সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ৪৯ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
340

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৪৯
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)

“দার্জিলিং”নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেঘে ঢাকা, বৃষ্টিভেজা,সবুজে ঘেরা এক অপার্থিব দৃশ্যপট। উঁচু নিঁচু পাহাড়, সারি সারি চা বাগান, ছোট বড় ঝরনা, জানা অজানা বুনোফুল আর মেঘমল্লার আস্তরণে মুড়িয়ে থাকা এই পাহাড়ি শহরটাকে প্রকৃতি প্রেমীদের সর্গ রাজ্য বললে খুব একটা ভুল হবেনা বৈকি।

দার্জিলিং এর আরও একটি প্রধান আকর্ষন হলো, ব্রিটিশ আমলের তৈরি সেই আশির দশকের কয়লা চালিত টয় ট্রেন। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয়হাজার সাতশত ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই পাহাড়ি শহরের নামকরণের সুস্পষ্ট কোনো ইতিহাস নেই, তবে লোকমুখে শোনা যায়,”দর্জেলিং” শব্দ থেকেই দার্জিলিং এর উৎপত্তি । দর্জে মানে বজ্র আর লিং মানে হলো দেশ, এককথায় দার্জিলিং মানে বজ্রেরদেশ।আবার অনেকের মতে সতেরো’শ পয়ষট্টির দিকে কোনো এক লামা এদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন তার নামানুসারেই দার্জিলিং নামকরণ করা হয়।

শুধু মাত্র যে দার্জিলিং তেমনটা নয়, চোখের খোরাক, মনের বাসনা মেটাতে এর পরবর্তী নর্থ সিকিম, সিটং সবগুলোই যেন প্রকৃতির বক্ষস্থল। শহুরে একঘেয়ে জীবনের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষগুলোকে একটু খানি সস্থির সঞ্চার খুজে দিতেই বোধ হয় উপরওয়ালার এই নিদারুণ সৃষ্টি।

চা পল্লবে ঘেরা সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত হোম’স্টে র যে ছোট্ট ছোট্ট কটেজ গুলো রয়েছে, তারই মধ্যে একটা কটেজের খোলা বারান্দায় বেতের চেয়ার আর বেতের কারুকাজ করা রেলিং এ কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে অরু। ওর মোহাবিষ্টের মতো চোখ দুটো পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নামা সারি সারি চা বাগানে নিবদ্ধ,চা বাগানের পাশ দিয়েই কলকলিয়ে বয়ে যাচ্ছে সরু ঝর্ণার বহর,কাচের মতো দেখতে ঝর্ণার সেই স্বচ্ছ পানিতে টুপটাপ ঝড়ে পরছে হাওয়ায় উড়ে আসা রংবেরঙের বুনোফুল।

সকাল সকাল মেঘের চাদরে ঢাকা পরেছে প্রকৃতি,অথচ
মাত্রই একপশলা বৃষ্টি হলো ঝমঝমিয়ে, ঝড়ে পরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি কনা গুলো সযত্নে ঠায় নিয়েছে চা পাতার গায়ে, নিয়ন সূর্যকীরনে সেই বৃষ্টি কনা গুলো ঝিল ধরছে বারেবারে, যেন এক নজরে দেখলে মনে হবে, চা-পাতা উপর কেউ সযত্নে স্বচ্ছ হিরের টুকরো সাজিয়ে রেখেছে।

অরু সেই সকাল থেকে বসে বসে মুগ্ধ নয়নে দেখেই যাচ্ছে এসব। দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে আসছে তবুও মন ভরছে না, বারবার ভাবনারা এক জায়গাতেই আটকে যাচ্ছে, প্রকৃতি এতো অপরূপ কেন? দু’গালে হাতদিয়ে চারিদিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে নয়ন জুড়াচ্ছে অরু, আর মনেমনে ভাবছে কালকের কথা,

কাল ক্রীতিকের সাথে ওমন তাড়াহুড়ো করে ফ্লাইটে উঠে আরও একদফা ঝটকা খেয়েছিল অরু। অরুর পড়নে তখন হালকা গোলাপি টপস আর সুতির ঘাগড়া ছিল,লম্বা চুল গুলো ছিল ক্লাচার দিয়ে বাঁধা, ওর পেছন পেছনই উঠেছিল ক্রীতিক,ফ্লাইটে ওঠার পরেও ক্রীতিক এমন একটা ভাব করছিল যেন ও আরেকটা দেশে নয়,বরং মতিঝিল থেকে হাতিরঝিল যাচ্ছে। চারিদিকের পরিস্থিতিতে একটু ও মাথাব্যথা নেই, আর না আছে কোন হেলদোল, ফোন স্ক্রল করছে তো করছে করছেই।

ওর কান্ডে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে পেছনে ঘুরে অরু শুধায়,
— আমাদের সিট কোথায়?

ক্রীতিক ফোন থেকে চোখ সরিয়ে আলগোছে নিজের চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে,
—- বিজনেস ক্লাসে।

— আপনি এতোটুকুর মধ্যে বিজনেস ক্লাস কিভাবে ম্যানেজ করলেন? আশ্চর্য!

