এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১০.

0
152

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১০.

প্রচন্ড ভয় নিয়ে সাইফের পানে তাকিয়ে রইলো নিশা। গলাটা বেজায় শুকিয়ে আছে। গত কয়েক ঘন্টায় আতঙ্কবাদীরা তাকে এক বিন্দু পানিও মুখে তুলতে দেয় নি। পায়ের ব্যথাটাও একপ্রকার সহনীয় হয়ে গিয়েছে এই পর্যায়ে। নিশা ক্লান্ত দেহটা দেয়ালে এলিয়ে দিয়ে খরা ধরা গলায় বলে,

“ আপনি চলে যান ভাইয়া। মরতে হলে আমি একা মরবো। দেশের জন্য জীবন গেলে তো আমাকে শহীদ বলা হবে তাইনা? “

সাইফ অবাক দৃষ্টি মেলে নিশার দিকে তাকালো। ভীতু মেয়েটা হঠাৎ মরার কথা বলছে কেন? সাইফ প্রশ্ন করে,

“ মৃত্যুকে ভয় পাও না? “

নিশা ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,

“ বাবা সবসময় বলতো মাতৃভূমি সবার উপরে। দেশের জন্য জীবন গেলে তাতে ভয় অথবা আফসোস থাকবে না। “

সপ্তাদশী রমণীর মুখে এই ভারী কথাগুলো খুব পছন্দ হলো সাইফের। কিন্তু সে কিছু বলার পূর্বেই প্রত্যয় ব্যস্ত পায়ে ডিফিউজ কিট নিয়ে প্রবেশ করে। সাইফ এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে সাথে সাথে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত হয়। হাতে সময় আছে কেবল আট মিনিট তেতাল্লিশ সেকেন্ড। সাইফ প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ সবাইকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সড়ে যা। “

প্রত্যয় একরোখা স্বরে বলে,

“ ওদের আমি ইতিমধ্যে দূরে সড়ে যাওয়ার কথা বলে এসেছি। তুই তাড়াতাড়ি বোম ডিফিউজ কর। “

সাইফ গভীর মনযোগে বোমের প্রতিটা তার দেখতে দেখতে উত্তর দেয়,

“ আমি তোকে যেতে বলেছি প্রত্যয়। “

“ তুই নিজের কাজ কর। “

সাইফ এই পর্যায়ে রেগে গিয়ে বলে,

“ শালা বাংলা সিনেমা পাইসোস? তোর এইসব রঙঢঙ বিয়ের পর নিজের বউরে দেখাইস। এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। “

প্রত্যয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। সে কিছু বলবে তার পূর্বেই সাইফ চেঁচিয়ে উঠে,

“ আই সেইড গো। “

ব্যস। সাথে সাথে প্রত্যয় সেখান থেকে প্রস্থান করে। সাইফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনযোগ দিয়ে আপন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিশা চোখ বুজে মনে মনে কালেমা পড়তে ব্যস্ত তখন। সময় যখন আর কেবল এক মিনিট বাকি তখন সাইফের কণ্ঠ তার কানে ভেসে আসে।

“ চোখ খুলুন মিস ইয়াসমিন। আনফরচুনেটলি এই দফায় আমাদের দুজনের একজনও শহীদের মর্যাদা পেলাম না। “

নিশা ভীত চোখ জোড়া মেলে তাকায়। নাহ। টাইম বোমের সেই টিক টিক শব্দ এখন আর কানে ভেসে আসছে না। বরং উল্টো সেই বোমের একটা নীল রঙা ওয়্যার কাটা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। সাইফের দক্ষ এবং সুনিপুণ হাতে এই বোম ডিফিউজ করার ঘটনাটা নিশার ঠিক বিশ্বাস হলো না। সে অবিশ্বাস্যকর গলায় প্রশ্ন করে,

“ এম আই সেফ নাও? “

নিশার এই বোকা প্রশ্নে সাইফ বরাবরের মতোই বিরক্ত হয়। মনে মনে শুধায়,

“ মাইয়া মানুষের এই এক সমস্যা। নিজের চোখে দেখা ঘটনাও এরা সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। “

