটার গতি দিগুন বাড়িয়ে দেয়, তবুও প্রত্যয়ের পুরুষালী কদমের সাথে পেরে উঠলো না অনুর ক্লান্ত শরীরটা, এক পর্যায়ে পেছন থেকেই ওর বাহু টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো প্রত্যয়। অনু ঝাড়ি মে’রে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে বললো,
— কি সমস্যা?
— আপনার কি সমস্যা? ইগনোর কেন করছেন?
পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে প্রত্যয়।
অনু একটু তাচ্ছিল্য হেসে নিজের ভেতরের অজ্ঞাত বেড়ে ওঠা রাগটাকে কৌশলে আড়াল করে বললো,
— আপনার কেন মনে হলো আমি আপনাকে ইগনোর করছি? আপনাকে ইগনোর করার কি যোগ্যতা আছে আমার?
— কথা এড়াচ্ছেন?
— মোটেই না, অনন্যা শেখ এতোটাও ভীতু নয়।
প্রত্যয় তীর্যক হেসে বললো,
— আই লাইক ইট।
অনু আবারও সামনের দিকে হাটা ধরলো, প্রত্যয় ওর পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে শুধালো,
— ফোন না ধরার কারনটা জানতে পারি?
— ইচ্ছে করেনি তাই ধরিনি।
— আপনার ইচ্ছেরা তো খুব বাজে,এই বলে অনুর পাঁচ আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো প্রত্যয়।
অনু হাটা থামিয়ে আবারও বিরক্তি নিয়ে বললো,
— আবারও হাত ধরেছেন কেন?
প্রত্যয়ের নির্লিপ্ত জবাব
— ইচ্ছে হয়েছে তাই ধরেছি , আমার ইচ্ছেরাও খুব একটা সুবিধার না বুঝলেন।
প্রত্যয়ের কথার পিঠে অনু লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম কন্ঠে শুধালো,
— প্রত্যয় সাহেব, আপনি শুধু আমার, তাইতো?
প্রত্যয় হেসে জবাব দেয়,
— হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
অনুর ফ্যাকাশে ক্লান্ত মুখটায় এতোক্ষণে হাসির ঝলক দেখা দিলো, নিজ হাতটা প্রত্যয়ের আঙুলের ভাজ থেকে বের করে, দুহাতে ওর বাহু আঁকড়ে ধরে মাথাটা এলিয়ে দিলো প্রত্যয়ের কাঁধের উপর।
প্রত্যয় তার গমগমে পুরুষালী হাস্কি স্বরটা কিছুটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— টায়ার্ড লাগছে?
অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে ওকে দু’হাতে উঁচিয়ে কোলে তুলে নিলো প্রত্যয়। পাকিস্তানি প্লাজো আর কামিজ পরেছিল অনু, দোপাট্টা দিয়ে টেনে রাখা মাথার আধখানা ঘোমটা টা সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো ওর। মাঝরাস্তায় প্রত্যয়ের হঠাৎ কর্মকান্ডে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অনু লজ্জিত কন্ঠে মিনমিনিয়ে বললো,
— বাড়ির কাছে চলে এসেছিতো,নামিয়ে দিন কেউ দেখে ফেলবে।
প্রত্যয় বাঁকা হেসে জবাব দেয়,
— বাড়িতে কেউ নেই ডিয়ার।
সেই হাসিতে চিকন ফ্রেমের চশমা পরিহিত প্রত্যয়কে আবারও একদফা নতুন রুপে আবিস্কার করলো অনু।
*****************************************
রাত নয়টা বেজে পয়ত্রিশ, রাতের খাওয়ার সময় হয়েছে। এরপর আবার ঘুমানোর পালা,পরেরদিন সকাল সকাল উঠতে হবে , অথচ অরু এখনো খেতেই আসেনি। অরু যে রুমটায় থাকে তার পাশের রুমটাই ক্রীতিকের। এলিসা অর্নব আর সায়র অন্য ভিলাতে থাকে। তবে খাবারের সিস্টেম বুফে বলে, খাবারের সময় হলে সবাই একই ডাইনিং এ জমায়েত হয় ওরা।
এখন ডিনারের টাইম, ডাইনিং এ সবাই উপস্থিত অথচ অরু নেই। চারদিকে চোখ বুলিয়ে অরুকে না দেখে এলিসা বললো,
— অরু কোথায়? এখনো খেতে আসেনি?