অরুর কথায় ক্রীতিক নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
—- সামনে চল দেখতে পাবি।

অরু ত্যক্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিককে রেখেই গটগটিয়ে বিজনেস ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলো। কেভিন ক্রু দের সাহায্যে বিজনেস ক্লাস খুঁজে নিয়ে, দরজাটা খুলে অরু ভেতরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ ভাবে চমকালো, সাথে ভয় ও পেলো মারা’ত্মক।

কারন ওকে দেখেই ভেতর থেকে এলিসা,অর্ণব, ক্যাথলিন ওরা সবাই একযোগে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
— সারপ্রাইজ!

অকস্মাৎ চিৎকারে হকচকিয়ে উঠলো অরু,সবাইকে এখানে এভাবে দেখতে পেয়ে মস্তিষ্ক আপাতত হ্যাং হয়ে আছে ওর, তাই অরু কোনোকিছু না ভেবে আবারও পেছনে ঘুরলো ক্রীতিকের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, তবে পেছনে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে একটা শক্ত ঢেউ খেলানো পুরুষালী বুকে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেলো অরু, তাড়াহুরো করে মাথা তুলতেই দেখতে পেলো এটা ক্রীতিক।

পরনে নেভি ব্লু হুডি আর ব্ল্যাক ওভার সাইজ ডেনিম,সামনের চুলগুলোকে সামলাতে মাথায় আটকানো কালো টুপি,আর ঠোঁটের কোনে লেগে আছে এক রহস্যময় হাসি, অরু ধরতে পারলো না ক্রীতিকের এই হাসির আসল কারন।অগত্যা, চোখ বড়বড় করে বিস্ময়ে ক্রীতিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অবুঝের মতো ।

ক্রীতিক ওর রহস্যময় হাসির অবসান ঘটিয়ে কাঁধ বাকিয়ে অরুর চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে বললো,
—- হ্যাপি ফার্স্ট হানিমুন জার্নি বেইবি।

ক্রীতিকের কথাতে অরুর চোয়াল ঝুলে পরার উপক্রম , এমন একটা আকস্মিক ঘটনায় আপনা আপনি ওর দু’হাত চলে গেলো নিজের মুখের উপর । অরু একবার ওদের সবার দিকে তাকাচ্ছে, তো আরেকবার ক্রীতিকের দিকে, এদিক ওদিক তাকিয়েই অস্ফুটে বলে ওঠে,
—- তারমানে এটা প্রি-প্ল্যান?

ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে অরু পুনরায় ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
—- তাহলে আমাকে ব্যাগ গোছাতে কেন বললেন না? আমিতো কিছুই নিয়ে আসিনি।

ক্রীতিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
—-উহুম, মন খারাপ করতে হবে না,সব কিনে দেবো বেইবি, এনিথিং ইউ নিড।

.
জামাকাপড়ের কথা মনে পরতেই অরু সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজের শরীরের দিকে চাইলো, কাল রাতে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ওরা কোনমতে হোম’স্টে তে এসে উঠেছিল, রাতের বেলা এমন পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টির মাঝে দোকানপাট সবই বন্ধ ছিল যার ফলরূপ জামা কাপড় আর কেনা হয়নি অরুর।

রাতে টপস খুলে গায়ে ক্রীতিকের হুডি চড়িয়ে ঘুমিয়েছে, আর এখনো সেভাবেই। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবে ও, তাছাড়া ক্রীতিক ও তো কোনো জামাকাপড় আনেনি, জামা কাপড় তো দূরে থাকে টুথব্রাশ টুথপেষ্ট টা পর্যন্ত নেই ওদের কাছে।

বিষয়টা বোধগম্য হতেই বারান্দা ছেড়ে বেডরুমে প্রবেশ করলো অরু। ক্রীতিক এখনো কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে খালি গায়ে ঘুমুচ্ছে। বিয়ের বয়স বেশ কয়েক মাস হলেও, অরু ক্রীতিকের একসাথে এক ঘরে রাত্রি যাপন করা হয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র। সেখানে কাল রাতে ওরা দুজন সত্যি কারের আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতোই একসাথে একঘরে এক বিছানাতে ঘুমিয়েছে,বিষয়টা অরুর চিত্তে প্রশান্তির ঝড় বয়িয়ে দেয়, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাটুকু উগড়ে আসে বারবার। হুটহাট মনে হতে থাকে উনি সত্যিই আমার পাশে? সত্যিই?অবিশ্বাস্য!

অরু যে কয়েকদিনই ক্রীতিকের সাথে ঘুমিয়েছে, ও খেয়াল করেছে ক্রীতিক সবসময় উপুর হয়ে ঘুমায়, ওর চওড়া পুরুষালী পৃষ্ঠদেশ কখনোই কম্ফোর্টারের আড়ালে ঢাকা পরেনা। বিষয়টা বরাবরই অরুর আকর্ষন কেড়ে নিতে সক্ষম। এই লোক ঘুমের মাঝেও ম্যানলি আচরণ করে। অরু ভেবে পায়না ক্রীতিক এমন কেন? একটু কি কিউট হওয়া যায়না? সবসময়ই ডার্ক চকলেট হতে হবে? একটু আধটু মিল্ক চকলেট হলে ক্ষতি কি?.