সাইফ নিশার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের ইউনিফর্মের বুকপকেটে থাকা ওয়াকি টকিটা বের করে প্রফুল্ল গলায় শুধায়,

“ দ্যা বোম ইজ ডিফিউজড। “

কথাটুকু বলেই ওয়াকি টকিটা ফের পকেটে রেখে সাইফ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ হাঁটতে পারবেন ম্যাডাম? “

নিশা চোখ তুলে সাইফের পানে তাকায়। সম্পূর্ণ বাম পা তার অবশ অনুভূত হচ্ছে। তবুও মুখ ফুটে সেই কথা না বলে সে মৃদু মাথা নেড়ে বুঝায় যে সে হাঁটতে সক্ষম। সাইফ দুই হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে দাঁড়িয়ে নীরবে পর্যবেক্ষণ করে নিশার ক্লান্ত ও আহত দেহ টেনে উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা। অত:পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে নিজেই নিচের দিকে ঝুকে নিশাকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে মনে মনে বলে,

“ এই প্রজাতির আরেক সমস্যা হলো এরা কখনো মুখ ফুটে কি সমস্যা তা বলতে চায় না। “

আচমকা কান্ডে নিশার লজ্জায় মূর্ছা যাওয়ার কথা থাকলেও সে তীব্র ব্যথায় একহাতে বাম পা চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠে। পাজাকোলে উঠার ফলে তার সম্পূর্ণ শরীর মনে হচ্ছে এখন হাওয়ায় ভাসছে। পা দুটোও ঝুলে আছে। সেই দুই পায়ের মধ্যে তার বা পা’টা মনে হচ্ছে এখনই হাঁটুর নিচ থেকে ছিড়ে পড়ে যাবে। কি তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাদায়ক সেই ব্যথা! নিশা তীব্র ব্যথার তারণায় নিজের চিকন হাতের আঙুলগুলো দ্বারা সাইফের ইউনিফর্মের বুকের কাছটা খামচে ধরে। নিশার ব্যথাতুর মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে সাইফ শান্ত গলায় শুধায়,

“ আর কিছুক্ষণ ধৈর্য্য ধরুন। এখান থেকে সোজা হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে আপনাকে। “

সাইফের কথা শেষ হতে না হতেই দুজন লেফটেন্যান্ট ভিতরে প্রবেশ করে। সাইফ নিশাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে তাদের একজনকে বলে উঠে,

“ তুমি কিটটা গুছিয়ে নিয়ে আসো সামির। আমি ইয়াসমিন ম্যাডামকে নিয়ে পিক আপ পয়েন্টে যাচ্ছি। উনাকে আর্জেন্ট হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। “

সামির কিট গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই সাইফ এবং অপর লেফটেন্যান্ট সেই বাড়ি থেকে বের হয়েই দ্রুত পায়ে বাকিদের সহ পিক আপ পয়েন্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা যখন সেই বাড়ি থেকে ঠিক একাশি কদম দূরে এসে পৌঁছেছে ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন থেকে ভেসে আসে বিকট ভয়ংকর শব্দ। শব্দের উৎস খুঁজতে পিছনে ফেরার পূর্বেই কোনো এক অজানা শক্তির ধাক্কায় এক নারীসহ পাঁচজন যুবক ছিটকে এক এক দিকে পড়ে গেলো।

বিকট শব্দের পর চারিদিক ছেয়ে গেলো পিনপতন নীরবতা। সেই নীরবতাকে চূর্ণ করতেই বোধহয় নিশা মৃদু স্বরে গোঙালো। ধোঁয়ায় চারিদিকটা বেশ আবছা আবছা হয়ে আছে। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। সাইফ কাশতে কাশতে সোজা হয়ে উঠে বসলো। তার ঠিক সামনেই মাটির উপর পড়ে থাকা নিশাকে দেখে এগিয়ে যেতে নিয়েও সে থেমে গেলো। হতভম্ব ভঙ্গিতে চকিতে পিছনে ফিরে সেই বাড়ির পানে তাকালো। মুহুর্তেই সে তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলো একটা নাম ধরে,