এলিসার কথায় ক্রীতিকও চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললো,
— তোরা শুরু কর আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি, মনেমনে ভাবলো,
— আমি ধ’মক দিয়ে না ডাকলে জীবনেও আসবেনা এই ঘার ত্যারা মেয়ে।
.
অরুকে ডাকতে গিয়ে ক্রীতিক ভিলায় প্রবেশ করতেই ওর ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো, পুরো ভিলা অন্ধকারে ছেয়ে আছে, বিচ থেকে ফিরে সারা সন্ধ্যা আর রুমে আসেনি ক্রীতিক। বাইক ভাড়া করে ব্যাংককের হাউওয়েতে রাইড করে বেড়িয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা। অথচ এতো রাত হয়ে গেলো এখনো লাইট জ্বালায়নি অরু আশ্চর্য।
ক্রীতিক দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে প্রত্যেকটা রুমের লাইট জ্বালালো, অতঃপর অরুর রুমের সামনে গিয়ে ওকে ডাকতে আরম্ভ করলো। ভেতর থেকে কোন সারাশব্দ না পেয়ে ক্রীতিক বিস্মিত হয়ে পরলো, মনে মনে ভাবলো,
— কালকের মতো কিছু হয়নিতো আবার?
কালকের কথা মনে পরতেই পাসওয়ার্ড টিপে তৎক্ষনাৎ ভেতরে প্রবেশ করলো ক্রীতিক। ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ওর শীরদাড়া বেয়ে যেনো শীতল স্রোত নেমে গেলো। মনে হলো কলিজাটা কেউ খাঁ’মচে ধরেছে। পুরো রুম ফাঁকা, তাহলে অরু কোথায়?
.
এলিসা, অর্নব,সায়র কালকের ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করছে আর খাবার খাচ্ছে, এলিসা ভুক্তভোগী অথচ টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে অর্নবের।সেই নিয়েই কখন থেকে হাসছে সায়র। সায়র যখন অর্নবকে নিয়ে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটোপুটি খাবে খাবে ভাব সেই মূহুর্তেই ছো মে’রে ওর কলার চেপে ধরে, ক্রীতিক হুংকার দিয়ে শুধালো,
— অরু কোথায়?
সায়র অসহায়ের মতো বললো,
— অরু কোথায় মানে? সেই যে বিকেলে উত্তম মাধ্যম দিলি তারপর আর আমি অরুর ধারে কাছেও যাইনি, বিলিভ মি, গড প্রমিস। নিজের কন্ঠানালীতে হাত ছুয়িয়ে কথাটা বললো সায়র।
ক্রীতিক আস্তে করে সায়র কে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়, কপালের সবগুলো রগ ফুলে আছে ওর। চোয়াল হয়ে আছে ইস্পাতের ন্যায় শক্ত, সেভাবে থেকেই ক্রীতিক সবার উদ্দেশ্যে বললো,
— অরুকে তোরা নিয়ে আসিস নি?
এলিসা আর অর্নব চোখাচোখি করে মিনমিনিয়ে বললো,
— তুইতো আমাদের আগেই চলে এসেছিস, আমরা আরও ভাবলাম অরুকেও সাথে করে নিয়ে এসেছিস।
–ড্যাময়েট।
সশব্দে শক্ত কাঠের ডাইনিং এ পাঞ্চ বসিয়ে দিলো ক্রীতিক। অতঃপর চেয়ারে ঝুলানো নিজের হুডিটা টা গায়ে চড়িয়ে সায়রের উদ্দেশ্যে বললো,
— সায়র কয়টা বাজে চেইক করতো।আমি দ্বীপে যাবো।
সায়র দ্রুত ঘড়ি দেখে বললো,
— প্রায় দশটার কাছাকাছি, এ সময় অতদূরের দ্বীপে কোন শীপই যেতে রাজি হবেনা। তাছাড়া দ্বীপের শেষ ফেরী সন্ধ্যা সাতটায়।
— তাহলে ইমারজেন্সী হেলিকপ্টার বুক কর।
সায়র একটু আমতাআমতা করে বললো,
— ইয়ে মানে, এতো রাতে হেলিকপ্টার বুক করাটা কিছুটা কস্টলি হয়ে যাবে।
ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ সায়রের দিকে অ’গ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— সো হোয়াট? টাকা কি তুই দিবি?
