সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ৫০ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
580

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৫০
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
( কঠোর এবং কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)
(আজকের পার্ট দূর্বল চিত্তদের জন্য নয়)

দুদিন ধরে ভারী বর্ষন, দার্জিলিং এর সবুজ স্নিগ্ধ আবহাওয়া ভারী বর্ষনে ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করেছে। আকাশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বুনো মহিষের পাল। কখন দিন আর কখন রাত তা ঠাওর করা দায়।

দু’দিন বৃষ্টিতে হোম’স্টে এর কটেজ থেকে বেরোতে না পারলেও,পাহাড়ের চূড়ায় মেঘেদের ভেলার সাথে খুনসুটি জমিয়ে বৃষ্টি মূখর দিনগুলো খুব একটা খারাপ কাটেনি অরুদের।

ওরা কখনো একসাথে বসে মনোপলি খেলায় মেতেছে, আবার কখনো গিটারের টুংটাং আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে নিঃসংকোচে গান ধরেছে একই সুরে, মুশল ধারার বর্ষন কিছুটা কমে এলে ছেলেরা তাড়াহুড়ো করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে শহরের দিক থেকে খাবার কিনে এনেছে ,আর মেয়েরা খুব যত্ন করে সেগুলো রান্না করে সবাইকে পরিবেশ করেছে। একেক দেশের একেক জন মিলেমিশেই যেন আস্ত একটা পরিবার ওরা।
নিজেদের বউকে কিছুটা ফুরসত দিতে কখনো বা পার্সেলও নিয়ে এসেছে ছেলেরা।

একসাথে মিলেমিশে গল্প, আড্ডা, খুনসুটি, দুষ্টমি অতঃপর দিন শেষে যে যার মতো জোড়ায় জোড়ায় ফিরেছে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত কটেজে। হয়তোবা ভালোবাসার মানুষের সাথে মধু রাত্রি যাপন করতে, নয়তো মনের মাঝে দমিয়ে রাখা একরাশ কাতরতা আর হতাশা নিয়ে ঘুমের দেশে পারি জমাতে ।

আর এভাবেই পার হয়েছে ওদের দার্জিলিং এর ঘরবন্দী দুটো দিন।
আজ সারাদিন বৃষ্টি নেই,তবে আকাশ গুমোট হয়ে ধূসর রঙ ধারণ করে আছে। এইতো কিছুক্ষণ হলো দিনের সুক্ষ্ম নিয়ন আলোতে আঁধারের পর্দা টেনে দিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে ধরনী জুড়ে। বাইরে মেঘ ডাকার গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছে, এক পশলা ঝুম বৃষ্টি এক্ষুনি নেমে এলো বলে।

আর ভেতরে আঙুলের ভাঁজে শাড়ির কুঁচি ধরে কোমড়ে গুঁজতে ব্যস্ত লতানো মোহনীয় শরীরের অধিকারীনি সদ্য যৌবনে পা রাখা মারাত্মক এক রূপসী যুবতী।

টকটকে লাল শীফনের শাড়িটা কোনমতে পড়া হয়ে গেলে, অরু ব্যস্ত হাতে আঁচল ঠিক করতে শুরু করে, প্রথমে সবসময়ের মতো আঁচলটা বাহু থেকে ছেড়ে দিলেও আজ কি ভেবে যেন আঁচল গুটিয়ে রাখলো কাঁধের উপরিভাগে। যার দরুন এক ফালি নির্মেদ কোমড়ের রহস্য উন্মুক্তই রয়ে গেলো।

হাতের কাজ শেষ করে অরু ঘুরে দাড়ালো কটেজের দেওয়ালে লাগোয়া অত্যধুনিক গোলাকার আয়নাটার দিকে, যেখানে ভেসে উঠেছে এক লাস্যময়ী সুন্দরী রমনীর নিদারুণ প্রতিবিম্ব। আয়নার প্রতিবিম্বতে নিজেকে সুন্দরী আবিষ্কার করে নিজেই লাজুক হাসলো অরু, তারপর কাঠের স্টুল টেনে বসে পরলো মাথা ভর্তি রেশমের মতো চুলগুলো আঁচড়াতে। চুলে চিরুনি চালাতে চালাতেই অরু ভাবতে লাগলো আজ সারাদিনের কথা,

আজ বৃষ্টি ছিলোনা বলেই দু’দিন বাদে সবাই মিলে বেরিয়েছিল ওরা। স্যাতস্যাতে আবহাওয়ার মাঝেই রকগার্ডেন, রেইনবো ফলস, পাম ফরেস্ট সবখানেই একটু করে ঢু মেরে, আবারও শহরের দিকে ফিরে এসেছে ওরা সবাই মিলে।

যেহেতু শহরটা সায়রের, তাই আজকের ট্যুর গাইড ও সায়র। ও সবাইকে এটা ওটা দেখাতে ব্যস্ত।