“ সামির! “

প্রত্যয় ইতিমধ্যে উঠে ছুট লাগিয়েছে সেই বাড়ির দিকে। হতভম্ব আরো দুজন লেফটেন্যান্টরাও সেদিকে ছুটে গিয়েছে। সাইফ বিস্ময় কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যেতে নিলেই একজন লেফটেন্যান্ট তাকে বাধা দিয়ে বললো,

“ আমাদের ম্যামকে নিয়ে এই মুহুর্তে এখান থেকে যেতে হবে। শি ইজ ইঞ্জুরড। “

সাইফ আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে অতি কষ্টে উচ্চারণ করলো,

“ সামির ওই বাড়ির ভেতর ছিলো। ও ও ইঞ্জুরড। ওকেও নিতে হবে সঙ্গে। লেট মি গো। “

লেফটেন্যান্ট আটকে রাখা কান্না গিলে নিয়ে বলে,

“ ওই বাড়ি অক্ষুণ্ণ নেই। ওখানে এখন সামিরের ইঞ্জুরড বডি না বরং ওর ছিন্ন বিছিন্ন শরীরের অংশ পাওয়া যাবে। “

সাইফ ধপ করে ফের মাটিতে বসে পড়লো। দূর হতে ভেসে আসছে প্রত্যয় সহ আরো দু’জন লেফটেন্যান্টের চিৎকার। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সাইফ নিষ্পলক চেয়ে রইলো সেই পানে।

এরকম অসংখ্য সামির মাতৃভূমির মাটিতে দেশের স্বার্থে শহীদ হচ্ছে। ক’জনার নাম জানে এই দেশের সাধারণ নাগরিকরা? এইরকম বহু সামিররা এই দেশের মাটিতে জন্ম নেয় বলেই হয়তো সাধারণ নাগরিকরা নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারে। কারণ তারা জানে এই সামিররাই একদিন বড় হয়ে তাদের এবং মাতৃভূমির সুরক্ষার জন্য নিজেরা রাতের পর রাত নির্ঘুম পাড় করবে। যেই নির্ঘুম রাতের সাক্ষী কেবল মহান প্রতিপালক। অত:পর একদিন তারা এভাবেই চির নিদ্রায় শায়িত হয়। সন্তানের ঘরে ফেরার অপেক্ষা করা পিতামাতার কাছে পৌঁছায় সন্তানের বুলেটে জর্জরিত নিথর দেহ কিংবা ছিন্ন বিছিন্ন দেহাংশ।

নিবিড়ভাবে চোখের সামনের বিধ্বংসী দৃশ্যপট দেখতে থাকা সাইফ তার সম্বিত ফিরে পায় এক রক্তাক্ত হাতের ছোঁয়ায়। সাইফের ডানহাতটা সেই হাতের ছোঁয়ায় মুহুর্তেই লাল বর্ণ ধারণ করলো। মাথা ঘুরিয়ে পাশে চাইতেই সে দেখলো জীবন তৃষ্ণায় তড়পাতে থাকা এক রমণীকে। অতি কষ্টে তার মুখে উচ্চারিত একটা শব্দ সাইফের কানে এসে পৌঁছায়৷

“ পানি… “

ব্যস! এইটুকুই। অসম্পূর্ণ কথা মুখে রেখেই দ্বিতীয় দফা চেতনা হারায় নিশা। ডিউটিরত একজন আর্মির কাছে তার ডিউটিই ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তাইতো সাইফ আটচল্লিশ কেজির সেই নারী দেহটা তুলে নিয়ে অগ্রসর হলো অপেক্ষারত হেলিকপ্টারের দিকে। তার পিছু পিছু আরেকজন লেফটেন্যান্ট হাঁটতে হাঁটতে হাতের ওয়াকি টকি দ্বারা হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দিলো ক্ষুদে বার্তা,