*****************************************
তিমিরে ঢাকা গভীর অরন্যে পথ হাড়িয়ে পায়ে কাঁ’টা ফুটিয়ে জটলা পাকানো দানবাকৃতির বট গাছের নিচে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অরু। তখন রাগের তোপে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে একমনে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় এসেছে, কোন রাস্তা দিয়ে এসেছে কিছুই মনে নেই ওর। যখন মস্তিষ্কে নাড়া দিলো যে ও গহীন জঙ্গলের মধ্যে চলে এসেছে তখন ঘোর আধারে ছেয়ে গিয়েছে ধরনী। আমাবস্যার রাতে জঙ্গলের মধ্যে এতোই অন্ধকার যে নিজের হাত পা পর্যন্ত খালি চোখে দেখার যো নেই। অরু যখন বুঝেছে যে ও পথ হারিয়ে ফেলেছে, তখন মতিভ্রম হারিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই দিগ্বিদিক ছুটেছে ও। যার ফলে বনবিঁচুডিতে বেধে জুতো সহ পায়ের বিভিন্ন অংশ ছি’ড়ে র’ক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে পা দুটো। হাটতে না পেরে অন্ধকারের মাঝেই অসহায়ের মতো গলা ফাটিয়ে ডেকেছে সবাইকে। অথচ নিরব বেলাভূমিতে একটা মানুষের আওয়াজ ও শোনা যায়নি, বরং ওর ডাকের বিপরীতে ভেসে এসেছে রাত জাগা বন্য প্রানী আর হুতুম পেচাঁর গা গুলানো ভ’য়ানক আওয়াজ। এক পর্যায়ে ডাকতে ডাকতে গলার স্বর ভে’ঙে গিয়েছে ওর। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে শরীর আর মনের জমাট বাঁধা ব্যাথা নিয়েই গাছের নিছে বসে পরেছে অরু। ফুপিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে নিস্তব্ধ অরন্য। কান্নার তালেতালে কেঁপে উঠছে ওর ছোট্ট শরীরটা।
এভাবেই কিছু সময় অতিবাহিত হয়, অরু এখনো হাটুতে মুখ গুঁজে কাদঁছে।চারিদিকে তাকাতেও কেমন গা ছমছম করছে ওর, সেসময় হঠাৎ শুকনো পাতার মরমর আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে সামনে চাইলো অরু, চারিদিকে অন্ধকার সামনে পেছনে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা অথচ পায়ের কাছে কোনোকিছুর উপস্থিতি সুস্পষ্ট। কিন্তু কি? ব্যাপারটা বোঝার জন্য নিজের একপায়ের ছেড়া জুতোটা দুরে ছুড়ে মারলো অরু, সঙ্গে সঙ্গে ফনা তুলে হিসহিসিয়ে উঠলো, জংলী এক সরীসৃপ। হঠাৎ করে নিজের এতো কাছে সাপের উপস্থিতি টের পেয়ে ক্রন্দনরত মুখটাকে দু-হাতে চেপে চোখ মুখ খিঁচে দৌড় লাগালো অরু। অন্ধকারে দৌড়াতে গিয়ে বনবিচুঁডিতে বেধে বারবার হুমড়ি খেয়ে পরছে ও,তবুও শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পুনঃরায় দৌড়াতে লাগলো অরু। একপর্যায়ে চোখের সামনে জলন্ত দুটো চোখের উপস্থিতি টের পেয়ে সে ছোটার গতি আবারও থমকে গেলো ওর। হঠাৎ করে অন্ধকার জঙ্গলে এমন জলন্ত চোখ দেখে, ভ’য় আ’তঙ্কে জর্জরিত হয়ে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো অরু। মনে মনে ভাবলো,
—এটা আবার কি? কোনো বাঘ ভাল্লুক নয়তো? এবার আমি কোন পথে যাবো? কাল সকাল অবধি আদৌও বেঁচে থাকবো তো?
