#হৃদয়হরণী
#পর্ব:২৫
#তানিশা সুলতানা
অভিমানের পাল্লা ভাড়ি হয়ে গেলে সহজে নারীর মন গলে না। নারী যেমন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে জানে ঠিক তেমন ভাবেই প্রচন্ড অভিমান করতেও জানে।
এই যে ছোঁয়া অভিমান করেছে। ঠিক অভিমান বলা চলে না এটাকে। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাদিকে আর জ্বালাবে না। সাদির সাথে কথাও বলবে না। তাকে নিয়ে ভাববে কিন্তু তাকে বুঝতে দিবে না। ভালোবাসবে দূর থেকে অধিকার দেখাবে না। মানুষটা যেভাবে ভালো থাকতে চায় থাকুক। সে অন্য কাউকে নিয়ে সুখে থাকতে চাইলে থাকবে।
ছোঁয়া এতোদিনে একটা কথা বুঝে গেছে
“জোর করে পাগলামি করে শুধু পাগল উপাধিটাই পাওয়া যায়।
কারো ভালোবাসা না”
তাই তো এতোটা জোর করে পাগলামি করেও সাদির মনে জায়গা করে নিতে পারলো না।
সাদি এখন নির্বাক দৃষ্টিতে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোঁয়া কোনো রেসপন্স করছে না। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে। পরি সাদির কোলে বসে সাদির দাঁড়ি নিয়ে খেলছে। কখনো টানছে কখনো হাত বুলাচ্ছে। চাপ দাঁড়ি গুলো একটুখানি বড় হয়েছে। ভেবেছিলো আজকে সেলুনে যাবে কিন্তু ছোঁয়ার জন্য যেতে পারলো না।
নাজমা বেগম গরম গরম ভাত নিয়ে এসেছে ইলিশ ভাজা দিয়ে। সাথে কাঁচা মরিচ। এটা ছোঁয়ার প্রিয়।
ছোঁয়ার পায়ের কাছে বসে ছিলো সাদি। নাজমা বেগম ছোঁয়ার মাথার কাছে বসে।
“আব্বা যাও খেয়ো এসো”
সাদি গম্ভীর গলায় জবাব দেয়
“পরে খাবো
” তোমার জন্য তোমার বাবা চাচা ভাই অপেক্ষা করছে। যাও
এবার আর সাদি না করতে পারে না। চুপচাপ পরিকে কোলে নিয়ে চলে যায়৷
সাদি যেতেই ছোঁয়া চোখ খুলে। নাজমা তাকে উঠে বসতে সাহায্য করে। ছোঁয়া শুধু এক ঢোক পানি খায়।
নাজমা এতো করে জোর করেও একটা দানা ভাত মুখে দিতে পারে না। ছোঁয়া পানি খেয়েই আবার শুয়ে পড়েছে। নাজমা এতোবার ডাকছে এতো কথা বলছে কিন্তু ছোঁয়া কোনো জবাব দিচ্ছে না। ভাড়ি অবাক হয় নাজমা বেগম। পায়ে কি বেশি ব্যাথা করছে?
এমন চুপচাপ থাকার মেয়ে তো তার নয়। ১০২° জ্বর নিয়েও মেয়েটা অনবরত কথা বলে চলে। হাত কেটে গিয়েছিলো একবার৷ চারটা সেলাই পড়েছিলো তবুও সে চুপচাপ থাকে নি। বরং কথা বলতে বলতে পাগল করে দিচ্ছিলো সকলকে। একটু ব্যাথা লাগলেই কাঁদতে কাঁদতে অস্থির করে তুলছিলো সকলকে। আর আজকে সেই মেয়ে এতোটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছে?
হয়ত আজকে একটু বেশিই ব্যাথা পেয়েছে। নাজমা বেগম ভাতের থালা রেখে কপালে হাত দেয়। জ্বর খুব বেশি নেই। কপালে চুমু খেয়ে লাইট অফ করে দিয়ে চলে যায় সে।
নাজমা বেগম চলে যেতেই ছোঁয়া চাপা স্বরে কান্না করতে থাকে।
সাদি দুই তিন বার রুটি মুখে নিয়েছে। গলা দিয়ে খাবার নামছো না তার। সাজ্জাত সেলিম সিফাত কেউ ই খেতে পারছে না। মমতা বেগম তো আহাজারি করে কেঁদেই চলেছে। বাড়ির ছোট সদস্য ছোঁয়া। পরিও ছোট কিন্তু নীরব। আর ছোঁয়া চঞ্চল। চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলে সকলের মনেই দাগ কেটে যায়।
সাবিনা বেগম মমতা বেগমের ভাত মেখে দিয়ে মাছের কাটা বেছে দিতে থাকে
“মা আপনাকে ঔষধ খেতে হবে। অল্প ভাত খেয়ে নিন।
অমত করে মমতা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে অল্প ভাত মুখে দিতে থাকে।
সাদি হাত ধুঁয়ে উঠে পড়ে। কেউ তাকে কিছু বলে না।
সাদি চলে যায় ছোঁয়ার রুমে। দরজা খোলার আওয়াজে ছোঁয়া কান্না থামিয়ে ফেলেছে। দরজা বন্ধ করে ছোঁয়ার পাশে এসে বসে সাদি। লাইট জ্বালায় না। হয়ত ছোঁয়ার সমস্যা হবে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
তখনই সাদির ফোন বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে স্কিনে তাকাতেই দেখতে পায় ” হিমি” নামটা জ্বল জ্বল করছে। ছোঁয়াও হালকা চোখ খুলে দেখেছে। নামটা দেখে বুকের ব্যাথা আরও বাড়তে থাকে। কান্না আটকে রাখা দায় হয়ে পড়ে৷
সাদি কল কেটে দেয় এবং ফোনটা বন্ধ করে ছোঁয়ার পাশে শুয়ে পড়ে। ছোঁয়ার মাথাটা নিজের বুকের ওপর রাখতে যেতেই ছোঁয়া শক্তি দেখিয়ে সরে যায়। তাতে পায়ে বেশ ব্যাথা পায়। সাদি অবাক হয়ে উঠে বসে। এই মেয়েটা কাল ওবদি সাদির কাছে আসার জন্য পাগল ছিলো আর আজকেই কি হলো?
