#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ২০
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]
[ আগেই বলে রাখছি গল্পের নায়ক ট’ক্সিক]
নিশুতিরাতে জোয়ার ভাঁটার উদ্যম গতি আর সামুদ্রিক ঢেউয়ের বিশাল গর্জনে চারিদিক অপার্থিব লাগছে। মাঝরাতের পরও কেটে গিয়েছে আরও কয়েক প্রহর। রাত জাগা পানকৌড়ি গুলো এখনো চিঁউচিঁউ করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো বেলাভূমি জুড়ে। চোখের সামনে জ্বলছে ফায়ারপ্লেসের দাউদাউ অ’গ্নিশিখা, সেথা থেকেই কাঠকয়লা পো’ড়ানো মটমট আওয়াজ ভেসে আসছে। ক্রীতিকের ভাসা ভাসা চোখ দুটোতে জলন্ত অ’গ্নিশিখার প্রতিচ্ছবি বিদ্যমান। সায়র ফায়ারপ্লেসের আ’গুনে আরও কয়েকটা কাঠের টুকরো দিয়ে ক্রীতিক আর অর্ণবের মুখোমুখি হয়ে বসে পরলো। অতঃপর নিজেদের মনের হাজারো কৌতুহল মেটাতে সায়র যখন ক্রীতিককে কিছু প্রশ্ন করতে যাবে, ঠিক তখনই অর্নব ওকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বোঝায়,
— আমি জিজ্ঞেস করছি।
ক্রীতিক তখনও আপন মনে জ্বলন্ত অ’গ্নিশিখার হেলদোল পরখ করায় ব্যাস্ত। অর্নব ওকে ডেকে বলে,
— সবাইকে রেখে অরুর প্রতিই এতো অবসেশট কেন তুই?
ক্রীতিক নিস্প্রভ চোখে জবাব দেয়,
— আই ডোন্ট নো!
অর্নব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আচ্ছা কবে থেকে এসব শুরু হয়েছে সেটা তো বল? তাছারা ওর জন্যে যদি তোর এতোই টান তাহলে বাংলাদেশে যাসনা কেন তুই?
ক্রীতিক একটু উপহাস করে হেঁসে বললো,
— কে বলেছে ওর জন্য আমার টান? ও আমার আসক্তি। মানুষ জানে নে’শা খারাপ জিনিস, তবুও নে’শাগ্রস্থরা নে’শা ছাড়তে পারেনা, অরুও আমার কাছে নে’শার মতোই , আমি জানি ওর আমার সম্পর্কে আগুন পানি সম জটিলতা তবুও ওকে আমার চাই।এট এনি কস্ট।
সায়র পাশ থেকে বলে ওঠে,
— তাহলেতো তুই অরুর প্রেমে পরেছিস।
ক্রীতিক কপট হেসে জবাব দেয়,
— এগারো বছরের বাচ্চা মেয়ের প্রেমে কে পরে ভাই?তবে হ্যা,আ’ম সিওর, আমি বাংলাদেশে থাকলে এতোদিনে অরু আমার বাচ্চার মা হয়ে যেতো । ওই জন্যই তো দেশে যেতাম না, কারণ ওর কাছে গেলে নিজেকে সামলানো, উত্তাল সাগরে পাল তোলা ডিঙি নৌকা সামলানোর মতোই মুশকিল।
সায়র আর অর্নব হতভম্ব হয়ে ক্রীতিকের পানেই চেয়ে আছে, দু’জনের মনেই একই প্রশ্ন কি বলছে এই ছেলেটা?