ওদিকে সারাদিন অরু নীলিমা আর এলিসারা এক সাথেই ছিল, আগমন টা যেভাবেই হোকনা কেন, হুট করে নিজেদের স্বপ্নের শহরে পা রেখে দু’বান্ধবীই পুলকিত ওরা, যার ফলরূপ উচ্ছ্বাসের কোন ঠিক ঠিকানা নেই ওদের।দুজন হাতে হাত ধরে হাটছে তো কখনো আবার দাঁড়িয়ে পরে একজন আরেকজনের ক্যামেরা ম্যান হয়ে ছবি তুলে দেওয়ার মোক্ষম দায়িত্ব পালন করছে।

এতো উচ্ছ্বাস, এতো উদ্দীপনার মাঝেও ক্রীতিকের চোখ মুখ ছিল বিষন্নতায় ঘেরা,চাহনীতে ছিল অমাবস্যার মতোই কালো মেঘের ঘনঘটা। সবার মাঝে উপস্থিত থেকেও যেন কিছু একটা নিয়ে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল ওকে। গতানুগতিক বেপরোয়া চলন বলনের মাঝেও ওর চোখের সেই অপারগ দীর্ঘশ্বাস আর আক্ষেপটুকু স্পষ্ট খেয়াল করেছে অরু।

ক্রীতিক কখনো ফোন স্ক্রল করেছে তো কখনো সবার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্মোক করেছে, এমনকি পরনের কালো রঙা হুডিটার চেইনটা যে বক্ষস্থল পর্যন্ত খুলে ভেতরের সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিটা দৃশ্যমান সে খেয়াল অবধি নেই ওর।

এতো আনন্দের মাঝেও এই সবকিছু চোখ এড়ায়নি অরুর। ক্রীতিককে এভাবে বিষন্ন মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অরু যতবারই ওর শুকনো মুখশ্রীর পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে,ঠিক ততবারই ক্রীতিকের চাহনিতে বুক কেঁপে উঠেছে অরুর। টলটলে দীঘির জলের মতো চোখ দুটোতে কি ভীষণ কাতরতা আর অপরাগতা তা কেবল অরুই টের পেয়েছে। ক্রীতিকের এমন ভগ্ন চাহনি দেখলে হৃদয়ে ভীষণ তোলপাড় হয় অরুর, বারবার মনে হয় সবার সামনেই ছুটে গিয়ে ক্রীতিকের বুকে ঝাপিয়ে পরতে,ওর ভাসা ভাসা চোখের পাতায় আবেশিত চুমু এঁকে দিয়ে দৃঢ় গলায় বলতে,
— এই তো আমি। তোমার বুকেই আছি,তাহলে কেন এই কাতরতা বলো?

কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়,কারণ ক্রীতিকের মতো ছন্নছাড়া, বেপরোয়া অরু নয়, যথেষ্ট লজ্জা আর সংকোচ রয়েছে ওর মধ্যে। তাই এবার নীলিমাকে রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরু দাঁড়ালো ক্রীতিকের পাশ ঘেষে, অরু পাশে এসে দাঁড়াতেই চোখ নামিয়ে এক ঝলক ওকে দেখে নিয়ে পুনরায় চোখ সরিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়ার কুন্ডলীতে মন দেয় ক্রীতিক।
ক্রীতিকের এহেন মুড অফ হওয়ার কারনটা যে ও নিজেই তা ভালোমতোই আঁচ করতে পারছে অরু। তবুও কিছুটা সংশয় নিয়ে কাঁপা কন্ঠে ক্রীতিককে শুধালো,
— কি হয়েছে, ঠিক আছেন আপনি।

অরুর কথায় ক্রীতিক আবারও সেই ব্যথাতুর চাহনি নিক্ষেপ করে, নরম গলায় জবাব দিলো,
— উমম, ঠিক আছি।

তারপর আর কোনো কথা নয়, অর্ণব আর সায়রকে ডাকতে ডাকতে অরুকে একপ্রকার এড়িয়েই ওখান থেকে চলে গিয়েছে ক্রীতিক।

এরপর সারাটাদিন অতিবাহিত হলো, অথচ দুজনার একটা বাক্য ও কথা আদান-প্রদান হয়নি, বেখেয়ালে দুজনার চোখচোখি হয়ে গেলে ক্রীতিকের ব্যাকুল দু’চোখ অরুকে ব্যথা দিয়েছে বারবার, এতো আনন্দের সবটাই কেমন ফিকে লেগেছে অরুর নিকট।
অবশেষে সন্ধ্যা নামতেই হৃদয়ের মাঝে একরাশ ব্যথাতুর অনুভূতি নিয়ে কটেজে ফিরেছে অরু। কটেজে ফিরে বেডরুমে প্রবেশ করে আর একমুহূর্ত ও অপেক্ষা করেনি ও, দ্রুত ব্যস্ত হয়ে পরেছে ক্রীতিকের জন্য নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করার কাজে।

*************************************************

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে,বৃষ্টির ফোঁটার ঘনত্ব কম,তাই গায়ে লাগছে না মোটে,ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেই পাহাড়ের চূড়ায় হোম স্টে এর ফ্রন্ট ইয়ার্ডের কাঠের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব, সায়র,আর ক্রীতিক। তিনজনের হাতেই একটা করে সিগারেটের শলাকা।ওদের নিঃশ্বাসের তালে তালে অন্ধকারের মাঝেই সেই শলাকা গুলো জ্বলছে আবার নিভছে।

নিকোশ আধারে পাহাড়ের ঢালে এক আধটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে অর্ণব দৃষ্টি নিক্ষেপন করে সায়রের দিকে, সায়র তখনো নির্লিপ্ত চোখে কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ পানে চেয়ে আছে, সে’সময় অর্ণব হাত বাড়িয়ে ওর পিঠ চাপড়ে বলে ওঠে,
—- নীলিমাকে উঠিয়ে নিয়ে এলি ভালো কথা, এবার কি করবি? কিছু ঠিক করেছিস?

সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— ভিসা পাসপোর্টের প্রসেস চলছে,কাজ হলেই ওকে নিয়ে ফিরে যাবো।

— আর তোর পুরান ঢাকাইয়া শশুর?

অর্ণবের কথায় সায়র কিছু একটা ভেবে ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে বললো,
—- আমার মনে হয়না নীলিমা যতটা ভ’য় দেখিয়েছে শশুর আব্বা অতোটাও ডে’ঞ্জা’রাস। কিছুদিন হয়তো রেগেমেগে বাঁশ হাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে,চিল ব্রো।

অর্ণব ফুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— তুইতো অলওয়েজই চিল, শশুরের ব’ন্দু’কের সামনে দাড়িয়েও বলিস চিল আব্বাজান। এতো চিল কই পাস?

অর্নবের কথায় সায়র মলিন হেসে ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমরা তো ফিরে যাচ্ছি, তুই কি করবি?

সায়রের কথায় একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ক্রীতিকের বুক চিড়ে,কিছু্ক্ষন থম মে’রে থেকে ও বললো,
—- আপাতত যাচ্ছিনা, কোম্পানির অনেক কিছু এখনো আয়ত্তে আসেনি, সবকিছু বুঝে উঠতে আরও বছর খানিক সময় লেগে যাবে, তারপর না হয় ফিরে যাবো।

ক্রীতিকের কথার পাছে অর্ণব স্ব-ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে উঠলো,
—- কোম্পানি তো তুই হেড অফিস থেকেও সামলাতে পারবি, এখানে থাকতে হবে কেন?

ক্রীতিক বললো,
— অরুকে নিয়ে ভাবছি, আমাদের সম্পর্কটা আরেকটু স্বাভাবিক হোক, আমি ওর অভ্যেসে পরিনত না হলে কোনোকিছুই সম্ভব নয়। নয়তো দেখা যাবে ইউ এস এ তে ফিরে মা আর আপার জন্য কা’ন্নাকা’টি লাগিয়ে দিয়েছে।

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব হ্যা সূচক মাথা নাড়ালেও সায়র বাম হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
— কিন্তু অরুতো…. এ্যা,এ্যা,এ্যাহ…

সায়রের কথা জিহ্বা অবধি এসেই থেমে গেলো, কারণ এই মূহুর্তে নিজের বাহু দিয়ে ওর গলাটা চে’পে ধরে আছে ক্রীতিক, ওর হাতের বাঁধনটা ছাড়ানোর জন্য সায়র কাইকুই করছে খুব, অর্ণবের কাছেও সাহায্য চাইছে,অথচ অর্ণব মিনমিনিয়ে হাসছে আর স্মো’কিং করছে।

সায়রকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে ক্রীতিক দাঁত কটমটিয়ে বললো,
— কতবার বলেছি আমার বউয়ের নাম মুখে নিবিনা তুই, কথা কানে যায় না?

সায়র খ্যাক খ্যাক কেশে উঠে অস্পষ্ট আওয়াজে বললো,
—- আরে ভাই আমি বিবাহিত এখন, ছাআআড়!

—- বিবাহিত কেন? তিন বাচ্চার বাপ হলেও তুই আমার বউয়ের নাম মুখে আনবি না,ব্যাস।

ক্রীতিকের কথায় সায়র এবার বিরক্ত হয়ে বললো,
— এমন ভাব করছিস যেন আমার মুখে জীবানু লেগে আছে, আমি তোর বউয়ের নাম মুখে নিলেই ফোস্কা পরবে।

— হ্যা পরবে,একশো বার পরবে, কারণ তুই পুরোটাই একটা ম’হামারী, আজ থেকে তোর নাম রাখা হলো সায়র ভাইরাস। আর আমি একদমই চাইনা আমার ওইটুকুনি বউটা তোর ভাইরাসে আ’ক্রান্ত হোক, দূর হ শালা।

কথাশেষ করে সায়রকে ধা’ক্কা মে’রে কাঁদার মধ্যে ফেলে দিলো ক্রীতিক। তা দেখে অর্ণব না চাইতেও মুখ ফসকে হো হো করে হেসে দিলো। ক্রীতিক ও নতুন উদ্যমে সিগারেট ধরিয়ে মিটমিট করে হাসি সংবরণ করছে, যথাসাধ্য চেষ্টা করেও মুখের আদলে গম্ভীর ভাবটা ধরে রাখা যাচ্ছেনা কিছুতেই। ওদের দু’জনার এহেন কপটতা আর ষ’ড়যন্ত্র:কারীর ন্যায় আচরণ দেখে সায়র কাঁদা ছাড়িয়ে উঠতে নিয়ে আবারও পিছলে পড়ে গিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো,
— শালা মীরজাফরের দল, তোদের কোনোদিন ভালো হবেনা, বউয়ের হাতে সকাল সন্ধ্যা উত্তম মাধ্যম খাবি তোরা, এই আমি অ’ভিশাপ দিলাম।