অরুর মন গহীনের অযাচিত প্রশ্নের উত্তর দিলো না গাঢ় ঘুমে বিভোর হয়ে থাকা ক্রীতিক। অরু মনের ভাবনা মনে পুষে রেখেই এগিয়ে গিয়ে কাঠের তৈরি তকতকে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে ক্রীতিকের শিওরে বসে পরে, এরপর হাত বাড়িয়ে ওর ঘাড় ছুঁই ছুঁই এলোমেলো চুল গুলোতে নিজের নরম তুলতুলে আঙুল চালাতে চালাতে আনমনে বলে ওঠে,
—- আমার কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার এতোটা কাছে, আপনি কি সত্যিই সেই জায়ান ক্রীতিক? যার বিছানায় ভুল করে ঘুমিয়ে ছিলাম বলে আমাকে চোখ দিয়েই ভ’স্ম করে দিয়েছিলেন?

আপনি কি সেই জায়ান ক্রীতিক? যার সামনে একটু আওয়াজ করে কেঁদে ছিলাম বলে আমাকে কনকনে ঠান্ডার মাঝেই বাইরে বের করে দিয়েছিলেন? আমারতো এখনো সেই শুরু থেকে এই পর্যন্ত চোখ বন্ধ করলে মনে হয় সবটা স্বপ্ন।এতো ভালোবাসা, এতো আবেগ, আপনার এই মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি সবকিছু আমার মতিভ্রম মনে হয় মাঝেমাঝেই ?যেন এক্ষুনি ভ্রম কেটে যাবে আমার, আর আপনিও আমাকে রেখে হারিয়ে যাবেন সেই সূদুর ক্যালিফোর্নিয়ায়। দিন যাবে, মাস যাবে, বছর যাবে আপনার দেখা আর আমি পাবোনা। সেই আগের মতো, এর ওর মুখে শুধু নামটাই শুনবো আপনার, ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেব জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

কিন্তু এবার তো আমি আর সহ্য করতে পারবো না সেই দ’হন, বলুন? সত্যি বলছি তেমনটা হলে আমি ম’রেই যাবো,কারন ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেব তো কেবল ক্রীতিক কুঞ্জেরই মালিক নয়, আমার মন,প্রান, আত্না সবকিছুর দখলদারি ও যে একমাত্র তার।

জায়ান ক্রীতিক, আপনি হরণ করেছেন আমার হৃদয়, ভালোবাসার সংজ্ঞা না জানা এক তরুণীর বুকে আপনি ভালোবাসার বি’ষা’ক্ত তী’র নিক্ষেপ করেছেন, সূত্রপাত করেছেন প্রকান্ড জলোচ্ছ্বাসের। আর এখন আমার মনে ভালোবাসার তুফান বাঁধিয়ে দিয়ে, আমার স্বপ্ন ভেঙে হারিয়ে গেলে আপনার খবর আছে।
যেদিন আপনাকে খু্ঁজে না পাবো, সেদিন আমিও হারিয়ে যাবো অলীক আকাশে, সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার রাতের আকাশে ঘুরে বেড়াবো, তখন খুঁজবেন তো আমাকে? মনে পরবে তো আমার কথা?

হুট করেই স্বপ্নের মতো করে পাওয়া মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসার উচ্ছাসে,একরাশ কাতরতা ঘীরে ধরেছে অরুর হৃদয় , এতোটা সুখ ওর কপালে সইবে কিনা তা নিয়েও সন্দিহান মেয়েটা, ওর কাছে জায়ান ক্রীতিক মানে অমূল্য সম্পদ, যা ও না চাইতেও নিজের করে পেয়েছে, হারিয়ে যাওয়ার ভ’য় তো একটু থাকবেই, এই মূহুর্তে সেই ভয়েই জর্জরিত হয়ে টুপটাপ অশ্রুকনা বিসর্জন দিচ্ছে অরু।

ক্রন্দনরত অরুর ফোপাঁনোর আওয়াজে ঘুমের মাঝেই একটু নড়েচড়ে উঠলো ক্রীতিক, ঘুমঘুম গলায় অস্পষ্ট আওয়াজে ডেকে উঠলো অরুকে,
— বেইবি.. কোথায় তুই?

ক্রীতিক মাত্রই নড়েচড়ে উঠেছে দেখে অরু তাড়াহুড়ো করে চোখের পানিটুকু মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে, শান্ত স্বরে বললো,
— এই যে, উঠুন এবার, শপিং এ যেতে হবে তো। আমাদের পড়ার কিছু নেই তো এখানে বাথরব ছাড়া ।

অরুর কথার পাছে ক্রীতিক বালিশে মুখ ঘষতে ঘষতে হাস্কিস্বরে বললো,
— কেন, নেই কেন? কালকে তো কিছু করিনি।

অরু এবার উঠে দাড়িয়ে বিরক্ত স্বরে বললো,
— কাল যে এক কাপড়ে দার্জিলিং চলে এলেন, তা ভুলে গিয়েছেন?

অরুর কথায় এতোক্ষণে টনক নড়লো ক্রীতিকের, তবে ওর মধ্যে শপিং এ যাওয়ার কোনোরকম হেলদোল দেখা গেলোনা, ও শরীরের কম্ফোর্টারটা আরেকটু ভালোভাবে গায়ে চড়িয়ে নতুন উদ্যমে ঘুমাতে ঘুমাতে অস্পষ্ট আওয়াজে বললো,
— ওয়ালেটে ইন্ডিয়ান কার্ড আছে যেটা খুশি নিয়ে যা, আমি এলিসাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি ও তোর সাথে যাবে।

—এই অচেনা দেশে শুধুমাত্র এলিসা আপুকে ভরসা করে আপনি আমাকে একা ছেড়ে দেবেন?