ওদের চোখে হাজারো কৌতুহলের ছড়াছড়ি দেখে, ক্রীতিক ভাবতে থাকে, ঠিক কবে নাগাত শুরু হয়ে ছিল সবকিছু, তারপর খানিকক্ষণের নিরবতা ভেঙে বলতে শুরু করে,
— অরু যখন প্রথম ক্রীতিক কুঞ্জে আসে, তখন আমি সবে সবে কলেজ পাশ দিয়ে ভার্সিটিতে উঠেছি মাত্র। তখন আমার কাছে জীবন মানে, আভিজাত্য, কতৃত্ব,পাওয়ার এসবই। কারণ ছোট বেলা থেকেই আমাকে এটাই শিখানো হয়েছে, যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে গেলে পূর্ব পুরুষদের পথ অনুসরণ করো। আমিও তাই করেছি। ছোট বেলা থেকেই ন্যানি, ট্রেইনার,মাস্টার এদের কাছে লালিত পালিত হতে হতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম পরিবার বলে কিছু হয়,তারপর যখন একটু ম্যাচিউর হই, তখন প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার জোরে আশেপাশের সবাইকে নিজেই কট্রোল করতে শুরু করি, আমার হাতের ইশারাতে সবাই যখন পুতুলের মতো নাচতো তাতে আমার অন্তরে পৈচাশিক আনন্দ হতো। তখন থেকেই ডমিনেটিং স্বভাবটা ভেতরে ঢুকে গিয়েছে, যা এখনো বদলাতে পারিনি আমি।
কলেজে ওঠার পর পারিবারিক সূত্রেই আমার রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয়। প্রথম প্রথম বাবা বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠান,সভা সমাবেশে নিয়ে গেলেও পরক্ষণে বাবার হয়ে আমারই যেতে হতো,একপর্যায়ে বাবা নয় সয়ং আমার জন্যই আমাকে যেতে হতো। ততদিনে প্রফেসর হওয়া, বিজনেস সামলানো কিংবা আমার শখের রাইডিং সব কিছুই ছিল দিবাস্বপ্ন মাত্র। কারন আমার ধ্যান,জ্ঞান সবকিছুই তখন রাজনীতিতে নিবদ্ধ।তখন মনে হতো, নিজে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়েও ক্ষমতার জোরে পাবলিক ভার্সিটিতে লিড দেওয়ার মতো পৈশাচিক তৃপ্তি আর কিছুতে নেই।
বাইরের জগতে এতো সুনাম, এতো জনপ্রিয়তা, এতো স্বজনপ্রীতি লোকেদের ভীড়েও দিন শেষে আমি ছিলাম নিঃসঙ্গ , যার উদরে আমার জন্ম হয়েছিল, যে খুব ছোট্ট বেলায় আমাকে ফেলে নিজের আত্মতৃপ্তির উদ্দেশ্যে নিজ দেশে পারি জমিয়েছিল,সেই বিদেশিনী মাকে বরাবরই ঘৃণা করে এসেছি আমি, তার সাথে মায়ের জাতি টাকেও। কেনো যেন আত্মিক টান কখনোই ছুঁতে পারেনি আমাকে, হয়তো ছোট থেকেই মায়ের মমতাহীন বেড়ে ওঠা সেজন্য । এভাবেই হাজারো মানুষের বেস্টনে একাকী, বিষন্ন জীবনটা ভালোই যাচ্ছিল । অনায়াসে দিন পার করে দেওয়ার মতো অনেক ব্যাস্ততাই ছিল তখন আমার কাঁধে। কখন বাড়িতে ফিরতাম, কখন বেরিয়ে যেতাম কেউ তার হদিস জানতো না। বলতে গেলে আমাদের পরিবারটা দিনকে দিন রাজনীতি প্রাঙ্গনে পরিনত হচ্ছিল, একই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কেউ কারও খোজ নিতাম না আমরা।
এক পর্যায়ে পরিবারের এরূপ ভাঙন লক্ষ করে দাদাসাহেব মৃ’ত্যু সজ্জায় এসে বাবাকে আবারও বিয়ে করতে বলেন। দাদার কথা রাখতে বাবাও সেই বয়সে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ঠিক তখনই আমার সৎ মায়ের সাথে পরিবারে আগমন ঘটে আরও দুই সদস্যের অরু আর অনু।
ওদের বাবার সম্মন্ধে আমার কিছুই জানা নেই। জানা থাকার কথাও না, কারণ বাবার বিয়ে নিয়ে আমার কোনোরূপ মতামত ছিল, না আমার এসবে কিছুই আসে -যেত।আর কিভাবেই বা আসবে? পরিবার কি জিনিস সেতো আমি জানিই না। ওরা ওদের মতো দিন কাটাতো,পড়াশোনা করতো আর আমি আমার মতো। ওই সময় অরুর দিকে ঠিক করে কখনো তাকিয়েছিলাম কিনা সেটাই বলা মুশকিল । যদিও বা কখনো সামনে পেয়েছি ধরে ঠাস ঠাস করে থা’প্পড় মেরেছি। তবুও আমার রুমে সারাক্ষণ উঁকি ঝুঁকি দিতো মেয়েটা, সুযোগ পেলেই রুমে এসে এটা-ওটা ধরতো। মাঝেমধ্যে তো বিরক্ত হয়ে খুব মা’রতাম।
ক্রীতিকের কথার মাঝে হুট করেই সায়র ফোড়ন কেটে বলে,
— তুই কিরে, এখন যার জন্য দিওয়ানা হয়ে ছটফট করিস, তখন তাকে এভাবে মা’রতিস?