*
ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আওয়াজ জানান দিচ্ছে রাত তখন বারোটা বেজে এক, বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, হোম স্টে এর পুরো এরিয়াতে বিদ্যুৎ নেই। যার দরুন তিমিরে ঢাকা পরেছে পাহাড়ি এই নির্জন বসতিটা। অরু হাত বাড়িয়ে আলগোছে একটা চার্জার লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে, এখন কিছুটা আলোকিত চারিপাশ।

বজ্রপাত বিহীন শান্ত কোমল বারিধারা, তাও দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে কটেজের তকতকে মেঝে, তাই অরু এবার হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যস্ত হাতে হাট করে খুলে রাখা জানালাটা বন্ধ করে দিলো।

অরু যখন রিনঝিন চুড়ি বাজিয়ে দ্রুত হস্তে জানালা বন্ধ করছিল, ঠিক তখনই অন্যপাশ দিয়ে চুল থেকে বৃষ্টিকনা ঝেড়ে সরাতে সরাতে একপ্রকার ছুটেই রুমে প্রবেশ করে ক্রীতিক। রুমে এসে আবছা আলোয় অরুকে না দেখতে পেয়ে গলা ছেড়ে ডেকে উঠলো ও,
— অরুউউ?

ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে অরু তাড়াহুড়ো হাতে নিজের শাড়িটা ঠিকঠাক করে,চুলগুলো আরেকটু ভালো মতো পরিপাটি করে হাতে একটা রেড ভেলভেট কেক নিয়ে এগিয়ে গেলো মেইন ডোরের দিকে, ক্রীতিক এখনো একই যায়গাতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, অরু এগিয়ে গিয়ে ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে ওর সামনে কেকটা বাড়িয়ে দিয়ে একগাল হেসে বললো,
—- হ্যাপি বার্থডে হাসবেন্ড, জন্ম দিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে। মোমবাতিটা নিভে যাবে ঝটপট কিছু উইশ করে ফেলুন।

— আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।

ক্রীতিকের দুচোখে তখন জ্বলজ্বল করছিল একটুকরো মোমবাতির নিয়ন অ’গ্নিশিখা, অথচ কেকের দিকে ওর কোনো রকম নজরই নেই, মা’দকতার অনলে ডুবে যাওয়া ঘোর লাগা দুটো চোখ আটকে আছে অরুর কাজল কালো চোখে,কৃত্তিম উপায়ে রঙিন করা রোজি দুটো ফিনফিনে ঠোঁটের ভাঁজে আর তারপর সেই আকর্ষিত একফালি নির্মেদ বাঁকানো কোমড় যা ক্রীতিকের সুস্থ সবল মস্তিষ্কটাকে অচল বানিয়ে দিতে সক্ষম,আর সেই ঘোরের মাঝেই অস্ফুটে কথাটা বলে ওঠে ক্রীতিক। ক্রীতিকের কথার পাছে অরু স্ব-ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কিছু চাওয়ার নেই মানে? এ আবার কেমন কথা?

অরুর কথায় জবাব দিলো না ক্রীতিক, উল্টে অরুর আগাগোড়া ইশারা করে ওকে প্রশ্ন ছুড়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— , ইজ ইট মাই বার্থডে প্রেজেন্ট বেইবি ?

অরু জবাব দিলো না,তীব্র সংকোচে মাথাটা নিচু করে ফেললো তৎক্ষনাৎ । মৌনতা সম্মতির লক্ষন সেটা ভেবেই বাঁকা হাসি খেলে গেলো ক্রীতিকের ঠোঁটের আগায়। ও আচমকা হাত থেকে কেকটা রেখে অরুকে ছোঁ মে’রে নিয়ে চলে গেলো কটেজের ছাঁদ খোলা বারান্দায়। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফুটো হয়ে পতিত বৃষ্টিকনা এসে ভিজিয়ে দিলো অরুর সর্বাঙ্গ, সুন্দর শাড়ি,সাজগোজ,লম্বা চুল সবকিছু ধুয়ে মুছে স্নিগ্ধতায় ছেয়ে গেলো ওর সমগ্র মুখ মন্ডল।

— হার্টবিট, ইউ লুকস্ প্রিটি।

ব্যাস এতোটুকুই, আর কোনো কমপ্লিমেন্ট দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না ক্রীতিক। বরং কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই দু’হাতে অরুর কোমড়টা শক্ত করে চেপে ধরে ওর গলার মাঝে হুট করেই দাবিয়ে দিলো নিজের মুখটা ।