“ দ্যা মিশন ইজ একমপ্লিসড উইথ ওয়ান মার্টার। “

__________

কক্সবাজার সি বীচের কাছাকাছি এক রিসোর্টে এসে পৌঁছেছে দূর্জয়। বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে তদন্ত করে সে জানতে পেরেছে রইস দিলদার নামক একজন ভারতীয় লোক এই রিসোর্টের দায়িত্বে রয়েছেন। সেই রইস দিলদারকে হাতেনাতে ধরতেই দূর্জয়ের কক্সবাজারে আগমন। পরিকল্পনা অনুযায়ী একজন ডাক্তারের পরিচয় দিয়ে হোটেলে চেক ইন করে সে। রিসিপশন কাউন্টার হতে সে এই তথ্যটুকুও সংগ্রহ করে নিয়েছে যে রইস দিলদার এই মুহুর্তে রিসোর্টে উপস্থিত আছে কিনা। কিন্তু দায়িত্বরত রিসিপশোনিস্ট তাকে জানায় যে রইস দিলদারকে আগামীকাল রিসোর্টে পাওয়া যাবে। দূর্জয় আর অতি আগ্রহ প্রকাশ করলো না তার সামনে। সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রুমের চাবি নিয়ে নিজের জন্য নির্ধারিত রুমে পৌঁছে যায়।

রুমে পৌঁছেই সর্বপ্রথম সে জুলফিকারকে কল দেয়। কিছুক্ষণ ফোন বাজতেই অপরপাশ হতে কল রিসিভ হয়। দূর্জয় উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ স্যার? নিশা কেমন আছে এখন? “

জুলফিকার থমথমে গলায় উত্তর দেয়,

“ সার্জারি চলছে ওর। আশা করছি সুস্থ হয়ে যাবে। “

দূর্জয় এই অবস্থায় সামান্য নরম সুরে প্রশ্ন করে,

“ আন্টি কেমন আছে? “

জুলফিকার সামান্য হেসে বলে উঠে,

“ এইমাত্র আমাকে শাসিয়ে গেলো। দু’দিন পর নিশার বার্থডে। সেই উপলক্ষে অগ্রীম একটা চমৎকার সাইকেল অর্ডার করেছে ও। নিশা যদি সুস্থ পায়ে সেই সাইকেলে বসতে না পারে তাহলে আমার পা ভেঙে দিবে বলেছে। “

জুলফিকারের হেসে বলা কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস টের পেয়ে দূর্জয় বলে উঠে,

“ এক মুহুর্তের জন্য নিজেদের মধ্যের ঝামেলাটা মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলুন। আপনাদের আরেকটাও পরিচয় আছে। আপনারা দুজনেই নিশার আব্বু আম্মু। এই মুহুর্তে আপনাদের দুজনেরই মেন্টাল সাপোর্ট প্রয়োজন। মনমালিন্য ভুলে কিছু সময়ের জন্য সেই মেন্টাল সাপোর্টটা একে অপরকে প্রোভাইড করুন। “

জুলফিকার থমথমে স্বরে জবাব দেয়,

“ একহাতে তালি বাজে না দূর্জয়। আর তাছাড়াও আমি নাঈমার সব শর্ত মেনে শুধুমাত্র এই কারণে নিশার কাস্টাডি ওকে দিয়েছিলা, কারণ আমি মনে করতাম নাঈমার থেকে ভালো করে কেউ আমার মেয়ের খেয়াল রাখতে পারবে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি নিশার নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে ওর মায়ের সাথে। তাই আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে নিজের বাড়ি ফিরবে এবার। তার বাবার বাড়িতে। চব্বিশ ঘণ্টা সম্পূর্ণ নিরাপত্তার অধীনে থাকবে ও। “

দূর্জয় কিছু বলতে নিবে তার আগেই জুলফিকার বলে উঠে,

“ তোমার মাথায় অলরেডি অনেক চিন্তার পাহাড় জমে আছে দূর্জয়। এসব নিয়ে ভেবে শুধু শুধু সময় নষ্ট করো না। সব ধ্যান এবং জ্ঞান মিশনে দাও। সময় হলে হসপিটাল এসে নিশার সাথে দেখা করে যেও। ও তোমাকে দেখলে খুশি হবে খুব। “

“ রজার দ্যাট। “

ফোনটা রেখে দিয়েই দূর্জয় তার পরিধেয় শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলতে খুলতে ব্যালকনির দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বারান্দা হতে রিসোর্টের সীমানার ভেতরে একটা বাচ্চা শিশুকে বাস্কেটবল হাতে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে দূর্জয় অনিমেষ সেই পানে তাকিয়ে রয়। চোখের সামনে ভেসে উঠে সোনালী অতীত।