ক্রীতিক মৃদু হেসে বলে,
— আই উইশ, অরু আগের মতো এখনো আমার রুমে উঁকি ঝুঁকি দিতো।
— আর তুই ওঁকে ঠাস ঠুস করে মা’রতিস।
অর্নব সায়রকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— আহা! থামতো তুই, জেকে তারপর কি হয়েছিল?
ক্রীতিক পুনরায় বলতে শুরু করে,
— অরুর মা সুদক্ষ এবং স্মার্ট মহিলা ছিল, যার জন্য বাবার সাথে ব্যাবসায়িক কাজে বিভিন্ন যায়গায় যেতেন তিনি, বলতে গেলে বাবাকে সাহায্য করার জন্যই, তবে আমার সাথে তার খুব একটা সাভাবিক সম্পর্ক ছিলোনা,যার দরুন সপ্তাহে একবারও আমাদের মুখ দেখাদেখি হতোনা, যদি হতো সেটাও অরুর জন্য, অরুকে মা’রলে সেটা নিয়ে নালিশ যেত বাবার কাছে।
বিপরীতে বাবার থেকে পেতাম হাজারটা তিরস্কার আর ভ’ৎসনা। এসবের কারনে মনে মনে জিদ হতো অরুর প্রতি,জিদের বসে দ্বিতীয়বার আমার রুমে এলে আরও বেশি করে মে’রে দিতাম ওকে।
এরকম যেতে যেতে বছর খানিক চলে যায়, তারপর একদিন, এটুকু বলে থেমে যায় ক্রীতিক,
সায়র, অর্নব দুজনই উৎকন্ঠা নিয়ে শুধালো –তারপর একদিন?
এবার ক্রীতিক নিজেও ভাবতে থাকে সে রাতের কথা,
পূর্নিমা রাত,আকাশে রূপোর থালার মতো মস্তবড় চাঁদ উঠেছে।চাঁদের নিয়ন আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিপাশ। ক্রীতিক কু্ঞ্জের মহলের ছাঁদটার আয়তন ছোট্টখাটো ফুটবল খেলার মাঠের মতোই বৃহৎ। জোছনা রাতে মায়ের অনুমতি সাপেক্ষ ছাঁদের পাঁচিল থেকে আচারের বয়াম গুলো ঘরে আনতেই ছাঁদে এসেছিল অরু। তখনই পাঁচিল ঘেষে দাড়িয়ে থাকা পুরো দস্তুর কালো দিয়ে আবৃত লম্বা মতো কাউকে দেখতে পেয়ে, অকস্মাৎ ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে অরু। তবে গলার স্বর বাইরে বেরোনোর আগেই শক্ত হাতে ওর মুখ চে’পে ধরে ক্রীতিক। অরু থেমে গিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাতেই ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বলে,
— তুই এখানে কেন?