প্রতিফলিত তীব্র আ’ক্রোশের ন্যায় একনাগাড়ের গাঢ় চুম্বন দিশেহারা করে দিচ্ছে অরুকে। ক্রীতিকের এমন আ’ক্রোশ দেখে এক পর্যায়ে অরুর মনে হচ্ছে, ওকে কোনো র’ক্তচো’ষা চেপে ধরেছে, এক্ষুনি নিজের লাল চোখ আর সূচালো দাঁত বের করে শরীরের সবটুকু র’ক্ত এক নিশ্বাসে শুষে নিয়ে যাবে সে, আর অরু পরে রইবে একটা নিথর র’ক্তহীন মানবী হয়ে।

বিষয়টা ভাবতেই অরুর গায়ে কাটা দিলো।রাতের আধারে,বৃষ্টির মাঝে ক্রীতিকের এহেন অতিরিক্ত উত্তেজনা দেখে কিছুটা ভীত ও হয়ে পরলো মেয়েটা, তাই ওকে নিজের থেকে সরানোর খুব জোর চেষ্টা করে কম্পিত গলায় অরু বললো,
— আরেহ অন্তত কেকটা তো কাটুন।

ক্রীতিক অরুকে এক ঝটকায় পেছনে ঘুরিয়ে ওর পোশাকের লাগোয়া ফিতেটা মুখের সাহায্যে টেনে খুলতে খুলতে হিসহিসিয়ে বললো,
— সব পরে খাবো, তার আগে…

মাঝ পথেই থেমে গেলো ক্রীতিক, দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে সন্দিহান গলায় অরুকে বললো,
—- বেইবি, এখন অন্তত এটা বলিস না যে তুই ফিট নেই। এখনো তোর…

আবারও থেমে গেলো ক্রীতিক, ভেতরের অস্থিরতাটা দমাতে চোখ বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষণ।

অরুর পৃষ্ঠদেশ উন্মুক্ত, ক্ষুদ্র বৃষ্টিকনা গুলো নিঃসংকোচে ঠায় নিয়েছে সেথায়,অথচ আলো পিছলে যাওয়ার মতোই মসৃণতা তার। এতোক্ষণে তো অরুও ডুব দিয়েছিল অজানা এক ঘোর লাগা শিহরণে,আর এখন এতো ঠান্ডার মাঝেও চোখমুখ গরমে জ্বলে যাচ্ছে ওর, তবুও ক্রীতিককে আসস্ত করতে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো অরু।

ক্রীতিক ওর হ্যা এর মানে বুঝতে না পেরে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
— এভাবে যন্ত্রনা না দিয়ে, মুখে বল। জাস্ট ইউজ ইওর ওয়ার্ড।

ক্রীতিকের ধমকে অরু কেঁপে উঠে নরম গলায় রিনরিনিয়ে বললো,
— ঠিক আছি।

অরুর কথাটা বলতে যতক্ষণ, তার পরক্ষনেই ঝড়ের গতিতে ওকে পুনরায় কাছে টেনে নিলো ক্রীতিক।

দিনশেষে আরও একবার অরুকেই সহ্য করতে হলো এই বেপরোয়া,খামখেয়ালি লোকটার উন্মাদনায় মত্ত মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসাময় এক দিশেহারা ঝড় তুফানের রাত। যা ওর নিকট চিরস্মরণীয়।

********************************

বেলা বেজেছে অনেক, তবে চারিদিকে চোখ বোলালে মনে হচ্ছে মাত্রই ভোর হলো। মেঘের চাদরে ঢেকে আছে প্রকৃতি,বৃষ্টি হচ্ছে দফায় দফায়, তার মাঝেই বাইকার জ্যাকেট আর লেদার প্যান্ট পরে ফ্রন্ট ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে দুরবিনের সাহায্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখার চেষ্টা করছে ক্রীতিক।

অরুর মাত্রই ঘুম ভেঙেছে, পরনে এখনো ক্রীতিকের হুডি, সেভাবেই একজোড়া হ্যালো কিটি পায়ে চড়িয়ে কটেজ থেকে বের হয়ে এলো ও।

ফ্রন্ট ইয়ার্ডে ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে চোখ ডলতে ডলতে ক্রীতিকের পাশ ঘেষেই দাঁড়িয়ে পরে অরু। অরুর আগমন টের পেয়ে দুরবিন থেকে চোখ সরিয়ে ওর কপালে শব্দ করে চুমু খেলো ক্রীতিক, অতঃপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— গুড মর্নিং বেইবি।

আদুরে বিড়াল ছানার মতো দু’হাতে ক্রীতিককে শক্ত করে আগলে ধরে আহ্লাদী গলায় অরু বললো,
— গুড মর্নিং, কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন?

— রাইডিং এ।

ক্রীতিকের কথায় অরু হকচকিয়ে উঠলো, ঘুমের ঘোর কেটে গেলো তৎক্ষনাৎ, সটান হয়ে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন গলায় অরু বললো,
— পা’গল আপনি? এই বর্ষায় কেউ রাইডিং এ যায়?