ক্রীতিক জুতসই আরাম করে শুয়ে বললো,
— আমি সঙ্গে গেলে ঠিক তোকে যেভাবে আগলে রাখতাম, এলিসাও সেভাবেই রাখবে, আই বিলিভ ইন হার। এখন যা তো, ঘুমাতে দে,নয়তো রাইড করতে পারবো না।

—- আপনি এখানেও রাইডিং এ যাবেন, তাও এই পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির মাঝে?

— উমম,হুমমম।

অরুর কথার প্রতি উত্তরে ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতে যেতে জবাব দিলো ক্রীতিক।

.
অরু শপিং এর উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে অনেকক্ষন, বেলা বেজেছে দশটা কি এগারোটা, ক্রীতিক এখনো ঘুমে তলিয়ে আছে, কি জানি কতদিনের ঘুম একসাথে ঘুমাচ্ছে ও। তবে ক্রীতিকের এই আরামের ঘুম বোধ হয় খুব একটা সহ্য হলোনা ওর ব্যাংক ম্যানেজারের,সেই সকাল থেকে মুঠো ফোনের ভাইব্রেট বাজিয়ে ম্যানেজার সাহেব কল দিয়েই যাচ্ছেন তো দিয়েই যাচ্ছেন।

ভাইব্রেটের কাঁপা আওয়াজে একপর্যায়ে ঘুম ছুটে গেলে নড়েচড়ে উঠে ফোন রিসিভ করলো ক্রীতিক। এপাশ থেকে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার সাহেব সালাম জানিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে ,
— স্যার আপনি বোধ হয় ঘুমিয়ে, বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত স্যার, বাট স্যার ইটস আর্জেন্ট।

— হ্যা বলুন।

ক্রীতিকের অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বললো,
—- স্যার সকাল সকাল আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে কয়েক লক্ষ টাকা উইড্রো করা হয়েছে।

ক্রীতিক মুখ থেকে একটু বিরুক্তিকর আওয়াজ বের করে বললো,
— সো হোয়াট?

ম্যানেজার সাহেব ভেবেছিল ক্রীতিক হয়তো অবাক হবে কিংবা প্রোপার ইনফেকশন জানতে চাইবে, কিন্তু তেমন কিছু না হওয়াতে তিনি ভরকে গিয়ে বললেন,
—- না মানে স্যার হুট করে সকাল সকাল এতোগুলা টাকা..

ম্যানেজারের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্রীতিক মাঝ পথে বলে ওঠে,
— ডোন্ট ওয়ারী ইট’স জাস্ট মাই ওয়াইফ।

ম্যানেজার সাহেব তৎক্ষনাৎ নিজের বোকামিতে খামি খেয়ে দূর্বল গলায় বললো,
— ওহ ওকে স্যার,দেন ইট ওয়াজ মাই মিসটেক,আ’ম রিয়েলি সরি।

তারপর ওপাশ থেকে ভেসে এলো কল কেটে দেওয়ার পিক পিক আওয়াজ।
ম্যানেজার সাহেব কল কেটে দিলে,হাতের ফোনটা বিছানার একপাশে ছুঁ’ড়ে ফেলে দিয়ে, ক্রীতিক আবারও চোখ বুজে মৃদু হেসে অস্ফুটে বললো,
— বউটা বড় হচ্ছে, স্বামীর টাকা কিভাবে ওড়াতে হয় তার যথাযথ ট্রেনিং নিচ্ছে, গুড জব এলিসা।

**********************************************

ক্রীতিকের কটেজের পাশেই যে কটেজটা অবস্থিত তার বেলকনিতেই আপাতত বসে আছে নীলিমা। কোনোরকম চেয়ারে কিংবা স্টুলে নয় মেঝেতে বসে আছে মেয়েটা,পরনে এখনো সেই দু’দিন আগের বাসী বেনারসি। ডাগর ডাগর চোখ দুটো ক্লান্তিতে কোটরে ঢুকে গিয়েছে, মুখশ্রী মলিন।

সেই মলিন মুখেই নিস্প্রভ চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে নীলিমা, বক্ষপিঞ্জর থেকে ক্রমাগত উগরে আসছে চাপা দীর্ঘশ্বাস। নীলিমা যখন ওর জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো ভেবে ভারী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, ঠিক সেসময় রুমে প্রবেশ করে সায়র, সায়রের চোখ মুখও ভীষণ গম্ভীর, সব সময়ের চঞ্চল হাসিখুশি, ঠান্ডা মস্তিষ্কের সায়র সত্তাটা হুট করেই কাল থেকে কেমন উধাও।

সায়রের হাতে কিছু শপিং ব্যাগ ছিল, ও সেগুলোকে নীলিমার সামনে ধরে গম্ভীর গলায় বললো,
— চেঞ্জ করে নাও।