ক্রীতিকের কথায় উত্তর না দিয়ে অরু,মিনিমিনিয়ে বলে,
— আপনার তো জ্বর এসেছে, হাতটা কেমন আ’গুনের গোলার মতো গড়ম হয়ে আছে।
ক্রীতিক অরুর শরীরে একপ্রকার ধা’ক্কা দিয়ে বলে,
— জ্বর আসলে তোর কি? যা করতে এসেছিস সেটা করে নেমে যা, জ্ব’রের ঘোরে তোকে দেখতে ইচ্ছা করেনা।
ক্রীতিকের রগচটা সভাব চরিত্র সবকিছুই অরুর জানা, তাই ও আর না বারিয়ে চুপচাপ আচারের বয়াম নিয়ে ছাঁদ থেকে নেমে যায়।
***************************************
মাঝরাত, কারেন্ট থাকা সত্বেও রুমের চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জ্বরের ঘোরে অন্ধকার রুমে শুয়েই থরথর করে কাঁপছে ক্রীতিক। সন্ধ্যা রাতে দুই দুইটা প্যারাসিটামল খেয়েও কাজ হয়নি,উল্টে হাড়কাঁপিয়ে দিগুণ তালে জ্ব’র উঠেছে। পার্টির লোকেদের থেকে বারবার কল আসাতে মোবাইলটাও বন্ধ করে রেখেছে ও। অনেক বেশি জ্বরের তোপে অন্ধকার রুমের মাঝেই জোনাকিপোকা দেখছিল ক্রীতিক।ঠিক তখনই গভীর তিমিরকে হটিয়ে একটা মোমবাতি সমেত রুমে প্রবেশ করে কিশোরী অরু। পরনে তার কালো রঙের কামিজ মাথায় আধটানা ঘোমটা। ক্রীতিক তখনও জ্বরের তোপে বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল, অরু মোমটা নিয়ে রুমের মাঝে এগিয়ে এসে নিজে থেকেই বললো,
— বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে, জেনারেটর ও নস্ট হয়ে পরে আছে, আপনার তো জ্বর তাই ভাবলাম মোমবাতি নিয়ে আসি।
— মোমবাতির প্রয়োজন নেই আমি অন্ধকার ভালোবাসি, তুই যাতো।
ক্রীতিকের এহেন ধমকেও অরু যায়না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ওর পাশ ঘেঁষে। অরুকে অনেকক্ষন যাবত দাড়িয়ে থাকতে থেকে ক্রীতিক হাস্কি স্বরে নাক টেনে বলে,
— কি হলো যাচ্ছিস না যে? আবারও মা’র খাওয়ার শখ জেগেছে? শখ জেগে থাকলে কাছে আয় থা’প্পড় দিচ্ছি।
অরু মুখ কাঁচুমাচু করে বলে,
— মা আঙ্কেলের সাথে শহরের বাইরে গিয়েছে,মামির অসুখ শুনে সকাল সকাল আপাও নানা বাড়ি গিয়েছে, বলেছিল বিকেলের মধ্যে ফিরবে কিন্তু ফেরেনি, এখন আবার কারেন্টও নেই, আমার অন্ধকারে ভয় করছে ভাইয়া, এখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকি, কারেন্ট এলেই চলে যাবো।
অরুর আকুতিভরা টলটলে চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে নিজে একটু সরে গিয়ে অরুর জন্য বিছানাতেই যায়গা করে দিলো ক্রীতিক। অরুও টু শব্দ না করে ভয়ে ভয়ে সেখানটায় গিয়ে বসে পরে।
ক্রীতিক চোখ দুটো বন্ধ রেখেই অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
— ভালো করে বস মা’রবো না।
অরু এবার ভালোভাবেই বসে, হাতে থাকা জলপট্টিটা ক্রীতিকের কপালে রেখে দেখে দেয়।
ক্রীতিক ভ্রুকুটি করে চোখ উল্টে সেটার দিকে তাকিয়ে বললো,
— এটা কি দিয়েছিস?