ওর কথায় ক্রীতিক ফিচেল হেঁসে জানালো,
—- পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির মাঝে রাইডিং এর থেকে এডভেঞ্চারাস আর কি হতে পারে হুম?

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
—- তাহলে আমিও যাবো।

ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ অরুর কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,
—- নো ওয়ে, তুই এখানেই থাকবি।

— কেন,আমি গেলে সমস্যাটা কি?

ক্রীতিক দুরবিনে নজর দিয়ে বললো,
— রাস্তাঘাট পিচ্ছিল, তার উপর একটু পরপর বৃষ্টি হচ্ছে এখন তোকে নেওয়া যাবে না।

অরু রুদ্ধ আওয়াজে বলে উঠলো,
— তারমানে আপনি বলতে চাইছেন রাস্তায় রি’স্ক আছে তাইতো?

—- সেটা কখন বললাম?

— এই যে এখন।

ক্রীতিক ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আমি তেমন কিছু…..

— তাহলে আমাকে নিয়ে যান, আমিও আপনার সাথে রাইডিং এ যেতে চাই।

ক্রীতিকের কথার মাঝেই চট করে কথাটা বলে ওঠে অরু।

ক্রীতিক ওকে চোখ পাকিয়ে কিছুটা গম্ভীর গলায় বললো,
— জিদ করছিস কেন? বলেছিতো নেব’না।

সারা রাতভর এতো ভালোবাসা দেওয়ার পরে সকাল সকাল ক্রীতিকের এতোটুকু শক্ত কথাও বেশ গায়ে লাগলো অরুর। অরু হলফ করে বলতে পারে, রাতের ক্রীতিক আর এখনকার ক্রীতিকের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যাবধান। কেন যেন না চাইতেও অভিমানি অশ্রুজলে টলটল করে উঠলো ওর দুচোখ। অরুর চোখে পানি ব্যাপরাটা বোধগম্য হতেই ক্রীতিক দ্রুত হস্তে ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললো,
— কাঁদছিস কেন বেইবি?এখনো শরীর খারাপ লাগছে?পেইন কি’লার নিয়েছিলি?

অরু ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
— আমাকেও নিয়ে যান, প্লিজ। আমিও আপনার সাথে যেতে চাই।

অরুর অসহায় আবদারের কাছে চরম ভাবে হেরে গিয়ে একটা তপ্ত অপারগ নিঃশ্বাস ছাড়লো ক্রীতিক,অতঃপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—- ঠিক আছে নিয়ে যাবো, তবে আমার মতো, লেদারসুট, গ্লাভস, সেইফটি প্যাড সবকিছু পরতে হবে। বল রাজি?

ক্রীতিকের কথার পাছে অরু মুচকি হেসে জোরে জোরে মাথা ঝাকালো।

*
বাইরে মুশলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, তারমধ্যেই পাহাড়ি রাস্তা ধরে সিটং এর দিকে শাঁই শাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে বাইকটা। ক্রীতিক খুব সাবধানে স্পিডোমিটারের গতি কমিয়ে বাইক রাইড করছে, যা অরুর কাছে প্রচন্ড বোরিং লাগছে, বাইকে বসে ঠেলা গাড়ির ফিল নিতে নিতে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে অরু ক্রীতিকের দিকে ঝুঁকে গিয়ে বললো,
— এতো আস্তে চলছে কেন বাইকটা? আপনি না রাইডার? এই আপনার রাইড? আবার আমাকে দিয়ে সেইফটি প্যাড ও পরিয়েছেন। হুহ!

অরুর কথায় ক্রীতিক কপট হেসে বললো,
—- তোর যে ফাস্ট রাইডিং পছন্দ সেটা আগে বলিস নি কেন? আমি আরও ভাবলাম ছোট মানুষ।

ক্রীতিকের কথার আগামাথা না বুঝে অরু ভ্রুকুটি করে বললো,
— আপনি কি বলতে চাইছেন?

— কিছুনা ধরে বস।

ক্রীতিকের কথামতো অরু ওর কাঁধে রাখা নিজ হাতের বাঁধনটা জোড়ালো করতেই স্পিডোমিটারের গতি দিগুণ বাড়িয়ে ফেললো ক্রীতিক। সচকিত চোখে রাইড করতে করতে সামনের লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে অরুকে শুধালো,
—- আর ইউ ওকে বেইবি?

ওর প্রশ্নের জবাবে অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, সঙ্গে সঙ্গে স্পিডোমিটারের গতি আরও বাড়িয়ে দিলো ক্রীতিক। এবার অরু আর তাল সামলাতে না পেরে আচমকা পরে গেলো ক্রীতিকের পিঠের উপর। ক্রীতিক একই ভাবে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে হেলমেট পরিহিত অরুকে বললো,
—- এভাবে নয়, শক্ত করে জড়িয়ে ধর।

অরু ধরলো। এরপর আর কোনো কথা নয় দুজনই চুপচাপ একটা লং রাইডিং উপভোগ করতে লাগলো পুরোটা সময় ধরে। এতোক্ষণ একই ভাবে বসে থাকায় অরুর বেশ সাহস বেড়েছে, ও হুটহাট করেই দু’হাত মেলে দিচ্ছে মুক্ত নীড় হারা পাখির ন্যায়। অরুকে চুপচাপ রাইডিং উপভোগ করতে দেখে ক্রীতিক ডেকে বললো,
— বেইবি, হাউ ইজ ইট?