“আমি কি করেছি জানি না। তবে সরি।
এমন কেনো করছো তুমি?
ছোঁয়া সাদির কথায় কান দেয় না। সে চিৎকার করে বাবা বলে ডেকে ওঠে। সাদি কপাল কুঁচকে ফেলে
” আশ্চর্য তোমার বাবাকে ডাকছো কেনো?
ছোঁয়া জবাব দেয় না। সে আগের মতোই চিৎকার করে বাবা বলে ডাকছে।
ছোঁয়ার চিৎকারে সাজ্জাত সহ বাড়ির সকলে চলে এসেছে দরজার সামনে। কিন্তু দরজা বন্ধ। মমতা বেগমের আহাজারির কান্না বেড়ে গেছে। সকলে দরজা ধাক্কাছে এবং ছোঁয়াকে ডাকছে। সাদি নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না।
সাদি ছোঁয়ার গাল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করো না ইডিয়েট। পরিণাম খুব খারাপ হবে।
ছোঁয়া এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে। চোখ দুটো ফুলে গেছে ছোঁয়া। গাল লাল হয়ে গেছে।
সাদিও এবার চিৎকার করে বলে ওঠে
” কি হয়েছে আমায় না বললে বুঝবো কি করে?
ততখনে সিফাত দরজা খুলে ফেলেছে চাবির সাহায্যে।
সাদির চিৎকারের সকলের ভয় আরও বেড়ে গেছে। সেলিম গিয়ে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে। সাজ্জাদ কঠিন দৃষ্টিতে সাদির দিকে তাকায়
“কি হয়েছে?
ছোঁয়া হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে
” আমি তোমাদের সাথে ঘুমবো।
ব্যাস সাদির রাগটা আরও বেড়ে যায়। মেয়েটা বড্ড বার বেড়েছে।
ছোঁয়ার টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাস এবং জগ ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সাদি।
সকলে সাদির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুজনের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে এটা বেশ বুঝতে পারছে সকলে।
“আমার সাদুর কি হইছে? আমার সাদু তো রাগে না। ওরে তোরা কি বলছিস?
বলতে বলতে সাদির পেছনে যায় মমতা বেগম।
__
নতুন ভোর নতুন দিনের সূচনা। সাদির দিন কাল একটুও ভালো যাচ্ছে না। সেই দিনের পরে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। একই বাড়িতে থেকে ছোঁয়ার দেখা পাওয়া দায় হয়ে উঠেছে৷ সারাক্ষণ রুমে বসে থাকে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। সাদি সামনে গেলেই চোখ বন্ধ করে ফেলে। হাজার ডাকলেও সাড়া দেয় না।
নিজেকে পাগল পাগল লাগছে সাদির। অফিসে মন টিকছে না। কাজে মন দিতে পারছে না। খেতে পারছে না। গোছালো সাদি পুরো অগোছালো হয়ে গেছে।
এটা বাড়ির সকলে খেয়াল করলেও এই বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না।
ছোঁয়া এখন মোটামুটি সুস্থ। হাঁটতে পারে না ভালোভাবে। তবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটু আতটু চলাফেরা করতে কারে।
সাদি অফিসে যাওয়ার পরে সে রুম থেকে বের হয়। মমতা বেগম মা বড়মা এবং আপির আদর খায়। তারা সারাদিন ছোঁয়ার পেছনে লেগে থাকে। ছোঁয়াকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।
আবার সাদি আসার আগে রুমে চলে যায়।
আজকেও গল্প করছিলো মমতা বেগমের সাথে। ওদের সামনে বসে পড়ি খেলছে।
এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। এই সময়ে কে আসলো? মনে প্রশ্ন জাগে ছোঁয়ার।
মমতা বেগম উঠে দরজা খুলে দেয়। সাদি এসেছেম উসকোখুসকো চুল লাল লাল চোখ দুটো ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে সাদিকে।
শার্টের তিনটে বোতাম খোলা।
“দাদুভাই তুমি এই সময়ে?
সাদি জবাব দেয় না।
সাদির পেছন থেকে বেরিয়ে আসে ইরা এবং রিমি। মমতা বেগমকে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
চলবে