অরু জানায়,
— জ্বর হলে মা আমাদের মাথায় এটা দিয়ে রাখে, এতে অনেকটা আরাম লাগে,আপনি অন্ধকারে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন, মনে হলো আপনার এটা প্রয়োজন তাই নিয়ে এসেছি।
অরুর কথা শুনে ক্রীতিক ওর মুখের পানে চাইলো,গত দের বছরে আজই বোধ হয় প্রথম ঠিকভাবে অরুর মুখের দিকে চাইলো ক্রীতিক,
সদ্য কিশোরীতে রূপ নেওয়া কচি একটা চেহারা। টিমটিমিয়ে জ্বলতে থাকা মোমের হলদে আলোও ওর চেহারাটা অস্পরীর মতোই সুন্দর লাগছে তীব্র জ্বরের ঘোরে থাকা ক্রীতিকের নেশালো চোখ দুটোতে। হুট করেই কেন যেন মনে হচ্ছে অরুর মতো মায়াবী মুখ পৃথিবীতে আর দুটো নেই।
ক্রীতিককে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে অরু ঠোঁট কামড়ে একটু এগিয়ে এসে জলপট্টিটা আবারও উল্টে দিলো।
— আমার জন্য কেন করছিস এসব?
ক্রীতিকের অজ্ঞাত প্রশ্নের উত্তর নেই অরুর কাছে, কিইবা বলবে ও? দেখছে মানুষটা জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে, অথচ কাউকে মুখ ফুটে বলছেনা অবধি , একা একাই কষ্ট সহ্য করছে, তাইতো হাতে করে জলপট্টিটা নিয়ে আসা।
— কি হলো, কিছু বল?
অরু আস্তে করে জবাব দেয়,
— আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছিল তাই।
ক্রীতিকের মতো পরিবারচ্যুত, বেপরোয়া, বেখেয়ালি, মায়ার বাঁধনহীন ছেলের কাছে অরুর অযাচিত মনে মুখ ফসকে বলা এই বাক্যটা ছিল আকাশসম আন্তরিকতা। অরুর কথায় অধিক তাপমাত্রায় দা’উদাউ করে জ্বলতে থাকা হৃদয়টা হঠাৎ করেই কেমন শীতল হয়ে গেলো, উল্টে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো দিগুন তালে।হুট করেই মনে হতে লাগলো অরু ওর আপন, খুব আপন।
অরুর দিকে তাকিয়ে হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই কখন যে বিদ্যুৎ চলে এসেছে টের পায়নি ক্রীতিক,টের পাওয়ার কথাও নয়,কারন এই রুমে এখনো আলো জ্বলছে না, বাইরের ঘরে মৃদু আলো জ্বলতে দেখে অরু বলে,
— বিদ্যুৎ চলে এসেছে, এবার আমি যাই।
ক্রীতিক অরুর হাত টেনে ধরে, ঘোর অসম্মতি জানিয়ে বলে,
— কোত্থাও যাবিনা তুই, এখানে বসে থাক আমার সামনে।
— কককেন?