অরু মুক্ত বাতাসে দু’হাত মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— দারুন, আমাকে এভাবে প্রশান্তির সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও আপনার আয়ু বাড়ুক, আমার সব আয়ু আপনার হোক।

অরু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাইকের ব্রেক কষলো ক্রীতিক, হঠাৎ এভাবে ব্রেক কষায় অরু কিছুটা ঘাবড়ে গেলো, ও ভাবছে কোন কথায় আবার চটে গেলো ক্রীতিক, তাই একটু ইতস্তত গলায় বললো,
— কি হয়েছে?

কিন্তু না অরুর ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল হলোনা, আজ বোধ হয় ক্রীতিক পন করে নিয়েছে কোনো কিছুতেই রাগবে না সে, তাই সেই মোতাবেক, অরুকে আঙুলের ইশারা দিয়ে একটা স্থানীয় টং দোকান দেখিয়ে বললো,
—- বেইবি, চা খাবি?

— আমি খেতে পারি, কিন্তু আপনিতো সচারাচর চা খান’না।

অরুর কথায় ক্রীতিক ওর কপালে আঙুলের টোকা দিয়ে বললো,
— তোর জন্য সব খেতে পারি আমি,ইভেন ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবার ও।

ক্রীতিকের কথাটা চট করেই অরুর কাছে পরিচিত শোনালো, কবে কোথায় এমন কিছু হয়েছে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গিয়েও বেশিদূর এগোতে পারলোনা ও, তার আগেই ক্রীতিক টেনেটুনে নিয়ে গেলো চায়ের দোকানে।

চা পান করে নতুন উদ্যমে আবারও বাইক এগিয়ে যায় স্বীয় গতিতে। দুপুরের দিকে বৃষ্টিটা একটু থেমে গেলেও এখন বিকেল বাড়ার সাথে সাথে পুনরায় বৃষ্টির গতিবেগ বেড়েছে, অরুর তাতে কোনো ধরনের মাথা ব্যথা না থাকলেও ক্রীতিক কিছুটা চিন্তিত, পাছে না আবার ঠান্ডা লেগে যায় দুজনারই।

ক্রীতিক চুপচাপ রাইড করছে দেখে অরু পেছন থেকে ওর গলা জড়িয়ে ধরে শুধালো,
— আর কতদূর?

ক্রীতিক ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বললো,
— এভাবে কাছে আসছিস কেন? কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো তো।তারপর যখন তখন এ’ক্সি’ডে’ন্ট।

অরু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে ক্রীতিকের কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,
—- উহুম, মোটেই না, আপনি খুব ভালো রাইড করেন, কতো মসৃণ, এতো দ্রুত চলেছে তাও আমি একটুও ভ’য় পাইনি।

— তাহলে তুমি করে ডাক?

ক্রীতিকের কথায় অরু ফিক করে হেসে বললো,
— আপনার তুমিতে এতো দূর্বলতা কেন বলুন তো?

ক্রীতিক বেখেয়ালে বললো,
— জানিনা, তোর মুখে তুমি ডাক শুনতে ভালো লাগে, মনে হয় দুনিয়াতে আমারও আপন কেউ আছে, আমি তার প্রয়োজন নই কেবলই প্রিয়জন।

— তুমি।
ক্রীতিকের কথা শেষ হতে না হতেই, রিনরিনে আওয়াজ ভেসে এলো অরুর দিক থেকে।

ক্রীতিক দু’চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— আবার বল।

অরু ক্রীতিকের গলাটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,
— তুমি, তুমি, তুমি, তুমি শুধু আমার জেকে।

অরুর মুখে এতোবার তুমি ডাক শুনে পুলকিত ক্রীতিক, তাই ও ঘাড়টা সামান্য ঘুরিয়ে অরুকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই কিছু একটা নজরে আসতেই অকস্মাৎ চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো অরুর।

ও দেখলো বৃষ্টির মাঝে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে হুট করেই কোথা থেকে যেনো রং সাইড দিয়ে একটা কাবার্ড ভ্যান ঢুকে পরেছে মাঝ রাস্তায়, যার দূরত্ব ওদের থেকে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার বা তার ও কম।

অরুর চোখ বড়বড় হয়ে গিয়েছে, ক্রীতিক সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে হেলমেটের উপর থেকে অরুর গালে আলতো চুমু খেলো, তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে উঠলো অরু,
— দেখেএএএএ!!