নীলিমা ঝগড়া করার অবস্থায় নেই, তাছাড়া সায়রের চোখ মুখ দেখেও মনে হচ্ছেনা যে ও ঝগড়া করতে ইচ্ছুক, তার উপরে দুদিন ধরে এক কাপড়ে থাকার দরুন শরীরটাও কেমন কুটকুট করছে, তাই উপায়ন্তর না পেয়ে প্যাকেট গুলো হাতে নিলো নীলিমা। আসলে গতকাল অরু বেশকিছু জামাকাপড় দিয়েছিল নীলিমাকে, কিন্তু অরুর তুলনায় নীলিমা একটু গুলুমুলু আর লম্বা হওয়ায় সেগুলো নীলিমার হয়নি, কারন অরু বেশির ভাগই লং স্কার্ট আর টপস পড়ে, আর না তখন জামার কাপড় নিয়ে ওর কোনোরকম খেয়াল ছিল। অগত্যা এক কাপড়েই একদেশ থেকে পারি দিয়ে আরেক দেশে চলে আসতে হলো নীলিমাকে।

নীলিমা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলে, সায়র গিয়ে বারান্দায় দাড়ালো।

বারান্দার রেলিং এ দু’হাত ভর করে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বোলাতেই বুক চিড়ে একফালি তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সায়রের। এটা মূলত সায়রের হোম’স্টে,শুধু একটা নয়, দার্জিলিং, সিটং মিলিয়ে বেশ কয়েকটা হোম’স্টে রয়েছে সায়রের।

সবগুলোই সায়রের বাঙালী ম্যানেজার দ্বায়িত্ব নিয়ে দেখা শুনা করেন। সায়রের পৈতৃক নিবাস দার্জিলিং এ। তবে পূর্বপুরুষ আর বন্ধু মহল বাংলাদেশী হওয়ায় বাংলাটা ওর ভালোই আয়ত্তে। সায়রের বাবা মা নেই, বাড়িতে কাকা জেঠা দুঃর্সম্পর্কের আত্নীয় স্বজন যারা রয়েছেন তাদের সাথেও সায়রের একেবারে যোগাযোগ নেই বললেই চলে, এককথায় বলা যায় পুরো পৃথিবীতে একটা নীলিমা আর একটা শক্ত ভীতের মতো বন্ধুমহল ছাড়া সায়রের আপন বলে কেউ নেই।

তাইতো নিজের শহরে ফিরে নতুন বউ আর বন্ধুদের নিয়ে , নিজের সবচেয়ে পছন্দের হোম’স্টে তেই উঠেছে সায়র। এখন শুধু অপেক্ষার পালা, সায়রের নব্য বিবাহিতা রাগীনি সবকিছুর জন্য সায়রকে আদৌও ক্ষমা করে মেনে নেবে?নাকি মা বাবার মতো সেও তার নিজস্ব পথ বেছে নিয়ে সায়রকে একা করে দিয়ে চলে যাবে?

সায়রের ভাবনার ছেদ ঘটে কাঠের দরজা খোলার খুটখাট আওয়াজে, সম্বিত ফিরে এলে সায়র পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় নীলিমা দাঁড়িয়ে আছে, পরনে ওর কিনে দেওয়া ফ্লোরাল প্রিন্টের সুতির চুড়িদার।

সায়রের পছন্দ বরাবরই অতুলনীয়,যার ফলরূপ বন্ধুমহলের অগাধ বিশ্বাস একবার সায়রের চোখ যেটাতে আটকে যায় সেটা সুন্দর হবেই হবে। সেক্ষেত্রে বলা যায় সায়রের চোখ নীলিমাতে আটকে গিয়েছিল তাই নীলিমাও যথেষ্ট সুন্দরী রমনী। আর এই মূহুর্তে সায়রের কিনে দেওয়া জামা পড়ে ওকে আরও বেশি আকর্ষনীয় আর লাবন্যময়ী লাগছে সায়রের দু’চোখে।

বারবার মনে হচ্ছে বাইরের অপরূপ প্রকৃতির মাঝে নীলিমাকে বসিয়ে দিলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও বোধহয় ফিকে হয়ে যাবে এই শ্যামলতা তরুনীর কাছে। কি সুন্দর মেয়েটা, ফ্লোরাল চুড়িদারে চাপা গায়ের রঙটাও কেমন জ্বলজ্বল করছে। আজকে বোধহয় নতুন করে আবারও সায়র মুগ্ধ হলো তার রাগীনির রূপে। তবে মুখে টু শব্দও করলো না, নীলিমার দিকে এগিয়েও গেলো না, বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো যথাস্থানে।

সায়র কোন কথা বলছে না দেখে নীলিমাই ধীর পায়ে এগিয়ে এলো, সায়রের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনেমনে নীলিমা ভাবছে,
— কি হলো লোকটার? এতোদিন তো কথা বলে বলে পা’গল করে দিতো, অযথা বিরক্ত করতো, ভুলভাল জোক্স শোনাতো, অথচ আজ এমন একটা পরিস্থিতিতে চুপ করে আছে কেন? এমন একটা ভাব যেন উনি আমাকে নয়, আমিই ওনাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে বিয়ে করেছি। আশ্চর্য!

নীলিমা সামনে এসে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে দেখে সায়র নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
— কিছু বলবে? জামা কাপড় সব ঠিকঠাক হয়েছে?

নীলিমা নিজের নিচু মাথাটা এদিক ওদিক নাড়িয়ে ইতস্তত কন্ঠে বললো,
— ইনারের সাইজ ঠিক হয়নি।

নীলিমা এতো সহজে কথাটা বলে দিলো যে, ওর কথাটা শুনে সায়রের আচমকা কাশি উঠে গেলো, ও কাশতে কাশতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— আসলে, আমিতো জানতাম না, তাই ওইভাবে আরকি বুঝতে পারিনি।সমস্যা নেই বিকেলে সবাই ঘুরতে বের হবে তখন এক ফাঁকে কিনে দেবো, আমাকে একচুয়াল সাইজটা বলে দিও।

নীলিমা সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে ভ্রুকুটি করে বললো,
— আপনি কিনে দেবেন?