ওই ভয়’ঙ্কর চোখ দুটো ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে , ব্যাপরটা বুঝতে পেরে আবারও উল্টো পথে ছুট লাগালো অরু। দৌড়াতে গিয়ে গাছের সাথে লেগে জামার হাতাটা ছিড়ে পিঠ অবধি নেমে এসেছে, তবুও থামলো না অরু, জীবন বাজি রেখে দৌড়াতে লাগলো যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকে। এভাবে ছুটতে ছুটতে মাঝপথে হঠাৎ করেই আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ওর। দ্রুত বেগে দুহাত চলে গেলো চোখের উপর।তীব্র ঘূর্ণন বাতাসে হাটু সমান লম্বা চুল গুলো উড়ে যেতে চাইছে যেন। এতোবেশি তীব্র বাতাস আর শব্দতে মনে হচ্ছে, শুধু চুল নয়, রোগা পাতলা গড়নের অরুও বোধ হয় উড়ে যাবে উচ্ছিষ্ট আবর্জনার ন্যায়।
কিসের এতো বাতাস, আর শব্দ?সাগর পারে কি ঘূর্নিঝড় শুরু হলো কিনা, বোধগম্য হলোনা অরুর, এতোক্ষণ অন্ধকারে থাকা চোখ দুটো হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে যেন এখন পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই বেশ কিছুক্ষন বাদে একটু রয়েসয়ে চোখ দুটো খুললো অরু, আর চোখ খোলা মাত্রই মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে যেন ধরেপ্রান চলে এলো ওর।
হেলিকপ্টারের নিয়ন আলোতে অরু দেখলো, ওর থেকে বেশ অনেকটা দুরে বিশাল হেলিকপ্টারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা মতো একজন। পরনে তার কালো হুডি। নিস্প্রভ চোখ দুটো অাহতদের মতো অরুর দিকেই নিবদ্ধ তার। চারিদিকে ভালোভাবে তাকিয়ে এতোক্ষনে অরু খেয়াল করলো ও দৌড়াতে দৌড়াতে সাগরপাড়ে চলে এসেছে। আর চোখের সামনে যে মানুষটা নিস্প্রভ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সে আর কেউ নয় সয়ং ক্রীতিক। ওর সেভিয়র। মানুষটা ক্রীতিক এটা বোধগম্য হতেই দৌড়ে গিয়ে ওর বুকে ঝাপিয়ে পরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো অরু। অরু এতোটা জোরেই ক্রীতিকের বুকে ঝাপিয়ে পড়েছিল যে ক্রীতিকের পেশিবহুল শরীরটাও কম্পিত হয়ে ওঠে । কা’দঁতে কা’দঁতে একহাতে ক্রীতিকের হুডি খামঁচে ধরে অন্যহাত দিয়ে ক্রমাগত ওর বুকে আ’ঘাত করে যাচ্ছে অরু। বিপরীতে ক্রীতিক টু শব্দও করছে না, চুপচাপ চোখ বন্ধকরে দাঁড়িয়ে আছে। কারন এই মূহুর্তে উপরওয়ালার কাছে ওর চেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ হয় আর কেউ নেই।
.
ক্রন্দনরত অরু এখনো ওকে ইচ্ছে মতো কি’লঘু’ষি দিয়ে যাচ্ছে, ক্রীতিক তাতে নজর না দিয়ে আলতো হাত বুলিয়ে দিলো অরুর নরম তুলতুলে গালে, যেখানটায় ওর পাঁচ আঙুলের ছাপ এখনো দৃশ্যমান। ইচ্ছেতো করছে আরও গভীর ভাবে আদর করে দিতে।কিন্তু তাতো সম্ভব নয়, তাই নিজের হুডিটা খুলে, সেটা দ্বারা অরুর পুরো শরীর ঢেকে দিয়ে,ওকে কোলে নিয়েই উঠে গেলো চলন্ত হেলিকপ্টারে।
অরু এখনো ক্রীতিকের কলার ছাড়েনি, একইভাবে ধরে রেখেছে, ওর বোধ হয় বিশ্বাস ছিল ক্রীতিক ওকে রেখে দ্বীপ ছেড়ে যাবেনা,কিছুতেই যাবেনা।
চলবে….