অরুর কথায় ক্রীতিক আচমকা সামনে তাকিয়ে শরীরের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে হা’র্ডব্রেক কষলো, কিন্তু তার আগেই পিচ্ছিল রাস্তা আর কাবার্ড ভ্যানের ধা’ক্কা মিলেমিশে বিশাল দেহী বাইকটা দুটো মানুষ সহ’ই ছিটকে পরলো পাহাড়ি রাস্তার খাদে।

চোখের সামনে প্লাস্টিকের খেলনার মতো একটা বাইক ছিটকে পরেছে দেখা মাত্রই কাবার্ড ভ্যানটা দ্রুত গতিতে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। তার পরবর্তী মূহুর্তটা একদম শুনশান নীরব। যেন আশেপাশে কিছুই ঘটেনি।

লোকালয় ছাপিয়ে এই যায়গাটা বেশ অনেকটা দূরে অবস্থিত , তাও পাহাড়ের ঢাল, বৃষ্টি হওয়ার দরুন মানুষ তো দূরে থাক একটা কাক পক্ষীও নেই আশেপাশে । রাস্তাদিয়ে তখনও সরোবরের ন্যায় কলকলিয়ে বয়ে যাচ্ছে জলের ধারা। সেই জলের ছাঁট চোখে মুখে আঁচড়ে পরতেই কেঁপে উঠল ক্রীতিক, শক্ত পাথর খন্ডে লেগে ওর হেলমেটটা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে, অরু তখনো ক্রীতিকের বুকের মাঝে চেতনাহীন হয়ে পরে আছে। কিভাবে কিভাবে যেন বাইকটা হাত থেকে ছুটে গেলেও অরুকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরেছিল ক্রীতিক। যার দরুন অরুর হেলমেটটা এখনো অক্ষত।

নিভু নিভু চোখে একঝলক অরুকে দেখলো ক্রীতিক, নাহ ওর হেলমেট ঠিকই আছে, নিজেরটা আদৌও ঠিক আছে কিনা তা দেখার মতো সুযোগ হলোনা ক্রীতিকের, কারণ ওর মাথাট শক্ত জড়বস্তুর মতোই ভার হয়েছে আছে, সেই সাথে চুলগুলো আঠালো মনে হচ্ছে, চোখ দুটো ঝাপসা, পুরো দুনিয়া ওলট-পালট দেখাচ্ছে, সেই ঝাপসা চোখেই ক্রীতিকের চোখ গেলো এককোনে উল্টে পরে থাকা বাইকটার দিকে। ও নিজের র’ক্তা’ক্ত হাতে বুক পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে কি ভেবে যেন দিয়াশলাইটা জ্বালিয়ে ছুঁ’ড়ে মা’রলো বাইকটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা সমান অ’গ্নিশিখা ছড়িয়ে দাউ দাউ করে ‘জ্বলে উঠলো বাইকটা।

বহুক্ষনের প্রচেস্টায় একটুখানি উঠে বসলো ক্রীতিক, অতঃপর খুব করে চেস্টা চালালো অরুকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে কোলে নেওয়ার, কিন্তু পারলোনা,উঠে দাঁড়ানোর আগেই হাঁটু ভেঙে ধপ করে বসে পরলো চুনোপাথরের উপর। নাক দিয়ে অনর্গল র’ক্ত ঝরছে, আজকে একটু বেশিই ঝরছে। কিন্তু কানের কাছে? এখান থেকেও কি যেন চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে, ক্রীতিক আস্তে করে হাত দিলো সেখানটায়, তারপর ভেজা হাতটা এনে ধরলো নিভু নিভু চোখের সামনে,

ধরতেই আবছা আবছা দেখতে পেলো ওর কান বেয়ে ঘন কালচে র’ক্ত গড়িয়ে পরছে,র’ক্তটা সাভাবিক নয়, ক্রীতিক তা দেখে একটু তাচ্ছিল্য করে হাসলো যেন কিছুই হয়নি। ব্যাস এটুকুই, এরপর পুরো রঙিন পৃথিবীটা ক্রীতিকের চোখের সামনে ধীরে ধীরে কালচে হয়ে এলো,হাত পা গুলো কাঁপতে কাঁপতে চোখের সামনে অকস্মাৎ আধারে তলিয়ে গেলো পুরো ধরনী। ক্রীতিক আস্তে করে পরে রইলো চেতনাহীন অরুর পাশেই।

একটু আগের খুনসুটি, অরুর গায়ের ঘ্রান, অরুর খিলখিল হাসির আওয়াজ আর সবশেষে দু’ঠোঁট নাড়িয়ে অস্পষ্ট ফ্যাস ফ্যাস আওয়াজ,
— মেইবি আই কুড’ন্ট প্রোটেক্ট ইউ,বাট আই লাভ ইউ হার্টবিট,
এরপর কয়েক মিনিট নিরবতা, পরক্ষনেই আবারও একটু ঠোঁট নাড়লো ক্রীতিক,

—আই লাভ ইউ আ লট। আমার সব আয়ু তোর হোক বউ। আমি না হয় তোর মধ্যেই বাঁচবো। অবশেষে আমি তুই মিলেমিশে একাকার হবো, আর বাঁধা নেই।

দেশের নামি-দামি ব্র্যান্ডেট বাইকটা তখনো দা’উদাউ করে জ্ব’লছিল এক কোনে, এটাই বোধ হয় অরুকে কষ্ট দেওয়ার জন্য অপারগ জায়ান ক্রীতিকের তীব্র রা’গের বহিঃপ্রকাশ ছিল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here