সায়র কাশতে কাশতে মাথা চুলকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোকাদের মতো বললো,
—- এখানে আমি ছাড়া কিনে দেওয়ার মতো আর কেউ আছে?

***********************************************

দু’হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে মাত্রই হোম’স্টে ফিরলো অরু, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে অথচ সূর্যি মামার দেখা নেই আজ । শহরের দিকে যা ও একটু সূর্যরশ্মী চোখে পরেছে, পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে উঠতে সেটাও মিলিয়ে গিয়েছে।

চারিদিক মেঘাচ্ছন্ন, পেজা তুলোর মতোন মেঘেদের ভেলায় সবুজ চা বাগানকে গাঢ় সবুজ লাগছে, কি অপরূপ দৃশ্য, অরু আরও একদফা মুগ্ধ হতে হতে কটেজে ফিরে এলো, দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে শপিং ব্যাগ গুলো একপাশে রেখে অরু এদিক ওদিক ক্রীতিক কে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

ও এমন একটা পর্যায়ে আছে যে, ক্রীতিককে ঠিক কি বলে সম্মোধন করবে সেটা ভেবে পায়না, ভালোবাসা যখন চরম শিখরে পৌঁছে যায়,কিংবা একান্ত কাছাকাছি মূহুর্ত গুলো, তখন তো নাম ধরেই ডেকে ফেলে, কিন্তু সচরাচর নাম ধরে ডাকাটা অরুর কেমন মুখে বাঁধে, কারণ সম্পর্ক যাই হোক ক্রীতিক ওর চেয়ে বারো বছরের বড়। এদিকে কিছু একটা বলে ডাকা যাচ্ছে না দেখে অরু চোখ দিয়ে খুঁজে খুঁজে হয়রান, এক পর্যায়ে উপয়ান্তর না পেয়ে অরু ভাইয়া বলেই ডেকে উঠলো ক্রীতিককে,
— ক্রীতিক ভাইয়া শুনছেন,কোথায় আপনি?

অরু ডেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক ওকে টান মে’রে বারান্দায় নিয়ে এসে দেওয়ালে চেপে ধরলো, কপালটা ভীষণ ভাবে কুঁচকে রেখে শক্ত গলায় বললো,
— কে তোর ভাইয়া?

অরুর মুখে জবাব নেই, ও তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের দিকে, আজ এই প্রথম ক্রীতিককে গ্লাস পড়তে দেখলো অরু, চিকন ফ্রেমের বড়বড় দুটো জুতসই গ্লাসে তাকে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে, আজকাল ল্যাপটপে কাজ করলেই চোখে গ্লাস লাগায় ক্রীতিক। আর এই মূহুর্তে চশমা পরিহিত ক্রীতিককে এতোটা কাছে দেখে শুষ্ক একটা ঢোক গিললো অরু, পরক্ষনেই ভেতরের উথাল পাথাল অবাধ্য অনুভূতি গুলো দমাতে চোখ নামিয়ে নিলো নিচে চাইলো ও।

অরু নিচে চেয়ে আছে দেখে ক্রীতিক ওর দিকে সামান্য গ্রীবা নামিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
—- কে তোর ভাইয়া, আন্সার মি্?

অরু জবাব দিলো না,মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু।

—- ডু ইউ থিংক আ’ম ইওর ব্রাদার?

ক্রীতিকের কথায় অরু এবার তাড়াহুড়ো না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
— ওকে ফাইন,তাহলে আমার গ্লাস খোলো।

তৎক্ষনাৎ অরু চকিতে মাথা উঁচিয়ে ক্রীতিকের চোখে চোখ রাখলো, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না ও, কি বললো মাত্র ক্রীতিক? খোলো?

প্রথমবার তুমি সম্মোধনে হুট করেই কেমন যেন একটা বউ বউ শিহরণ ছড়িয়ে গেলো অরুর সর্বাঙ্গ জুড়ে। অরু কাঁচুমাচু করছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বললো,
—- আমি কিছু বলেছি, আমার চশমাটা খুলে ফেলো অরু।

অরু এবার কথা শুনলো ক্রীতিকের, নিজের কম্পিত দু’হাত বাড়িয়ে খুলে ফেললো ক্রীতিকের গ্লাস, গ্লাস তখনো অরুর হাতেই ছিল, ক্রীতিক আর সেটাকে রেখে দেওয়ার অপেক্ষা করলো না, তার আগেই ধৈর্য হারা হয়ে তরিৎ গতিতে অধর ডোবালো অরুর ওষ্ঠাধরের ভাঁজে। অরুর ঠোঁটে একের পর এক গাঢ় চুমু একে দিতে দিতে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বললো,
— এবার বল কে তোর ভাইয়া? ভাইয়ারা কি বোনদের সাথে এমন কিছু করে, যা আমি করছি?

অরু তৎক্ষনাৎ চোখ খিঁচে না সূচক মাথা নাড়ালো।

ক্রীতিক সেভাবেই অরুর হাতটা তুলে চোখের সামনে এনে দু’জনার কাপল রিং গুলো ইশারা করে বললো,
—- দেখতো তোর অনামিকা আঙুলে আমার দেওয়া রিংটা চকচক করছে, এটা কারা দেয় জানিস?