__________

নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের স্পোর্টস ক্লাবের একজন সক্রিয় মেম্বার হয়ে উঠে দূর্জয়। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের দূরান্ততার প্রকাশ দেয় বাস্কেটবল কোর্টে। বছরের মাঝামাঝি সময় তখন। হাফ ইয়ারলি এক্সামের রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার দু’দিন পরের ঘটনা। বিশাল আকাশ জুড়ে সেদিন সূর্যের দেখা মিলে নি। বাস্কেটবল কোর্টে নিজের দলের কয়েকজন ছেলের সাথে বাস্কেটবল খেলতে ব্যস্ত দূর্জয়। পড়নে তার হাতা কাটা এক স্পোর্টস টি শার্ট এবং থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। হাঁটু সমান মোজা দ্বারা তার শ্যাম পা জোড়া আবৃত।

খেলতে খেলতে হঠাৎ দূর্জয় বাস্কেটে বল ছুড়ে মারতেই ফিল্ডের একপাশ হতে ভেসে এলো একটা তীক্ষ্ণ শিস বাজানোর শব্দ। দূর্জয় সহ বাকি ছেলেরাও সেই শব্দ অনুসরণ করে পাশ ফিরে তাকাতে দেখে একটা কাঠের বেঞ্চির উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে বাণী। তার পাশেই বেঞ্চির হ্যান্ডেলে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে আরমিন। দুজনের পড়নেই এখনো স্কুল ইউনিফর্ম। তার মানে ছুটি হওয়ার পর এরা বাসায় না গিয়ে এতক্ষণ ধরে এদিকেই ঘুরঘুর করছিলো।

দূর্জয়ের স্বাভাবিক মুখখানা এইবার শক্তরূপ ধারণ করলো। এই মেয়ের সমস্যা কোথায় তা সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। এসব অহেতুক কাজ করে সে দূর্জয়ের নজরে পড়তে চাইছে। দূর্জয় চরম রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে বাণীর দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলেই আরমিন ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে। সে মিনমিনে গলায় বলে উঠে,

“ বাণী? চল পালাই। যদি ক্লাস টিচারের কাছে কমপ্লেইন করে? “

বাণী সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে,

“ কিছু করবে না। “

বাণীর কথা শেষ হতে হতেই দূর্জয় তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় প্রশ্ন করে,

“ মতলব কি তোমার? “

বাণী হেসে বলে,

“ তোমাকে টেক্কা দেওয়া। হাফ ইয়ারলিতে ফোর্টিন্থ হয়েছি। ফাইনালে তোমার পিছনের সিট দখল করবো। “

দূর্জয় বাকা হেসে বলে,

“ তাহলে আর আমাকে টেক্কা কিভাবে দিবে? সেই ফার্স্ট পজিশন তো আমার আয়ত্তেই থাকবে। “

“ তোমার পজিশন দখল করা আমার ইনটেনশন নয়। তোমার পাশের পজিশনটা দখল করাই আমার আসল ইনটেনশন। সেই পজিশনে অন্য কেউ সুইটেবল না। হোক সেটা একাডেমিক্যাল লাইফে কিংবা পার্সোনাল লাইফে। “

কথাটুকু বলেই বাণী দাঁত বের করে হেসে চোখ টিপে দেয়। দূর্জয়ের মেজাজ গরম হয়ে যায় বাণীর কথা শুনে। এই মেয়ের রোগ কি সেই সম্পর্কে এবার সে ক্লিয়ার হলো। বয়সের আগে পেকে গিয়েছে এই মেয়ে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। দূর্জয়ও বুদ্ধিমানদের কাতারে নিজের নাম লেখাতে চায়। তাইতো সে বাণীর পাশে বেঞ্চির উপর রাখা নিজের ব্যাগটা এক কাধে ঝুলিয়ে একটা বোতল হতে পানি খেতে খেতে উল্টো ঘুরে হাঁটতে থাকে। আচমকা পিছন থেকে বাণী ফের ডাকে,