ক্রীতিক হাস্কি স্বরে জবাব দেয়,
— তোকে দেখবো তাই।
ক্রীতিক শক্ত করে অরুর হাত ধরে রেখেছে,
উপায়ন্তর না পেয়ে অরু সেখানেই বসে থাকে সারারাত, একপর্যায়ে ঝিমুতে ঝিমুতে কখন যে ক্রীতিকের বুকের উপরই ঘুমিয়ে পরেছে সেটা অরুর অজানাই রয়ে যায়, অথচ ক্রীতিকের চোখে একফোটাও ঘুম নেই, ও সারারাত জেগে ঘোর লাগা চোখে অরুকে দেখেছে, সময়ের সাথে সাথে মোমের আলো ফুরিয়ে গিয়েছে, তবুও দেখেছে, শেষমেশ অরু যখন ক্রীতিকের বুকেই ঘুমিয়ে পরে, তখন দ্বিতীয়বারের মতো আবারও হৃদস্পন্দন গতি হারায় ক্রীতিকের। ও চোখ দুটো বন্ধ করে হিসহিসিয়ে বলে,
— তুই আমার অরু, খুব তারাতাড়ি বড় হয়ে যা, তোকে আমি দেখবো, সারাজীবন ধরে দেখবো।
*****************************************
সেদিন রাতের পর থেকেই ক্রীতিকের হৃদয়ে বাসা বাধে অরুর প্রতি অজানা এক আসক্তি। যার কোনো নামদাম নেই, শুধু হৃদ মাঝারে বয়ে চলা এক সুপ্ত, গভীর, আর বেসামাল অনুভূতির ছড়াছড়ি । ধীরে ধীরে সবার আড়ালে শুরু হয় অরুর প্রতি নিজের দখলদারি। অরু যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতো সেই রাস্তায় সবসময় দুজন লোক লাগানো থাকতো। অরু কার সাথে মিশছে কার সাথে ঘুরছে,বন্ধু মহলে কোনো ছেলের আনাগোনা আছে কিনা সব কিছুরই পাই টু পাই খবর নিতো ক্রীতিক, অরু আম পারতে গিয়ে গাছ থেকে পরে ব্যাথা পেয়েছে বলে,সেদিনই বাপ দাদার আমলের ঐতিহ্যবাহী আম গাছকে কে’টেকুটে বাড়ি থেকে বিদায় করে ক্রীতিক । বাড়ির ঐতিহ্য,বাবা দাদার স্মৃতিকে এভাবে কেটে ফেলায় ছেলের বেপরোয়া কান্ডে জামশেদ জায়ান চৌধুরী ও হতবাক হয়েছিলেন, কিন্তু বলার মতো কিছু নেই তার।কিইবা বলবেন?ছেলে কি তার কথা শোনে?
এভাবে সময়ের পরিবর্তনে সেই আসক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে দিগুণ হারে, স্কুল ব্যাতিত ক্রীতিক কুঞ্জের বাইরে পা রাখা নিষিদ্ধ হয়ে যায় অরুর জন্য। কিশোরী অরুর মাথায় ঢোকেনা, হঠাৎ করেই ক্রীতিক কেন তার উপর এতো অধিকার দেখাচ্ছে। আগেতো কখন আসতো কখন যেত তারই হদিস থাকতো না, আর এখন বাড়িতে কেউ না থাকলেই ক্রীতিককে দেখতে পায় অরু। শুধু দেখতে পায় বললে ভুল হবে, ওকে জোর জ’বরদস্তি করে নিজের সামনে বসিয়ে রাখে ক্রীতিক,চোখের সামনে থেকে সরলেই গালে এসে আঁচড়ে পরে শক্ত হাতের থা’প্পড়। থা’প্পড় খেয়ে অরু কাঁদলে পুনরায় থা’প্পড়।
*****************************************
এভাবেই দিন যাচ্ছিল, সবার অগোচরে ভেতরের সুপ্ত অনুভূতি গুলো তরতর করে বাড়ছিল ক্রীতিকের মাঝে।ক্রীতিকের হুটহাট করা পাগলামিতে বিরক্ত হয়ে আজকাল আর আগের মতো ওর রুমের ধারে কাছেও ভেরে না অরু। মাঝেমধ্যে ওকে একনজর দেখে চলে যাবে বলে,ওর নাম করে ক্রীতিক জোরে জোরে ডাকে, তবুও সেদিকে পা বাড়ায় না অরু।
তবে আজকে দুরুদুরু বুকে সেই আসতেই হলো ক্রীতিকের রুমের সামনে। বাড়ির অফিস রুমে পার্টি অফিসের মিটিং চলছে, সবাই উপস্থিত, অথচ ক্রীতিকের খবর নেই,মোবাইল বন্ধ করে অন্দরমহলে বসে সে কি করছে কে জানে? মিটিং এর মাঝে সবাই তর্ক বিতর্কে ব্যাস্ত, তাই জামশেদ জায়ান চৌধুরী অরুকে ডেকে বলে,
— তোমার ক্রীতিক ভাইয়াকে ডেকে দাওতো অরু।
তার কথা রাখতেই আপাতত ভর সন্ধ্যাবেলা ক্রীতিকের রুমে কড়া নেড়েছে অরু।
অরু কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে ওকে হ্যাঁচকা টানে ভেতরে নিয়ে গেলো ক্রীতিক, ভেতরে নিয়ে গিয়ে চোখ রাঙিয়ে অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
— গত দুদিন ধরে ডাকছি তোকে?সামনে আসছিস না কেন কি সমস্যা?