অরু এবার হ্যা না দুইদিকেই মাথা নাড়ালো, ক্রীতিক একহাতে ওর তুলতুলে কোমল বাঁকানো কোমড়টা শক্ত চেপে ধরে বললো,

— লাভার’রা। আমি তোর লাভার, তাই তোকে এটা দিয়েছি, এটার মানে হচ্ছে তুই শুধু আমার প্রোপার্টি, তোকে আর কেউ এপ্রোচ করতে পারবে না। নো ওয়ান।

ক্রীতিকের কথায় ওকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে, অরু চোখ বুজে জলদি জলদি হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। ক্রীতিক এবার অরুর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে দু-হাতে ওর টপস টা ধরে ধীরে ধীরে উপরে তুলতে শুরু করে। এই পর্যায়ে এসে অকস্মাৎ চোখ খুলে ক্রীতিকের দু’হাত চেপে ধরলো অরু।

ক্রীতিক সঙ্গে সঙ্গে অরুকে ছেড়ে দিয়ে, দু’পকেটে হাত গুঁজে একটা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর টেবিল থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে সেটা পান করে ধপ করে বসে পরলো বেতের চেয়ারে। অরু একটু মাথা তুলে ক্রীতিকের আগাগোড়া পরখ করে মিনমিনিয়ে শুধালো,
— রাগ করেছেন?

ক্রীতিক জবাব দিলোনা, অরুকে টেনে এনে নিজের উরুর উপর বসিয়ে ওর কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে অসহায় স্বরে বললো,
—- আর কতদিন হার্টবিট? ইটস বদারিং মি। আই কান্ট উফফ!

ক্রীতিক বেশ বিরক্ত, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অরু নরম স্বরে বললো,
— আমি সরি।

অরুর হঠাৎ ক্ষমা পার্থনায় ক্রীতিক নিজের মাথা তুলে শুধালো,
— তুই কেন সরি হচ্ছিস?

— এই যে বারবার আপনার মেজাজ খারাপ করে দেওয়ার জন্য।

অরুর কথায় ক্রীতিক জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা টেনে বললো,
— ইট’স ন্যাচারাল বেইবি, এতে আমি মন খারাপ করিনি, তুই বড় হয়ে গিয়েছিস এটা আমাদের দু’জনার জন্যই ঠিক কতবড় ব্লেসিং,সেটা ভবিষ্যতে বুঝতে পারবি। এখন চল।

অরু অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
— কোথায় যাবো?

ক্রীতিক ওকে কোলে তুলে বেডরুমের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
—- তোর পছন্দের শহরে এসেছিস অথচ ঘুরে দেখবি না? নাকি আজকে সারাদিন আমার সাথে….
ক্রীতিককে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অরু হকচকিয়ে বলে ওঠে,

—- নাহ যাবো তো।

ক্রীতিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলে,
—- লেটস গো বেইবি।

*************************************************

অরুর মতে পুরো দার্জিলিং শহরটাই বিষ্ময়কর, এখানে আলাদা করে দেখতে যাওয়ার কিছু নেই, কটেজের বারান্দায় বসে বসেও দার্জিলিং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আহরণ করা যায় নির্বিগ্নে। তবুও সবাই মিলেমিশে আজ বেশ কয়েকটা টুরিস্ট এরিয়তে ঘুরে বেরিয়েছে ওরা।

সারা বিকেল ঘোরাঘুরি করে এখন স্ট্রিট মার্কেটে ঢুকেছে সবাই। ক্রীতিক ভিড়ভাট্টার মধ্যে নেই। তাই একটা বাইক রেন্ট করে অরুকে নিয়ে সোজা বেরিয়ে পরেছে রাইডিং এ।

পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সরু রাস্তা ধরে খুব ধীর গতিতে রাইড করছে ক্রীতিক,পাছে না বড়বড় খাদ দেখে অরু আবার ভয় পেয়ে যায় সেই চিন্তায়।

কয়েকঘন্টার রাইডিং শেষে ওরা যখন আবার শহর মুখী হলো তখনই পেট্রোল নিতে পেট্রোল পাম্পে ঢুকে পরে ক্রীতিক। ও অরুকে একটা যায়গায় দাড় করিয়ে বললো,
— বেইবি ওয়েট আ মিনিট, ওকে?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সায় জানালে, ক্রীতিক গাড়িতে পেট্রোল তুলতে এগিয়ে যায়। ক্রীতিক যখন নিজের কাজে গভীর মনোযোগী তখনই পেছন থেকে একজন অত্যাধুনিক গোছের সুন্দরী মহিলা রিনরিনে আওয়াজে ডেকে উঠলো ওকে,
— হেই জায়ান ক্রীতিক ওরফে মিস্টার অভদ্র।

পরিচিত অপরিচিতর মাঝে ঝুলতে থাকা এক নারী কন্ঠস্বর শুনে আস্তে করে ঘাড় ঘোরালো ক্রীতিক, পেছনে তাকিয়ে চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে স্পষ্ট কন্ঠে জবাব দিলো ,
— ইয়েস?