“ ইয়ো টপার? “

দূর্জয় হাঁটা থামায় না। কেবল ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। বাণী সাথে সাথে নিজের বুকের বা পাশে হাত রেখে চোখ বুজে ফেলে। দূর্জয়ের দুর্বোধ্য মনের আঙিনায় প্রতিধ্বনিত হয় একটাই শব্দ,

“ ইঁচড়েপাকা। “

দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই বাণী চোখ মেলে তাকায়। তার পাশে বেঞ্চির উপর রাখা কালো রঙের গিটারটা কোলে তুলে নিয়ে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠে,

“ দিল কি খাতা ভি হে কেয়া
মুঝকো গিলা ভি হে কেয়া
ইস দিল লাগি কে সিভা
দিল নে কিয়া ভি হে কেয়া?
আশিক হে ইয়ে চোর নেহি হে
মে কেয়া কারু?
দিল পে মেরা জোর নেহি হে
মে কেয়া কারু? “

অতীতের পাতা উল্টে বর্তমানে ফিরে আসতেই এতো বছরে প্রথম বারের মতো বাণী নামক মেয়েটার কথা ভাবতে বসে দূর্জয়ের অবচেতন মন। সদা প্রফুল্ল হাস্যজ্বল মেয়েটা তার বর্তমান ব্যক্তিগত জীবনে কেমন আছে? ভালো আছে তো? ছোট প্রশ্নটা মন গহীনে উঁকি দিতেই দূর্জয় নিজের প্রতি বিরক্তবোধ করে। এই অযাচিত আগ্রহের মানে কি? বাণী কেমন আছে তা ভাবা নিশ্চয়ই দূর্জয়ের কাজ নয়? মাথা থেকে বাণী নামক ভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে রুমে ফিরে আসে দূর্জয়। আজ রাতের অপেক্ষা রইলো কেবল। কালকে রইস দিলদারকে একবার হাতেনাতে ধরতে পারলেই কেবল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।

__________

রাত তখন হয়তো সোয়া আটটা বাজে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই হিরণের সামনে পড়লো এক চক্ষু শীতল দৃশ্য। সম্পূর্ণ লিভিং এরিয়া জুড়ে ছোট ছোট পা ফেলে বহ্নি দৌড়ে যাচ্ছে। তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে বাণী। দুই মা মেয়ের মুখেই একই ধরনের হাসি। দাঁতের পাটিতে থাকা গেজ দাঁত যেনো সেই হাসির সৌন্দর্য্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আচমকা দৌড়াতে গিয়ে কার্পেটের সাথে পা লেগে বহ্নি পারে যেতে নিলেই হিরণ বড় বড় দুটি কদম ফেলে এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে তুলে নিলো। হিরণকে দেখতেই বাণীর পা জোড়া থমকে গেলো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই। সেই দৃশ্যটুকু হিরণের চক্ষুগোচর হয়নি। সে খুব সূক্ষ্মভাবে সেই দৃশ্যটাকে এড়িয়ে গিয়ে মেয়েকে বলে,

“ ঠিক আছো মা? “

বহ্নি পাপার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

“ পাপা! সেভ মি! মাম্মা আমাকে হান্ট করছিলো। “

হিরণ চোখ সরু করে বলে,

“ পাপা এসে পড়েছি না? এখন আর পারবে না। পাপা মাম্মার থেকেও ফাস্ট দৌড়াতে পারি। “

বহ্নি হেসে বাণীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ মাম্মা, এখন আমাকে আর পাপাকে ক্যাচ করে দেখাও। “

বাণী শুষ্ক মুখে অনাগ্রহ নিয়ে ধীর গলায় শুধায়,

“ মাম্মা টায়ার্ড এখন মা। “

বাণীর অনাগ্রহের কারণ কি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না হিরণের। সে তাই আর বাণীকে বিরক্ত না করে মেয়েকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যেতে নিলেই বাসার বাহির হতে ভেসে আসে গাড়ির হর্ণের শব্দ। মুহুর্তেই হিরণ সতর্ক দৃষ্টি মেলে দরজার দিকে তাকায়। এই মুহুর্তে তো কারো আসার কথা নয়। তাহলে এই অসময়ে কে তার বাড়িতে আসলো? হিরণের ভাবনার মাঝেই তার সবথেকে কাছের এবং বিশ্বস্ত লোক ইবাত ব্যস্ত পায়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। হিরণকে দেখতে পেয়েই সে আর বিলম্ব না করে বলে উঠে,

