প্রেমসুধা #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ২

0
310

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২

তীব্র বর্ষণের ইতি টেনে আকাশ ঠমক ধরে বসলো। স্থির মেঘমালার তাতে ধ্যান নেই। তারা উড়ো উড়ি করতে ব্যাস্ত। রাতের আকাশ অথচ একদম ফকফকা যেন। গাড়ির কাঁচটা বন্ধ থাকায় পৌষ আবহাওয়া ঠিক ঠাওড় করতে ব্যার্থ। শুধু জানালায় মাথা এলিয়ে বাইরে দেখে যাচ্ছে। পাশের মানুষটার দিকে তার ধ্যান জ্ঞান কিছুই নেই আপাতত। সে নিজেকে নিয়ে বিভোর। ভাবনায় তার চিরায়ত চিরপরিচিত বাড়ীটা। এমন আবহাওয়াতে নিশ্চিত ওর দলবল নিয়ে ছাদে আড্ডা জমাতো। আড্ডার মাঝেই ইনি,মিনি দুইজন চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য’র কোলে ঘুমিয়ে পরতো। রাত যখনই একটু বাড়তে শুরু করবে তখনই ছাদে আগমন ঘটতো হেমন্ত’র। সবগুলোকে ধমকে, ধামকে, থাপড়ে নিচে নামাতো। এটাই তো হতো। কিন্তু আজ হলো না। আর কোনদিন হবে বলে ও মনে হচ্ছে না। পৌষে’র বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। মাথায় হঠাৎ ই যন্ত্রণা হচ্ছে। সেই যন্ত্রণা বাড়লো যখন তীব্র হর্ণের শব্দ হলো। পৌষ চমকালো। সম্মুখে দৃষ্টিপাত করতেই বুঝলো ওরা পৌঁছে গিয়েছে। এই বাড়ী পৌষ’র চেনা। খুব গভীর ভাবে না হলেও একটু চেনা। বাইরটা সে অনেকবার ই দেখেছে। ভেতরে যাওয়া হয় নি। ঐ সর্বোচ্চ গেট পর্যন্ত তাও খুব দরকারে। একবার বোধহয় ঢুকা ও হয়েছিলো তবে এই চরিত্রহীন পুরুষের ফ্ল্যাটে নয়। তার ভাইয়ের ফ্ল্যাটে।
“উফ” শব্দ করে সরতে চাইলো পৌষ। তার ভাবনায় ছেদ পরেছে। ব্যাথা দেয়া কোমড়টাতে পুণরায় শক্ত করে ধরেছে তৌসিফ তালুকদার। রাগে র*ক্ত যেন পৌষ’র টগবগিয়ে উঠছে। এই লোকের এসব ছোঁয়াছুঁয়ি ওর পছন্দ হচ্ছে না। গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। পৌষ কিছু বলার আগেই হঠাৎ জমে গেলো। তার অনুভূতি মুহুর্তেই থিতলে গেলো যেন। তৌসিফ তালুকদার তার অতি নিকটে। সহসা খিঁচে চোখ বুজে নিলো পৌষ। তাকালো না আর। তাকাবেও না। মরণ হোক তার তবে চোখ যে খোলা যাবে না।
ভারী পুরুষের নিঃশ্বাস শিঘ্রই তার সামনে থেকে হটলো। দরজা খুলে গটগট পায়ে নেমেও দাঁড়ালো। মৃদুস্বরে ড্রাইভার বলে উঠলো,

— ম্যাডাম, আমরা পৌঁছে গিয়েছে। আপনি কি এখন নামবেন?

ফট করে চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো পৌষ। এদিক ওদিক তাকিয়ে ও যখন কাঙ্ক্ষিত পুরুষটাকে দেখলো না তখন শাড়ী সামলে বেরিয়ে এলো। নাহ, কোন বিয়ে বিয়ে আমেজ নেই এখানে। একদম ই না। সারা জনম কার সাদামাটা ই আছে। একটু কি সাজানো যেতো না? নিজের ভাবনায় বিরক্ত পৌষ। কেন সাজাবে? পৌষ কি আর ইচ্ছে করে বিয়ে করেছে? পরক্ষণেই খেয়াল হলো এক শক্ত হাতের মুঠোয় ওর নরম হাতটা আটকা পড়েছে। লোকটা তাকে তাকানোর বা বুঝার সময়টুকু ও দিলো না। তার বড় বড় পায়ের ধাপে পা মিলাতে বেশ বেগ পোহাতে হলো পৌষ’র। শাড়ী পরায় সেই ঝামেলা বাড়লো একটু। এক প্রকার হুমড়ি খেয়ে পরলো নীচে অথচ তার ডান হাতটা এখনও তৌসিফ ধরে আছে। পরা মাত্র ই যেন না পৌষ কান্নার সুর তুলবে ওমনিই তাকে ফট করে কোলে তুলে নিলো তৌসিফ। কান্নার সুর তো দূর ক উচ্চারণ করার সময়টুকু ও পেলো না পৌষ। বড়ই আফসোস হলো তার। কান্না করতে না পারলে তার ভেতর ফুলেফেঁপে উঠে, শ্বাস কষ্ট হয়। মনে হয় এই বুঝি ম’রে গেলো। দম আটকে আসে কেমন করে। তবে আজ সেসবের সময় হলো না। কেউ তাকে হাতে ধরে সময় দিলো ও না৷ সোজা দরজায় নক করতেই এক মহিলা দরজা খুলে দিলো। তৌসিফ কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ড্রয়িং রুম পেরুলো। একদম মাস্টার বেড রুমে ঢুকে সযত্নে নরম বিছানাটার মাঝে রাখলো পৌষ’কে। পরপর গেলো দরজা লাগাতে।
ফাটা চোখে এদিক ওদিক তাকালো পৌষ। সারাটা ঘরময় আভিজাত্যের ছোঁয়া। পৌষ মুগ্ধ হলো। গোল গোল চোখ করে দেখলো সবকিছু। তবে সোনালী আলো থাকায় ততটাও দেখতে পেলো না। মনে মনে গালি দিলো,