অরু মুখ ঝামটি দিয়ে বলে,
— সবসময় বকাঝকা করেন, গায়ে হা’ত তোলেন আপনাকে আমার বিরক্ত লাগে।
— আগেতো মা’রলেও পেছনে ঘুরঘুর করতি তখন বিরক্ত লাগতো না?
— তখন তো বুঝতাম না যে আপনি আমায় এতো অপছন্দ করেন, এখন তো বুঝি আমি আপনার সৎ বোন,তাই আমাকে দু-চোখে দেখতে পারেন না আপনি।
অরুর কথা শেষ হতে দেরি হলো, তবে ওর শরীরে ক্রীতিকের হাত পরতে দেরি হলোনা। ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— এটা কেন দিয়েছি জানিস? নিজেকে আমার সৎ বোন দাবি করার জন্য, তুই আমার বোন না, আমার বোন হওয়ার কোনো যোগ্যতাই তোর মাঝে নেই। আর না আমি তোকে বোনের নজরে দেখি।
মা’র খেয়ে গালে হাত দিয়ে মেঝেতে বসেই ফুপিয়ে কাঁদছে অরু।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ক্রু’দ্ধ মস্তিষ্কটাকে স্থীর করে অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে পরে ক্রীতিক, তারপর আলতো হাতে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
—আ’ম সরি অরু,খুব লেগেছে? কেন আমাকে এভাবে য’ন্ত্রনা দিস বলতো? তুই যখন আরেকটু বড় হবি তখন আমার আজকের কথাগুলি ঠিক বুঝতে পারবি, ততদিন শুধু তোকে একটু দেখে দেখে রাখতে হবে আমার।
ক্রীতিকের মুখে আদুরে আওয়াজ শুনে অভিমানে অরু এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠলো,
এভাবে নাক ফুলিয়ে কাঁদায় ওকে অনেক বেশি আকর্ষনীয় আর মায়াবী লাগছিল ক্রীতিকের চোখে, তাই নিজেকে সংযত না রাখতে পেরে হুট করেই ওর গালে সশব্দে চুমু খেয়ে বসলো ক্রীতিক। তবে ওদের বসার ধরনটা এমন ছিল যে, যে কেউ পেছন দিক থেকে দেখলে ভুল বুঝতে পারে, হলোও তাই।
মিসেস আজমেরী শেখ বাড়িতেই ছিলেন সেদিন, ক্রীতিকের রুম থেকে মেয়ের ক্রন্দনরত আওয়াজ শুনেই তিনি বুঝে গিয়েছেন আবারও হয়তো তার ছোট মেয়েটাকে মে’রেছে ক্রীতিক।
তৎক্ষনাৎ তিনি মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য ক্রীতিকের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন, তবে রুমে প্রবেশের আগেই পা দুটো আটকে গেলো তার, সন্ধ্যা রাতের আবছা আলোয় তিনি স্পষ্ট দেখেলের তার ছোট্ট মেয়েটার সাথে ঘনিষ্ঠ সময় পার করছে ক্রীতিক।
***************************************
পার্টি অফিসের ছোট বড় সবার সামনে, পরপর অনর্গল থা’প্পড়ের আ’ঘাতে র’ক্তাক্ত হয়ে উঠেছে ক্রীতিকের গৌড় মুখমন্ডল। আর দুটো থা’প্পড় দিলেই হয়তো নাক ফে’টে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেরিয়ে আসবে।
তবুও কিছুতেই থামানো যাচ্ছেনা জামশেদ জায়ান চৌধুরীকে। রা’গের তোপে থরথর করে কাঁপছেন তিনি, হাতের পাশাপাশি মুখ দিয়ে যা আসছে সেটা বলেই আ’ঘাত করছেন নিজের একমাত্র ছেলেকে। অরু অনু ওর মায়ের আঁচল ধরে রুমের এককোণে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জামশেদ জায়ান চৌধুরী ওকে মা’রতে মা’রতে ক্লান্ত হয়ে বললেন,
— আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল কোনো আমেরিকান নাচনেওয়ালীর ছেলের চরিত্র এর চেয়ে ভালো আর হবে না।
বরাবরই নিজের মায়ের কথা শুনলে ক্রীতিকের মাথায় র’ক্ত উঠে যায়, উগ্রতার চড়ম সীমানায় পৌঁছে যায় ও,এবারও তাই হলো, চিৎকার দিয়ে নিজের বাবার মুখের উপর বললো,
— তুমিই সেই আমেরিকান নাচনেওয়ালীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে,যার ফল আমি।
সঙ্গে সঙ্গে জামশেদ জায়ান আবারও ওকে সজোড়ে চ’ড় মারলেন, অতঃপর আশেপাশের চ্যালাপ্যালাদের ডেকে বললেন,
— প্রাইভেট জেটের ব্যাবস্থা করো,আজ এই মূহুর্তে ও দেশ ছাড়বে, স্বাধীনতা পেতে পেতে ওর ভেতরের পুরোটাই নর্দমার মতো কালো হয়ে গিয়েছে, ওকে শুদ্ধ করা প্রয়োজন, তারজন্য সবার আগে ওর স্বাধীনতা হর’ন করতে হবে। আজ এই মূহুর্তে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরীর রাজনৈতিক পদ বাতিল করা হলো, তোমার রাজনৈতিক জীবন এখানেই সমাপ্ত। বিদেশে গিয়ে মানুষ হয়ে ফেরো।
বাবার কথার পিঠে ক্রীতিক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছু’ড়ে মা’রে, দলের লোকেদের হাত থেকে নিজের পাসপোর্ট আর ব্যাগটা ছো মে’রে নিয়ে, ছোট্ট অরুর দিকে একপলক তাকিয়ে আবারও চোখ সরিয়ে বলে,
— ফিরবো না, কোনো দিন ফিরবো না এ দেশে, শুধু একটা গুরুত্বপূর্ন জিনিস রেখে গেলাম, সময় হলে সেটাও নিয়ে যাবো। কারণ ক্রীতিক কোনো জিনিস হাত পেতে নেয়না, কে’ড়ে নেয়।
.
ক্রীতিক যখন গাড়ি করে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, তখন দোতলার দেওয়াল জোড়া জানালা দিয়ে ওর পানেই অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিল অরু। ক্রীতিকও তাই,ও গাড়িতে বসে ছিল ঠিকই তবে হিং’স্র দপদপে চোখদুটো ছিল দোতলার জানায় নিবদ্ধ।
একপর্যায়ে গাড়িটা যেতে যেতে চোখের আড়াল হয়ে যায়, তবুও সেদিকে তাকিয়ে রয় অরু, কি নিয়ে এতো ঝামেলা হলো সেসব মাথায় না ঢুকলেও এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে ও, আজ ওর জনই বাড়ি ছাড়া হয়েছে বাড়ির একমাত্র রাজপুত্র, জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।
ওদিকে যেতে যেতেই ক্রীতিকের কে’টে যাওয়া ঠোঁট দুটো বাঁকা হাসিতে প্রসারিত হলো, ব্যাক সিটে গা এলিয়ে দিয়েই বিড়বিড়ালো সে,
—love is temporary but obsession is permanent. and I’m da’ngerously obsessed with you aurora seikh. খুব বেশি না, আমাকে সামলানোর মতো একটুখানি বড় হ, আমি অপেক্ষার প্রহর গুনছি…..
চলবে…….