“ স্যার! শমসের স্যার এসেছে। এক্ষুণি প্রবেশ করবে। “

হিরণের চেহারা মুহুর্তেই বদলে যায়। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে মেয়েকে বাণীর কোলে দিয়ে বলে,

“ উপরে যাও রাইট নাও। রুম ভেতর থেকে লক করে দাও। আমি ছাড়া অন্য কারো কথায় দরজা খুলবে না। “

বাণী টু শব্দ কিংবা পাল্টা প্রশ্ন করে না। তার শান্ত মন জানে এতো বছর ধরে এই অতিথিহীন ঘরে হুট করে শমসের নামক সেই লোকের আগমন কোনো ভালো লক্ষণ নয়। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কোনো ব্যাপার। সে আর অপেক্ষা না করে একপ্রকার ছুটে মেয়েকে নিয়ে উপরে চলে যায়। হিরণ শান্ত ভঙ্গিতে দরজা মুখো হয়ে দাঁড়ায়। তার পাশেই তীরের মতো দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইবাত।

শমসের মজুমদার বেশ সংখ্যক লোক নিয়ে মুখ্য দ্বার দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে হেসে বলে উঠে,

“ হিরণ! মাই সান। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম। “

হিরণের মুখভঙ্গি বেশ শান্ত ও দৃঢ়। সে গম্ভীর গলায় শুধায়,

“ এখানে আসার কারণ কি? আমি নিজেই একটু পর আপনার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হতাম মিটিংয়ের জন্য। “

শমসের মজুমদার কোনো ভনিতা ছাড়া একটা সোফায় গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে হেসে বলে,

“ তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি আমি। যেই মিটিং আমার বাসায় হওয়ার কথা ছিলো তা এখন এখানে হবে। আর তাছাড়া আমি এখানে আরেকটা উদ্দেশ্যেও এসেছি। আমার বৌমা আর নাতনিকে দেখছি না। তারা কোথায়? “

হিরণ রুক্ষ দৃষ্টি মেলে একবার শমসের মজুমদারের পিছনে উপস্থিত বাকিদের দেখে নেয়। রইস দিলদার সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এখানে উপস্থিত রয়েছে। হিরণের দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় রইস দিলদারের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক রাশভারী মুখশ্রীর যুবকের দিকে। আব্রাহাম! ইদানীং শমসের মজুমদারের সাথে প্রায় সর্বত্র এই যুবকের দেখা মিলে।

হিরণ আব্রাহামের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শমসেরের দিকে তাকায়। শমসেরের ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি। সেই হাসির রহস্য হিরণ জানে। যেই সত্য এখন সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট তা আর লুকানোর মানে হয়না। সে নীরবে ফোন বের করে ডায়াল করে ব্যক্তিগত একটা নাম্বার। কলটা রিসিভ হতেই হিরণ শীতল গলায় শুধায়,

“ বহ্নিকে নিয়ে নিচে এসো। “

ব্যস! ছোট্ট বাক্যের আদেশ বর্তানো শেষ করেই হিরণ ফোনটা ফের প্যান্টের পকেটে চালান করে দেয়। কিঞ্চিৎকাল সময় পেরোতেই সিঁড়ি বেয়ে ধীর পায়ে নেমে আসে এক পরিপূর্ণ নারী। তার কোলে গলা জড়িয়ে কাধে মুখ লুকিয়ে রেখেছে এক ছোট্ট শিশু। বাণী নিচে নেমে হিরণের পিছু এসে থামে। এর সামনে আর পা বাড়ানোর সাহস নেই তার। শমসের হেসে বলে উঠে,

“ আরে! ছেলের আকাশে দেখি একটা না দুটো চাঁদ। “

হিরণ কোনো প্রতুত্তর করে না। সে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়। শমসের নিজেই ফের বলে উঠে,