— ফকিন্নি।

এমন সোনালী আলো তার কাছে ফকিন্নি ই মনে হলো। চারশত চল্লিশ বোল্ডের বাতিতে এমন হলুদ হলুদ দেখায়। তাদের বাসায় এনার্জি বাল্ব। সাদা ঝকঝকা, ফকফকা আলো ছড়ায়। একদম চকচক করে চারপাশ। আর এত বড় লোকের বাড়ীতে কি না ড্রিম লাইটের বদলে এই হলুদ বাত্তি? মানা যায় এসব? এই বাল্ব গুলোতে চৈত্র পানি ঢুকিয়ে দুটো বিটা ফিশ ছেড়েছিলো একবার। রাতে হলে চোখ ধাধানো সুন্দর লাগতো দেখতে।
পৌষ যখন ওর এলোমেলো ভাবনাতে মশগুল তখনই হঠাৎ ওর আঁচলে টান পরলো। চমকে উঠে ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো ও। বড় বড় চোখে দেখে গেলো তৌসিফ’কে। হ্যাঁ, এইতো সেই পুরুষটা। সুন্দর পুরুষ। চেহারা, দেহ, চুল, ব্যাক্তিত্ব কোনটাতেই সে পিছিয়ে নেই। পেছানো শুধু চরিত্রের দিক থেকে। যেটা একজন ব্যাক্তির সবটুকু সত্বা বহন করে তৌসিফ তালুকদারের সেটাই নেই।
কথাটা মনে পরতেই সবে মাত্র মুগ্ধ হতে শুরু করা পৌষ ভাবনার জাল ভেদ করে বেরিয়ে এলো। তৌসিফ তালুকদার ততক্ষণে এগিয়ে আসছে পৌষ’র দিকে। এই একা বাড়ীতে বদ্ধ দরজার ভেতরে পৌষ’র সকল সাহস পালালো। তার নজর বন্দী হলো শুধু হলুদ আলোয় আলোকিত এক সুদর্শন পুরুষ যে এগিয়ে আসছে পৌষ’র দিকে। পৌষ যেন এই মুহূর্তে বাক শক্তি ও হারিয়ে ফেললো। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তৌসিফ তালুকদারের দিকে। তবে কি আজ ই তার জীবনের বড় বড় দুটো ধাক্কা একসাথে এলো?

___________________

— হেমু?

বাবা’র ডাকে হেমন্ত তাকালো। ছাদে একা দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান বসিয়েছিলো মাত্র। দুটো টান দেয়া হয়েছে সবে। এমনটা নয় সে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। সবাই জানে কিন্তু ততটাও অভদ্রতা হেমন্ত দেখায় না যে বাপ-চাচাদের সামনে সিগারেট টানবে। তাই তো জলন্ত সিগারেটটা নীচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো। জ্বলন্ত আগুন নিমিষেই বুজে গেলো শুধু বুজলো না হেমন্তের বুকের আগুনটা। ওর বাবা ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই হেমন্ত মাথা নিচু করেই বললো,

— কিছু বলবে?

— আমার কি কিছু বলার আদৌ বাকি আছে?

— সেটা তো আমি জানি না বাবা। নিজের যা ইচ্ছে হলো করলে তুমি। এখন বলছো বলার বাকি আছে নাকি নেই?

— শুধু আমার একার ইচ্ছেতে এটা হয় নি হেমু। তুমি জানো সেটা। পৌষ আমার দায়িত্ব।

তাচ্ছিল্য হাসলো হেমন্ত। বললো,

— দায়িত্ব বরাবর পালন করেছো বাবা। গুড নাইট।

বলে এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না হেমন্ত। গটগট পায়ে নীচে নেমে এলো। এই মুহুর্তে তার সহ্য হচ্ছে না তার বাবাকে।
নীচে সোজা পৌষ’র রুমে ঢুকলো হেমন্ত। ঢুকা মাত্র ই চমকালো। পাঁচ বাদর বসা এখানে। এদের মধ্যে দুটো ঘুমে কাঁদা। পিহা ও ঢুলছে। জৌষ্ঠ্য আর চৈত্র সজাগ পুরোপুরি। এদের সন্ধ্যা থেকেই দেখা যাচ্ছিলো না। মাতম জমাচ্ছে তারা তাদের ভালোবাসার একমাত্র বোনের জন্য। পৌষ এ বাড়ীর কি তা প্রতিটা ইট জানে। প্রতিটা জান জানে অথচ চঞ্চলা পৌষটা এখন নেই। থাকলে এখন দৌড়ে হেমন্তের কাছে এসে আবদার জমাতো। রাত হলেই তার হাবিজাবি খেতে মন চায়। তার নাকি ভয়ংকর ক্রেভিং হয়। না জানি পৌষ’টা খেলো কি না? ওখানে কি কেউ জানে দিন ভর না খাওয়া পৌষ রাত হলেও ক্ষুধায় কেঁদে ও ফেলে? তার যে ঝুড়ি ঝুড়ি আবদার। কে পূরণ করবে সেগুলো? তৌসিফ তালুকদার কি তার খবর রাখবে নাকি পৌষ’টাকে শুধু স্ত্রী দায়িত্ব ই পালন করতে হবে?

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here