ক্রীতিক ঘাড় ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা আন্তরিকতা সরূপ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। ক্রীতিক ও থতমত খেয়ে ওর পিঠে হালকা হাত ছোঁয়ালো।

ওদিকে মেয়েটার কান্ডে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো অরুর, অধর জুগল আলাদা হয়ে গেলো আপনা আপনি, দু’হাত মুঠি বদ্ধ রেখে নিজেকে কোনোমতে সামলে অরু মনেমনে বললো,
—- ওনাকে ছেড়ে দিন আপু, উনি আমার, শুধু আমার।

মেয়েটা ক্রীতিককে অভিবাদন সূলভ হাগ করে, একগাল হেসে বললো,
— চিনতে পেরেছো, হু আই এ্যাম?

ক্রীতিক একটু চিন্তা করে বললো,
— শ্রাবনী রাইট? বাংলাদেশে আমাদের সাথে নর্থসাউথে পড়তে। আর তোমার বোন তো সানফ্রান্সিসকোতে পড়াশুনা করে, সায়নী অর সামথিং।

শ্রাবনী হেসে বললো,
—- হ্যা ও দেশে এসেছে বলেই দার্জিলিং এ বেড়াতে আসা, বাই দা ওয়ে তোমার খবর কি? সেই যে নর্থসাউথ থেকে গ্রাজুয়েশনের আগেই বেরিয়ে গেলে, তারপর তো আর খোঁজই পেলাম না।

ক্রীতিক হাতের কাজ সারতে সারতে বললো,
— এই চলছে।

—- বিয়ে করেছো?

শ্রাবনীর কথায় ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে পাশ ঘুরে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে,
— ইয়েস, মিট মাই ওয়াইফ, আব…

কথা মাঝ পথেই আটকে গেলো ক্রীতিকের, কারণ অরু এখানে নেই। এখানে তো দূরে থাক পুরো পেট্রোল পাম্পের আসেপাশেও নেই। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ক্রীতিক শ্রাবনীকে তৎক্ষনাৎ বিদায় জানিয়ে বললো,
— আমি আসছি।

শ্রাবনী উপর নিচ মাথা নাড়ালে, ক্রীতিক দ্রুত চলে যায় সেখান থেকে, ক্রীতিক চলে যেতেই শ্রাবনী কাঁদো কাঁদো গলায় বিড়বিড়ালো,
—- আমার ক্রাশের ও বিয়ে হয়ে গেলো?

গাড়ি থেকে নেমে পেছন দিক দিয়ে সায়নী বলে উঠলো,
— ওইটা আমারও ক্রাশ দি ভাই। তার চেয়েও বড় কথা জেকে স্যারের ওয়াইফ আমার ভালো ফ্রেন্ড।
শ্রাবনী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আমরা মেয়েরা সবসময় রেড ফ্ল্যাগের প্রেমে পড়ি কেন বলতো?
সায়নী ঠোঁট উল্টে শান্ত স্বরে বললো,
— হু নোজ।

.
রাস্তার এদিকে ওদিক খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে অরুর দেখা পেলো ক্রীতিক।
ও দেখলো দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুটপাতে বসে আছে অরু। এভাবে অরুকে বসে থাকতে দেখে ক্রীতিক এগিয়ে এসে বললো,
—- কি হয়েছে এখানে বসে আছিস কেন? তুই যে এতদূর চলে এলি, একবারও আমাকে বলে এসেছিস? তোর সাহস কি করে হলো এমন একটা অচেনা যায়গায় আমাকে না জানিয়ে এতো দুর চলে আসার?

ক্রীতিকের আওয়াজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরু উঠে দাড়ালো, অতঃপর ওর কথার কোনোরূপ জবাব না দিয়েই একপ্রকার অগ্রাহ্য করে হাটা ধরলো অন্যদিকে,

অরুর এহেন কান্ডে পেছন থেকে ক্রীতিক ডেকে চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় গলায় বলে,
— অরু কোথায় যাচ্ছিস?

অরু যেতে যেতে জবাব দিলো,
— আপনি থাকুন আপনার বান্ধবীকে নিয়ে আমি চললাম।

অরুর কথায় একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ক্রীতিকের বুক চিড়ে, অতঃপর অনেকটা জিদি গলায় অরুকে উদ্দেশ্য করে ক্রীতিক বলে উঠলো,
—- যেখানে খুশি যা,তার আগে তোকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো সেটা শিখিয়ে দিয়ে যা।

এবার হাঁটার গতি পুরোপুরি থেমে গেলো অরুর, আর এক পা ও সামনে বাড়ানোর শক্তি নেই ওর, ও ওখানেই আটকা পরেছে, ক্রীতিকের প্রনয়াসক্তির অদৃশ্য শেকলে বাধা পরেছে ওর পা দু’টো ।

অরু দাড়িয়ে পরেছে দেখে, ক্রীতিক একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরলো অরুর, এরপর ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,

— আমায় ছেড়ে কোথায় যাবি তুই? আমি যেমন অতিরিক্ত ভালোবাসা দিই ,তেমনি ক’ষ্টটাও অতিরিক্তই দিই, মাইন্ড ইট হার্টবিট।

আজকে প্রথমবার তাই ও’য়া’র্নিং দিলাম, দ্বিতীয়বার আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথাটা উচ্চারণ করার স্পর্ধা দেখানোর আগেই তুই শেষ। আই রিপিট মে’রে ফে’ল’বো একদম।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here