“ কই আমার দাদুভাইয়ের মুখটা দেখি? “

বাণী প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে হিরণের পানে তাকায়। হিরণ চোখের ইশারায় বলে মেয়েকে কোল থেকে নামাতে। বাণী তাই করে। বহ্নি ঘুরে শমসের মজুমদারের মুখোমুখি তাকাতেই শমসের মজুমদার দেখে হালকা গোলাপি রঙের একটা ফুটফুটে পুতুল যেনো দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রঙটা বাপ মা মিলিয়ে উজ্জ্বল ফর্সা বর্ণের। মাথায় ঘাড় সমান পাতলা চুল। চোখের পাপড়ি গুলো বেশ ঘন। শমসের একপলক বহ্নিকে আগাগোড়া পরখ করে নিয়ে হাস্যজ্বল গলায় বলে উঠে,

“ দাদুভাই দূরে কেনো দাঁড়িয়ে? কাছে আসো। আমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি তোমার দাদু হই। “

শমসেরের এই অহেতুক আদিখ্যেতা হিরণের ঠিক সহ্য হচ্ছে না। তবুও ঝামেলা এড়ানোর জন্য সে মেয়ের পানে তাকিয়ে নরম সুরে বলে,

“ যাও মা। “

বহ্নি বাধ্য মেয়ের মতো ছোট ছোট কদম ফেলে শমসের মজুমদারের দিকে এগিয়ে যায়। শমসের মজুমদার বহ্নিকে কোলে বসিয়েই তার সাথে আসা একজনকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বলে। সাথে সাথে সেই যুবক নিজের হাতে থাকা র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো বেশ কিছু চকলেট বক্স বর্গাকৃতির টি টেবিলের উপর রাখে। অত:পর হেসে বলে,

“ এই সব গিফট আমার দাদুভাইয়ের জন্য। তোমার চকলেট পছন্দ তো? “

বহ্নি দাঁত বের করে হেসে মাথা নাড়ায়। শমসের ফের প্রশ্ন করে,

“ তোমার আর কি কি পছন্দ? “

বহ্নি সাথে সাথে প্রফুল্ল গলায় জবাব দেয়,

“ মার্ভেল মুভিস, সুপারহিরোস আর পাপার ব্ল্যাক শুটার। “

শমসের মজুমদার শব্দ করে হেসে উঠে শুধায়,

“ তাই নাকি? তুমি শুটার নিয়ে খেলতে পছন্দ করো? “

বহ্নি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। শমসের মজুমদার চোখের পলকেই নিজের পকেট হতে একটা পিস্তল বের করে তা বহ্নির হাতে ধরিয়ে হিরণের দিকে তাক করে। এই ঘটনাটা যতটা না দ্রুত ঘটলো তার থেকেও দ্রুত হিরণ নিজের ব্লেজারের ভিতর পিছনের দিকে প্যান্টে গুজে রাখা পিস্তলটা বের করে শমসের মজুমদারের দিকে তাক করে ধরে। মুহুর্তেই পরিস্থিতি বদলে যায়। হিরণের লোকেরা এবং শমসের মজুমদারের লোকেরাও নিজেদের পিস্তল বের করে একে অপরের দিকে তাক করে।

শমসের মজুমদারের ধূর্ত কর্মকান্ড এবং হিরণের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখে বাণী পাথর বনে যায়। গোল গোল চাহনিতে বরফের ন্যায় জমে যায় সে। বহু কষ্টে তার গলা চিড়ে বেরিয়ে আসে দুটি শব্দ,

“ আমার মেয়ে! “

হিরণের কর্ণগোচর হয় না সেই ছোট্ট দুটি শব্দ। তার মেয়ের মুখের পানে তাকিয়ে তারও বুক মুচড়ে উঠছে। কিন্তু সেই দূর্বলতাটুকু প্রকাশের অবকাশ নেই তার। একটা প্রবাদ বাক্য অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে একই বনে কখনো দুটি সিংহ রাজা হতে পারে না। তেমনই পাপের সাম্রাজ্যেও একসাথে দুজন বাপ কখনো থাকতে পারে না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here